ফিরিয়ে দেওয়া

ফিরিয়ে দেওয়া

আঠারো বছর আগেকার সেই ষোড়শী চাঞ্চল্য, লজ্জা, শিহরণ আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিলো মুহুর্তেই। গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক করছে লোকটা কি নেহাল? হ্যাঁ নেহাল! সেই মুখ, সেই হাত, সেই চশমা, আর ওর প্রিয় আকাশী রঙের শার্ট। এতো বছর ধরে মানুষের চেহারা কি একই থাকতে পারে? পছন্দও কি বদলায় না?
“আমি তোকে ছাড়া বাঁচবনা রে পাগলী। আমাকে ফিরিয়ে দিস নে।” পুরনো কথাগুলো চিৎকারের মত কানে বেজে উঠতে লাগলো।

নেহাল আমাকে দেখে ফেলার আগেই আমি পাশের কফিশপে ঢুকে পড়লাম। নেহালের সামনাসামনি দাঁড়ানোর হিম্মত নাই আমার। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে ভেতরের অস্থিরতা কাটাতে চাইছি, পারছিনা যেন। আঠারো বছর পরেও কেমন করে এক পলক দেখেই চিনে ফেললাম ওকে? মনের কত গভীরে, কত গভীরে জায়গা করে নিয়েছিল সে যে আমি টের পাইনি কোনোদিন। শপের ছেলেটা একমগ ঠান্ডা কফি দিয়ে গেলো। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ মনে হলো ভুল দেখেছি হয়ত। অস্থিরতা কেটে গেলো। কিন্তু শপের বাইরে যাওয়ার সাহস হলো না। ছোটছেলে শৌখিনকে কোচিং থেকে নিতে এসেছি। তার পাশেই কফিশপ। ওকে টেক্সট করে দিলাম কফিশপে আছি।

চোখ বন্ধ করে পুরোপুরি স্থির হলাম। আমাদের বাড়ির দক্ষিণের কাঁচাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে যেদিন প্রথম নেহাল কে দেখি সেদিনে ফিরে গেলাম। কলেজে ভাইয়ার ক্লাসমেট ছিল পাতলা গড়ন আর ভারী ফ্রেমের চশমা আঁটা কাজল চোখের ছেলেটা। ভাইয়ার বন্ধুদের সামনে যেতে মানা ছিলোনা কিন্তু লজ্জায় যেতে পারতাম না। ভাইয়ার স্কুলের বন্ধুরা পাড়ারই ছেলেমেয়ে তাই ওদের দেখে তেমন সংকোচ আসত না। কলেজের বন্ধু গুলোকে সংকোচে এড়িয়ে যেতাম কিন্তু উঁকি দেয়ার লোভ সামলাতে পারতাম না।চাটাইয়ের বেড়াওয়ালা দক্ষিণের ঘরটাই ছিল উঁকি দেয়ার মোক্ষম উপায়।

নেহাল সেদিন প্রথম এসেছিল, পাকা আমের মৌসুমে। শহরের ছেলে গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়ার শখ খুব তার। মা বাড়িতে ছিলোনা। ছোট ফুপি জলখাবারের ব্যবস্থা করলেন। লেহাল কিছুতেই কিছু খাবেনা, আমগাছে উঠে আম খাবে শুধু। ফুপি বার বার নিষেধ করতে লাগলো। পরের ছেলে, একটা বিপদ হলে লজ্জায় পড়তে হবে। তার উপর মা বাসায় নেই।

নেহালের জিদের কাছে কারো কথা টিকলো না। চাতাল থেকে মই পাড়ানো হলো। ভাইয়া আমাকে ঝুড়ি নিয়ে আম কুড়াতে বললো। যেগুলো জালে আটকাবে না অথবা জাল ধরার আগেই ঝরে যাবে সেগুলো কুড়াতে হবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেহাল তরতর করে মই ছাড়াই গাছের নিচের ডালে গিয়ে উঠলো। তারপর ভাইয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে এডাল সে ডালে সেকি দাপাদাপি! আমি লজ্জায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে আম কুড়াই, ভাইয়ার কোনো আক্কেল নাই। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে আমার। মা এলে নালিশ দেব মনে মনে ঠিক করলাম।

আম পাড়া শেষ হয়ে গেলো। ফুপি আর আমি মিলে আ্মের ছোট ছোট ঝুড়িগুলো রেখে আসলাম। ভাইয়া আগে গাছ থেকে নেমে গেলো। নেহাল বসে রইলো দুইমানুষ সমান উচ্চতার ভারি ডালে। লাফিয়ে নামবে, সব কাজেই কেরামতি দেখানো চাই! কিন্তু লাফ দিয়ে নামার সময় পা মচকে গেলো বেচারা নেহালের। খুব ব্যথা পেলেও একফোঁটা আওয়াজ করলোনা সে। পা চেপে ধরে বসে রইল মাটিতে। আমার আর ফুপির জান উড়ে গেলো। সমস্ত সঙ্কোচ উবে গেলো। ধরাধরি করে বারান্দায় এনে বসালাম তাকে। ফুপি বাতাস করছে, ভাইয়া পিঠ ধরে বসিয়ে রেখেছে, আমি পানি ঢালছি নেহালের পায়ে।

কাঠের টুলের উপর আলতো করে রাখা পায়ের আঙুলগুলো তারপরে কতবার চোখে ভেসে উঠেছে তার শেষ নেই। সেদিনের সেই বিপদ সহসা কেটে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছিল সঙ্কোচ, জড়তা। সেই সাথে কেমন যেন গা কাঁপানো শিহরণ ভর করেছিল। নেহালের মুখে চাওয়ার সাহস হয়নি কখনো তবুও হৃদয়জুড়ে সেই একটা ছবিই আঁকা হয়ে গিয়েছিল। অপ্রকাশিতব্য সেই অনুভূতির পাহাড় দিন দিন বড়ই হচ্ছিল শুধু। নেহালের সহজ আচরণেও সামলে নিতে পারতাম না জড়তা, ভয়, আর সঙ্কোচকে। মনে হত এই বুঝি মনের খবর জেনে যাবে নেহাল।

কফিটা শেষ করতে পারলাম না। মুখ জুড়ে বিস্বাদ। তারপর আবার ভুলতে না চাওয়া স্মৃতির দুলুনি। অনুভূতির টালমাটাল সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস এসেছিল একদিন। বাড়িজুড়ে হইচই, কানাকানি। বজ্রপাতের মত কানে এলো নেহাল আমাকে ভালবাসে। ওর কোন খাতায় গোঁজা কবিতায় সে প্রেমের খোঁজ পেয়েছে ভাইয়া আমার। প্রথম দেখায় প্রথম প্রেমের কাব্যই হয়ে গেল কাল। ভাইয়ার প্রাণের বন্ধু শত্রু হয়ে গেল সেদিন থেকে। আমিতো ভালবাসার খবর আগেভাগে পেলামই না, মঞ্জুর করার ফুরসৎটাও পেলাম না। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আমার। আমার বুকভাঙা কষ্ট ছাপিয়ে নেহালের ভালবাসা ফুলের গালিচা বিছিয়ে দিলো। কেউ জানলোনা সেই শোকানন্দের গল্প।

সেই বিভিষীকা রাতেই শেষবার দেখেছিলাম ওকে। কাঠের জানালায় ঠুক ঠুক আওয়াজ শুনে জানালা খুলে দেখি আবছায়ায় এক কালোমুর্তি, চেনা চেনা। ভয় পাইনি। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ভালোকরে মুখটা দেখছিলাম। নেহালের উদ্ভ্রান্ত দুচোখে জলের ধারা ছুটে যাচ্ছে, চাহনিতে আকুতি। “আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি, আমি তোকে ছাড়া বাঁচবনা রে পাগলী। আমাকে ফিরিয়ে দিস নে।” কথাগুলো বলে যাচ্ছে সে এক অন্য নেহাল, অন্য ভাষা। আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম আবেগের অতলে।

মুহুর্তে শক্ত করে নিয়েছিলাম নিজেকে। বাপ-ভাইয়ে ইজ্জত আর তেইশ বছর বয়সী এক তরুণের ভবিষ্যৎ আমার হ্যাঁবোধক অথবা নাবোধক যেকোনো একটা শব্দতে মিশে আছে। আমি আকুল হয়ে হাত বাড়িয়ে তার চোখের জলটুকু মুছে দিয়েছিলাম শুধু। বলতে পারিনি আমার মনেও কিছু কথা ছিল। দেখাতে পারিনি আমার চোখেও বন্যা নেমেছিল। আস্তে জানালা বন্ধ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম সে আমার কেউ নয়। পাষাণের দেয়ালে বাঁধা পেয়ে ফিরে যাওয়া জলের স্রোতের মতই ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে।

শোখিন এসে গেছে শপের সামনে। ওকে দেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। প্রেশার নেমে গেছে মনে হচ্ছে। একটা রিক্সা নিয়ে উঠে পড়লাম তাড়াতাড়ি। ছেলের কাঁধে হেলান দিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের করচাটা আবার হিসেব করতে লাগলাম। কিভাবে সব ভুলে আমি পাড়ি দিয়েছিলাম অন্য জগতে? ভালবাসা আত্মসাৎ করার ভাগ্য নাই যার দুনিয়ার কোথাও তারজন্য ভালবাসা থাকেনা আর। অপমান, অত্যাচার, বঞ্চনাগুলো শুধু সেই ফিরিয়ে দেওয়ার রাতটাকে মনে করিয়ে দিত। না ভাই, না বাবা কেউ আর ভালবাসেনি। বাবা তো চলেই গেলো জলদি জলদি। ভাইয়ের ঘাড়ের বোঝা হলাম। কি লাভ পেলাম বংশের ইজ্জত বাঁচিয়ে? কি পেলাম ভালবাসা কোরবানী দিয়ে? শৌখিন কে সাথে নিয়ে বাসায় এলাম। বড় ছেলে শোভন গেস্টরুমে কার সাথে যেন কথা বলছে। মাথা খুব ধরে আছে আমার। ফ্রেশ হয়ে শৌখিন কে দিয়ে গেস্টরুমে নাস্তা পাঠালাম। কিছুক্ষণ পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো ছেলেটা। “মা, বাবা পাঠিয়েছেন লোকটাকে। একটা চিঠিও আছে।”

শোভণের বাবা অনেক বছর আগেই আমাদেরকে রেখে চলে গেছে। সেই মানুষটাকে কোনোদিনও ঘরমুখী করতে পারেনি কেউ। বিয়ে, বউ, বাচ্চা কিছুই তাকে মায়ায় বাঁধতে পারেনি। শ্বশুরের সংসারে জায়গা হইনি আমার। ভাইয়ার গলগ্রহ না হয়ে নিজের পথ ধরেছিলাম আমি। অনেক সময় লেগেছিল পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেতে। একহাতে বড় করেছি শোভন-শৌখিনকে। কোনো অভিযোগ ছিলোনা ওদের বাবার উপর। সবমানুষ তো আর সংসারী হয়না।
শোভনের বাবা ভ্রমণ পাগল মানুষ। পথে আয় পথেই খরচ। ছেলেকে শিক্ষিত করে কোনো সুফলই পাননি আমার শ্বশুরবাবা। ছেলেকে বাড়ি থেকে শেষবার বের করে দিয়েছিলেন যখন তিনি কিন্তু ভাবেননি যে তার পুত্রধন আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা। অনেক খুঁজেও মেলেনি আর।

আমি অবশ্য বিশ্বাস করতাম একদিন সে ফিরে আসবে। সেই বিশ্বাসেই কেটে গেছে বারো বছর। চিঠিতে শোভনের বাবা ক্ষমা চেয়েছে আমার কাছে। সে খুব অসুস্থ। সে একবার তার স্ত্রীপুত্রদের দেখতে চায়। যে লোকটাকে সে পাঠিয়েছে সে তার ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু। তার সাথে আমাদেরকে যেতে বলেছে। তাকে যেন ফিরিয়ে না দিই। চিঠিটা ভাঁজ করে খাটের কোণায় রাখলাম। অসুস্থ মানুষটাকে এবার নিশ্চয় ঘরে ফেরাতে পারবো।শোভনকে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বললাম। লোকটার সাথেও কথা বলা জরুরী।

গেস্ট রুমের পর্দা ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মাথা ঘুরে গেলো, পা টলে উঠলো, পড়তে গিয়ে শোভনকে ধরে ফেললাম। শোভন এক হাতে আমার ভর রেখে আরেক হাতে চেয়ারটা টেনে আমাকে বসিয়ে দিলো। আমি বসে আছি নেহালের মুখোমুখি। শোভনের বাবার সেই ভ্রমণসঙ্গী আর কেউ নয়, সে নেহাল। কফিশপের সামনে দেখা সেই নেহাল। ভাইয়ার বন্ধু থেকে শত্রু বনে যাওয়া সেই নেহাল। কথা রাখতে পারবনা আমি। শোভনের বাবার ঠিকানা নিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে নেহালকে। ফিরিয়ে দেওয়ার গল্পগুলো ফিরে ফিরেই আসে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত