~হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
: ওয়ালাইকুৃম সালাম। কে?
: আমি নিনিত।
আমি নিনিত নামটা শুনে অনেকটাই অবাক হয়েছি। নিনিত আমার
ছেলের নাম।
: নিনিত( অস্ফুট গলায়)
: হ্যা আমি।
: তুমি মানে তুই
: আপনি আমার মা বলছেন?
: হুম। আমার নাম্বার কোথায় পেলে?
: আমি জোগাড় করেছি।
: আমাকে মনে আছে তোমার?
: আচ্ছা, আপনি আমার সাথে একবার দেখা করবেন?
: হুম।
: আচ্ছা, কাল আমি ময়মনসিংহ আসবো। আপনি স্টেশনে থাকবেন
কষ্ট করে। আমি আপনাকে দেখতে চাই।
এটা বলেই নিনিত ফোনটা কেটে দিয়েছিলো। নিনিত আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে কলটা কেটে দিয়েছিলো।
আমার হাত পা কাপতে শুরু করে দিয়েছিলো। আমি হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বাড়ির উঠোনেই বসে ছিলাম। বড় ভাইয়ের মেয়ের মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছিলাম। এমন সময় নিনিতের কলটা আসলো। মিতু হা করে আমার কান্নার কারণটা বুঝার চেষ্টা করছে। এতোক্ষণে বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে।
মা পিছন থেকে বার বার বলছে, রেনু কেডায় কি কইছে?
আমার মাইয়া কারো ঘাড়ের উপর বইয়া খায় না। আমার মাইয়ারে কেডায় কি কইছে?
: আম্মা কেউ কিছু বলে নাই আমারে
: তাইলে কান্দছ কেন?
আমি বুঝি না মনে করছোছ?
: নিনিতে কল দিয়েছিল আম্মা।
: কেডায় কল দিছিন?
: নিনিত আম্মা। আমার নিনিতে কল দিয়েছিলো।
সবাই বেশ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেউ কেউ এটা বুঝার চেষ্টা করছে নিনিত কে।
বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে ছিলাম আমি। প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। বাবা আমার সুখের জন্য সবটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু
আরিফের পরিবার আমাকে মেনে নেয় নি স্বাভাবিক ভাবে। ওদের বাসায় থাকতে দিয়েছিলো আমাকে ঠিকই কিন্তু ওদের বাড়ির বউয়ের সম্মান আমাকে কখনও দেয় নি।
আরিফের মুখ চেয়ে মাথা নিচু করে সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম। শ্বশুর বাড়ি ছিল খুলনা। ময়মনসিংহ থেকে অনেক দূরে। আরিফ
ময়মনসিংহ পড়াশোনা করতো আর এভাবেই পরিচয় হয়েছিলো আমাদের।
যখন খুলনা থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে আসতো আরিফ। আব্বা টেংরা মাছ কিনে আম্মাকে ঝোল করতে বলতেন। বলতেন, আমার
রেনুর মুখটা শুগাইয়া গেছে।
কিন্তু আব্বা কোনোদিন আমার শ্বশুর বাড়িতে যায় নি। আমিও কোনোদিন জোর করি নাই যাওয়ার জন্য। সত্যি বলতে আমি চাই
নি, আব্বা আমার পরিনতি দেখুক। আমার বাবা সহ্য করতে পারবে না।
..
সময় যাচ্ছিলো,,
আমিও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিলো। প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম আরিফের বাড়িতে বউয়ের সম্মান পাওয়ার।
বিয়ের পরের বছরই মাতৃেত্বরে স্বাদ পেয়েছিলাম। কোল জুড়ে নিনিত এসেছিলো। বাবা ততোদিনে শয্যাশায়ী। তাই সবাই
খুলনার বাড়িতে গেলেও বাবা যেতে পারেন নি। আমার শ্বশুর বাড়িতে বউয়ের কোনো সম্মান না থাকলে কি হবে। নাতি ছিল বেশ আদুরে। সবার বড় নাতি বলে কথা।
আরিফ তখন ঢাকায় চাকুরি করে। নিনিত আদো আদো গলায় মা মা বলে ডাকে।
আরিফ প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার খুলনায় আসতো।
ময়মনসিংহ আসা হচ্ছিলো না অনেক দিন। আমার শাশুড়ি মাকে বলেছিলাম, বাবা তো অসুস্থ। কয়েক দিনের জন্য ময়মনসিংহ
যাবো আম্মা?
উনি মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, সাহস কতো তোমার?
আমার নাতিরে নিয়ে এতো দূরে যাওয়ার কথা মুখে আনো?
আমি আর কিচ্ছু বলি নাই। কিন্তু আব্বার জন্য মনটা বেশ ছটফট করতেছিলো।
মনে মনে ঠিক করেছিলাম, এবারের মাসে আরিফ আসলে ওকে বলবো নিয়ে যেতে।
কিন্তু ঐ মাসে আরিফ এসেছিলো ঠিকই কিন্তু খাটকিতে করে।
উঠোনে ওর লাশটা রাখা ছিলো।
আমার শাশুড়ি আমাকে আরিফের লাশ পর্যন্ত স্পর্শ করতে দেয়
নি। আমি নাকি অলক্ষী। আমার জন্য আরিফের এক্সিডেন্ট
হয়েছে। উনি সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করছিলেন।
আরিফের দাফন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে আমার শাশুড়ি বললেন,
তোমার আর এই বাড়িতে থাকা হবে না।
আমার ছেলেই যখন নাই, তখন বউ দিয়ে কি হবে?
আমি বলেছিলাম, নিনিতকে নিয়ে আমি চলে যাবো মা। কিন্তু শাশুড়ি
মা ঘরের দরজা দিয়ে বলেছিলেন, বাপের বাড়ি থেকে নিনিতরে
নিয়ে আসো না। এটা আমার ছেলের চিহ্ন। আর হ্যা, আমার নাতির
সাথে সাবধান যোগাযোগ করতে চেষ্টা করবা না। তোমার
কালো ছায়া যেনো আমার নাতির উপর না পড়ে।
..
আমি আমার শাশুড়ির পা ধরে বলেছিলাম, মা নিনিত এখনো বুকের দুধ
খায়। ও মরে যাবে মা।
কিন্তু উনি উনার সিদ্ধান্তের স্থির ছিলেন। ভাইজানের সাথে তারপর ময়মনসিংহ চলে আসি।
আব্বা কড়া গলায় বলেছিলেন, আমি এখনও মরে যায় নাই। আমার রেনুর থাকার জায়গা থাকবো না?
রেনু আমার কাছে থাকবে। আমি আবার বিয়ে দিবো আমার মেয়ের। আমার মেয়ে কোনো দিক দা কম নাকি।
কিন্তু নতুন করে আর নাকফুল পড়তে ইচ্ছা হয় নি। তাই এভাবেই বাপের বাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছি। আব্বা চলে গিয়েছেন প্রায় এক যুগ হবে। আম্মা আছেন।
আব্বা মারা যাওয়ার আগে আমাকে আলাদা ভাবে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন যেনো কোনো অসুবিধা না হয়।
.. ভাইদের সংসার হয়েছে। ওদের সন্তানদের মাঝে আমি নিনিতকে খুজতে চেষ্টা করি। মিতু সবসময় আমার সাথে থেকে।
রাতেও আমার সাথে ঘুমায়।
অন্য ভাতিজা ভাতিজির কাছেও ভালোবাসার নাম রেনু ফুপি।
..
এভাবেই প্রায় ১৬ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। চুলে এখন পাক ধরেছে। আম্মা প্রায়ই মাথায় হাত রেখে বলেন, রেনু তোর সুখ দেইখা যদি মরতে পারতাম।
আমি এর বদলে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলি, আরিফের কাছে যেদিন যাবো ঐ দিনই সব সুখ ধরা দিবে আমায়।
আম্মা আরিফের নাম শুনলেই বেশ রেগে যায়। কিন্তু আমি আরিফকে ভালোবাসি।
আরিফ আমার ভালোবাসা কখনো অসম্মান করে নি কিন্তু ভাগ্য বলতেও তো একটা কিছু আছে বিধাতা আমাকে প্রতি মুহূর্তে এটা
বুঝিয়েছেন আরিফ প্রতি মুহূর্তে আমার পাশে আছে। হোক তা বাস্তব বা কল্পনা। প্রতিটা সময় আমি আরিফকে অনুভব করি।
এভাবে কেটে গিয়েছে এতোগুলো বছর। আমি জানি না, আমার নিনিত দেখতে কেমন হয়েছে। আমি মায়ের দায়িত্ব
পালনের সুযোগটুকু পায় নি।
আমি আমার নিনিতের সাথে থাকতে পারি নি। প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলো তখন আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে মায়ের দায়িত্ব
পালন করতে পারি নি। আদর বা শাসনের মায়াজালে জড়ানোর সুযোগটুকু আমার ছিল না। আমি ভাবতে পারি নি, নিনিত এভাবে আমার কাছে এসে ধরা দিবে। ওর দুনিয়ায় আমাকেও ঠাই দিবে এটা আমি কল্পনাও করি নাই। কিন্তু আর ওর গলা শুনে মনে হচ্ছিলো এটা তো আমার রক্ত। তাই বেইমানি করে নাই। আমাকে ঠিকই খুজে নিলো।
..
সবাই অবাক হয়েছিলো নিনিতের ফোন কলের কথা শুনে। রাতে আবার নিনিতের নাম্বার থেকে কল এলো, আমি স্পিকার অন
করে কথা বললাম ওর সাথে সবার সামনে। সবার বিশ্বাস হলো, এটা নিনিত। আমি মিথ্যা বলি নাই
..
সকাল ১১ টায় ট্রেন আসার কথা ছিলো। এর প্রায় ২ ঘন্টা আগে এসে হাজির হয়েছিলাম স্টেশনে।
নিনিত রাতে ফোন দিয়ে বলেছিলো, মা আপনাকে আমি চিনবো কি করে?
আপনি কি পড়ে থাকবেন?
আমি বলেছিলাম, কালো বোরকা পড়া থাকবে আমার। আমি ঠিকই তোমাকে চিনে নিবো বাবা।
..
মা, ভাইজানরা, ভাবিরা, ভাতিজা ভাতিজি সবাই মিলে অপেক্ষা করছিলাম নিনিতের।
আমার মা কোনো ছেলেকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জানতে চাচ্ছিল, তুমি কি আমার নিনিত?
সবাই না করে দিচ্ছিলো।
আমার পিছন দিক থেকে একসাথে ৫ টা ছেলে এসেছিলো।
মনে হচ্ছিলো, আমার হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।
ওরা আমার ঠিক পিছনে তাকিয়ে ছিলো, পিছন ঘুরে দেখি ওরা দাড়িয়ে আছে।
আমার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলো না। অনেক কষ্ট করে
বলেছিলাম, তুমি আমার নিনিত?
ছেলেটা কোনো কথা না বলে আমাকে জাপ্টে ধরে কাদতে শুরু করে দিয়েছিলো। তারপরের কিছুক্ষণ কি হলো
আমি জানি না। সমস্ত স্টেশনের লোক হা করে তাকিয়ে ছিলো।
আমার নিনিত হাউমাউ করে কাদছিলো।
আমি ঘোরের মাঝে ছিলাম। আমি স্বপ্নের মাঝে ছিলাম। আমি বাস্তবে ফিরতে চাচ্ছিলামম না।
কান্না থামিয়ে নিনিত বলেছিলো, মা আমি আপনাকে নিতে আসছি।
আমি জানতে চাচ্ছিলাম, কোথায় যাবো
: কেন? মা। আপনার বাড়িতে যাবেন। আপনার ছেলের সাথে থাকবেন।
: কিন্তু তোর দাদু্?
: দাদু, বরন ডালা সাজিয়ে বসে আছে।
আমি কিচ্ছু বলতে পারি নি। আম্মার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, আম্মা তোমার নাতিন আমাকে নিতে আসছে।
আম্মা, চোখে পানি নিয়ে বলেছিলো, নানুভাই তো নানুরে চিনে না। শুধু মারে নিয়ে চলে যাইতাছে গা। নানুর বাড়িডা পাড়াইয়া
দেখবি না?
..
বিকাল বেলা, ট্রেনে জানালার পাশের সিটে বসে আছি। উদ্দেশ্য খুলনা। আমার ছেলে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে
আছে। ওর চারজন বন্ধু আমাদের কান্ড কারখানা হা করে দেখে যাচ্ছে..