কি দেখো ” বেলকনিতে দাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমু দিতেই পিছন থেকে বনশ্রী এমন কথা শুনে ঘুরে দাড়ালো রাজ ।
– কাক! কাক দেখি।
– কাক আবার দেখার কি হলো?কোকিল হলে অন্য কথা।
– কাক তো একটা নিঃস্বার্থ প্রাণী। কোকিল তো মানুষের মতো বেঈমান।
– বুঝলাম না?
– কোকিল তো কাকের বাসায় ডিম পাড়ে,
আর কাক নিজের ডিম মনে করে তা দিতে থাকে। আর যখন কোকিলের বাচ্চা বড় হয়ে যায়, তখন সে নিজের মতো করে চলে যায়। ভালো মানুষগুলো খারাপ মানুষদেরকে আপন মনে করে বুকে স্থান দেয়। আর যখন সময় আসে,তখন খারাপ মানুষগুলো স্থান দেওয়া মানুষগুলোর বুকে ছুড়ি চালিয়ে যায়।
– তা অবশ্য ঠিক বলেছ।
– আর কাক’রা কত সামাজিক। তারা সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকে।
– হুমম।
– তুমি একবার একটি কাক’কে আঘাত করে দেখো, বাকি কাকগুলো ছুটে এসে চিৎকার শুরু করে দিবে।
– তা অবশ্য ঠিকই বলেছ।
– কাকের মাংস কাকে খায়না। কিন্তু পৃথিবী শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, তারা তাদের মাংস খায়।
– রাজ বুঝলাম না ঠিক কীভাবে?
– মনে করো তুমি কোনো বিপদে পড়লে।তখন তোমার পাশে থাকা মানুষটি সেই সুযোগ কাজে লাগাবে। তারা তখন চিন্তা করবে তাদের স্বার্থ। তখন তুমি মরে গেলেও তার কিছু যায় আসেনা।
– মনে হচ্ছে কখনও এরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছ।
– বুকে অনেক বড় একটা ক্ষত আছে। যা হয়তো কোনোভাবেই শুকাবে না।
– কি এমন ক্ষত যা কোনোভাবেই শুকাবে না।
– কিছু কথা সময়ের সাথে সাথে গোপন হয়ে যায়। যেমন তোমরা জেনেছো এই শহরে আমি একা। আমার কোনো ভাই বোন নেই। আমি কাকার বাসায় মানুষ হয়েছি। এই কথাগুলো ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
– মানে?
– আমিও মা বাবার আদরের সন্তান ছিলাম। একটা রোড এক্সিডেন্ট মা বাবা মারা যান। তখন আমি সবে মাত্র মাধ্যমিক পাস করি।
আমার একটা ছোট্ট বোন আছে। থাকে নিয়েই শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। চলে আসি আজানা শহরে মামার বাসায় । বোন তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। বোনের লেখাপড়া, আর দুইবেলা খাওয়ার জন্য নেমে পড়ি জীবন যুদ্ধে। যদিও মামার বাসায় থাকতাম, কিন্তু তারা তো আর মা বাবা না যে আমাকে বসিয়ে খাওয়াবে। প্রথমে কাজ শুরু করি বাসের হেলপার হিসাবে। তারপর কিছু টাকা জমিয়ে শুরু করি ফুটপাতে ব্যবসা। এভাবেই একটা সময় নিজে একটা ছোটখাটো দোকানের মালিক হয়ে যাই । যদিও মামার বাসায় টাকা দিতে থাকতাম তবুও মামির যন্ত্রনা দিন দিন বাড়ছে ।
উনার কথাগুলো যেনো বিষ এর মতো লাগে, তাই তখন মামার বাসা থেকে সরে গিয়ে আলাদা বাসা নিলাম।
বোনকে অনেক কষ্টে পড়ালেখা করাচ্ছি। দোকানের লাভ দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে। কোনোদিন বোনকে একটু কষ্ট পেতে দেইনি। দোকানের কাজ শেষ করে প্রায় সময় আমি রান্না করতাম। কলেজে শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি করালাম বোনকে, ভাবলাম আমি তো পড়ালেখা করতে পারিনি, বোনটা পড়ালেখা করুক। ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরে জানতে পারলাম, সে একটা ছেলেকে ভালবাসে। কোনো ভাই তার বোনকে কোনো বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিবেনা। তাই আমিও দিতে চাইনি। তখন সে আমার কথা অমান্য করে। আমাকে বলেছে- সে এখন বড় হয়েছে। পড়ালেখা জানা একজন মানুষ। তার নিজের ভালো এখন সে নিজে বুঝতে শিখেছে।
কথাগুলো শুনে বেশ রাগ হয়েছিলো। তাই সেদিন একটা থাপ্পড় দিয়েছিলাম। পরেরদিন দোকান থেকে এসে দেখি। সে বাসায় নেই। তার বিছানায় চিরকুট লেখা। ঐই ছেলের সাথে সে পালিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি। তাদের সম্পর্ক ভার্সিটি থেকে শুরুনা। শুরু কলেজ থেকে। শারীরিক রিলেশন পর্যন্ত শেষ। আর চিরকুটেও লেখা ছিলো। তাই আর খোঁজ নেইনি। তারপর এই শহর ছেড়ে চলে আসি কাকার বাসায়। এখানেই নতুন ভাবে শুরু করি জীবন। কথাগুলো শেষ করে চোখের জল মুছছে রাজ। বনশ্রী পেছন থেকে রাজকে জড়িয়ে ধরলো।
– তুমি কোনো চিন্তা করোনা রাজ, দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
– একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবেই, বেঁচে আছে আমার মতো হাজারো লাশ।
এখন বনশ্রীর ভালবাসা নিয়েই বেঁচে আছে রাজ। তবুও মনের গভীরে একটা ক্ষত রয়ে যাবে সারা জীবন।
প্রিয় মানুষগুলোর দেওয়া কষ্ট পৃথিবীর সবথেকে ভারী জিনিস যা অনেকের ক্ষেত্রেই বহন করা সম্ভব না।।