একজন মধ্যবয়স্ক লোক কে অনেক্ষণ যাবত অসহায়ভাবে ব্যাংক ম্যানেজারের নিকট কাকুতিমিনতি করতে দেখছে আবির। নিজের কাগজ গুলো ঠিক করার দরুন আবির ওখানে যেতেও পারছে না। আবির চিন্তা করছে,, মানুষ টার সাথে ম্যানেজার এমন বিহেভ করছে কেন?? হঠাৎ পাশ দিয়ে একজন মহিলা কে যেতে দেখে,
—আন্টি ওখানে কি হয়েছে?
—লোকটি বলছে ওনার টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট আছে। কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজার বলছে ওনার একাউন্টে কোন টাকা নেই। সরল ভঙ্গিতে কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।
আবিরের কাছে অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। ও নিজেও টাকা উঠাতে এসেছে বাবাকে না জানিয়ে। মা, বাবার পিন নাম্বার জানে জন্য মায়ের সুবাদে মাঝে মধ্যেই আবির টাকা উঠাতে পারে। আর ইচ্ছামতো উড়াতে পারে। আবির ভাবতে লাগল, এতক্ষণ যাবত ওনাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা চলছে আর ম্যানেজারও তার একই কথাতে অটুট আছে তার মানে নিশ্চয় বড় কোনো গন্ডগোল আছে। আবির চেয়ার টা ছেড়ে উঠে পড়ল।
—বাবা, আমি সত্য বলছি আমি কোন টাকা উঠায়নি। টাকাগুলো আমার সারাজীবনের সঞ্চয়। এমন করো না। আমায় টাকাগুলো দিয়ে দাও। অপরিচিত লোকটি জোর দিয়েই কথাটা বললেন।
—আরে আপনি কেনো বুঝতে চাইছেন না আপনার একাউন্টে কোন টাকা নেই। আপনি না উঠালেন আপনার স্ত্রী বা সন্তান হয়তো উঠিয়েছে। ম্যানেজার বিরক্তস্বরে বললেন।
—বাবা, আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ তো আমার একাউন্টের গোপন নাম্বার যানে না। কিন্তু আমি জানি, আমার স্ত্রী আমায় না জানিয়ে এমন টা করবে না। একটু ভালো করে দেখো বাবা। হয়তো তোমাদের ভুল হচ্ছে। ম্যানেজার এবার রাগ করে বৃদ্ধ কে ধাক্কা দিয়ে,
—এই যান তো, যান এখান থেকে। লাখ লাখ টাকার হিসেব করছি আজ ১০ বছর যাবত। একটা দিন, একজনও কোন কমপ্লেইন নিয়ে আসলো না। আর উনি আসছেন আমায় বলতে আমার ভুল হয়েছে। লোকটি টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যায়। আবির গিয়ে লোকটিকে আস্তে করে উঠায়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল,
—কাজ টা কি আপনি ঠিক করলেন??
—কি করবো ভাই। এক ঘন্টা ধরে ওনাকে বোঝাচ্ছি যে, ওনার একাউন্টে কোন টাকা নেয়। এরপরও শুধু বলেই চলেছে ওনার একাউন্টে টাকা আছে।
—এটা তো আপনি ওনাকে সহজ করে বলতে পারতেন।
—আর কত সহজ ভাবে বললে উনি বুঝতে পারবেন বলবেন আমাকে?? আর শুধু উনি না, ওইযে দেখুন হাজার টা লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও মানুষ। অমানুষ বা যন্ত্র না। আর আপনি নিজেই ওনার একাউন্ট দেখুন, এই যে দেখুন, পুরো শূন্য। আবির লোকটির দিকে তাকিয়ে,,
—আপনার নাম আনিসুল কবির??
—হুম বাবা
আবির চেয়ে দেখল, ম্যানেজারের তথ্যটাই সঠিক। আনিসুল কবির নামের ব্যাক্তির একাউন্টে একটা কানাকড়িও নেই। আবির কবির লোকটির দিকে তাকিয়ে,,
—কাকু, আপনার একাউন্টে সত্যিই কোন টাকা নেই।
—কবির লোকটি কিছুসময় নিরব হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই আবার বলতে লাগল তোমাদের ভুল হচ্ছে। আমার একাউন্টে টাকা আছে।
আবির বুঝতে পারলো টাকাগুলো লোকটির হয়তো খুব প্রয়োজন। আর তাছাড়া ৫ লাখ টাকার হিসেব যদি কেউ না পায়, তার কেমন লাগা উচিত, সেটা আবির বুঝতে পারছে। আবির চিন্তা করল কি করে ওনাকে বিশ্বাস করানো যাবে যে ওনার একাউন্টে কোন টাকা নেই। কবিরের বেষভুষা দেখে আবির এটুকু অনুমান করতে পারছে কবির লোকটি হয়তো গ্রামের হবে। ব্যাপার টা কবির কে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, শহর থেকে ৭ কি.মি. ভেতরের রুপপুর গ্রামে থাকেন উনি। আবির কিছুসময় ভাবল তারপর ম্যানেজার কে ডেকে বলল,
—স্যার, একাউন্ট টা থেকে লাষ্ট কবে টাকা উঠানো হয়েছে?? আর কখন? ম্যানেজার চেক করে বলল,
—১৫ তারিখ, সকাল ১১,৪৫ মিনিট।
—সিসি-টিভি ফুটেজ দেখা যাবে তো তাই না?
ম্যানেজার আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, হুম দেখা যাবে কিন্তু এত ঝামেলা করার সময় আমাদের নেই। ওনাকে সিকিউরিটি দিয়ে বের করে দিচ্ছি তাই হবে।
—স্যার, এক মিনিট। সিকিউরিটি দিয়ে ওনাকে বের করে দিলে ওনার মনেতে আপনি অপরাধী হয়ে থাকবেন সারাজীবন। কারণ উনি মনে করেই থাকবেন টাকাগুলো আপনারাই হয়তো মেরে দিয়েছেন। আর তাছাড়া, ৫,০০,০০০ টাকার গরমিল। ভাবুন তো আপনার সাথে যদি ব্যাপার টা ঘটতো? ম্যানেজার কিছুসময় চুপ করে রইল। তারপর কোথায় যেন চলে গেলেন। এর ১০ মিনিট পরে এসে বললেন,
—এই নিন, ফুটেজ।
—থ্যাংকস স্যার।
আবির ম্যানেজারের থেকে ফুটেজ টা নিয়েই অন করে দিলো। কবির, আবির,ম্যানেজার, ছাড়াও অনেকে এখন জড়ো হয়েছে ওখানে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবির। ঠিক ১১.৩০ মিনিটের সময়, কবির কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
—আমার ছেলে, জয়। এখানে কি করছে??
—আপনার ছেলে?? কোনটা?
–ওইযে টিভির মধ্যে লাল শার্ট পড়া।
আবির জুম করে দেখলো ছেলেটাকে। এরপর ঠিক ১১.৪৫ মিনিটে জয়, ব্যাংক কর্মকর্তার থেকে একটা ব্যাগে টাকা গুলো নিয়ে ব্যাংক থেকে বেরোয়ে গেল। আবির কবিরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওনার চোখে পানি। হয়তো উনি এখন বুঝতে পেরেছেন সত্য টা। তবে ম্যানেজার ব্যাপার টা আরো বেশি সিওর হওয়ার জন্য ঐ কর্মকর্তা কে ডেকে জয়ের ফুটেজ টা দেখিয়ে ব্যাপারটা জানতে চাইলে উনি সব বলে দেন। সময় টা সকাল গড়িয়ে দুপুর, কবির চেয়ারটাতে এখনও বসে আছে। আবির টাকা উঠায়ে, বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও পিছনে এসে কবিরের পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
–আপনাকে না জানিয়ে আপনার ছেলে এই কাজ টা কেমনে করল?? কবির জলছল চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে,
—জানি না বাবা। আমার সারাজীবনের সঞ্চয় এটা। মধ্যবিত্ত পরিবার আমার। এক সন্তান আর স্ত্রী জাহ্নবীকে নিয়েই আমার সংসার। ছেলেটাকে ছোট থেকে কোন অভাবের মধ্যে রাখিনি। সব আবদার গুলো পূরণ করেছি। আমি আমার কাজ থেকে যেই টাকাটুকু পেতাম সবটুকুই পরিবারের কাজে ব্যয় করতাম। কিন্তু জাহ্নবী বলতো, বিপদ আপদের কথা তো আর বলে কয়ে আসে না। আর তাছাড়া একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত ও তো আছে। তার জন্য হলেও কিছু টাকা গুছিয়ে রাখো। জাহ্নবীর কথাতেই আমি প্রতি মাসে ৩০০০ করে ব্যাংকে রাখতাম। ১৫ বছর ধরে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ করে এই ৫০০০০০ টাকা গুছিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জয় কে কিছু টাকা দিবো। ও যেকোন জায়গায় কাজ জুটিয়ে নিবে। আর বাকি টাকাটা রেখে দিবো নিজেদের প্রয়োজনে।
কিন্তু ছেলে আমার বড় হয়ে কেমন যেন হয়ে গেলো। ওর মায়ের সাথে সবসময় রাগ নিয়ে কথা বলতো। আমি অনেক বার বারণ করেছি এমন আচরণ না করতে। কিন্তু নাহ। কোন লাভ হতো না। বুঝতে পেরেছিলাম বেশি আদরের ফল হিসেবে ছেলে আমাদের পিছন থেকে ছুড়ি বসাচ্ছে।
কিছুদিন পরে নিজ পছন্দমতো একজন কে বিয়ে করে নিয়ে এলো জয়। আর এরপরপরি শুরু হয় আমাদের সেই দিনগুলো। যেটার আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। অসুস্থ জাহ্নবী কাজ না করতে পারলেও বউমার মুখের ভাষায় কাজ করতে বাধ্য হতো। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকতাম কেউ একটু টু শব্দও করতে পারতো না। কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে এলেই, আমার স্ত্রীর উপর এমন আচরণ শুরু হতো।
জাহ্নবী কখনো আমাকে এগুলো বলেনি বাসায় ঝামেলা হবে ভেবে।কিন্তু বিষয়টা হয়তো উপরওয়ালা আমায় জানাতে চেয়েছিলেন আর তার জন্য ঐদিন দুপুরে বাসায় গিয়ে দেখি, আমার অসুস্থ স্ত্রী জাহ্নবী, এক গাদা কাপড় নিয়ে কলপার বসে আছে। আমার সবটুকু বুঝা হয়ে গেছিল। ঐদিনেই আমি জয় আর ওর বউকে আমার ঘর থেকে বের করে দেই। সাথে এটাও বলি, যদি কখনো আমার সন্তান হয়ে উঠতে পারিস তো ঐদিন এই বাড়িতে আসবি তার আগে কখনো আসবি না।
এর ১ বছর অবধি জয়ের কোন খবর আমরা পাই নি। আমার স্ত্রী কান্না করতো ছেলের জন্য। ছেলেকে নিয়ে সবসময় দুঃশ্চিতা করত জাহ্নবী। এর ফলে অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়ে জাহ্নবী। হসপিটালে ভর্তি করা হলে ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এটা জানান আমার স্ত্রীর নাকি দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। যেটা আরো বেশি খারাপের দিকে চলে গিয়েছে প্রেসারের মেডিসিন না খাওয়ার সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় দুঃশ্চিতার জন্য। যত দ্রুত সম্ভব কিডনি ট্রান্সফার করতে হবে।
কাজ পাগল মানুষ আমি। কাজ ছাড়া কিছু বুঝতাম না। সারাদিন দৌঁড়ের উপরে থাকতাম। আর তার সুবাদে ঘরেতে আমার কিছু টাকা ছিল। ওটা দিয়েই প্রথম দু বার ডায়ালাইসিস করা হয়েছে জাহ্নবীর। কিন্তু আগামী ২৮ তারিখে ওর অপারেশনের ডেট দিয়েছে ডাক্তার। যার জন্য কয়েক লাখ টাকা লাগবে যেটা নিতেই এখানে এসেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার জন্য এত বড় ধাক্কা প্রস্তুত রয়েছে। আবির পুরো চুপ হয়ে আছে। কিছুই বলার নেই ওর। শুধু কবির কে জিজ্ঞেস করলো,
–কাকু, আপনার সন্তানকে আপনি পিন নাম্বার জানিয়েছিলেন কেনো?? আপনি কি জানেন না এটা খুব গোপনীয় ভাবে মনে রাখতে হয়??
—জানতাম বাবা। কিন্তু, আমি সত্য বলছি, আমার স্ত্রী আর আমি ছাড়া কেউ জানতো না পিন নাম্বার। তবে, আমার মনে হচ্ছে, জাহ্নবী জয় কে হয়তো পিন নাম্বার টা বলে দিয়েছিল। অতিরিক্ত খরচের অভ্যাস ছিল বলে আমি জয় কে কড়াকড়ি ভাবে টাকা দিতাম। এই কারণে জয় মাঝে মাঝেই ওর মায়ের কাছে টাকার জন্য আবদার করতো। বোকা মেয়ে জাহ্নবী। আর ছেলেকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসতো জন্য কখনো না করতো না। আবিরের হাতগুলো কাঁপছে। ও নিজেই তো জয়ের মতো কাজ করছে। বাবাকে না জানিয়েই তার একাউন্ট থেকে টাকা উঠায় প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনে। হাতে থাকা টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আবির নিরবে চেয়ে থাকে। হঠাৎ করেই ওর চোখ জলে ঝাপসা হয়ে যায়। চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত কাউন্টারে গিয়ে পুনরায় দাঁড়িয়ে পরে।
–আরে আপনি? মাত্র না টাকা উঠাইলেন, এখন আবার টাকা জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছেন যে??ব্যাংক কর্মকর্তা বিষ্ময়ে প্রশ্ন করল।
—এই টাকার মালিকানায় এখনও আমার নাম যোগ হয়নি স্যার।
ব্যাংক কর্মকর্তা কিছুই বুঝল না। আবির টাকা টা ডিপোজিট করে সেই জায়গাটাতে এসে দাঁড়ালো যেখানে কবির নামক লোকটি বসে ছিল।
কিন্তু আর সকল কে দেখতে পেলেও আবির কবির কে দেখতে পেল না। আবিরের খুব খারাপ লাগছে কবিরের জন্য। ও ভাবতে লাগল, মানুষটা হয়তো তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য এখন কারোর দোরগোঁড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে। নিজের এতদিনে গড়া মান সম্মান টুকুকে জলাঞ্জলি দিয়ে।