আমার দ্বিতীয় ছেলে যখন স্ত্রীর পেটে আসলো, তখন আমার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক।ব্যবসায় লোকসান দিয়ে হা পিত্যেশ করছি। মা অসুস্থ, বাবা হাইপারটেনশনের রোগী। ছোট ছোট ভাই বোন গুলো লেখা পড়া নিয়ে ব্যস্ত।আমি কাউকে নিজের কথা বলতে পারছিলাম না। একমাত্র স্ত্রী ছাড়া বাসার কেউ আমার পরিস্থিতি জানতো না।
যখন ব্যবসায় লোকসান গুনছিলাম, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার পাশে কেউ নেই। একে একে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। যেসব বন্ধুর একবেলা আমার অফিসে বসে এক কাপ চা না খেয়ে গেলে রাতে ঘুম হতো না, তারাও আস্তে আস্তে সরে পড়লো।আমি একেবারেই একা হয়ে গেলাম।
যখন দ্বিতীয় ছেলে জম্মের সময় ঘনিয়ে এলো, স্ত্রীকে একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালাম। প্রাইভেট ক্লিনিকে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু খরচের কথা ভেবে স্ত্রী রাজি হয়নি। একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে একটা কেবিন জোগাড় করতে পারলাম। আমার স্ত্রী চাইছিল বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হউক। যখন দুইদিন পেড়িয়ে যাওয়ার পরও বাচ্চা ডেলিভারি হচ্ছিল না,তখন অনেক আত্মীয় স্বজন পরামর্শ দিল সিজার করার জন্য। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করলো। ডাক্তার জানালো তখনও এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে এই মূহুর্তে সিজার করতে হবে। তবে আমরা চাইলে তারা চিন্তা ভাবনা করতে পারে।
আমার শ্বশুর বাড়ির এক বিশাল বড়লোক আত্নীয় এসেই হম্বিতম্বি শুরু করে দিল। এই সব নোংরা হাসপাতালে কখনো চিকিৎসা হয়? এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানে মরন ডেকে আনা! আমার উচিত ইমিডিয়েট একটা ভালো প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যাওয়া। তারা হাসপাতাল পর্ব শেষ করে শুরু করলো এই মাসে কয় সেট গয়না কিনেছে তার খোশগল্প! আরেক আত্মীয় পরামর্শ দিল ল্যাব এইড অথবা স্কয়ার হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য। একবারও প্রশ্ন করলো না সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আমার আছে কিনা! তারা চলে যাওয়ার পর আমার স্ত্রী আমার হাত ধরে বসে রইল। তার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়তে লাগলো।বুঝলাম আমার হাত ধরে সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে। স্ত্রীর সামনে বসেই আমার এক পাওনাদার বন্ধুকে ফোন দিলাম। বিপদে সাহায্য করেছিলাম। সে ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
রাতে যখন প্রচন্ড ব্যথা উঠলো তখন শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাকে পরামর্শ দিল সিজার করানোর জন্য। কেউ কেউ আমাকে হার কিপ্টে বলে গালি দিতে শুরু করলো। স্ত্রী চাইছিল না,আমার অবস্থা শ্বশুর বাড়ির কেউ জানুক।সে শুধু আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরে রাখলো। রাত বারোটার দিকে আমার ছেলে নরমালি দুনিয়ার বুকে চলে আসলো। পরের দিন জানা গেল ছেলে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছে না। সেই সময় প্রচন্ড শীত পড়েছিল। এক সপ্তাহ সূর্যের মুখ দেখা যায় না এমন অবস্থা। ছেলেকে তৎক্ষনাৎ হিটিং মেশিনে পাঠানো হলো।
ছেলের বয়স যখন ছয় মাস তখন বুঝা গেল ছেলে স্বাভাবিক আচরণ করছে না।ডাক দিলে সাড়া দিচ্ছে না। ভালো করে তাকাচ্ছে না।শুরু হলো আরেক মানসিক যন্ত্রণা! কেউ কেউ বলা শুরু করলো তখন যদি সিজার করা হতো তাহলে ছেলের এ সমস্যা হতো না। আমার আত্বীয় স্বজন আমাকে বেশী পাগল করে ফেললো।কেউ বুঝতে চাইল না,কপালে যদি লেখা থাকে তাহলে নরমাল, সিজার কোন বিষয় নয়।তাদের কথায় মনে হলো সিজার না করানোটা ছিল আমার জন্য বিশাল অপরাধ! অথচ তারা কেউ ডাক্তার নয়।
আমি বাবা হয়ে ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারলাম না। আমার স্ত্রীর চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছু রইল না! এ ডাক্তার ও ডাক্তার করতে করতে কয়েক বছর পার করে দিলাম। বাংলাদেশের বাঘা বাঘা শিশু নিউরোজিস্ট দেখিয়েও কোন লাভ হলো না। ইন্ডিয়ান ডাক্তারদের সাথেও যোগাযোগ করা হলো। অসুস্থ শিশুকে বুকে জড়িয়ে কান্না চাপতে চাপতে দিন পার করি।মাথার ভেতর কোন যুক্তি কাজ করে না। নিজেকে ধিক্কার দেই একজন অযোগ্য বাবা হিসেবে। মনে হয় আমার বাচ্চা বলছে, যদি ভালো করে দুনিয়ায় আনার সামর্থ্য না থাকে তাহলে কেন আমাকে আনতে গেলে, বাবা?আমার কি অপরাধ? আমি কেন স্বাভাবিক মানুষ হতে পারলাম না?
এখন আমার হাতে টাকা আছে। চাইলে বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারি।কিন্তু এই টাকা আমার কাছে এখন মূল্যহীন! বাচ্চাকে একটা অটিস্টিক স্কুলে ভর্তি করেছি। সেখানে সে নাচ গান শিখছে। ছবি আঁকা শিখছে। জানি না তার কপালে কী আছে। যখনই বাচ্চার দিকে তাকাই,তখনই মনে হয় আমি একজন অযোগ্য পিতা!