বেশ্যা জীবন

বেশ্যা জীবন

মেয়েটাকে এক রাতের জন্য ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলাম। বাড়িতে সপ্তাহ খানেক কেউ থাকবেনা। বাবা মা বেড়াতে গিয়েছিলেন। ছোটবোনটা মহিলা কলেজেই থাকে। বাড়ি একদম ফাকা। কেন এনেছিলাম জানেন?

আমি একটা প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ক্রমশ ড্রাগ এ্যাডাক্টেড হচ্ছিলাম। কারো ধার ধারতামনা। লেখাপড়া বন্ধ করে সারাদিন নেশায়
পরেছিলাম। বাবা মা কেঁদেকেঁদে বারবার ফিরে আসার জন্য বলত। ছোটবোনটা প্রায়ই ফোন দিয়ে কাঁদে,বলে ভাইয়া ফিরে আয় তুই। কিন্তু আমার ফেরার কোন রাস্তাই ছিলনা,কষ্টে বাঁচার কোন ইচ্ছেই ছিলনা মনের মাঝে।

সে রাতে হিরোইন কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ মেয়েটা এসে বলেছিলো, ভাইয়া পছন্দ হয় আমায়?
বলেছিলাম,দুরে থাক আমার থেকে,আমি ওরকম না। মেয়েটা আরো কাছে এসে বলে,প্লিজ ভাইয়া,দেখুননা আমার দিকে,কোন
কমতি নেই আমার মাঝে। খেকিয়ে বলেছিলাম,তোকে বলছিনা চলেযেতে। মেয়েটা বোধহয় একটু ভয় পেয়েছিল।
ভয়েভয়ে বলেছিলো,টাকার খুব দরকার ছিলো,যা দিবেন তাই দিয়েই,,,,

ভাবতে লাগলাম আমি। কাছে যা টাকাছিলো তাদিয়ে আরো ছ দিন চলতে হবে। কোনভাবেই নষ্টকরা যাবেনা,কারণ নেশাখোরদের কেউ টাকা ধার দেয়না। বাড়িতে বাবা মা-ও নেই। ভাবছিলাম,মনে মনে কয়েক সেকেন্ড একটা হিসেব করছিলাম।
হঠাৎ আমার ভাবনায় ছেদ করে মেয়েটা আবার বলেছিলো,আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই যাব। বললাম,আমার বাড়িতে যাবি?
মেয়েটা মাথা নাড়ে। বেশি কিন্তু দিবোনা,তুই রাজি তো? মেয়েটা আমার পিছনে আমায় অনুসরণ করে চলতে থাকে,,,,

কিভাবে কি করব কিছুতেই বুঝতে পারছিলামনা সেদিন। ভাবলাম নেশাটা আগে সেরেনেই।
মোম জ্বালিয়ে নিয়ে সবেমাত্র একটা টান দিয়েছিলাম। মেয়েটা বলেছিলো, ভাইয়া আমার সামনে এগুলো খাবেননা। আমার মাথা ঘোরে,বমি আসে। কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম সে রাতে।

ভাবছিলাম মেয়েটার জীবনে কি আমিই প্রথম নেশাখোর? নাকি ওর বিছানায় শোয় প্রত্যেকেই ভালো ছিলো?
বলেছিলাম,কেন হিরোইনের ধোয়ায় তোর বুঝি কষ্ট হয়?
ও উত্তরে বলেছিলো,হুম, খুব খারাপ লাগে,বিড়ি, সিগারেটের ধোয়াও সহ্য হয়না আমার।
ফেলে দিয়েছিলাম হিরোইন সেরাতে।
মেয়েটাকে প্রশ্ন করেছিলাম,তুই কি এই লাইনে নতুন?
মাথা নেড়েছিলো ও।
বললাম তবে কেন এসেছিস এই নোংরা জগতে?
এই জগতটা তো ভালোনয়।
ও মাথা তুলে আমার মুখপানে কিছুক্ষন চেয়েছিলো।ওর চোখমুখে ছিলো বিস্ময়ের আবছায়া। হয়ত ও অবাক হয়েছিলো এইভেবে
যে,এমন প্রশ্ন তো কেউ কোনদিন করেনা,এতগল্পের সময় তো কারোকাছে থাকেনা।
ও বিছানা থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে আমি বলেছিলাম,পুরো দুহাজার দিবো রাতটা থাকবি আমার সাথে? থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা।
ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে বলে আগে টাকাটা দিন।টাকা বাহির করে দিলাম। তিনদিনের নেশার টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম ওর হাতে।
ও হেসে বলেছিলো,ভাইয়া একটু ফোন করতে পারি?
বললাম আমার ফোননেই।
ও একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো,ফোন নেই? আরে নিয়ে নেবনা। আমি ওরকম মেয়ে নই।
আমি বললাম,জানি তুই ওরকম না। কিন্তু সত্যিই আমার ফোন নেইরে,,ওটাকে বেঁচে সাতদিন আগে হিরোইন খেয়েছি।
কিন্তু কেন বলত? ফোন কি করবি? অন্য কাউকে বাতিল করবি নাকি?
মেয়েটা কিছুই বলেনি,কোন উত্তর করেনি।চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো,,,,,

রাত আনুমানিক বারোটা,মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। আমি কি করব বুঝতে পারছিলামনা। নেশাটাও এতক্ষনে চড়ে বসেছে।
সিগারেটের চিকচিকে কাগজটায় হিরোইন নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিলাম। হঠাৎ মেয়েটা কেশে উঠলো,বুঝতে পারলাম ধোয়ায় ওর
কাশি উঠেছে। হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠে,বলেছিনা আমার সামনে খাবেননা। যান বাহিরে থেকে খেয়ে আসুন। আগুন নিভিয়ে বাহিরে যেতে চাইলাম।
ও আবার বলে,কেন খান এগুলো?
বললাম কষ্টে।
ও বলে,কিসের জন্য আপনার এত কষ্ট যে জীবনটাকে এভাবে আঁধারে নিয়ে যাচ্ছেন?
ওর প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম সেদিন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওর ভালো করে দেখছিলাম সেদিন। বয়স খুব একটা না।বছর আঠারো হবে হয়ত।
বলেছিলাম, তোর জীবন টা কোথায়?
কোন আলোয় আছিস তুই?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটুপর চোখের কোনবেয়ে জল গড়িয়ে আসে। আমি আরো অবাক হয়েযাই।
কিছুক্ষন পর চোখের জল মুছে ও বলেছিলো,
কিছু করবেননা?
আমি বলেছিলাম,কিছুই করার ফিলিংস নাইরে। তুই ঘুমা। ও আবার প্রশ্ন করে,কেন?
এমনিতেই। তুই বলেছিলি না কেন আমি নেশাকরি?
শুনবি?
মেয়েটা মাথা ঝোকায়। আমি বলতে শুরুকরি পেছনের ফেলে আসা ইতিহাস। যেখানে আছে শুধুই হাহাকার আর কষ্ট।মেয়েটা গল্প
শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরে।

পরদিন সকালে ও যখন চলে যাচ্ছিল বলেছিলাম,তোর ঠিকানাটা দিবি? ও বলেছিলো না। বললাম আজ আবার এই ঠিকানায় চলে
আসিস। মেয়েটা হেসে বলে আচ্ছা,আজ কতনিবে সে টাকার কথা না বলেই চলেগেল ও।
পরদিন ওর গল্প শুনতে লাগলাম,
ও বলে,আমি কলেজে পড়ি। এবার বিএ পড়তাম ।বাবা বেঁচে নেই।ছোট্ট একটা বোন,মা আর আমি।এই আমার পরিবার।দিনের বারোটা পর্যন্ত মানুষের বাড়িতে কাজ করি আমি। বিকেলে বাচ্চাদের পড়াই। আর মা সারাদিন কাজ করতেন।রাতে বাতির আলোয়
কলেজের বইপড়ি। বছর তিনেক আগে পাঁচ হাজার টাকায় ঝি এর কাজ করতাম এক বাড়িতে। তারা সকালে নাস্তা আর দুপুরের
খাবার দিতো আমায়।
দিব্যি চলেযেত দিন।
আমি বললাম,তারপর?
তারপর যখন এস,এস,সি পাশ করেছিলাম,কলেজে ভর্তি হলাম।লেখাপড়ার খরচ বাড়তে লাগলো।
প্রাইভেট পড়ার সময় ছিলোনা,গাইডের প্রয়োজন দেখা দিত।প্রথম প্রথম বান্ধবীদের থেকে নিতাম। কিন্তু ঝি এর কাজের জন্য
প্রতিদিন কলেজে যেতে পারতাম না।তাই তারাও আর নোট দিতনা।
অবশেষে বাড়ির মালিককে বলে দুপুরের খাবারের বদলে একহাজার টাকা বেতন বাড়িয়ে নিয়েছিলাম।

সকালের নাস্তার দুটো বিস্কুট আর এক কাপ চা খেয়েই কাজ করতাম সারাদিন।
-এটুকু খেয়ে তুই থাকতে পারতি? তোর কষ্ট হতনা?
-প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিলো।পেটে মোচড় দিয়ে ব্যাথা হত।মাথা ঘুরে পরেও গিয়েছিলাম কয়েকদিন।
জানেন,মালিকের বাড়িতে দুটো গরু ছিলো।বহুবার গরুকে খাবার দিতে গিয়ে ঐ পঁচা পান্তা গুলো খেয়েছিলাম।কি করব,ক্ষুধার জ্বালায় যে কাজ করতে পারতামনা।আর কাজ না করলে মালিক তো বেতন দিবেনা। রাতের খাবার মা অন্যের বাড়ি থেকে আনত। ছোট বোনকে খাওয়ানোর পর যা থাকত,মা আর আমি ভাগ করে খেতাম। আমি মা কে বলতাম মা,জীবনে একদিন
সুখ আসবেই। একদিন কষ্টগুলো সুখে রুপান্তরিত হবেই।
-তারপর?
মেয়েটা আবার বলতে থাকে, আমি ইন্টার পাশ করলাম।কিন্তু আর কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। যে বস্তিটাতে থাকতাম একদিন সেখানে আগুন লাগে। ঘরে যা টাকাছিলো আগুনে পুড়ে গেছে।খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি।আবার কষ্টটাকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম।এবার বিকেলে বস্তির বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেছিলাম।ভেবেছি লাম,এবছর না হোক সামনে বছর আবার ভর্তি হব।কিন্তু হয়ত সে কপাল আমার নেই। একরাতে বাড়ি ফেরার পথে মা এক্সিডেন্ট করে বসেন। কষ্টটা যেন এবার নিয়তি হয়ে
গিয়েছিলো। কি করব আমি? কোনদিকে যাব? একদিকে ছোটবোন,আরেকদিকে হাসপাতালে মা। কোন পথ না পেয়ে দিনের কাজের পাশাপাশি রাতে এপথে নেমে এলাম,,,,
-তারপর কি হলরে?
মেয়েটার কন্ঠ ভারি হয়ে আসে,ও কাঁদোকাঁদো স্বরে বলতে থাকে, ব্যবসা করতে লাগলাম নিজের দেহ দিয়ে,,
আজ একটা মাস যাবত মার কাছে ছোট বোনকে রেখে রাতে পড়ার নামে বেড়িয়ে পরি আমি।
ফেরী করে বেড়াই নিজের দেহকে নিয়ে।
দেহটার কত মূল্য হবে নিজেই ঠিক করে দেই,,,,
কাঁদতে থাকে মেয়েটি,কাঁদতে থাকি আমি।

মেয়েটা তারপর থেকে রোজ আসত। আমি বুঝতে পারি আমার হিরোইনের নেশাটা এখন বদলে গেছে।নেশাটা এখন ওর গল্প শোনায় রুপান্তরিত হয়েছে। হঠাৎ একদিন শুনলাম ওর মা মারা গেছে।
আমি বাবাকে বললাম ওর কথা।
বলেছিলাম,বাবা আমার স্বপ্ন তো জোড়া লেগে ভেঙেছিলো,কিন্তু এ মেয়েটা স্বপ্নের খোজটুকুও পায়নি।
বাবা বিজ্ঞান ভালো বুঝতেন।দুটো কালো মেঘের ঘষায় সৃষ্ট বিদ্যুৎ যে সবাইকে আলোকিত করতে পারে এইভেবে আমি আর মেয়েটাকে একত্র করে দিলেন।বিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিলেন,দুজনের আধারের জীবনটাকে এবার আলোকিত করো তোমরা।
ও হ্যা, মেয়েটার নাম ইভা

আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী,আমি, সীমা,বাবা-মা-বোন আর ওর ছোটবোন ওর মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে।
সীমা কেঁদে বলল,মা বলেছিলামনা সুখ আসবেই।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত