দূর্ঘটনা

দূর্ঘটনা

আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আসার সময় একটা চিঠিও লিখে এসেছি। যেনো তারা অযথা আমাকে না খুঁজে। বাসায় আমার এই প্রেম কেউ মেনে নেয়নী তাই আমার এই পলায়ন। আমি যাকে ভালবাসি তাকে ছাড়া আমি আর বাঁচতে পারছিলাম না। তাই চলেই এলাম ওর কাছে চিরদিনের জন্য। বলাই যায় এটা একটা আবেগে ভরপুর প্রেম।

প্রেমিকের সাথে ঢাকার বাসে উঠে ঢাকা চলে আসলাম। ঢাকা পৌছানোর পরে আমাকে এক যায়গায় দাড় করিয়ে রেখে সে ফোনে কথা বলতে বলতে একটু আড়ালে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ওকে আর দেখতেই পেলাম না। ভেবে ছিলাম কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসবে কিন্তু দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও সে ফিরে এলো না। পরে খেয়াল করলাম আমার ব্যাগটা ওর হাতে ছিল। যার মধ্যে আমার সেলফোন, টাকা, কিছু গহণা এবং টুকিটাকি কিছু জিনিস পত্র ছিল। সন্ধ্যে হয়ে এলো অচেনা শহরে খুব ভয় লাগছিল।

কারো থেকে ফোন চেয়ে যে বাসায় ফোন করবো তাতেও সমস্যা। প্রথমত বাসায় ফেরার মুখ নেই, দ্বিতীয়ত এই ব্যস্ত শহরের মানুষ গুলো কেউ আমাকে নিজের ফোনে কথা বলতে দেবে না। হঠাৎ কয়েকটা বখাটে ছেলে আমার পিছু নিলো। আমি খুব দ্রুত হাটতে হাটতে এক সময় দৌড় দিলাম। পেছনে দেখে দেখে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ অনুভব করলাম কিছু একটার সাথে আমি প্রবল জোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছি। আমার নিজেকে খুব পাতলা অনুভব হচ্ছে। সারা পৃথিবীটা ঘুরছে আর আমি যেনো হাওয়ায় ভাসছি। আমার শরীরের কোথায় আঘাত লেগেছে সেটা খুব চেষ্টা করেও অনুভব করতে পারলাম না। এর পর ঘুমে দুটি চোখ বুজে এলো তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই।

আমি হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। চোখ মেলে দেখলাম আমি একটা ক্যাবিনে আছি। দেখে মনে হলো বেশ নামী দামী কোনো নার্সিংহোম হবে। কিন্তু কে এখানে আমাকে নিয়ে এসেছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আরেকটা প্রশ্ন হলো আমার কি হয়ে ছিল? একটা জোরে ধাক্কা খেয়ে ছিলাম এই টুকুই মনে আছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম ব্যান্ডেজ করা। রুমে একটা নার্স এলো তাকে কিছু বলার আগেই সে ডাক্তার কে ডাকলো আমার জ্ঞান ফিরেছে বলে।

পরে শুনলাম আমি একটা প্রাইভেট কার্ এর সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিলাম আর দু দিন পর আমার জ্ঞান ফিরেছে। ঐ কার্ এর মালিক আমাকে এখানে ভর্তি করেছে। এবং সে রোজ দু বার এসে দেখে যায় আমাকে। আমার নাকি মাথায় খুব বড় আঘাত লেগেছে। এতে আমার ম্যামোরী লস হবার সম্ভাবনা আছে। মনে মনে ভাবলাম ম্যামোরী লস হলেই ভালো হতো তাহলে কয়েক দিন আগে আমার সাথে যা কিছু হয়েছে ওসব ভেবে ঘেন্না অন্তত লাগতো না। ডাক্তার আমার নাম জিজ্ঞেস করলো আমি বললাম মনে নেই। সবাই ধরে নিয়েছে যে আমার ম্যামোরী লস হয়ে গেছে। আমার এটা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ঐ কার্ ওয়ালা বাধ্য হয়েই আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো।

বাড়িটা বেশ বড়, আমি সেখানে পৌঁছানোর পর ঐ বাড়ির সবাই আমার সামনে এসে দাড়িয়ে এমন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো যে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। আমার এই অবাঞ্চিত প্রবেশটাকে ওদের চেয়ে আমাকেই বেশী বিভ্রান্ত করে করলো। কিন্তু আমি কোথায় যাবো? তাই এত লজ্জা নিয়েও কিছু দিনের জন্য আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

দু দিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম এ বাসার মানুষ গুলো খুব ভালো। অবশ্য পৃথিবীর কোনো মানুষকেই আমার খারাপ লাগে না। এজন্যই তো এত বড় একটা ধোঁকা খেয়েছি। যাই হোক এ বাসার সদস্য সংখ্যা ছয় জন। কার্ এর মালিক পুরুষটির নাম হলো আসফাক মাহমুদ। এখানে থাকে উনার মা এবং উনার ভাই ভাবী আর ভাইয়ের দুই ছেলে। আসফাক সাহেবের মা বললেন যেনো তাকে আমি মামণি বলে ডাকি। আমার অবশ্য ডাকতে আপত্তি ছিল না। যেহেতু আমার অতীত স্মৃতি মনে নেই তাই মামণি আমাকে একটা নাম উপহার দিলেন। নামটা বেশ সুন্দর “আনন্দিতা”। তাই আমার আসল নামটা এখানে না প্রকাশ করি।

এক মাসের মধ্যেই আমি এ বাড়ির একজন হয়ে গেলাম। আমি একটু চঞ্চলা প্রকৃতির তাই সবাইকে আপন করতে আমার যেমন সময় লাগে না তেমনি সবার আপন জন হতেও আমার সময় লাগে না। আমি সারা বাড়ি দৌড় ঝাপ করে সব কিছু নিজের করে নিলাম। শুধু মাত্র আসফাকের একটা বান্ধবী মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে। ওকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। মেয়েটা বেশ সুন্দর তবে আমার চেয়ে বেশী নয়। আসফাকের পাশে ওকে একদম মানায় না। ঢংগী মেয়ে একটা, কোমর দুলিয়ে হাটে। ইচ্ছে করে একটা বললাম না থাক।

ডাক্তার আমাকে এক গাদা ওষুধ দিয়েছে, খেলেই শুধু ঘুম পায় তাছাড়াও আমি তো আসলেই স্মৃতি হারাইনী তাই ওষুধ গুলো খাই না। মামণি রোজ বলে সময় মত ঠিকঠাক ওষুধ খেতে। ধ্যাত্তেরী! সব কথা শুনি মামণির শুধু ঐ ওষুধ খাওয়া ছাড়া। কি করে বলবো যে আমার ম্যামোরী লস টস হয়নী!

এই বাড়ির মানুষ গুলো আমাকে একটু ভয় ভয় করে সেটা আমি বুঝতে পারি কিন্তু কেনো ভয় করে সেটা বুঝি না। আর ঐ আসফাক মানে কার্ ওয়ালা কেমন অদ্ভুত মানুষ, বাড়িতে এত্তো সুন্দরী একটা মেয়ে আছে অথচ একবারও সে তাকায় না। কেনো তাকাবে না? তাকাতেই হবে, তাই আমি ওর সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করি। ওকে জ্বালাতে বেশ লাগে।

দেড়মাস হয়ে গেছে হঠাৎ একদিন মাঝ বয়োসী দম্পত্তি এলো এ বাড়িতে। আমাকে তাদের সামনে ডাকা হলো। আমি সেখানে দাড়াতেই উনারা আমাকে দেখেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি বুঝলাম না যে তারা কেনো কাঁদছেন। তবে কিছুক্ষণ পর সব কিছুই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো। আসফাক আমার ছবি পত্রিকাতে দিয়ে ছিল। আর এরা সেই খবর পড়ে আমার বাবা মা সেজে আমাকে নিতে এসেছে। এমনকি তারা অনেক গুলো ছবি নিয়ে এসেছে। দেখলাম ছবির মেয়েটা অবিকল আমার মতই দেখতে।

এর আগে আমি নয় বার শুনেছি, কেউ বলেছে তুমি আমার বোনের মত দেখতে, কেউ বলেছে খালার মত দেখতে, কেউ বলেছে সদ্যবিবাহিত চাচীর মত দেখতে, কেউ বলেছে ভাইজীর মত দেখতে। কি common চেহারা আমার! কিন্তু এই ভাবে ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কেউ আসেনী। যাই হোক উনাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে সে আবার দেখতে অবিকল আমার মতই তাই আমি উনাদের ইমোশনটা বুঝতে পারছি। আমি উনাদের সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি তাদের মেয়ে নই। যেহেতু সবাই জানে যে আমার স্মৃতি হারিয়ে গেছে তাই সবাই একত্রে আমাকে জাতীয় সঙ্গীতের মত বুঝাতে শুরু করলো যে আমি ওদেরই মেয়ে।

উনাদের ভাষ্যমতে আমি ভার্সিটিতে পড়তাম, আমার একটা রোড এক্সিডেন্ট হয়ে ছিল। অবশ্য সেটা আসফাকের গাড়ীর সাথেই। আমি কারো সাথে পালিয়ে যাইনী। তাদের টাকা ও গহণার কোনো ক্ষয়ক্ষতিও হয়নী। আর আমার নাম নাকি লিথিল। এসব শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না তাই বলেই দিলাম যে আমার স্মৃতি হারিয়ে যায়নী, আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। আমি বাড়ি থেকে কেনো পালিয়েছি কার জন্য পালিয়েছি সব ঘটনা উপস্থাপন করলাম। এরপর আমাদের বাড়ির ফোন নাম্বার আসফাককে দিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো। তখন আমি নিজেও টেনশনে পড়ে গেলাম। বাবার নাম্বারে ফোন ঢুকলো আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম-“বাবাই আমি লুবা”
কিন্তু ওপাশ থেকে বললো-“আমি তো এখনো বিয়েই করিনী!”

আমি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তবুও আমি ঐ বাড়ি থেকে কোথাও গেলাম না। মনে হচ্ছিল আসফাককে ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে থাকতে পারবো না। ওকে আমি ভালবাসি কি না জানি না, তবে আমার এই বিভ্রান্তির মাঝে আসফাকই আমার একমাত্র ঠিকানা। আমি যেনো কেমন হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কি যেনো হারিয়ে ফেলেছি, এরপর যদি আসফাককেও হারাই তবে আমি বাঁচবো কি করে? দু দিন ধরে এসব ভাবনায় মাথা অগোছালো হয়ে গেছিল।

সেদিন বিকেলে আসফাকের সেই বান্ধবীটা এলো, ওর নাম ইরা। ওকে আসফাকের ঘরে দেখে আমার এত্তো রাগ হলো যে আমি ফলের ঝুরি থেকে ছুরি নিয়ে গেলাম ইরাকে খুন করতে। সবাই আমাকে ধরে ফেললো। খুন করা হলো না ইরাকে। তারপর ধস্তাধস্তিতে হঠাৎ আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি চুপি চুপি যা কিছু শুনলাম তাতে আমার পৃথিবী উল্টে গেলো। ডাক্তার বলছিল আমার নাকি ম্যামোরী লস হয়েছে তার সাথে এমন একটা রোগ হয়েছে যে, আমি মন গড়া কাহিণী নিজের সাথে জুড়ে দিয়েছি। বাবার নাম্বারে ফোন করা, নিজের বাড়ির ভুল ঠিকানা দেয়া এমনকি নিজের ভুল নাম বিশ্বাস করা সব কিছুই নাকি আমার মানুষিক রোগের কারণে।

এই দু দিনে আরো অনেক কিছুই ঘটে গেছিল যা আমার অজানা ছিল। আমার বাড়ির ঠিকানাতে জেলার নামটা ঠিক থাকলেও গ্রামটা খুঁজে পাওয়া যায়নী। ভার্সিটির একটা মেয়ে আমার বান্ধবীসহ রুমমেট বলে দাবী করেছে এবং সে ঐ মাঝ বয়সী দম্পত্তিকে আমার বাবা মা হিসেবে সনাক্ত করেছে। সব মিলে প্রমাণ হয়ে গেছে যে আমার ম্যামোরী লস হয়েছে এবং মাথায় আঘাতের কারণে এমন একটা মানুষিক রোগ সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাবে আমি অন্য মানুষকে বাবা মা হিসেবে কল্পনা করছি, আদৌ এমন কেউ নেই।

এরপর আমাকে মেন্টালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি চার বছর ধরে এই মেন্টাল হাসপাতালে আছি। আর চার বছর ধরে এদের বোঝাচ্ছি যে আমার ম্যামরী লস হয়নী কিন্তু কেউ তা বুঝতেই চাইছে না। কিন্তু বাবার নাম্বারে ফোন দিলে আগে একজন রিসিভ করে বলতো রং নম্বর, এখন আর কেউ রিসিভ করে না। এই চার বছরে আসফাক এক বার দেখা করতে এসে ছিল। আমি খুব কেঁদে ছিলাম। ওকে বলে ছিলাম-“আমি তোমাকে না দেখে এখানে কি করে থাকবো? তোমাকে সকাল বিকেল দেখার অভ্যেস যে হয়ে গেছে আমার!” সে আমার কথা শুনে করুণ দৃষ্টিতে নির্বাক চেয়ে থেকে চলে গেলো। আমি অশ্রু শিক্ত চোখে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। এরপর আর কখনো সে এখানে আসেনী।

আমি পালিয়ে গেছিলাম বলে বাবা মনে হয় খুব রাগ করেছে তাই আমার সাথে কথা বলে না। কিন্তু ঐ মাঝ বয়সী দম্পত্তি প্রায় আমাকে দেখতে এসে খুব কাঁদেন। আমি উনাদেরও বোঝাতে পারি না যে আমি ওদের মেয়ে নই। ওরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না কেনো? আমার নিজের বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বাবা আমি তোমাকে খুব miss করছি। এই কারাগারে পাগলদের সাথে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। বাবা তুমি কবে আসবে আমাকে নিতে?

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত