রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই হুট করে একটা সাইনবোর্ডে চোখে আটকালো!সাইনবোর্ডে লিখা:- “কান্নাঘর” ‘এখানে সুলভ মূল্যে কান্না করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়!’ কি আশ্চর্য!এ রাস্তায় তো এ সাইনবোর্ড আগে কখনো চোখে পড়েনি।হালকা শীতের রাত!তখন সিলেটে কেবল বৃষ্টি থেমেছে।রাত একটা।আমি কফির নেশায় বের হয়েছি। কৌতুহল থামাতে না পেরে ভেতরে ঢুকেই পড়লাম!ওরে বাবা!কি দারুণ আয়োজন!২১ ডিগ্রীতে এসি চলছে!কেমন বিষন্ন ভায়োলিন আর খুব মৃদ্যু ভয়েসের কোনো গান চলছে!হালকা সবুজ আলো আর খানিকটা আধো-অন্ধকার ব্যাপার।শান্ত চারদিক! আমি কাস্টমার ডেস্কে গিয়ে যোগাযোগ করতেই একটা টোকেন পেলাম।টোকেন নিয়ে সরাসরি-‘দুঃখঘরে!’ আমার রুমটা পেয়ে গেলাম ভেতরে ঢোকার আগে শুধু ম্যানেজার একটা কথা বললেন- আমরা বিশ্বাস করি-‘জন্মঘর’-যেমন রয়েছে-হসপিটাল,মৃত্যু ঘর যেমন রয়েছে,তেমনি কান্নাঘরও জরুরী। এ শহরে চিৎকার করে কাঁদার মতো কোনো জায়গা নেই! শুধু এই কান্নাঘর আছে!মন খুলে কাঁদুন।’
রুমটা বেশ গোছানো…রুমে শুধু কান্নার যে ব্যবস্থা তাই না,প্রচন্ড কাঁদতে পারার মত কিছু মুভির সিডি ও রেখে দেওয়া আছে।কাঁদার মতন ট্রাজেডি উপন্যাস আছে! আর আছে একটা ডায়েরী!আমি একটা চেয়ারে বসতেই কেমন অদ্ভুত বিষন্নতা অনুভব করলাম।নীলার জন্য,তার চলে যাবার পর দীর্ঘদিনের কান্না জমে আছে;জীবনে কিছুই করতে পারি নি-বলে কান্না জমে আছে!সবার সামনে নিজে একটা কথা বলবো-কে কী বলবে ভেবে কথা না বলতে পারার যন্ত্রনা-বুকের ভেতর আছে।হুট করে কান্না চলে এলো।কাঁদতে থাকলাম।জীবনের একেক স্মৃতি,নিজেকে নষ্ট করার গল্প-ভেবে ভেবে একটা পুরো রাত কাঁদলাম। কান্নাঘর-ঘরটার বিশেষত্ব ছিলো।যে যে কান্নাঘরে আসবে তার পেমেন্ট টাকায় হবে না।শুধু সারাটা রাত কাটাবার পর শেষরাতে নিজের কান্নার গল্পটা লিখে যেতে হবে!এটাই পেমেন্ট!এ ঘর শুধু খোলা হবে রাত বারোটায়।থাকবে ভোর ছয়টা পর্যন্ত।
কান্নাঘরে-ঢুকেই চমকে গিয়েছিলাম প্রথমটায়।কি আশ্চর্য!এত্তো মানুষ আসে কান্না ঘরে?এ শহরে এতো মানুষ কাঁদার জায়গা খু্ঁজে পায় না।?এ শহর এতো দুঃখী মানু্ষ? নীলার কথা ভাবতে ভাবতে রাতটা পার করে দিলাম!তারমাঝেই ডাইরিটা বের করে নিলাম! ডাইরির কভারে লিখা-“দুঃখকে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে,কান্নাঘরের বিল পরিশোধ করুন!নিজের গল্পটি লিখুন!’ ডায়েরির পাতায় পাতায় গল্প।বেশিরভাগই নাম পরিচয়হীন! অরিদ্রা-নামের এক মেয়ে লিখেছে- ‘বরুণ, কাল ভোরে আত্মহত্যা করবো;আপাতত এই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই!তোমার প্রতারণার খবর শুনে এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় আর এ মুহূর্তে আমার হাতে নেই!’ জাস্ট এতোটুকুই।
চোখ থমকে গেলো হঠাৎ। কি আশ্চর্য!তার চারটা পাতা পরেই আরেকটা চিঠি। বরুণের লিখা। ‘অরিদ্রা- তোমার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি।বুকের ভেতর তো পুঁড়াচ্ছে ভীষণ!তুমি কি জানো-সেদিন তোমাকে ছেঁড়ে চলে এসেছিলাম কেনো? কারণ আমি জানতাম-আমি তিনদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছি! আজ শেষ দিন!’ পরের পেইজে ইশিকা নামের একজন লিখেছে- “জীবনে কোথাও নিজের কথা বলতে পারিনি।নিজের স্বপ্ন ছিলো বড় হবার!অথচ মুখ ফুটে কিছু বললেই সবাই হোহো করে হেসে ওঠতো!কারণ আমার জন্ম থেকেই “ঠোঁটকাটা” রোগ ছিলো!’কথা বললে বড্ড বাজে দেখাতো।
চোখে ঘুম ঘুম ভাব এসেছে।কান্নার পর নিজেকে প্রচন্ড হালকা লাগছে। শরীরটা একটু ঘাম ছেড়েছে।এবার ডাইরিটা নিয়ে লিখলাম- ‘নীলা- নিজের শব্দ আজ শেষ হয়ে গেছে বলে ধার করে লিখছি! কে যেন বলেছিলো-‘আমরা কখনোই ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি না বোধহয়,আমরা ভালোবাসার মানুষটি আমাদের ভালোবাসে-এ ব্যাপারটাকে ভালোবাসি।’ তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে?নাকি আমাকে করুণা করে ভালোবাসি বলে পাশে ছিলে?’ দূরে ফজরের আজান দিচ্ছে!রুমে আজানের শব্দ বাজছে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ!’-বলে শেষ হয়ে গেলো।আমি বের হয়ে গেলাম রুম থেকে। দরজায় লিখা-‘যদি মনে করেন,কাঁদলে নিজের ভেতর বড্ড শান্তি লাগে;নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগে-তবে আবার আসবেন!নয়তো নিজে মরুন;অন্যদের আসার এবং কাঁদার জায়গা দিন!এ শহরে আর কাঁদার জায়গা নেই।’
করিডরে হাঁটতে হাঁটতেই নীলার কথা মনে হলো।শুধুমাত্র টাকার জন্য ভুঁড়িওয়ালা মানুষটাকে বিয়ে করে নিশ্চয় সে সুখী হবে না!নিশ্চয়-সেও একদিন আসবে কান্নাঘরে! কেঁদে যাবে-চিৎকার করে!হাউমাউ করে! এসে কি নীলা ভুল করেও পড়বে আমার এ চিঠি?সঙ্গে কি তার বাচ্চাকাচ্চা থাকবে? আমি হয়তো তখন ঠিক কোনো চাকরির খবর পত্রিকা কেঁটে,যত্ন করে আবেদন পত্র তৈরি করে পরের ইন্টার ভিউটার জন্য প্রস্তুত হবো।এ শহরে চাকরী আর কই?সত্যিকারের ভালোবাসাই আর কই? একটা জীবন না হয় অবহেলায় কাঁটিয়ে দিবো।