হৃদয়হীনা

হৃদয়হীনা

আমি মেয়েটার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এত মায়াবী একটা মেয়ে এরকম কাজ করে আমি ভাবতেই পারছি না। রাত নয়টা বাজে তখন। আমি একলা একলা হাটছিলাম।একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা হোটেলের সামনে। এদিকে এর আগে কখনো আসা হয়নি। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে দেখে ডাকলো। আমি মেয়েটার সামনে যেতেই বলল…

-এত লেইট হলো ক্যান?? আমি অবাক হয়ে বললাম…
-মানে??
-টাকা কত এনেছিস? আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম….
-কিসের টাকা?
-আমার খরচ দুই হাজার। তোকে বলেনি? আমি একটু ভেবে বললাম…
-আমার কাছে এত টাকা নেই। আর টাকা আপনাকে দিবো কেন?? কিসের খরচ?
– ভাব ধরবি না। কত আছে তোর কাছে? আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম…
-সতেরশো।

-চল ভিতরে। এটা বলেই মেয়েটা আমাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। আমি কিছুটা ভীতকন্ঠে বললাম…
-এখানে কেন এসেছি?? মেয়েটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল…
-তুই কি ম্যানেজার সাহেবের লোক না??
-কে ম্যানেজার সাহেব?? আমার কথাটা শুনে মেয়েটা আমার সামনে থেকে রুমের বাইরে গিয়ে একটা লোককে নিয়ে এসে বলল…
-এইডা আফনের লোক না??
-না। মনে হয় আজ আসেনি।

আমি বুঝতে পারছি মেয়েটার কি পেশা। আমি কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। আমি ভাবতেই পারছি না মেয়েটা এসব কাজ করে। মেয়েটা আমাকে বলার সুযোগ ও দিচ্ছে না যে আমি এসব করতে চাই না। লোকটা ওকে কি যেন বলল। তারপর মেয়েটা আমাকে বলল…

-সতেরশো টাকা দে। আমি দিয়ে দিলাম। এক হাজার টাকা নিয়ে লোকটা চলে গেলো।তারপর মেয়েটা বলল…
-এর আগে কখনো এসব হয়েছে??
-না।শুনুন আমি এসব করতে আসিনি।
-তার মানে এই প্রথম এখানে?
-হুম। এটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর হাতের ব্যাগটা থেজে টাকা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল…

-তোকে আমি সতেরশো টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছি। তুই চলে যা। আমি তোর জীবনের প্রথম নারী হতে চাই না। আমি বললাম…
-কেন?
-তোর এই পাপ কাজের সূচনা আমার দ্বারা হউক আমি চাইনা।
-কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। টাকা কিছু কম আছে।
-চলে যা।প্লিজ। আমি বললাম…
-আপনার সাথে সারারাত কথা বলবো আমি। অন্য কিছু করার ইচ্ছা নেই আমার।

-শুধু কথা??
-হুম। মেয়েটা আমার পাশে বসে বলল…
-কি নাম তোর??
-রিফাত।
-সরি রে।
-কেন??
-তোকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। আসলে অন্য জনের আসার কথা ছিলো। তুই আমার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়েছিলি তাই ভাবলাম তুই সে।

-একটা কথা বলবো??
-কি??
– নাম কি আপনার?

আমার কথাটা শুনে মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঐদিন সারারাত ওর সাথে কথা হয়। সকাল বেলা আমি বাসায় চলে আসি। আমার হাতে কোনো টাকা ছিলো না। ও আমাকে আসার সময় বলল…

-আমি তোর কোনো কাজেই আসলাম না। তুই টাকাটা নিয়ে যা। আমি টাকাটা নিলাম। তারপর ও আবার ডেকে বলল…
-আবার আসবি তো তুই.?

ওর এই কথাটাতে একটা মায়া ছিলো। ফিরে চাওয়ার আকুতি মিশ্রিত ছিলো সে কথায়। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে চলে এসেছিলাম সেদিন। তারপর একদিন ওর সাথে আবার দেখা করি আমি। সেদিন বিকালটা ওর সাথেই ঘুরি।মেয়েটার মায়াবী চেহারাটা কেন জানি আমাকে খুব টানে। ইচ্ছা করে সারাদিন ওর পাশে বসে থাকি। ওর মুখটা সব সময় মলিন থাকতো। কখনো এক চিলটে হাসি দেখিনি ওর মুখে। ওর সাথে যখন বসেছিলাম তখন ও একটা গাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, মনে হচ্ছিলো গাছের পাতা গুলোর কথা ও শুনতে পারছে। কিন্তু আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ও হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল…

-আমার আসল নাম ইফা।
-তাহলে লিজা কেন বলেছিলে??
-আমার ছদ্মনাম ওটা। এটা বলেই ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
-আমার অন্তত হাতটাও ধরতে ইচ্ছা করেনা তোর??

ওর কথাটা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো মস্তিষ্ক থেমে গেছে। আমি কিছু না বলে ওর হাতটা ধরেছিলাম। ও তখন একটা হাসি দিয়েছিলো। মিষ্টি একটা মুচকি হাসি। এটাই ছিলো ওর প্রথম হাসি দেখা। যেন আমার সহস্রাধিক বছরের আশার অবসান হলো। তখন ও বলেছিলো…

-শুনবি আমি কিভাবে ইফা থেকে লিজা হয়েছি? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম। তখন ও বলা শুরু করলো….

আমার বাবা কৃষক। মা গৃহিণী তবে বাড়িতে কিছু হাস মুরগি পালন করতো। সেগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা জমিয়ে আমাকে ঢাকা শহরের নামিদামি একটা কলেজে ভর্তি করে। হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। মেয়ে মানুষ তেমন কোনো চাকরীও পাইনি। তাই অনেক কষ্টেই চলতে হতো। কলেজে আমার একটা বান্ধবী আছে। নাম সুমি। মেয়েটা খুবই মিশুক। আমার মতো একটা গ্রাম্য মেয়ের সাথে কেইবা বন্ধুত্ত করতে চায়?? সুমির সাথে আমি মানিয়ে চলতে পারতাম না। কিভাবেই বা চলবো?? ওরা সব সময় দামী দামী জামা কাপড় পরে, পার্টি করে বেড়ায় আর আমি ওদের সাথে কিভাবে যাবো?? তারপর একদিন হঠাৎ সুমি বলল…

-আমার থেকে টাকা নে। তোর সমস্যা শেষ হলে ফিরিয়ে দিস!
-কিন্তু?
-কোনো কিন্তু নেই। তোর যত লাগে নিবি।
-আচ্ছা।

তারপর থেকেই আমি ওদের সাথেই চলতাম। খরচ করতাম ইচ্ছা মতো কিন্তু বুঝতে পারিনি এই খরচ করা এক সময় আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে। ছয় মাস যাওয়ার পর হঠাৎ সুমি বলল ওর থেকে ধার করা ত্রিশ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিতে। আমি তখন বললাম আমার সমস্যা শেষ হলে দিয়ে দিবো। কিন্তু ওরা মানতে চায়নি। এমনকি আমাকে হুমকি দেয় যে আমার বাড়িতে গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। যদি আমার বাবা মা জানতে পারে আমি ত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছি তাহলে আমাকে মেরেই ফেলবে। ভয়ে আমার এক বান্ধবী তিশাকে বললাম…

-এত টাকা কিভাবে জোগাড় করি বলতো।
-তোকে একটা বুদ্ধি দিতে পারি।যদি করিস ভালই হবে।
-কি বল।
-এক জনের সাথে একটা রাত শুতে হবে। এক রাতের জন্য তোকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে দিবি আর বাকিটা তোর। শুধুই তো এক রাত।
-ছিঃ। তুই আমাকে এটা বলতে পারলি??
-এটা ছাড়া টাকা কিভাবে দিবি?? যাই হোক। তোর ভালর জন্যই বললাম!
-দরকার নেই।

এরপর থেকে ওরা আমার উপর আরো চাপ বাড়িয়ে দিলো। আমার উপর মানসিক অত্যাচার শুরু করে দিলো। আমি সারাদিন খাওয়াদাওয়া করতে পারতাম না।আসলে ওরা আমাকে খাওয়াদাওয়া করতে দিতো না। অতঃপর আমি ওদের কথা মতো একটা ছেলের সাথে রাত কাটানোর জন্য রাজি হয়ে যাই। সেই ছেলের সাথে যখন দেখা হলো সে বলল..

-তোমাকে আমার সাথে শুয়ানোর জন্য দুই লাখ টাকা দিয়েছি তোমার বান্ধবীদের।
-মানে??
-হুম। তারাই তোমাকে ট্র‍্যাপে ফেলে এখানে পাঠিয়েছে।

আমি ভাবতেই পারছি না আমাকে এভাবে ধোকা দিবে ওরা। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিবে এত সহজে। তারপর থেকে ওরা আমাকে বারবার বিভিন্নরকম ব্ল্যাকমেইল করে এই কাজে পাঠাতো। আর তারপর থেকেই আমার নাম হয়ে গেল লিজা। কথাগুলো শেষে লিজা কান্না করতে লাগলো। তারপর বলল..

-জানিস? আমার কাছে এখন অনেক টাকা।কিন্তু বাড়িতে আমার গরীব বাবা মার কাছে পাঠাতেও পারি না। কারণ তাহলে তারা জানতে চাইবে আমি টাকা কই পেলাম।

-আপনাকে আমি একটা কথা বলবো??
-বল।
-আমি বিয়ে করতে চাই আপনাকে। কথাটা শুনে ও অবাক হলো না। বরং আমার কথাটা ঘুরিয়ে বলল…
-তোর কাঁধে মাথা রাখি??
-হুম রাখুন।
-আর শোন। তুই আমাকে তুমি করেই বলিস।

ইফাকে আমি অনেক বার বলেছি সব কিছু ছেড়ে চলে আসতে কিন্তু ও এড়িয়ে যেত কথাটা। ওর প্রতি আস্তে আস্তে এক প্রকার টান তৈরী হলো। আমি ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না। ওকে না দেখলেও ভাল লাগে না। আজ অনেক দিন পর ইফার সাথে আমার দেখা হবে। আমি লেইকে গিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতেছি। অনেকক্ষণ পর ওর দেখা পেলাম। দূর থেকে মেয়েটা আমাকে দেখেই হাসছে। এই হাসিটা মেয়েটার মুখে সব সময় ফুটে থাকলে কতই না সুন্দর লাগতো।

-মানুষ কখন আত্মহত্যা করতে চায় জানিস?? আমি ইফার কথাটার উত্তর চুপ থেকে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললাম জানি না। ও আমার হাতটা শক্ত করে চেপে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে বলল…

-যখন সে কষ্ট সহ্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
-কিন্তু আত্মহত্যা কোনো কিছুরই সমাধান হতে পারে না। তুমি এসব করার চেষ্টাও করবা না কখনো। ও হেসে বলল..
-আমার তো কোনো কষ্ট নেই। আমার শরীরে হৃদয় নেই। মানুষের হৃদয় না থাকলে কি কষ্ট পায়??
-আমি খুব শীঘ্রই একটা চাকরী নিবো। তারপর তোমাকে আমার বউ করে নিবো।
-কিন্তু সমাজ??

-দরকার কি সেই সমাজের?? যে সমাজ আজ তোমার মতো নিষ্পাপ মেয়েকে এই কাজ করাতে বাধ্য করেছে?? সমাজের মানুষরুপী শয়তান গুলো কেন তখন তোমার জীবনটা এলোমেলো করে দিলো?? তখন ওদের বিবেক ছিল কই??
-মানুষগুলো এরকমি।

ইফার সাথে সেটাই আমার শেষ দেখা। আর কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে আমার।প্রতি সপ্তাহে আমি ওর সাথে দেখা করতাম। কিন্তু ওই দিনের পর হঠাৎ ইফার কোনো খোঁজখবর পেলাম না। শুনেছি ওকে নাকি খুন করা হয়েছে। ওর বাথরুমে ওর লাশ পাওয়া গেছে। আমি লাশটাও দেখতে পারিনি। শুনেছি ওর বাড়িতে লাশ পাঠানো হয়েছে। ওর বান্ধবীদের আমি কল দিয়েছিলাম। তখন বলল…

-ইফা আত্মহত্যা করেছে। আপনি আর আমাদের কল দিবেন না।

আমি তারপর ও অনেকবার বলেছি “ইফা আত্মহত্যা করেনি। ওকে খুন করা হয়েছে।আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি ও আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না। ও আত্মহত্যা করতে চাইলে অনেক আগেই করতে পারতো।” কিন্তু কে শুনে কার কথা। ইফার লাশ পাওয়া গেলেও মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হলো না। হবেই বা কি করে সমাজের মানুষগুলো লোভের মোহে ভুলে গেছে তারা মানুষ, তাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব বলতে কিছু একটা থাকা দরকার। মনুষ্যত্ব আজ সমাজ থেকে অনেক দূরে। ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি না জানি না। সব কিছুর নিচে ধামাচাপা পরে গেল ইফার মৃত্যুর রহস্য। ইফার মতো আরো অনেকের মৃত্যুর আসল রহস্য বের হবে না। ভুলে যাবো আমরা তাদের। আর অসৎ মানুষগুলো তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাবে নিমিত্তে!!

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত