গভীর রাতে মদ্যপ স্বামী যখন টলতে টলতে ঘরে ফেরে, তখন হঠাৎই মনে পড়ে যায়,একটা ছেলে আমার জন্যই জীবনে প্রথম সিগারেট ধরেছিল। কেবল আমারই জন্য ঘুমন্ত স্বামীর পাশে শুয়ে নির্ঘুম রাতে যখন আমার বালিশটা ভিজে যায়, তখন অনুভব করি চোখের জলে একটা ছেলের পুরো জীবনটাই স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। কেবল আমারই জন্য আমার স্বামী শেষ কবে আমার দিকে ভাল করে তাকিয়েছেন মনে নেই। তার একটু মনোযোগ আকর্ষনের জন্য আমাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। অথচ সেই ছেলেটির মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি আমাকে জড়িয়ে রাখত সর্বক্ষন। সেই দৃষ্টিও বেদনায় মলিন হয়ে গিয়েছিল।
কেবল আমারই জন্য অর্ধাঙ্গিনী হয়েও আমার স্বামীর পৃথিবীতে আমার স্রেফ অযাচিত উপস্থিতি। সেই ছেলেটির পুরো পৃথিবী ছিল আমাকে ঘিরে। আমি শূন্য সেই পৃথিবীতে ছেলেটি অস্তিত্ব সংকটে। কেবল আমারই জন্য স্বামীকে ভালোবেসেও বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাই না। কিন্তু সেই ছেলেটি আমাকে নিঃশর্ত ভাবে ভালোবাসত। আমার অবহেলা আমার উপেক্ষা কোন কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তবু সেই ভালোবাসাও ধুলোয় লুটিয়েছিল। কেবল আমারই জন্য তিন বছরের ভালোবাসা ভাঙতে আমি সময় নেইনি তিন মিনিটও। জেনে বুঝে আমি সেই ছেলেটির হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম। সে আমাকে বারবার অনুরোধ করেছিল। আমি শুনিনি। আমার দৃষ্টি তখন আরও উপরে। বাসা থেকে বিয়ের জন্য ছেলে দেখছিল। পরিবারের বড় মেয়ে আমি। লেখাপড়ায়ও খুব একটা ভালো না।
বাবা মার বোঝাই বলা যায়। যেন তাড়াতে পারলেই বাঁচেন। আমি আর কিই বা করতাম! কিন্তু এসব স্রেফ অজুহাত। করার হয়ত অনেক কিছুই ছিল। আমারই ইচ্ছে হয়নি। একটা ভবঘুরে বেকার ছেলের সাথে প্রেম করা যায়। কিন্তু বিয়ের বাজারে সে একেবারেই অযোগ্য। আমার সামনে অনেক বিকল্প ছিল। আমি সেরাটা বেছে নিয়েছি। ছেলেটা..নাহ্ ছেলে বললে ভুল হবে। এক মধ্য বয়সী ভদ্রলোক। অগাধ টাকা পয়সার মালিক। সুন্দরী বউকে ভালোই রাখবে। এমনটাই ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক সম্মোধনটা আমার স্বামীর সাথে যায় না। সে একজন মাতাল চরিত্রহীন। নারী আসক্তি তার বহু পুরোনো। আমি তার স্ত্রী নই বরং বড়লোক বাড়ির গৃহসজ্জার উপকরন মাত্র।
অন্যায় করলে শাস্তি তো পেতেই হয়। কিন্তু সেই শাস্তি যে এত তীব্র হতে পারে আমার ধারনা ছিল না। যখন সেই অপরাধকেই আমি অপরাধ বলে স্বীকার করিনি। আজ স্বপ্নহীন রুক্ষ পৃথিবীতে আমি একা। অথচ সেই ছেলেটি আমাকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেছিল। সায় ছিল আমারও। কিন্তু নিষ্ঠুর স্বার্থপরের মত আমি ওকে ছেড়ে এসেছি। নিজে ভালো থাকার জন্য ওর ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছি।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকতে পারে না। কাউকে করা আঘাত প্রতিঘাত হিসেবে ফিরে আসে..আসবেই! আমি তো আর সে সবের উর্ধ্বে নই। অথচ সে সাধারনের থেকে আলাদা। এত বড় প্রতারনার পরও ছেলেটি আমাকে একবার প্রতারক কিংবা ধোঁকাবাজ বলে গালি দেয় নি। নিজেকেই ডুবিয়ে দিয়েছে অন্ধকারের সমুদ্রে। কোন অভিযোগ ছিল না, কেবল নিরব সমর্পনে সে আমাকে চেয়েছিল। আমি নির্দয়ের মত সেই আহ্বান উপেক্ষা করেছি। যে ছেলেটি আমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে আজ মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে।
কেবল আমারই জন্য আজ আমার তাসের ঘর ভাঙার অপেক্ষায়। ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ধ্বংস স্তূপে জীবন যখন থেমে যাচ্ছে তখনই মনে পড়ে যায়, একটি ছেলের হৃদয় ভেঙেছিল। কেবল আমারই জন্য..