পাঁচ বছরের চুমকি খুব খুশি, মা আর দাদীর সাথে মেয়ে দেখে এসেছে সে।
ওখানে অনেক নাস্তা খেলো, ঘুরলো, তারপর ট্যাক্সি করে বাসায় চলে এলো।
বাবা জানতে চান,
-কিরে মা, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?
-না, বাবা।
-কেনো! কেনো! সুন্দর না?
-না, বাবা।
-দেখতে কেমন?
-কালো, মোটা, বড় বড় চোখ, বড় বড় কান…
বাবা হাসেন।
-আমার মায়ের তবে পছন্দ হয়নি?
-উহু..একদম না।
চুমকি রাতে মা বাবার মাঝখানে ঘুমায়। ঘুমাবার আগে প্রতিদিনের মতো বাবা পা ধুইয়ে দিয়েছে চুমকিকে।
সন্ধ্যায় মা ধুইয়ে দিলেও, সে স্যান্ডেল এক কোণে রেখে পুরো ঘরময় দৌড়ায়। পা আবার ময়লা হয়।
বিছানায় শুতে গিয়ে চুমকি বলে,
-বাবা, দেখাও তোমার শক্তি…
-শক্তি খেলা খেলবি?
-হুম!
-তবে দাঁড়া আমার হাতের তালুতে।
বাবা শুয়ে মেয়েকে হাতের তালুতে করে ধীরেধীরে উপরে তোলে।
চুমকি হাত থেকে নেমে, বিছানায় খুশিতে লাফায়।
-আমার বাবার অনেক শক্তি, অনেক অনেক।
হাতে তালি দিতে থাকে সে।
সকালে বালিশের নিচে কি যেন খুঁজে চুমকি।
-বাবা, নাই!
বাবা, লেমনজুস চকলেট কই?
-পাসনি? আজ আমার বালিশের নিচে দেখতো।
-হু পেয়েছি..!! পেয়েছি..!!
হাতের মুঠোয় চকলেট নিয়ে চুমকি দৌড়ে চলে যায়।
-আগে দাঁত মেজেনে চুমকি। তারপর চকলেট খাস।
-আচ্ছা।
আচ্ছা বললেও চুমকি চকলেট মুখে পুরে দেয়।
বাবা সদরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন আর চুমকি স্কুলে।
-বাবা দুই টাকা।
-আজকেও লাগবে?
-প্রতিদিন লাগবে।
-কি করিস মা টাকা দিয়ে?
-আমার ব্যাংক আছেনা? ওখানে রাখবো।
-আগে বল, বাবাকে কত ভালোবাসিস?
-আমার হাত পায়ের যতোগুলো আঙ্গুল আছে, তার থেকেও অনেক বেশি।
-তাই! এত্তো ভালোবাসিস!?
বলে, হা..হা..হা..করে বাবা হাসেন।
-আর তোর মাকে?
-শুধু হাতের আঙ্গুলের সমান।
-হুম, গুড..গুড।
এ্যাই শুনছো, তুমি শুধু হাতের আঙ্গুল।
-ভালো, ভালো। বাপ মেয়ের মধ্যে ভালোবাসা থাকলেই হবে, আমার লাগবেনা।
মা অন্য রুম থেকে জবাব দেন।
আজ চুমকিকে পরীর মত লাগছে। খুব সুন্দর জামা বানিয়ে এনেছে বাবা। বাবাও খুব সেজেছেন। মাথায় পাগড়ী, গায়ে সেরোয়ানী।বাপ মেয়ে কার এর পেছনের সীটে বসে আছে।
-বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-বউ আনতে।
-কার বউ?
-আমার বউ, তোমার ছোট আরেকটা আম্মু আসবে।
-কে?
-ঐ যে তুমি দেখেছো তো, চোখ বড় বড়, কান বড় বড়…
-অহ..আমি তো তাকে চিনি “ও” তো সুন্দর না।
-থাক মা..সুন্দর লাগবেনা।
-তাহলে বউ আনছো কেনো?
-বউ তোমার জন্য একটা ভাই আনবে।
তারপর তারা ঘরে বউ নিয়ে ফিরে।
রাত হয়।
বউ বসে আছে, চুমকি আর তার মা বাবার রুমে।
-আমার ঘুম পাচ্ছে মা, রুমে আসো।
-চল, আজ এই রুমে চল, আজকে আমরা মা মেয়ে গল্প করে একসাথে ঘুমাবো।
মায়ের কন্ঠ কান্না মেশানো।
-না, আমি আমার রুমে ঘুমাবো।
-আজ ঐ রুমে যেতে নেই মা।
হয়তো গভীর কষ্টের সাথে মা এ কথাটি বলেন।
ছোট্ট চুমকি বুঝতে পারেনা, ধরতে পারেনা মায়ের কষ্ট।
-কেনো? কেনো যেতে নেই? আমি বাবার সাথে ঘুমাবো।
চুমকি ঐ রুমে যেতে চায়। সবাই ওকে আটকে রাখে। সবাইকে চুমকীর শত্রু মনে হয়। এমনকি মা কেও।
চুমকী বাবা বাবা বলে কাঁদতে থাকে, সে যে পাঁচ বছরের এই জীবনটাতে একদিনও বাবাকে ছাড়া ঘুমায়নি।
আজ বাবা পা ধুইয়ে দেয়নি, শক্তি খেলাও খেলেনি। চুমকীকে একটি বার দেখতেও আসেনি।
চুমকী কাঁদতেই থাকে, সে বুঝতে পারে না আজ তার বাবার বাসর রাত!
আজ তার নিজের রুমে যেতে মানা।
অনেক সময় লেগেছে চুমকীর জানতে, মেয়ে হয়ে জন্মানো মানে অপূর্ণতা। একটা ছেলে জন্ম নিলে সংসার পরিপূর্ণ হয়, কিন্তু একটি মেয়ে জন্ম নিলে সংসার নাকি অপূর্ণ থেকে যায়। ঘরে তখন নাকি বাতি জ্বালাবার কেউ থাকেনা।
তার মায়ের পেটে যে আর কোনো সন্তান আসবেনা। কিন্তু বাবা আর অন্য সবাই বলেন, ছেলে সন্তান ছাড়া যে দম্পতি’র জীবন বৃথা!
ধীরেধীরে বালিশের নিচেও আর চকলেট পাওয়া যায়না। চুমকী হাতড়িয়ে ফেরত আসে।