মাঘ মাসের মাঝামাঝি ইজাজ যখন বাড়িতে ফিরলো, একা ফিরলো না। গায়ে চাদর জড়ানো ঘোমটা সমেত একজন নারীও ঢুকলো তার পিছুপিছু। ঘন কুয়াশার মধ্যে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে আসার সময় যে দু-চারজনের নজরে পড়েনি এমন নয়। ঘটনাটা আগে-ই গ্রামের সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেছে। তারা জিজ্ঞেস করলো– ‘কী ইজাজ ভাই, বাড়ি ফিরলা তবে?’
ইজাজ সংক্ষিপ্ত উত্তরে বললো– ‘হ, আইছি, কী খবর তোদের?’
‘আমাদের আর খবর! পোড়া কপালে একটাও জোটে না।’ তারা হাসে। আবার জিজ্ঞেস করে– ‘তো ইজাজ ভাই, আপনের সাথে কে চিনতে পারলাম না।’
ইজাজ জানে, তারা বুঝেও মশকারা করছে। কিছু না বলতে বলতেও বললো– ‘চিনবানে বাড়িতে গেলে। আগে বাড়ি যাই।’
‘হ-হ আগে বাড়ি যাও। নতুন ভাবিরে কইয়ো মিষ্টি রাখতে , রাতে একবার আইবো।’
সংবাদটা ততোক্ষণে ছড়িয়ে পড়ছে। আতিয়া ইরফান হাজীর বাড়িতে ছিলো। কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছে ঠিক এমন সময় তার কাছে খবরটা পৌঁছলো। ‘যাও গো, তোমার সোয়ামী আইছে নয়া বউ নিয়া।’
সে হাতের কাজ ফেলে দু চোখে চৈত্রের আগুন আর বৈশাখের ঝড় নিয়ে দ্রুত বাড়ির পানে ছুটে যায়।
ইজাজ ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে বউকে খাটের একপাশে বসিয়ে বাচ্চাদুটিকে আদর করতে থাকে। অনেকদিন পর ফিরেছে। আসার সময় দুই ছেলের জন্য শীতের নতুন সোয়েটার, জামা জুতো নিয়ে এসেছে। সেগুলো ব্যাগ থেকে বের করে নিজ হাতে পরিয়ে দেয়। ছেলে দুটি নতুন কাপড়, লজেন্স-মিঠাই আর এতোদিন পর বাপকে পেয়ে খুব উল্লসিত হল। ছোট ছেলে তার কোলে বসে আর বড়টা পাশে বসে গল্প জুড়েছে। বাচ্চাদুটিকে নিয়ে সে খুব আহ্লাদিত। এমন সময় একটি ঝড় এসে বাড়িকে নাড়িয়ে দিল।
আতিয়া এসে পুরো বাড়িটা মাথায় তুললো। রাগে ক্ষোভে বকতে বকতে উঠানে ঢুকে– ‘শালার ভাই শালা, এতোদিন খবর নাই, এখন আইছে মাউগ নিয়া। কতো বড় সাহস আমার ঘরে নিয়া ঢুকছে।’
কোমরে কাপড় আগেই সে পেঁচিয়ে নিয়েছিলো। ঘরে ঢুকেই ইজাজের দিকে আঙ্গুল ছুড়ে দিলো এক ঝামড়ি– ‘এতোদিন কোথায় ছিলে মিয়া, এই বেটি কেডা? কার পারমিশনে বেটি নিয়া বাড়ি ঢুকছো? এত্তো বড় সাহস!’ কিরিমিরি খেয়ে সে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো– ‘এই মুহূর্তে এই বেটি নিয়া আমার ঘর থেকে বাহির হও কইলাম।’
স্বামী এবং নতুন বউকে শ্রাব্য-অশ্রাব্য যত্তোসব গালিগালাজ করেও কান্ত হলো না। নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে মাথা নত করে বসা ছিলো। সে আচমকা গিয়ে ঘোমটা ধরে হেচকা টানে খুলে ফেললো। হাত ধরে সজোরে টান দিয়ে বললো– ‘মাগির মাগি আমার ঘর থেকে বের হ।’ তাতে নতুন বউ প্রচণ্ড ঝাকুনি খেয়ে ককিয়ে উঠলো তবু খাট থেকে নামলো না। খাটের কোণে শক্ত করে ধরে চেপে রইলো। বাইরে থেকে তখন দুজন মহিলা এসে আতিয়ার হাত ছাড়ালো। রাগে-ক্ষোভে এবার আতিয়া বাচ্চাদের দিকে তেড়ে গেলো– ‘এইসব গা থেকে খোল, হাতে কী? এগুলো ফেলে দে কইলাম। এতোদিন ধরি বাচ্চা দুটা আছে না মরছে খবর নাই। মাউগ নিয়া পিরীত মারছে, আর এখন আসি আহ্লাদ দেখাচ্ছে।’
বাচ্চা দুটি মায়ের এমন অগ্নিমূর্তি আর ঝাড়ি খেয়ে তাদের বাবাকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে ললিপপ চুষতে থাকে আর মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে।
বউয়ের হাতে চরম ভাবে হেনস্তা হওয়া সত্ত্বেও ইজাজ কোন প্রতিবাদ করছে না। সে নিরবে হজম করে যাচ্ছে । সেও বুঝতে পারছে পরিস্থিতি প্রতিকূল। এখন যদি উচ্চবাচ্য করে, বড় বউর পক্ষে সবার সমর্থন আরো দৃঢ় হবে। তার পক্ষে কাউকে পাবে না। সবাই বলবে, এতোদিন থেকে কোন খোঁজ খবর নাই আর এখন সতিন নিয়ে এসে উল্টো ঝাঁজ দেখাচ্ছে। এমনিতেই সবাই বড় বউর ঝাঁঝে সমর্থন দিয়ে বলছে– ‘বেটিতো উচিৎ কথা বলছে। সে তার রাগে চিল্লাচ্ছে, এরকম হলে কে না চিল্লাবে।’ ইজাজ বুঝলো, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বড় বউর অনুকূলে। সে মাটি সমান ধর্য্য নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। আর কখনো মানুষজনের দিকে সহানুভূতির আশায় করুণ ভাবে তাকায় এবং উপায় ভাবে।
ততোক্ষণে উঠানে বেশ মানুষজন জমে গেছে। তাদের বেশির ভাগই মহিলা। কয়েকজন উঠতি বয়সের পোলাপান জড়ো হলেও মুরব্বিগোছের কেউ নেই।
আতিয়া উঠানে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে– ‘দেখো তামাশা, সেই কার্তিক মাসে গেছে। গিয়া একটা কানাকড়ি দিবে দূরের কথা কোন খবরই নেয় নি। আমি কী কষ্ট করি মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করি বাচ্চাদুটা পালতেছি তাতো আপনারা দেখতেছেন। আর এখন চুপচাপ এসে বেটি নিয়া ঢুকছে। আপনারা বিচার করি দ্যান’, এ বলে সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। এবং তার বাকি কথামালা ভেসে গেলো কান্নার তোড়ে।
এতোক্ষণ সবাই নিরবে দাঁড়িয়ে দেখলেও এবার দু তিনজন পুরুষ আতিয়ার পক্ষে মুখ খুলতে শুরু করলো– ‘বেটি কি আর বিনা দুঃখে ঝাড়ছে? বাচ্চা দুটা পোলা নিয়া বেচারিকে কিনা কষ্টে ফেলি গেছে। দিন রাত মানুষের বাড়ি খাটুনি খাটি তিন পেট চালাচ্ছে। একটা বার খবর নেয় নি। আর এখন কো–থেকে আরেকটা নিয়া আইছে।’
‘হারামজাদা এক বউ খাওয়াতে পারছে না তার ওপর আরেক বউ। ’
‘দুইটারে ফালাইয়া মাইর দিলে বিয়ার হাউস নামি যাইবো।’
‘ঐ বেটিরও দোষ কম না। তার বউ আছে জেনে বিয়ে বসে কেমনে? দুইটারে পিডাইয়া বাহির করো।’
মহিলারাও এতোক্ষণে ঘরের মধ্যে নতুন বউয়ের সাথে আলাপ জুড়েছে। বাড়ি কোথায়– ঘর কোথায়? নাম কী? মা বাপ আছেন, তারা কী করেন, ভাইবোন কয়জন, বিয়ে হয়েছে কয়জনের, ভাইয়েরা কী করে, এক সাথে না আলাদা? যে যার মতো প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর সেও খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিচ্ছে।
‘তো- তুমি যে বিয়ে বসলা, তার যে বউ আছে একথা জানিয়া বিয়ে করো নি?’
‘বিয়ের আগেতো আমারে এ একথা জানায় নি। পরে জানছি।’
‘বিয়ে করেছো ভালো কথা, যেখানে ছিলা তাও ভালো আছিলা– এখানে আসলা কেন, এখন বড় বউতো কোন ভাবে মানি নিবে না।’
‘আমার দোষ কই, আমারে নিয়া না আসলে কি আমি আসি? নিয়া আইছেন কাজে আইছি। কিভাবে খাওয়াইবে, কোথায় রাখবে যে বিয়া করছে সেই না জানে।’ খুব শান্ত শিষ্ট ভাবে জবাব দেয়।
‘বেটির কথাটাও ফেলে দেবার না। সে তো আর জোর করি বিয়ে করেনি। আর বাড়িতে না নিয়ে আসায় কি আইছে। বেটির দোষ কোনখানে?’ ভিড়ের মধ্য থেকে একজন মহিলা নতুন বউয়ে কথায় সায় দিয়ে কথাগুলো বললে অন্যরাও তার কথায় সায় দিয়ে বলেন–, ‘কথা তো ঠিক। তার কী দোষ? তাকে নিয়া না আসলে সে কি আসতো?’
সময় গড়ালো। অনেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এতোক্ষণে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে লাগলো।
‘ফালতো যত্তোসব। এখানে আসিয়া কাম কাজ নষ্ট।’ তাদের নিজনিজ কাজে চলে যেতে লাগলো। যারা আগে খবর পায় নি, এদিকে যাওয়ার পথে শোরগোল শুনে কৌতূহলে এসে উঠানে জড়ো হলো। টানটান উত্তেজনা দেখে তারা তাদের কাক্সিক্ষত কিছু দেখার অপেক্ষায় রইলো। এতোক্ষণে এখানে দু ভাগ হয়ে একপক্ষ যা বড় অংশ তারা বড় বউ পক্ষে দাঁড়ালো আবার এক পক্ষ ছোট বউর পক্ষে। তারা বললো– ‘দোষ করলে তোমার স্বামী করছে, বেটির দোষ কোথায়?’
শেষ পর্যন্ত উপস্থিত সকলে সিদ্ধান্ত দিলো– ‘মুরব্বি দু চারজন না বসলে বিষয়টি মিমাংশা হবে না। এখন যে যার মতো থাকো। কোন মার-দরবার করিও না।’ তারা যে যার পথে চলে গেল।
রাতে মুরব্বিরা বসার কথা থাকলেও পঞ্চায়েতের সর্দার না আসায় পরদিন সকালে বৈঠক বসলো।
ইজাজ কথার ওপর কী এক কথা বলায় পঞ্চায়েতের সর্দার রাগে-ক্ষোভে তার গালে, পিঠে টাস টাস কয়েক থাপ্পর বসিয়ে দেন।
‘হারামজাদা শয়তান! গাঁও নষ্ট করতে লাগছিস। এখন তোর দেখাদেখি আরেকজন গিয়া আরেকখান করবো। এক বউ খাওয়ানোর মুরোদ নাই তার ওপর আরেক বউ। কত্তো বড় সাহস!’
‘এই তুই যে বিয়ে করলি, বড় বউর অনুমতি নিছিস? আইন জানছ না দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে প্রথম বউর পারমিশন লাগে। মূর্খ কোথাকার এখন যদি থানা পুলিশ হয় তবে জামাই-বউ দুটাই জেলে পঁচে মরবি…।’
সবার মধ্য থেকে ইরফান হাজি বললেন– ‘আর কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। যা ঘটার ঘটিগেছে। সবাই মিলি একটা সমাধান দিয়া দেও।’
‘দুটা বাচ্চার দিকে চাইয়া ছাড় দিচ্ছি। না হয় তোরে পুলিশের প্যাদানী দিয়া জেলে ঢুকাতাম। ’ পঞ্চায়েতের সর্দার বললেন– ‘এখন সেই সমাধান দিক– দুই বউ কেমনে খাওয়াবে, কেমনে রাখবে?’
ইজাজ ভয়ে কাচুমাচু। বিনীত ভাবে বললো– ‘বিয়ে করছি এখনতো ফেলে দিতে পারমু না। বড় বউকেও তো আর ছাড়ি যাইনি। কাল থেকে একটা রিক্সা নিমু। যা রোজগার হয়– চাল,ডাল,তেল,সাবান দুজনকে সমান ভাগে দিমু। কোন মার-দরবার হইবো না।’
মাতব্বররা ঘরের রুম, চুলা ভাগ করে দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বউকেও একটু শাসিয়ে গেলেন– ‘তোমার মুখটাও যেন কন্ট্রোল থাকে। কোন ফ্যাসাদ যাতে না শুনি।’
আতিয়া মাতব্বরদের বাড়ি বাড়ি হেঁটে কান্নাকাটি করে সব খোলে বলে বিচার জমিয়েছিলো। তার ধারণা ছিল মাতব্বররা এসে নতুন বউকে বের করে দিবেন। তা না করে এখন উল্টো তারা তার ঘর ভাগ করে দিয়েছেন। যে ঘর বানাতে তাকে কতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। টুকরিতে করে মাথা দিয়ে মাটি বয়ে ভিটে উঁচু করছে। কতো পরিশ্রম করে সংসারটা সাজিয়েছে। আর এখন উড়ে এসে জুড়ে বসে আরেকজন ভাগ বসিয়েছে। নিজেকে কোন ভাবেই প্রবোধ দিতে পারছে না। এই নারীর সাথে কিছুতেই একছাদের নিচে থাকতে পারবে না। প্রয়োজনে ছেমড়া-ছেমড়ি দুটারেই জেলের ভাত খাওয়াবে। পাড়াপড়শীরা বললেন- ‘বাদ দাও। যা হবার হইছে। মিলেমিশে থাকো আর যাক কদিন। দেখো কী করে’
কোন কোন মহিলা উস্কানী দিয়ে বললো– ‘তা কি এতো সোজা! বড় বউর পারমিশন ছাড়া বিয়ে। নারীদের আইন যে কতো কঠিন! কোর্টে উঠলে না ঠের পাবে।’ তাদের কথায় আতিয়া একটু জোর পায়।
‘আমার গণ-গোষ্ঠি কি কেউ নাই মনে করছে? গিয়া যদি বলি, শিক্ষা দেওয়ার মতো দিবা।’
সে এমনিতেই পুড়ছিলো। এরিমধ্যে দুদিন পার হলো না– কাটা গায়ে লবনের ছিটা! আতিয়া পানি, গোবর দিয়ে যত্ন করে যে লাউঝাড় তুলেছিলো, তাতে সবে লাউ ধরতে শুরু করছে। একটামাত্র খাওয়ার উপযুক্ত। লাউটা এতোদিন থেকে চোখে চোখে রেখে আসছে। এটা বিক্রি করলেও দুটা টাকা পাবে। কিন্তু সেদিন যখন আতিয়া অন্য বাড়িতে কাজে চলে যাবার পর ঘরে তরকারী না থাকায় ইজাজ লাউটা পেরে দুভাগ করে অর্ধেক ছোট বউকে দিয়ে অর্ধেক রেখে দেয় বড় বউয়ের জন্য। আতিয়া সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরে এমন কাণ্ড দেখে সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। ইজাজ বাড়িতে ফিরে দেখলো দু বউ তুমুল বাগ-যুদ্ধে লিপ্ত। থামাতে না পেরে অবশেষে দু বউয়ের পিঠে টাস টাস কয়েকটা বসিয়ে দিলো। আর তাতে বড়বউ আরো সাঁ সাঁ করে উঠলো। স্বামীকে তুইতুকারি করে বললো– ‘ তোকে যতোক্ষণ জেলের ভাত না খাওয়াইছি আমার বাপের নাম আব্বাছ না!’ সে অনেকক্ষণ যা তা বকে গেল। ইজাজ আরো একবার তেড়ে গেলেও মারলো না। শুধু বললো- মুখ বেশি বাড়িছে, এক্কেবারে সিলাই দিয়া দিমু। দু বউকে শাসিয়ে ইজাজ বিড়ি ধরিয়ে বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে গেল, আতিয়াও চট জলদি ব্যাগ গুছিয়ে বাচ্চাদুটি নিয়ে বাপের বাড়ির পথ ধরলো।
ইজাজের দ্বিতীয় বিয়ের দু তিনদিন পরই আতিয়ার কানে খবর আসে। শুনে সে প্রথমে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। বাচ্চা দুটি নিয়ে বিপাকে পড়লো। অগ্রায়হণের শেষে গ্রামের সকল চাষি-মজুররা ফিরলেও ইজাজ ফিরেনি। এমনকি কোন টাকা পয়সা দেয়া দূরের কথা ফোনদিয়ে তাদের কোন খবরও রাখেনি। ইজাজের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে পাড়াজুড়ে প্রথমে বেশ মাতামাতি ছিল। সবার মুখে ছিল ঘুরেফিরে একই প্রসঙ্গ। এনিয়ে কথা বলতে বলতে আতিয়ার খুব বিরক্তি লাগতো।
‘বাদ দাও এই খারামখোরের কথা। আমার আল্লাহ আছেন। একশোটা বিয়ে করুক তাতে আমার কী? তার লাগি কি আমি ঠেকছি। আমার হাত পা আছে। আগের চেয়ে ভালই আছি আল্লাহর রহমতে। বাচ্চাদুটা বড় হলে আমার কিসের টান?’ সংসার নিয়ে প্রথম কয়দিন হিমশিম খেলেও পরে তা নিজের মতো করে সামলে নেয়। মাড়া-ঝাড়ি, ধান শুকানো, কোন বাড়িতে কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, কারো বাসন মাজা এভাবে এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে তার দিনকাল খারাপ যাচ্ছিলো না। আমনের মৌসুমে পাড়া-মহল্লায় কাজ করে দশ-বারো মণ ধানও তুলেছে ঘরে। ঘর থেকে বেরোনোর সময় পান চিবাতে চিবাতে বের হয়। ফেরার সময়ও পানমুখে লাল ঠোঁটে ঘরে ফিরে। পান সুপারী নিয়ে স্বামীর সাথে কতো ঝগড়া করতে হতো তার। এখন কোন কিছু নিয়ে কারো সাথে বিবাদ নেই। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে কোন খোঁজ খবর নিচ্ছে না, এ নিয়েও কারো কাছে সে কোন অভিযোগ করেনি। সমস্যা বাঁধলো যখন ইজাজ ঘরে ফিরলো। ফিরছে তাও আবার ঐ বউ নিয়ে। ক্ষোভটাতো তার এখানেই।
বাপের বাড়ি গিয়ে ভাইদের কাছে সব খুলে বলার পরও খুব একটা সুবিধে করতে পারলো না। ভাইয়েরা বললো– ‘তাতে কী হইছে। মানুষ কি আর দুই বিয়া করছে না? তোকে তো সে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নি। ঝামেলা না পাকিয়ে বাড়ি চলি যা। তোরে মারধর করে বের করে দিলে দেখমু নে।’
বাপ-মা মারা গেছে সেই কবে। বাপের রেখে যাওয়া ছোট এক ভিটেতে কোন মতে দুই ভাই মাথা গুজে আছে। দিন আনে তো দিন খায়। এতোকিছু নিয়ে তাদের ভাবার সময় কোথায়? নিজের পেটের ধান্ধায় নিজেরা ব্যস্ত। এখন বোন যদি বাচ্ছাদুটি নিয়ে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে, সেটা তাদের জন্য জবর বোঝা হয়ে যায়। তারা বোনকে বাড়িতে ফিরে যেতে বুঝায়।
সেখানে দু তিনদিন থেকে খুব একটা পশ্রয় না পেয়ে আতিয়া ফের বাচ্ছা দুটি নিয়ে স্বামীর বাড়ি ফিরে আসে।
রাতে ইজাজ বড় দেখে দুটি মাছ কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরে উঠানে এসে আতিয়াকে ডাক দেয়। খরচের ব্যাগ আতিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলে– ‘বড় দেখি একটা তুই রাখি অন্যটা ওরে দিয়া দে।’ স্বামীর মুখে একথা শুনার পর আতিয়া ক্ষোভ দেখায়– ‘একলা একজনের কামাই দিয়া আলাদা দুটা সংসারের ঘানি টানা কি সোজা? একচুলায়, একপাতিলে রান্না হবে। আমি কি কইছি আলাদা হইতে?’ হঠাৎ বড় বউর এমন বিচারিক এবং আপোষকামী কথায় ইজাজের মনে একটা স্বস্তির শীতল সমীরণ ঢেউ খেলে যায়। বড়বউর এ কথার কোন প্রতিত্তোর না দিয়ে কেবল ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠোঁটে ঈষৎ হাসি রেখা ফুটিয়ে বলে– ’তুমি যা কও তাই হইবে।’ আতিয়া ছোটবউকে ডাক দিয়ে বলে– ‘বটিটা নিয়া আসো গো।’
ছোটবউ চটজলদি সারা দিয়ে খুব সমীহের সাথে বটি দা এনে বড়বউর হাতে তুলে বলে– ‘এই নাও আপা বটি’। আতিয়া কুলায় ছাই নিয়ে মাছ কাটতে বসতে গেলে ইজাজ ছোটবউকে খুব জোরে ধমকি দেয়– ‘এই তুই কী করছস, তুই কাটতে পারছ না,তোর হাত নাই? অনেক দূরের পথ জার্নি করি আইছে, একটু রেস্ট করুক।’ আতিয়ার দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো– ও কাজ করুক, তুমি গিয়া রেস্ট করো।
ছোটবউ বটিটা হাত থেকে নিতে চাইলে আতিয়া বারণ করে– ‘না আমি পারবো, তুমি তরকারিটা কেটে নাও।’ আবার স্বামীকে একটু শাসিয়ে বললো– ‘আমাদের কাজে তুমি নাক গলিয়ো না, তুমি চুপচাপ বসি থাকো।’
একজন মাছ কাটছে, একজন তরকারি কাটছে দেখে ইজাজের ভালই লাগলো। মনে একটা আতঙ্ক ছিলো– না জানি কোন বিপদে ফেলে! আবার এমন পরিবর্তনে তার কাছে কিছুটা অবাক ঠেকলো। পরে মিলালো, ভাইয়েরা নিশ্চয় পশ্রয় দেয়নি, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার পাঠিয়েছে। যাক এখন তার বেশ স্বস্তি লাগছে। ভালভাবে দুটা চললেই হল। সে খাটের ওপর বসে বাচ্চা দুটির সাথে খেলা করতে লাগলো।
দুপুরে গোছল শেষে চুল শুকিয়ে ছোটবউ দাওয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছে। আতিয়া উঠানের একপাশ থেকে তার চুলের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। চুল এসে কোমরের নিচে পড়েছে। তার চুল থেকেও অনেক বেশি এবং লম্বা। তবে খসখসে হয়ে আছে। মনে হয় বেশ কদিন থেকে তেল পড়েনি। সে কাছে এসে চুলে হাত বুলিয়ে বললো– ‘কি গো তোমার চুল তো দেখছি লাল হই গেছে। তেল দেও না, ঘরে তেল নাই?’
ছোটবউ না সূচক মাথা নেড়ে বিনীত স্বরে বলে– ‘তেল নাই আপা।’
‘দেখো অবস্থা! এতোদিনে একশিশি তেল আনি দিতে পারলো না। কোন ফকিরেওতো এমন করে না।’ এ বলে চটজলদি গিয়ে নিজের তেলের বোতলটা নিয়ে আসলো। আপন হাতে ছোটবউর চুলে তেল মাখাতে মাখাতে বললো– ‘দেখ, এতো ঘন চুল আর তেলের অভাবে কি আটা হয়ে আছে। তেল নাই আমারে কও নি কেন?’ সে খুব যতন করে শুধু মাথা আছড়ে দিলো না; নিজের জন্য কেনা নতুন খোপাটাও এনে ছোটবউর চুলে বেঁধে দিলো।
‘কাঁচা বয়স। একটু সাজুগুজু না করে থাকলে কি মন কাড়তে পারবা? এখনই তো ফিটফাট থাকার সময়।’ গালে আলতো চিমটি কেটে বললো– ‘আয়নায় গিয়া দেখো, কি সুন্দর দেখাইছে।’
পাড়া-পড়শী মহিলারা যারা দুই সতিনের ঝগড়া দেখবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিলো, তাদের সে আশার গুড়ে পিঁপড়া উঠলো। সম্পূর্ণ চিত্র দেখা গেল ভিন্ন। দুই সতিন যে ভাবে চলছে এক ঘরে মায়ের পেটের দু বোনও এভাবে থাকে না। দেখা যায় দু সতিন দাওয়ায় বসে একজন আরেকজনের মাথা আছড়ে দিচ্ছে। চুলে বিলি কাটছে, উকুন বাছতে বাছতে গল্প করছে। মুখভরে পান খাচ্ছে। বাড়িতে ফেরিওয়ালা এলে দু সতিন মিলে চুড়ি রাখছে। বড়বউ ছোটবউকে নেইলপালিশ, লিপিস্টিক, পাউডার, স্নো ইত্যাদি রেখে দিচ্ছে। তাদের দিন যে আন্তরিক যাচ্ছে আন্দাজ করা যায়। তা দেখে কোন কোন মহিলার গা জ্বলে। ‘বহুত দেখছি। রসে রঙ্গে আর কয়দিন? যাক না দুদিন, দেখবা র্সাকাস!’
দু বউ নিয়ে ইজাজের ওপর বাড়তি চাপ পড়লো। কিভাবে দু টাকা বেশি রোজগার করা যায় সে ধান্ধায় তার ফুসরত নেই। ইতিমধ্যে সে সাধারণ রিক্সা ছেড়ে মোটর চালিত রিক্সা নিয়েছে। মালিককে তিনশ টাকা দিয়ে নিজের পোষাতে হয়। সকালে বের হয়ে দুপুরের খানাটা বেশিরভাগ বাইরে খেয়ে নেয়। দুকানে টিভি দেখে আড্ডা মেরে ঘরে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বা তার বেশিও বেজে যায়।
ছোটবউ‹র দিনকালটা বেশ সাজুগুজু কাটছে। অধিকাংশ কাজ আতিয়া একাই সামলে নেয়। বাইরের কাজ সে ছোটবউকে করতেই দেয় না।
‘তুমি ঘর সামলাবা। বাহির দেখমু আমি।’
উঠান ঝাড়ু দেয়া, লাউ, শিমের মাচা ঠিক করা, তরকারি পাড়া এসব বড় বউ-ই করে। ঘরের টুকটাক কাজ শেষে অনেক সময় ছোটবউ অলস সময় কাটায়। বাচ্চা দুটিকে সামলায়। গোছল করায়, ভাত খাওয়ায়। আতিয়ার হাতে যে মোবাইল ছিলো সেটাও সিম পাল্টে মেমোরিসহ ছোটবউকে দিয়ে দেয়।
‘আমার কি আর মোবাইল চালানোর অবসর আছে? তোমার কাছেই থাক। দরকার হলে পরে না হয় একটা নিবো।’
পাড়ার উঠতি দু চারজন যারা সম্পর্কে দেবর তারাও কখনো কখনো ইজাজের ঘরে আসে। বসে খানিক ঢং-তামাশা, গল্প করে। আতিয়া শুরুতেই তাদেরকে ছোটবউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। ‘দেওরদের চিনিয়া রাখো। মাঝে মাঝে সুখ-দুঃখের কথা কইতে পারবা। তারাও নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা কইবো।’
রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার কালে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে– দুই ভাবি কী করতাছো গো?
আতিয়া ঘর থেকে জবাব দেয়–‘ রাস্তা থাকি না জিকাইয়া ঘরে আসি দেইখা যাও।’
পাশের পাড়ার আক্কাছ প্রায় সময় আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করে। সন্ধ্যার পর এসে মোবাইল চার্জ দেয়। শুয়ে শুয়ে গান বাজায়। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। তাও একদিন কাজে গেলে তিনদিন বসে খায়। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। রাস্তাদিয়ে যাওয়ার সময় চায়না মোবাইলে গান বাজিয়ে বাজিয়ে হাঁটে। আক্কাছ এলে আতিয়াও পানের বাটা বের করে দেয়। সন্ধ্যার পর আসলে ছোটবউকে দিয়ে চা-ও বসায়। ছোটবউর সাথে ইতিমধ্যে তার বেশ খাতির জমেছে। কোন কোনদিন সে লজেন্স, আচার , চানাচুরও নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময় চিনি চাপাতাও নিয়ে হাজির। আতিয়া প্রায়দিন মানুষের বাড়িতে কাজে চলে যায়। কোনদিন দু ছেলেও মায়ের পিছু ধরে। কাজ শেষে এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে গল্প-গুজব করে সময় গড়ায়। পান খায়। আক্কাছ এসে ছোটবউর সাথে গল্প করে সময় কাটায়। তার মোবাইলে নতুন গান, ভিডিও শেয়ার করে। ছোটবউ লোডের জন্য দশ বিশ টাকা দিলে সেটাও আক্কাছ নেয় না। ‘আরে রাখো, তুমার জন্য আর কেউ না থাকলে আমিতো আছি।’
ইজাজ রাতে খরচপাতি নিয়ে রিক্সা মালিকের কাছে সমজিয়ে পরে ঘরে ফিরে। পরদিন আবার রিক্সা নিয়ে কামাইয়ে নেমে পড়ে। তার দু বউয়ের সংসার খুব খারাপ যাচ্ছে না। দু বউ মিলেমিশে থাকায় এ পর্যন্ত কোনদিন কাইজা-ফ্যাসাদেরও বিচার করতে হয়নি তাকে। এদিক দিয়ে সে অনেকটা স্বস্তিতে আছে। দু সতিনের এমন মিল মহব্বত নিয়ে তাদের পাড়ায়ও আলোচনা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের দিয়ে উদাহরণও দেয়া হয়। যেমন– দু বোনে ঝগড়া লাগছে। মা তাদের শাসিয়ে বলেন– ‘দুই বইনেরও জাগা হয় না। ঐ বাড়ি যে দুই সতিন আছে তোমরার মতো দরবার করতে শুনছো?’
বউ স্বামীর সাথে কোনকিছুর অভাবে কথা কাটাকাটি হলে বলে– ‘ঐ বেটা রিক্সা চালাই দুই বউয়ের খাওন দাওন দিতে পারে আর তুমি এক বউ চালাইতে পারো না।’
মাঝে-মধ্যে আতিয়ার কাছে পাড়ার কোন মহিলা সতিনের কথা জিজ্ঞেস করলে সেও বলে– ‘চলতাছে। কারো ভিতরের খবরতো জানি না!’
তখন গাছেরা নতুন পত্র-পল্লবে আচ্ছাদিত। আম, লিচুর মুকুল থেকে ধীরে ধীরে ফল বিকশিত হয়ে জ্যৈষ্ঠের জন্য পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতিতে নতুন গুঞ্জন। দখিনা বাতাস নতুন পাতায় আলোড়ন তুলে দেহ ছুঁয়ে গিয়ে উত্তরে ঢেউ তুলে বয়ে যায়। তখন শরীরে আলসেমি কাবু করে। মধ্যরাতেও ঘুম ভাঙ্গলেও শুনা যায় কুকিলের কুহুতান। পরক্ষণে সে ডাক ঘুমকে আরো নিবিঢ় করে তুলে। প্রাকৃতিক প্রাণচাঞ্চল্যে মনে যেমন আলোড়ন জাগে আবার কোন কোন মনে জেগে ওঠে অপ্রাঞ্জল ভাব। ইজাজ হয়তো কোন কিছু নিয়ে গভীরে চিন্তা করে না। রাত পোহালে জীবিকার জন্য নেমে পড়ে আবার রাতে খরচ নিয়ে ঘরে ফিরে। আজ সে একটু বেশি ক্লান্ত ছিল। রাতে ফিরে দেখে ছোটবউ আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার খাটে ছেলেদুটিও সেখানে ঘুমিয়ে আছে। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে বড় বউ বলে, আগবেলা খেয়ে নিয়েছে, বলছে মাথা ধরছে নাকি। ইজাজ খাওয়া-দাওয়া শেষে বড় বউর খাটে গা এলিয়ে দেয়। ইজাজ বড়বউকে বলে– বোরোধান কাটার মৌসুম আইতাছে, যামু কিনা ভাবতাছি। বড়বউ বলে, দরকার নাই থাক। ঝাড়ের একটা বাঁশ টিনের চালে নুয়ে পড়ছে। সেটা বাতাসের নাড়া-চাড়ায় চড়চড় শব্দ করে। বড় বউকে বলে– দিনে মনে করি দিস, এটা কাটতে হইবো। বড় বউ বলে– শুধু আগা কেটে দিলেও চলবো। সারাদিনের পরিশ্রম, বিছানায় উষ্ণ আনন্দ শেষে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে টিনের চালের চড়চড় শব্দ শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় রাজ্যের ঘুমে।
সে রাতে তাদের বাড়ির আশপাশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, চিৎকার-শোরগোলে। তারা প্রথমে আন্দাজ করতে পারে না আওয়াজটা কোনদিক থেকে আসছে। পরক্ষণে তারা নিশ্চিত হয় এটা ইজাজের বউ আতিয়ার চিৎকার। ‘ছিনালের ছিনাল, বেশ্যার বেশ্যা আমার নতুন শাড়ি, ব্লাউজ, কাপড়-চোপড় সব নিয়া ভাগছে… নিজের বোনের মতো দেখতাম, মাগির মাগি আমার ছাবাল পোলাদুটা রাখি দরজা খোলে ভাগছে গো…।
ইজাজের বাড়ির দিকে আসতে লাগলো একের পর এক টর্চের আলো।