নিঃস্ব

নিঃস্ব

ইফতির সাথে ফোনে গল্প করছিলাম।হঠাৎ মনে হলো রান্না ঘরে ঝড় বয়ে গেছে।থালাবাসন পড়ার শব্দ,হাতা খুন্তি নাড়ার শব্দ এত বেশি পরিমাণে হচ্ছিলো যে একটু পরেই পাশের বাসার মানুষ আমাদের বাসায় চলে আসবে। আমি দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। রান্নাঘরের অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। আমার এত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা রান্না ঘরের একি বেহাল অবস্থা! আর সেখানে রাধুনি অবস্থায় যাকে দেখলাম তা দেখে মনে হলো চোখে ভুল দেখছি।চোখে ডলা দিয়ে আবার দেখলাম।নাহ!!বাবা ই তো। আমি বাবাকে বললাম

-বাবা, একি করছেন?দিন আমাকে দিন।আমি রান্না করে দিচ্ছি।
-না বৌমা।খবরদার আজকে এইখানে তুমি ঢুকবে না।
-হঠাৎ আপনার রান্না করার এত শখ হলো কেন?
-তোমার শাশুড়ি মা বলেছে আজকে আমাকে রান্না করতে।
-ও।তার আগে আপনি নিশ্চয়ই আম্মাকে কোনো খোঁচা মেরে কথা বলেছিলেন।কি বলেছেন শুনি? বাবা কাচুমাচু মুখ করে বলল
-ইয়ে মানে আমি বলেছিলাম ঘরের কাজ করা খুব সোজা।তোমার মা সারাদিন কোনো কাজ করে না। আমি রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালাম।

-আহা বৌমা ভুল হয়ে গেছে।
-ঠিক আছে।আমি যাচ্ছি। তখনি বাবা পিছন থেকে ডাকলেন
-আশা
-কি হয়েছে?
-বলছিলাম যে একটু সাহায্য করে দাও না।কোনটা লবণ কোনটা চিনি সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
-পারবো না।এবার বুঝুন ঠ্যালার নাম বাবাজি। মেয়েদের কাজ খুব সোজা, মেয়েরা কোনো কাজ ই করে না।তাইনা?? বাবা অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রুমে আসার পর সোহান জিজ্ঞাস করছে

-কি হলো আশা মনে হচ্ছে খুব রেগে আছো?
-হ্যা রেগে আছি।বাবা কি বলেছে জানো?
-কি বলেছে?
-বলেছে মেয়েদের কাজ নাকি খুব সোজা।
মেয়েরা নাকি কোনো কাজ ই করে না। ও হেসে বলল

-বাবা তো ঠিক ই বলেছে।মেয়েদের যেই না কাজ,ওইটা ছেলেরা চুটকি বাজিয়ে করতে পারে। তারপর রান্না ঘরের দৃশ্য দাড়ালো অনেকটা এইরকম, আশেপাশে থালাবাসন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সোহান সবজি কাটছে।বাবা এখন ডাল বসিয়েছে চুলায়।আমি আর আমার শাশুড়ি মা রান্নাঘরের সামনে মোড়া পেতে বসে আছি। মা তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে

-বুঝলে বৌমা রান্না করা নাকি খুব সোজা।
-হ্যা মা।এত্ত সোজা যে ছেলেরা চুটকি বাজিয়ে করে ফেলতে পারে।

দুইজন আমাদের দুইজনের দিকে কঠিন একটা লুক দিলো। আমি বাবার রান্না করা দেখছি।বাবা ডালের মধ্যে লবণের বদলে চিনি দিয়ে দিয়েছেন।আর হলুদ মরিচ আল্লাহর নাম নিয়ে পুরোটাই পারলে ঢেলে দেন।আর সোহান বেগুন কাটছে।একেকটা একেক সাইজের।মনে হচ্ছে মানুষ না,কোনো গরুকে খাওয়াবে। আমরা এটা নিয়ে যখন হাসাহাসি করছিলাম তখন সোহান আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল

-তোমরা এখানে বসে কি করছো?? যাও ঘরে যাও। তখন মা বললেন
-চলো তো বৌমা আমরা বরং একটু বেরিয়ে আসি। বাপ বেটা মিলে রান্না করুক। তখন বাবা বলল
-হ্যা যাও।আমাদের এই বিপদে ফেলে দুইজনে গিয়ে আনন্দ করো গিয়ে। মা আর আমি বেরিয়েছি।বেশ বুঝতে পারছি আজকে বাসার রান্না মুখে দেয়া যাবে না।আমি মা কে বললাম

-মা চলো ফুচকা খাই।
-না রে মা। বাসায় দুই বাপ বেটা না খেয়ে আছে।আমার মুখ দিয়ে খাবার যাবে না।তুমি খাও।

-তুমি না খেলে আমি একা খাবো নাকি?এক কাজ করি আজকে খাবার টা বাইরে থেকে কিনে নিয়ে যাই।
-হু তাই করি।দুইজনের জন্য খুব মায়া হচ্ছে জানো তো।তোমার শশুড়ের ওই কথা শুনে মাথা গরম করে রান্না করতে পাঠিয়ে দিলাম।কাজ টা ঠিক হলো না।কখনো তো দুইজনকে রান্নাঘর পর্যন্ত আসতেই দেই নি।

-উফ মা,বেশি মায়া দেখিও নাতো।এরপরে দুইজন যদি আবার বলে মেয়েদের কাজ সহজ তাহলে ঘর মোছার কাজটাও উনাদের দিয়ে করাবো। মা তখন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন

-এই আমি যে তোমার শাশুড়ি সেটা খেয়াল আছে??আমার সামনেই আমার বর আর ছেলেকে দিয়ে কাজ করানোর ফন্দি করছো??
-স্যরি মা।
-তবে তুমিও খুব একটা খারাপ কিছু বলো নি।

এরপর যদি আবার মেয়েদের টিজ করে কথা বলে দুইজনকে দিয়েই ঘর মুছাবো।আমার তো দুই বাপ বেটা কেমন চেহারা বানাবে সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছে। দুইজনে হাসতে লাগলাম। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার কিনে নিলাম।সোহান আর বাবার পছন্দ মত খাবার কিনে বাসার দিকে রওনা দিলাম। বাসায় ফিরে দেখি বাসার সামনে অনেক লোকের ভীড়।ভয়ে কয়েকটা হার্টবিট যেন মিস করে গেলো।কি এমন হয়েছে?কেউ মনে হয় দমকলে ফোন দিয়েছিলো।দমকলের গাড়ি দেখলাম এসে পৌছেছে।তাহলে কি আমাদের বাসায় আগুন লেগেছে।হাত থেকে খাবারের প্যাকেটগুলি পড়ে গেলো।ভীড় ঠেলে ভিতরে যেতে নিলাম। কয়েকজন আমাদের আটকাতে চাইলো।আগুন টা রান্নাঘরেই লেগেছে।সেখান থেকে অনেক খানি ছড়িয়ে পড়েছে।দমকলের লোক ভিতরে ঢুকে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছে।

কেউ কেউ বলছে সিলন্ডার ব্লাস্ট হয়ে আগুন লেগেছে।আর জানালা গুলিও হয়ত বন্ধ ছিলো। মনে পড়লো জানালা গুলি খোলা ছিলো না। গ্যাস লিক হয়ে হয়ত বেড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ টাও পায় নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে।মা খবর টা শুনেই অজ্ঞান হয়ে গেছেন।আমি ঘরের বাইরে রাস্তার উপরেই বসে আছি।আমার কোলে মায়ের মাথা। মাকে ডাকছি।কেউ একজন পানি এনে মায়ের মুখে ছিটা দিলো।মায়ের জ্ঞান ফিরলো।

বাবা আর সোহানের কালিমাখা দেহ টা বের করে আনা হলো।পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পুরো শরীর। দুইজনকে চেনা যাচ্ছে না।আমার পাগলের মত লাগছে।একবার বাবার লাশের দিকে যাচ্ছি একবার সোহানের।দুইজনের বীভৎস অবস্থা। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম।অনেকবার ডাকলাম। কানেও ধরলাম। আমি ওদের বলে চলেছি, ‘বাবা আমরা হার মেনেছি।মেয়েদের কাজ আসলেই খুব সহজ।সোহান শুনো না মেয়েদের কাজ ছেলেরা চুটকি বাজিয়ে করে ফেলতে পারে।আমি আর মা হেরে গেছি।গো হারা হেরে গেছি।

তোমরা উঠো।বললাম তো হেরে গেছি আমরা।আর কখনো তোমাদের সাথে প্রতিযোগিতা করবো না।আর রাগ করে থেকো না।’ কেউ কোনো কথা বলছে না।মা রাস্তার উপরেই থ মেরে বসে আছে।চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। চোখ দিয়ে জল ও পড়ছে না।আমি মায়ের কাছে গেলাম।মা কোনো কথা বলছে না। চারদিকে এত হইচই, কিন্তু আমার পরিবারের তিনজন সদস্যই একদম চুপ।তাদের এই শব্দহীনতা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না,একদম না। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম

-মা, তুমি কাঁদছো না কেনো?আজকে আমাদের খুব দুঃখের দিন।দেখো দুইজন কী সুন্দর ভাবে আমাদের ফাকি দিয়ে চলে গেলো।সব এই দুইজনের চাল।একটা দিন রান্না করতে বলেছি তাতেই ফাকি দিলো।বাপ বেটা খুব ফাকিবাজ। মা তবুও নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।মায়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না।মা কি বুঝতে পারছেন না আজ থেকে আমরা নিঃস্ব।আমাদের আর নিজের বলতে কেউ রইলো না…

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত