সে বহুদিন আগের কথা । খড়গপুর টাউন স্কুলের দুই ছাত্র ছাত্রী বসে গল্প করছিল একটা বড় অশস্ত্থ গাছের নিচে বাঁধানো বেদী তে বসে । ছাত্রীটির নাম পল্লবী -ক্লাস টেনে পড়ে । পাশের গলিতে বাড়ি । আর ছাত্রটির নাম সায়ন
-ইলেভেনে পড়ে । সদ্য বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুজনের । সামনেই বাড়ি সায়নের । সবে বসন্ত কাল এসেছে । দু একটা শালিখ পাখি সামনে পিছনে ইতিউতি করছে আর সামনের সাজানো বাগান টায় দেশি বিদেশী হরেক রকম ফুলের সমারোহ । সায়ন হঠাৎ পল্লবীর কোঁকড়ানো ঝুলে থাকা চুলে হাত দিয়ে বললো , “মামন , তোকে এই কোঁকড়ানো চুলে দারুন লাগছে । পল্লবী মুখ নিচু করে বললো , “সে তো সবদিন বলো আমাকে দারুন দেখতে লাগছে ।” সায়ন একটা নুড়ি পায়ের নিচ থেকে তুলে সামনের শালিখ পাখিটার টার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো , “হুম , কিন্তু আজ সত্যি অন্যরকম লাগছে । তোর একটা ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছে ।” লজ্জায় মুখ নিচু করে পল্লবী বললো , “ধ্যাত ! আমি পারবোনা । ”
-“তুই চল না। বাড়ি তে কেউ নেই । সায়ন অসহিষ্ণু ভাবে বলেই উঠে দাঁড়িয়ে পল্লবীর হাত ধরে টান দিল। পল্লবী উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “কাউকে দেখাবে না তো ?অদ্রিজা , সুস্মিতা , শৌভিক দের ?”
-“মাথা খারাপ? এটা শুধু তোর আর আমার। ”
পল্লবী কিছু বলে ওঠার আগেই সায়ন তার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ।ছুটির দিন গুলো তে সায়ন আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শেখে । ছবি আঁকা তার নেশা-ভালো ছবি আঁকে। সুবিমল বাবু আর রীনা দেবী সেদিন একটা ইনভাইটেশনে গেছিলেন । অফিসের ক্লার্ক রতনের ছেলের বৌভাত উপলক্ষে । বাড়ি ফাঁকা ছিল । সায়ন নিজের আঁকার ঘরে ঢুকে হঠাৎ পল্লবীর দিকে ফিরে বললো , টাইটানিক ছবিটা দেখেছিস? পল্লবী মাথা নাড়লো। সায়ন বললো , “সেরকমই একটা ছবি আঁকতে চাই। পল্লবী লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো , “ছিঃ ! অসভ্য তুমি ”
-“বেশি ঘ্যান ঘ্যান করিসনা। ” সায়ন রেগে বললো।” ওটা জাস্ট আমার জন্য। সারাজীবন পাশে রাখবো। “-সায়ন বলতে থাকলো। পল্লবী দুহাত দিয়ে চোখ ঢাকলো আর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “ইশ “। তারপর বললো , “একদম না। আমি কাকিমা কে বলে দিব ।”
-“মা কে বলবি ?”সায়ন চুলের বেণী ধরে টেনে বললো ।
-“ছাড়ো ছাড়ো লাগছে “পল্লবী কঁকিয়ে উঠলো ।
-“আর বলবি ?” সায়ন কটমট করে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো ।
-“না । ”
তারপর বেনী দুলিয়ে আবদার করে বলতে থাকলো , “তবে একটা শর্ত আছে । ” সায়ন তির্যক ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো , “কি শর্ত ?”
-“ছবি দুটো কপি করবে । একটা তুমি নেবে আর একটা আমি নেবো । ”
-“তুই কি করবি ?”
-“তুমি কি করবে আমার ছবি নিয়ে ?”পল্লবী সায়নের প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলো । সায়ন বললো , “সারাজীবন রেখে দিবো । যখনই ইচ্ছে হবে , একবার ছবি টা দেখে নেবো । কিন্তু তুই ?”
-“আমারও যখন ইচ্ছে হবে এটা দেখবো । ছুঁয়ে দেখবো তোমার হাতের ছোঁয়া কেমন লেগে আছে । ”
সায়ন বিড়বিড় করে বললো , “মাথামোটা , গবেট । ” তারপর নিজের কাজ শুরু করার চেষ্টায় লেগে গেল । সায়ন ক্যানভাস ফ্রেম স্ট্যান্ডে ক্যানভাস টা রেখে যখন পিছন ফিরে দেখে ষোড়শ বর্ষীয় মেয়েটি একরকম নিরাভরণ হয়ে পাশের খাটে বসেছে । সায়ন কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল নগ্ন শরীর টার দিকে । কৈশোর এবং বয়ঃসন্ধির নির্বাক আকুলতা মিশে ঘোর যেন তখনও কাটেনি । অতল গিরিগুহার পরতে পরতে সাজিয়ে রাখা অসীম রত্নভান্ডারের দ্যুতিতে ডুবে গেছিল সায়ন । চেতনা ফিরলো তখনই যখন পল্লবীর আওয়াজে ।
-“আমার লজ্জা লাগছে তাড়াতাড়ি আঁকো । ”
বেশ এইভাবে দিনগুলো কাটছিল , প্রতিদিন স্কুল থেকে কিশোর কিশোরী যুগল বসে যেত আড্ডা দিতে বা কখনও ছবি আঁকতে । পল্লবীর বাবা প্রকাশ ঘোষ ছিল সুবিমল বাবুর ড্রাইভার । পাশের গলিতে এক কামরা টিনের ঘর । ড্রাইভারের মেয়ে হলেও রীনা দেবী নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন পল্লবী কে । বাড়ির সর্বত্র অবাধ যাতায়াত ছিল তার ।জেলার চিফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সুবিমল বাবু । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সুবিমল বাবুর ট্রান্সফার অর্ডার আসলো , খড়গ পুর ছেড়ে সোজা বালুরঘাট । বেশ জোরকদমে চলতে থাকলো নতুন জায়গাতে যাওয়ার প্রস্তুতি । একটা মেঘলা দুপুরে হঠাৎ একদিন সায়ন খেয়াল করলো পল্লবী আনমনা হয়ে বসে আছে । রং তুলি ছেড়ে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো , “কি রে তুই চুপচাপ কেন ?মন খারাপ নাকি ?”পল্লবী নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠলো , সায়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো , “কি রে কাঁদছিস কেন ?”
-“তুমি তো চলে যাচ্ছো বালুরঘাট । ”
-“ওহঃ । কাঁদিস না আমি ফোন করবো । ছুটি তে আসবো তোর সাথে দেখা করতে । ”
-“কিন্তু আমাদের তো ফোন নেই । ”
-“চিঠি লিখবো প্রতি সপ্তাহে একটা করে ।”
সায়ন আশ্বস্ত করে বললো । পল্লবী চোখ মুছতে মুছতে বললো , “মিথ্যে কথা ! ভুলে যাবে আমাকে । “সায়ন এগিয়ে এলো পল্লবীর কাছে তারপর চিবুক তুলে বললো , “মন খারাপ করিসনা পাগলী । তুই শুধু আমার । ”
তারপর আস্তে আস্তে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো , “তোকে কখনও ভুলে থাকা যায় । ওই যে ছবিটা তোর এঁকেছি , ওটার মধ্যেই তুই থাকবি । ” কেঁপে উঠলো পল্লবী -কিশোরী মনের দোলাচলে একটা সুতীব্র ঢেউ এসে লাগলো বুকে , ধীরে ধীরে অনুভব একজোড়া নরম ঠোঁট মিশে যাচ্ছে তার ঠোঁটে ।বসন্তের মৃদু হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে উড়িয়ে দিল তার কোঁকড়ানো চুল গুলো । বাইরের ঘরে টিভি তে বোধহয় একটা পুরনো হিন্দি সিনেমা চলছিল , বাতাসে ভাসছে সেই ছবির গানের সুর টা , “গঁবা হ্যায় চাঁদ তারে গঁবা হ্যায় -তেরে মেরে মিলন কে -আপনে দিওয়ানাপনকে -নজারে গঁবা হ্যায় “–
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে । সতের বছরের কিশোর বালকটি আজ পরিপূর্ন যুবক ।পল্লবীর কথা একাকী রাত গুলোতে মনে পড়লে সে একদৃষ্টে তার আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে । এই জীবনে পল্লবী বলতে এই ছবি ছাড়া আর কোন সূত্র নেই । দিল্লি থেকে পুনা , পুনা থেকে কলকাতা সর্বত্রই ছবিটি তার সঙ্গী । কর্মসূত্রে কলকাতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই এক পাগল মানুষের সাথে । মানুষটির নাম ধনঞ্জয় পোদ্দার । হাঁ , একরকম পাগল মানুষই এই ধনঞ্জয় পোদ্দার ।অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয় বন্ধুত্বে রূপ নিল । এবং আমাদের এই গল্পের মোড় ও হঠাৎ পাল্টে গেল । প্রায় রাতে দুজনের আড্ডার আসর বসে সায়নের ফ্ল্যাটে । এইরকম এক রাতে ধনঞ্জয় বাবু লাস্ট পেগ টা ঢেলে বলে উঠলেন , “আপনার মতো মানুষ জীবনে খুব ই কম দেখেছি। “সায়ন জানে এবার নেশা চড়ে গেছে। এবার উনি আস্তে আস্তে তেল দিতে শুরু করবেন । ফিশ ফ্রাই টা মুখে দিয়ে সায়ন বললো , “থাক থাক আর প্রেজ করতে হবেনা । ”
কে শোনে কার কথা ! অদ্ভুত এক মানুষ ধনঞ্জয় পোদ্দার । যত দিন গেছে মানুষ টার প্রেমে পড়ে গেছে সায়ন । অ্যাক্সিস ব্যাংকের জোনাল ম্যানেজার হিসেবে সায়ন জয়েন করার মাস খানেকের মধ্যেই ধনঞ্জয় বাবুর সাথে পরিচয়। উনি একটা এন জি ও চালান । একটা বিদেশী অনুদান পাওয়ার জন্য সায়নের সাথে প্রথম দেখা করতে আসেন যাতে অ্যাক্সিস ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান টা পাওয়া যায় । প্রথম প্রথম সায়নের মনে হয়েছিল আর পাঁচজন এন জি ও এর মতো এটা ও । সরকারি অনুদান আর প্রচার পাওয়ার কৌশল তার আড়ালে বেআইনি ব্যাবসা । কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙ্গলো , ধনঞ্জয় বাবুর চাপাচাপি তে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক ছুটির দিনে হাজির হলো ব্যারাক পুরের আনন্দ নিকেতন অনাথ আশ্রমে । অনেকটা খোলা জায়গার উপর সরু পাকাবাড়ি লম্বালম্বি ভাবে , অ্যাসবেস্টসের ছাউনি । প্রায় গোটা চল্লিশেক বাচ্চা ছেলে মেয়ে , সাথে লাগোয়া একটা বিদ্যালয় । অপরদিকে একটা একতলা বাড়ি তে প্রায় কুড়িজন মতো বৃদ্ধ -বৃদ্ধা । সহায় সম্বলহীন বিবাহ বিচ্ছিন্ন বা বিধবা মহিলাই এখানে সব কিছু দেখাশোনা করেন ।সায়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল বৃদ্ধাশ্রমের দিকে , হুঁশ ফিরলো ধনঞ্জয় বাবুর কথায় ।
-“ইচ্ছে থাকলেও আলাদা বৃদ্ধাশ্রম বা অসহায় মহিলা দের জন্য কিছু করে উঠতে পারিনি । তাই মহিলা বৃদ্ধ দের ও আপাত আশ্রয় এটাই । ”
চল্লিশোর্ধ্ মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে গেছিল মনে মনে । তারপর দুজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে । একলা থাকে সায়ন, বাবা মা দিল্লিতে থাকেন , বালুরঘাটে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই সুবিমল বাবু প্রমোশন পেয়ে দিল্লি চলে যান কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন মন্ত্রকের অ্যাসিস্টান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে । তারপর ওখানেই একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে নেন ।এদিকে সায়ন পড়াশোনা সম্পূর্ন করে অ্যাক্সিস ব্যাংকে ফিল্ড অফিসার হিসেবে জয়েন করে পুনা চলে যায় তারপর ওখান থেকে প্রমোশন পেয়ে সহকারী জোনাল ম্যানেজার হিসেবে কলকাতা চলে আসে । রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ফাঁকা ফ্ল্যাটে দিন কাটতেই চায়না । রাতে একা একা পেগ বানিয়ে বসে সাথে আনা পল্লবীর ছবিটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ।অজস্র চিঠি লিখেও খড়গ পুরের ঠিকানায় কোন উত্তর পায়নি । পল্লবীদের ফোন ছিলনা , নম্বর টা থাকলে হয়তো যোগাযোগ টা থাকতো । হয়তো এতদিনে বিয়ে হয়ে সুখী ঘর সংসার করছে । আদৌ কি সায়নের কথা মনে আছে ?একবার ছুটির দিন দেখে খড়্গপুর গিয়ে খোঁজ নেবে প্রকাশ কাকু প্রতিমা কাকিমার ।
কলকাতায় একমাত্র ধনঞ্জয় বাবুর সাথেই হৃদ্যতা বেশি সায়নের, প্রায়ই অকৃতদার মানুষটি কে ডেকে নেয় নিজের ফ্ল্যাটে । আড্ডার সাথে পান ও চলতে থাকে । আর দু পেগ পড়লেই ধনঞ্জয় বাবুকে আর চেনাই যায়না । ধনঞ্জয় বাবুর একটা রোগ হচ্ছে নেশা চড়লে নিজের পুরনো প্রেমিকার কথা একবার বলবেনই ।এবং বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন সায়ন কেন বিয়ে করেনি । সায়ন অনেকবার ভেবেছে মামনের কথা বলবে , কিন্তু কৈশোর বয়সের কথা ধনঞ্জয় বাবু যদি তাঁর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গীতে হো হো করে হেসে ওঠেন তাহলে লজ্জায় পড়ে যাবে সায়ন । হঠাৎ সায়ন খেয়াল করলো ধনঞ্জয় পুবদিকের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন নিবিড় ভাবে । আশ্চর্য হয়ে সায়ন তাকিয়ে দেখলো ফাঁকা দেওয়াল -একটা পেইন্টিং টাঙানো আছে -আলো আঁধারি তে মেশা মুখ টা চেনা যায়না
-অদ্ভুত শান্ত চোখে পল্লবী শুয়ে আছে অর্ধনগ্ন হয়ে ।
সায়ন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ধনঞ্জয় বাবু কি দেখছেন ?” ধনঞ্জয় বাবুর হুঁশ ফিরে এলো , পাশ ফিরে বললেন , “অদ্ভুত সুন্দর ছবিটা । কার আঁকা ?কোথা থেকে কিনলেন ?” সায়ন হো হো করে হেসে বললো , “কিনবো কেন ?আমার নিজেরই আঁকা । আর্ট স্কুলে পড়ার সময় খুব ছবি আঁকতাম ।”ধনঞ্জয় বাবু বললেন , “আপনি তো ট্যালেন্টেড লোক মশাই । এত সুন্দর পেইন্টিং করেন জানতাম না তো । তারপর সিগারেট টা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বললেন , “বাট , আমি এই ছবিটা কোথায় একটা দেখেছি । ঠিক মনে পড়ছেনা । হুবুহ একইরকম । “চমকে উঠলো সায়ন , গ্লাস চলকে কয়েক ফোঁটা পানীয় পড়লো টেবিলে । সঙ্গে সঙ্গে চকিতের ন্যায় ধনঞ্জয় বাবুকে প্রশ্ন করলো , “এই ছবিটা ?কোথায় কবে দেখেছেন ?” সায়নের হঠাৎ ব্যতিব্যস্তে অবাক হলেন ধনঞ্জয় বাবু , বললেন , “মাস কয়েক আগে একটা বাড়ি তে । কিন্তু আপনি এত উত্তেজিত হয়ে উঠছেন কেন ?” দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে সায়ন পাগলের মতো বলে উঠলো , “প্লিজ ওখানে আমাকে নিয়ে চলুন । খুব প্রয়োজন । প্লিজ ”
ধনঞ্জয় বাবুর নেশা কেটে গেছে । সায়নের দাপাদাপি তে যেন ফ্লাশব্যাকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন । তারপর ধীরে ধীরে বললেন , “আমার এই স্বল্প পুঁজি তে আপনি তো জানেন অনাথ ছেলে মেয়ে -সহায় সম্বলহীন মহিলা -বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের জন্য কাজ করে থাকি ।কয়েকমাস আগে সারা কলকাতা সহ শহরতলি জুড়ে একটা ক্যাম্পেন করেছিলাম জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী বা হঠাৎ করে অ্যাক্সিডেন্টে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মানুষ দের জন্য একটা তালিকা তৈরি করে যৎসামান্য আর্থিক সাহায্য তুলে দেওয়ার । প্রচারের অভাবে সবার কাছে আমাদের পরিষেবা টা পৌঁছে দিতে পারিনি। তবুও প্রায় দুশো টা মতো প্রতিবন্ধী মানুষের অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছিল । আমি নিজেই সেগুলোর সার্ভে করেছিলুম । তিলজলা বস্তি তে একটা ভাঙ্গা ভাড়া বাড়িতে সার্ভে করতে গিয়ে ঠিক এইরকম একটা ছবি দেখেছিলাম স্পষ্ট মনে আছে আমার ।ওদের অ্যাক্সিডেন্টাল কেস । কোন এক দুর্ঘটনায় মেয়েটি প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে ।বাবা নেই , খুব কষ্টে দিন কাটে। ওই বস্তির এক নেতা টাইপের কেউ কিছু আর্থিক সাহায্যের আমাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল । সায়ন অধৈর্য হয়ে বললো , “তারপর আপনি টাকা পাঠিয়েছিলেন ?”
-“নাঃ ”
সিগারেট টার ছাই অ্যাশট্রে তে ফেলে ধনঞ্জয় বাবু বললেন , “পুরো প্রক্রিয়া টা করে উঠতে আমাদের প্রায় মাস দেড়েক লেগেছিল । পরে যখন আমার লোককে দিয়ে টাকা পাঠাই , সে ফিরে এসেছিল ওই ঠিকানায় কাউকে না পেয়ে । আমি পরে ভেবেছিলাম ওই বস্তি তে গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ খবর নিয়ে ওদের প্রাপ্য টাকা টা পৌঁছে দেব । কিন্তু কাজের চাপে ভুলেই গেছলাম । আজ এই ছবিটা দেখেই মনে পড়লো । “তারপর আরো অবাক করে দিয়ে ধনঞ্জয় বাবু বললেন , “ওই বাড়ি তে দুজন মহিলা -মা ও মেয়ে । কিন্তু একজ্যাক্টলি কে প্রতিবন্ধী সেটা আমি শিওর বলতে পারছিনা ।আমার আশ্রমের ম্যানেজার রমেন ডিটেলস জানে ।”সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে বললো , “প্লিজ আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবেন ?সারাজীবন আপনার উপকার মনে রাখবো ।
ধনঞ্জয় বাবু যারপরনাই বিস্মিত হয়ে গেলেন কিন্তু নিজের বিস্ময় ভাব লুকিয়ে বললেন , “সময়ের খেয়াল আছে আপনার ? এখন রাত এগারো টা বাজে । এতরাতে ওখানে যাওয়ার কি প্রয়োজন । কালকে যাবেন ।” তারপর অল্প একটু থেমে বললেন , “কিছু মনে করবেন না সায়ন বাবু । আপনার এত আগ্রহ উতলা হওয়ার কারন টা জানতে পারি কি ?”সায়ন উদাস ভাবে তাকিয়ে ছিল ঘড়ির কাঁটার দিকে । টিকটিক করে সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরেই চলেছে আপনমনে। পর্যাবৃত্ত দোলগতির দিকে তাকিয়ে বলল , “এই ছবির মাত্র দুটো কপি । একটা আমার কাছে । আর এক কপি যার কাছে আছে সে আমার মনের কোহিনুর । ”
সারা রাত অসহ্য এক যন্ত্রনায় জ্বলতে পুড়তে লাগলো । ঘুম আসেইনা । প্রতিমা কাকিমা না মামন কে অ্যাকসিডেন্ট করে আজ প্রতিবন্ধী সেজে বসে আছে । নিজের উপরই রাগ হতে জমতে থাকলো । দিল্লি তে কলেজে পড়ার সময় বা পরে কি আর একটু ভালোভাবে খোঁজ খবর নিলে কি ওদের সন্ধান পাওয়া যেত ?ছোট থেকেই প্রতিমা কাকিমা কে নিজের মায়ের মতোই দেখে এসেছে । তার স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠলো যখন মা খাওয়াতে পারতো না তখন প্রতিমা কাকিমাই কোলে তুলে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে খাওয়াতেন । কাকিমা আগে কাকে খাইয়ে দিবে তাই নিয়ে প্রত্যহ পল্লবী অর্থাৎ মামনের সাথে মারপিট লাগতো । আচ্ছা , পল্লবী যদি কোন কারনে একটা হাত বা পা খুইয়ে বসে থাকে তাহলে কি সায়ন পারবে বাবা মা সহ সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে পল্লবীকে বুকে তুলে নিতে ? আদৌ কি ওরা তিলজলা বস্তিতে আছে ?কিন্তু ধনঞ্জয় বাবু বললেন যে ওদের টাকা পাঠিয়ে ও ফেরত নিতে হয়েছে ওদের খোঁজ না পেয়ে ।
ওরা কি হারিয়ে গেছে ! এতবড় শহরে কোথায় খুঁজে পাবে ওদেরকে । চোখের কোন টা ভিজে উঠলো ।নাহ , গলাটা শুকিয়ে গেছে । সে বিছানা থেকে উঠে বসলো , পাশে কাজের মাসির রেখে দেওয়া জলের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল পান করলো । হালকা নীলচে আলোয় হঠাৎ নজরে পড়লো পল্লবীর ছবি টা ! আলো আঁধারি বেয়ে পল্লবীর অশ্রুরাশি কি চুঁইয়ে পড়ছে ! একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো , কোঁকড়ানো চুল -শান্ত লাজুক চাহনি – পল্লবী কি এমনই দেখতে আছে ?মামন কি একই আছে ?না গত দশ বছরে মুখের আদল ঠিক কতটা পাল্টেগেছে ! সেদিনের সেই ষোড়শী মেয়েটি কি আজও খোঁজে তাকে রাতে একা শুয়ে শুয়ে ?
তখন প্রায় সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে । তীব্র গতিতে একটা গাড়ি এসে থামলো একটা বাড়ির সামনে । ধনঞ্জয় বাবু তাড়াতাড়ি নেমে এসে পাশের বাড়ি তে নক করতে এক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে আসলেন , ধনঞ্জয় নমস্কার করে বললেন, “আমি একটা এন জি ও এর তরফ থেকে এসেছি । আমরা প্রতিবন্ধী মানুষদের অল্প কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকি ।কিন্তু প্রকাশ সিংহের বাড়ি তে তালা বন্ধ । আপনি কি বলতে পারবেন উনাদের কোথায় পাওয়া যাবে ?” ভদ্রমহিলা ভালকরে ধনঞ্জয় বাবু এবং পিছনে এসে দাঁড়ানো সায়ন কে ভালোভাবে মেপে নিয়ে বললেন , “বাড়ি ভাড়া দিতে পারেনি তাই বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দিয়েছে । এখন ঠিক কোথায় আছে জানিনা তবে ওই মোড়ের কাছে যে ভুষিমাল দোকান টা ওখানে খোঁজ করুন ও হয়তো জানে । ”
ধনঞ্জয় বাবু আর সায়ন হতাশ হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসে মোড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন । বাঁক টা ঘুরতেই একটা ভুষিমাল দোকান । সায়ন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো ধনঞ্জয় বাবু এগিয়ে গেলেন । সায়ন পাশ ফিরে দেখল কয়েকটা অর্ধ উলঙ্গ বাচ্চা ছেলে মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা ধুলো করছে । চারপাশে বেশ আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বেশ বোঝাই যায় তিলোত্তমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক দমবন্ধ করা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এগুলো । হয়তো সন্ধ্যে হলেই চারপাশে মদের আসর বসে । সায়ন মুখ তুলে দেখলো ধনঞ্জয় বাবু ওই ভুষিমাল দোকানের এক ব্যক্তির সাথে হাত নেড়ে কিছু বলছেন ।
আচ্ছা আজ কি খুঁজে পাবে পল্লবীকে । যদি পায় পল্লবী কি চিনতে পারবে ?তার কি বিয়ে হয়ে গেছে ?না আজও সায়ন কে মনের মনিকোঠায় লুকিয়ে রেখেছে ! বালুরঘাটে গিয়েই তো সে চিঠি লিখেছিল পল্লবী কে । কোন চিঠি কি পল্লবীর হাতে এসে পৌঁছায়নি ! খড়্গপুর থেকে কিকরে কলকাতায় এসে হাজির হলো প্রকাশ কাকুরা । প্রতিমা মাসি কি এখনও মনে রেখেছে সায়ন কে ! রোজ বিকেলে দৌড়ে পল্লবীর বাড়িতে যেত শুধু মাত্র প্রতিমা মাসির হাতের তৈরি তিলের নাড়ু খাওয়ার জন্য ।কাল অনেক রাত পর্যন্ত এই সব ভাবতে ভাবতেই ঘুম ধরে গেছিল ।সকাল বেলা ধনঞ্জয় বাবুর ফোনে ঘুম ভাঙ্গে ।
এমনিতে রবিবার ছুটির দিন তাই স্নান ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়েছে ।কাল রাত থেকে মনের মধ্যে যে দমবন্ধ করা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল আজ যেন আরো বেড়ে গেছে । যদি না পায় ওদের ? চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো হঠাৎ, সম্বিত ফিরলো ধনঞ্জয় বাবুর ডাকে । ধনঞ্জয় বাবু বললেন ,”চলুন একটু সামনের দিকে বস্তি টা পেরিয়ে যেতে হবে একটু ” সায়ন গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিল । গাড়ি টা থামলো একটা সরু রাস্তা টার প্রায় শেষ প্রান্তে । কয়েকটা ঘুপচি মতো ঘর । কাঠের পাটাতন -পুরনো টিন দিয়ে ঘেরা । পিছন দিক দিয়ে একটা নিকাশি নর্দমা বয়ে চলেছে । সায়ন দেখল এটাকে একটা সরু খালই বলা যায়। গাড়ি থেকে নামতেই একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে মুখে এসে লাগলো । ধনঞ্জয় বাবু এগিয়ে গেলেন । প্রায় তিনটে ঘুপচি পার হয়ে চার নম্বর ঘরের সামনে এসে থামলেন । সায়ন পিছন পিছন এসে দেখলো একটা পুরনো টিন -অ্যাসবেস্টস
-কাঠের তক্তা জোড়াতালি দিয়ে একটা ঘুপচি ঘর । ভিতর টা অন্ধকার লাগছে । ধনঞ্জয় বাবু মাথা নুইয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন তারপর পিছন ফিরে ইশারা করতেই সায়ন ঢুকলো , মাথায় একটু লাগলো।
ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে এক মহিলা বেরিয়ে আসলেন । সায়ন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো -চোখের সামনে প্রতিমা কাকিমা, যার কোলে মাথা রেখে অজস্র দিন ঘুমিয়ে পড়েছে ।পরনে শতধা ছিন্ন এক শাড়ি , মাথার চুলে পাক ধরেছে , দারিদ্রের করাল গ্রাসে সেই ভুবন মোহিনী হাসি টা আজ আর নেই -নেই কপালে সেই আধখানা চাঁদের মতো বড় টিপ টাও । ভিতর থেকে টিনের দেওয়ালের ওপাশ থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলো , “কে এসেছে মা ?”
চমকে উঠলো সায়ন । তারমানে পল্লবী আজ অসহায় ।
প্রতিমা কাকিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুই ধোপদুরস্ত দুটো মানুষের দিকে । সায়ন কোন কথা না বলে সরাসরি গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো । তারপর টিনের ঘেরা জায়গা টার ওপাশে চলে গেল । একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর বসে এক ছাব্বিশ সাতাশ বছরের মেয়ে নাইটি পরে বসে -চারপাশে কাগজের ঠোঙা ছড়ানো । চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল দুচোখ বেয়ে , নিজেকে সামলে সায়ন চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে । আশ্চর্য -টিনের দেওয়ালে সেই ছবিটা টাঙানো । তাহলে পল্লবী ও এতদিন ধরে আগলে রেখেছে তার সায়নদা কে নিজের বুকের মধ্যে ! ঘটনার পরম্পরায় পল্লবী অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল অচেনা যুবকটির দিকে কয়েক সেকেন্ড , ক্ষনিকের ঘোর লাগা তারপর অস্ফুটে মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো , “সায়নদা ” আনন্দে -কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠলো -ইচ্ছে করলো তার উঠে এসে জড়িয়ে ধরে সায়নকে- কিন্তু পারলো না । নাহ । আর সামলাতে পারলো না নিজে॥ কে সায়ন , সোজা এগিয়ে গেল তারপর এক পা হীন প্রতিবন্ধী মেয়ে টা কে এক হ্যাঁচকায় কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো । কোন কথা নেই । কাঁধ বেয়ে দুজনের অশ্রুধারা বয়ে গেল । কয়েক সেকেন্ড পর একটু থেমে সায়ন বললো , “আমি বলেছিলাম আসবো। ”
-“অনেক দেরি হয়ে গেল সায়নদা ,আমি আর স্বাভাবিক নেই । পা হারিয়ে আমি একটা আবর্জনা হয়ে গেছি এইপৃথিবীর। ”
-“চুপ । যেমন আছিস যেভাবে আছিস তাই নিয়েই তুই শুধু আমার । “সায়ন বলতে থাকলো , পল্লবী কোন কথা বলতে পারলো না । তারপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।