ভোরের আলো ফুটতে শুরু হয়েছে। বনের পাখিরাও প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে অবিরাম কিচিরমিচির করেই যাচ্ছে। মুয়াজ্জিন সাহেব আজানের ধ্বনি তুলতেই এক নবাগত কন্যা কান্নার তীব্র ধ্বনিতে জানান দিলো সে এসে গেছে এই পৃথিবীর বুকে। তাকে জায়গা করে দিতেই বুঝি মা তখনি পৃথিবী ত্যাগ করে। কি হতো মা বেঁচে থাকলে? পৃথিবীর মধ্যে জায়গা কি খুব কম হতো? তা হলে ও নাহয় মায়ের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতো। আচ্ছা মা এর বুকে শুলে খুব শান্তি লাগে তাই না? ঠিক কতোটুকু শান্তি? জানা নেই দিয়ার।
দিয়া হওয়ার সময় ই দিয়ার মা মারা যায়। দুধের বাচ্চাকে বাবা কি করে পালবে? তার জন্য আগমন ঘটে নতুন মার। সহজ বাংলায় সৎ মার। যারা ইতিহাস করে গেছে অধিকাংশ সৎ মা ই সৎ সন্তানকে পুরোপুরি মাতৃস্নেহ দিতে পারেন না। তবে কিছুটা তো দেওয়াই যায়? তাতে তো কারোর আপত্তি থাকার কথা না। প্রাকৃতিকভাবে আপত্তি চলে আসে। কারোর কাছে তীব্র আপত্তিকর। যখন নিজের সন্তান চলে আসে তখনি আমার তার (সতীনের) ব্যাপার টা চলে আসে। এই জন্যই বোধহয় মাত্র পাঁচ বছরেই দিয়া বুঝে গিয়েছিলো সৎ মা মানে সৎ মা ই সে কখনো মা হয়ে উঠে না।
দিয়ার সৎ মা নীলুফা বেগম। লোকমুখে নীলু ই প্রচলিত। তার প্রথম সন্তান আসে দিয়ার যখন পাঁচ বছর চলে ঠিক তখন ই। আর তখন থেকেই বের হয়ে আসে আসল রূপ। পাঁচ বছরের শিশুটিকে দিয়ে ঘরের থালাবাসন ধোয়ানো থেকে ঘর পছন্দ মুছিয়ে ছাড়ে। কিছু মহিলা যেনো কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি দিয়ে নিজের বরকে হাতের মুঠোতে রাখে। যে উঠতে বললে উঠে আর বসতে বললে বসে। দিয়ার বাবা ও নীলু বেগমকে প্রচন্ড মাত্রায় ভয় পেতেন। ভয় পাওয়া টা ও স্বাভাবিক। যদি কোনো বাবা শুনে সে বাড়ি না থাকা অবস্থায় তার মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে তাহলে সে তো কথা শুনতে বাধ্যই। ভাগ্যের এমনি নির্মম পরিহাস দিয়ার বাবাকে দিয়াকে কোনো আত্মীয়ের বাসায় ও রাখতে পারবে না।
দিয়ার দাদাবাড়ি প্রেম এর তীব্রবিরোধী। তাইতো ওর বাবা-মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলো। যার ফলশ্রুতিতে এই বিশাল পৃথিবীতে তাঁদের আপন বলতে কেউ নেই। স্ত্রী কে ভয় পেলেও খুব কঠোরভাবেই বলেছিলো আর যাই করুক দিয়াকে পড়াশোনা করতে দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে উনি মেনেও নিয়েছিলেন। দিয়ার তখন দশ বছর চলছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে আর ছোটবোন রিয়ার পাঁচ বছর চলে। সবে আদর্শলিপি পড়তে শুরু করেছে। তার জন্য বাসায় দুটো টিচার রাখা অথচ দিয়ার জন্য কোনো টিচার নেই। তার মা এর সাফ কথা “স্কুলে পড়াচ্ছি ঐ ঢেড়। এতো আজাইরা খরচের টাকা নেই” গাইডলাইন ছাড়া পড়াশোনা করা সম্ভব না। তাই দিয়া পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না থাকলেও খুব খারাপ ও আবার ছিলো না।
এর মাঝে ছোট একটা ভাই ও হয়েছে নাম রায়ান। দিয়া, রিয়া, রায়ান যতই বড় হচ্ছিলো ততোই দিয়ার দুঃখ শুধু বেড়েই যাচ্ছিলো। রিয়া তো কখনো দিয়াকে আপু বলে ডাকেই নি। সবসময় তুই করেই বলে। জুতো কখনো নিজে পড়েও নি আর খোলার তো প্রশ্ন ই আসে না। কোনো একটা খাবার ভালো না লাগলে দিয়ার উপর ছুড়ে ফেলতো। বাবা এইসব চুপচাপ দেখতে তার কিছুই করার ছিলো না। কারণ এর মাঝেই এক্সিডেন্ট করে হুইল চেয়ারে অবস্থান নিতে হয়েছে। রায়ানের চোখের মণি ছিলো দিয়া। কিন্তু ঘরের সবচেয়ে ছোট সদস্য বলে কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না। মাঝেমাঝে কিছু বললেও মা আর রিয়া বকা দিতো।
মানুষের এক জীবন দুঃখের হলে নাকি আরেকজীবন সুখের হয়? কিন্তু আল্লাহ্ বোধহয় কিছু মানুষের জীবনে সুখ এর ছিটেফোঁটাও লিখে রাখে না। তাইতো এসএসসি পরীক্ষা দিতে না দিতে এক মাতালের সাথে বিয়ে দিয়ে ঘরের আপদ দূর করে দিয়েছে। সেখানেও সুখের মুখ দেখার সুযোগ হয় নি। প্রতিদিন ই স্বামী এসে মারধোর করতো। শ্বাশুড়ি ও উঠতে বসতে কথা শুনাতো। আর দেবর তো সুযোগ পেলেই কৌশলে গায়ে যেখানে সেখানে হাত দিতো। এ কথা স্বামীকে বললে কখনোই বিশ্বাস করতো না উল্টো আরো মারধর করতো। এভাবেই চলছিলো দিনগুলো। দিয়া শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনছিলো। এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার আদৌ কোনো মানে হয়? একদিন ওর ফুপাতো ননদ মারিয়া বেড়াতে আসে। মারিয়ার সামনে তারা খুব ভালো ব্যবহার করতো। দিয়া তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না।
কিন্তু শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়? দিয়ার গায়ে যে পরিমাণ অত্যাচার এর দাগ আছে তা কি আর অভিনয় দিয়ে মুছে ফেলা যাবে? মারিয়া দাগ দেখেই বুঝে গিয়েছিলো কিন্তু দিয়া স্বামীর কথা ভেবে অস্বীকার করে। বলে ওর উপর কোনো অত্যাচার করা হয় না। মারিয়ার জোর করা আর যখন বলে আমি ল এর স্টুডেন্ট আমি এইসব খুব ভালো করেই বুঝি তখন দিয়া চুপ করে শুধু নিচে তাকিয়ে থাকে। মারিয়া ওদের নামে কেইস করতে বলে আর তখন দিয়া বলে “যতই হোক উনি আমার স্বামী। উনার পায়ের নিচে আমার জান্নাত। আমি উনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবো না” মারিয়া তাচ্ছিল্যের সাথে বলে “স্বামী! এই স্বামীর পায়ের নিচে জান্নাত না জাহান্নাম আছে। জানোয়ারের বাচ্চা। লজ্জা হচ্ছে এর বোন বলে আমি। ছিঃ” দিয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে “উনি যেমন ই হোক। বিয়ে যখন হইছে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত উনার কল্যাণ কামনা করে যাবো” মারিয়া আর কিছু বলে না শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সাইফ বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে সব শুনছিলো। আজ নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। ওর মতো একটা ছেলের জীবনে কেনো দিয়ার মতো একটা ভালো মেয়ে আসলো? এমন এমন একটা মেয়ের সাথে কি করে এতোদিন এতোটা খারাপ ব্যবহার করলো? নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। দুপুরে সবাই খাচ্ছিলো। তরকারিতে লবণ সামান্য বেশি হয়ে গেছে। তাই দেবর উঠে থাপ্পড় দিতে গেলে সাইফ ধমক দিয়ে বলে “সোহান, সে ভাবী হয়। সম্মান করতে শিখো” সোহান যত টা না লজ্জা পায় তার চেয়ে বেশি রাগে গজগজ করতে থাকে। খাবার টেবিলে সবাই একরাশ বিস্ময় নিয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাইফুল তখন ই উঠে যায়। নিজেও বুঝতে পারছে না কি করে এই কথা বললো?
দিয়া প্রতিদিন ই কান্না করে আজ ও করছে। অন্যদিন নিরবে কান্না করলেও আজ শব্দ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাইফ বুঝতে পারছে না আজ কেন দিয়া এতো কাঁদছে? আজ তো কেউ কিছু বলে নি। সুখের কান্না সাইফ চিনতে পারে নি। অনেকক্ষণ ভাবছে ওর কাছে যাবে কি যাবে না? ভাবতে ভাবতেই ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখেই জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?” দিয়া কিছু না বলে জড়িয়ে ধরে আরো কান্না করতে থাকে। দিয়া জড়িয়ে ধরতেই সাইফের ভিতর কিছু একটা ফিল হয় কিন্তু সাইফ বুঝে না। দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দিয়া মাথা তুলে বলে “আঠারো বছরে আজকের মতো আনন্দ কোনো দিন ও হয় নি। সুখ বুঝি এমন ই হয়?” সাইফ কিছু না বলে শুধু অবাক দৃষ্টিতে দিয়াকে দেখে। চোখের নিচে কালি পড়ে, স্বাস্থ্য শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিয়ে নেয় আজ থেকে আর দিয়াকে কোনো কষ্ট পেতে দিবে না।
এরপর থেকে দিয়ার সাথে কেউ আর খারাপ ব্যবহার করে নি। মা আর দেবর মন থেকে মানতে পারছে না কিন্তু সাইফের কথা সবাই শুনে চলতে বাধ্য। দিয়ার স্বাস্থ্য এর অবস্থা ও উন্নত হয়েছে আর চেহারা ও। এখন দিয়াকে দেখলে চোখ ফিরতে চায় না। সাইফ যতক্ষণ বাসায় থাকে আড়চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে। মাঝরাতে উঠে ঘুমন্ত মুখ টা দেখে। আলতো করে মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। একরাতে চুল সরাতে গেলে দিয়া জেগে যায়। সাইফ ইতস্তত করে সরে যায়। একটু পর আবার দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে “তোমায় একটু স্পর্শ করতে পারি?”
দিয়া কিছু না বলে সাইফের বুকে মাথা রাখে। সেদিন রাতেই দিয়াকে সাইফ একদম আপন করে নেয়। বিয়ের দেড় বছর পর ঐ রাত ই ছিলো ওদের প্রথম সোহাগ রাত।
দিয়ার সুখের দিনগুলো সব আকাশে উড়ছিলো। তিনমাসের মাথায় দিয়া বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ডাক্তার এসে বলে নতুন অতিথি আসছে। এই খবর শুনে আস্তে আস্তে দেবর আর মা ও মন থেকেই দিয়াকে ভালোবাসতে শুরু করে। মেয়ে নাকি ছেলে? কি নাম হবে? এই নিয়েই সারা বাড়ি মাতামাতি। দিয়ার প্রচুর পরিমাণে পেটে ব্যথা করছে। সহ্য করতে পারছে না। শ্বাশুড়ি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো “প্রসব বেদনা একটু সহ্য করতেই হয়। একবার পুচকু টা এসে যাক দেখবা জান্নাতি সুখ পাবা” সোহান কল দিয়ে জানাতেই সাইফ সোজা বাবার কবর জিয়ারত করে দোয়া চাইতে যায়। তারপর সেখান থেকে ফেরার সময় একটা পায়েল, জিরো সাইজের এক জোড়া জুতো আর একশো একশো টা লাল গোলাপ কিনে নেয়।
সাইফ ট্যাক্সিতে বসে ভাবছে কখন রাস্তা টা শেষ হবে? এতো বড় কেন রাস্তা টা? চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যত দেখছে তার পুচকু টা পিঠে চড়ে ঘোড়া চড়া খেলছে আর দিয়া রাগ চোখ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠে। চোখ খুলতেই দেখে সামনে একটা ট্রাক সঝোরে আসছে তারপর আর কিছু মনে নেই। কিছু সেকেন্ড এর জন্য দেখেছিলো একটা শীতাতপ রুমে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না অপারেশন থিয়েটার যে এটা।
এক্সিডেন্ট কাছাকাছি হওয়ায় দিয়া যেই হাসপাতালে সাইফকেও ঐ হাসপাতালেই নেওয়া হয়েছিলো। সাইফের পরিবার দুটো অটির দিকে তাকিয়ে আছে। একটা থেকে যেখানে সুখের সংবাদ আসবে অন্যটাতে তেমনি দুঃখের কালো ছায়া বিরাজ করছে। কি হতে চলছে কোনো ধারণা নেই।
এক সময় দুটো অটির আলোই নিভে গেলো। সাইফের সারা শরীর সাদা চাদরে ঢেকে বের করা হলো। সোহানচুপচাপ দেখলো। বাবার মতো ভাই আর নেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মা তো কেঁদেই একাকার। সোহান সান্ত্বনা দিয়ে বললো “ভাবীর কাছে চলো। নতুন অতিথি এসেছে তো” দিয়ার অটির কাছে যেতেই ডাক্তার বললো “স্যরি, বাচ্চাটা মৃত ছিলো” দিয়া উঠে পাগলের মতো নিজের সন্তানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ডাক্তার যখন বললো মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে তখন দিয়া একটাই কথা বলেছিলো “সাইফকে কি জবাব দিবে? কত স্বপ্ন বুনেছিলো। বাচ্চার সাথে এই করবে সেই করবে।” সোহান নিচু গলায় বলেছিলো “ভাইয়া আর নেই। এই হাসপাতালের অটিতেই চিরবিদায় নিয়েছে” দিয়া দৌড়ে বের হয়ে যায়। সাইফের লাশ জড়িয়ে ধরে কান্না করে। হাসপাতালের সবাইকে ধরে ধরে বলে “একটু আল্লাহ্ কে বলেন না, আমার সাইফকে ফিরিয়ে দিতে”কিন্তু কেউ কথা শুনে নি। ডাক্তার এসে পায়েল আর জুতাগুলো হাতে দেয়। দিয়া মৃত বাচ্চাটাকেই জুতাগুলো পড়িয়ে দেয়।
দিয়াকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ওর শ্বাশুড়ি অনেক চেষ্টা করে কিন্তু দিয়া রাজি হয় না। কতই বা বয়স হয়েছিলো? এইতো বিশ ই তো। আর কিছুদিন পর একুশ হতো। এমন সময় ই তো মেয়েদের বিয়ে হয় আর দিয়া স্বামীকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কান্না নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যায়। একসময় আর কান্না আসে না। চোখের প্রতিটি অশ্রুকনা ও শুকিয়ে যায়।
এতিমখানায় এক সাদা শাড়ি পরিহিতা বসে আছে। সারা অঙ্গে কোনো সাজ নেই। একদম ট্রিপিক্যাল বিধবা মহিলা। শুধু পায়ে একটা পায়েল পড়া। পিছন থেকে এক পিচ্চি এসে জড়িয়ে ধরে বলে “দিয়ামা” দিয়া মুচকি হেসে ওকে কোলে নিয়ে চুমু দেয়। ওর পুচকু নেই তো কি হয়েছে? এতোগুলো পুচকু আছে ওর এখন। শুধু সাইফ ই কোথাও নেই। ওর অভাব কখনো পূরণ হবে না। যে শিখিয়েছিল সুখ কি? আজ তো ও অনেক সুখি শুধু সুখ ভাগ করতে পারছে নাহ। আর এতো সুখ ও সহ্য হয় না। তবুও জীবন চলে জীবনের মতোই। চলছে তো জীবনের ত্রিশতম বছর।
(সমাপ্ত)