নিহা খাবার টেবিলে বসে আছে, ১২ টা বেজে গেলো আতিক এর এখনও আসার নাম কথা নাই।
শ্বশুর শাশুড়ি সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
রাত ১ টা কলিং বেল বেজে উঠলো!
আতিক আসলো! নিহা খেতে বলল,
আতিক- আমি খেয়ে এসেছি, অনেক ক্লান্ত আমি ঘুমাবো। কাল আবার চট্টগ্রাম যেতে হবে।
।।
আতিক ঘুমিয়ে গেলো! একবার ও জিজ্ঞেস করলো না নিহা খেয়েছে কি না?
নিহা না খেয়ে আতিকের এক পাশে শুয়ে গেলো!
রাত ৩ টা বাজে এখন ও নিহার চোখে ঘুম নাই, এক পাশ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।
।।
মনে হচ্ছে বুকের মধ্যেটা কেউ বার বার ছুরি দিয়ে আঘাত করছে, কোন কিছুর অভাব নাই নিহার ঢাকায় নিজস্ব বাড়ী,
গাড়ী সব আছে, শ্বশুর শাশুড়িও খুব খারাপ বলা যাবে না, হয়তো মা-বাবার মতো হয় নি, তবে খারাপ না, আর স্বামী এমনি খারাপ না,
তবে শুধু টাকা আর টাকা! ব্যাবসা ছাড়া কিছু বুঝে না! শেষ নিহা কখন এক সাথে ঘুরতে গেছে ঠিক মনে পড়ে না।
।।
আজ বড্ড সিমেল এর কথা মনে পড়ছে।
নিহা ভাবতে ভাবতে অতিতে হারিয়ে গেলো! আজ থেকে ৮ বছর আগের কথা
নিহা তখন সদ্য কলেজে উঠেছে! এক দিন রাস্তায় তাদের দেখা তখন থেকেই সিমেল নিহার প্রেমে পড়ে যায়।
নিহা খুব ধার্মিক! সে বিয়ের আগে প্রেম করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের মাঝে মাঝে ফোনে আর ফেসবুকে কথা হতো।
নিহা খুব ভালো ছাত্রী। আর প্রবল পড়ার ইচ্ছা! সিমেল তাকে বলতো, তাকে বিয়ে করলে তাকে পড়ানোর বিয়ের দায়িত্ব তার!
অথচ সে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম বর্ষের ছাত্র। অবশ্য সিমেল একটু অন্য রকম ছেলে ছিল, কারণ তার তেমন কোন লোভ ছিল না,
সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, সিমেল বোরখার মধ্যে তার শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখে নি।
।।
সিমেল নিহার সাথে যখন কথা বলতো, তখন তাকে খুব বেশি বড় বড় স্বপ্ন দেখাতো না, সে যতো টুকু পারবে সে ওটায় বলতো।
যেমন বলতো, আমার বেশি টাকার প্রয়োজন নাই, যে চাকুরী করি না কেন কম বেতন পেলেও আমি রাজী কিন্তু আমাকে যেন বিকেলেই ছুটি দেওয়া হয়,
কারণ আমি সন্ধ্যাটা তোমার সাথে কাটাতে চাই।
।।
সিমেল বলতো, দেখো নিহা আমি হয়তো তোমাকে ফাইভ- স্টার হোটেলে নিয়ে যেতে পারবো না, কিন্তু প্রতিদিন চেষ্টা করবো,
তোমাকে সময় দিতে অফিস থেকে বাসা ফিরার সময় একটা চকলেট হলেও নিয়ে আসবো।
।।
কথা গুলো নিহার খুব বিরক্ত লাগতো, আর মূল্য হীন ও, কিন্তু এখন নিহা বুঝে, একটা চকলেট এর মূল্য কতো,
নিহার শ্বশুর বাড়ীর টাকার অভাব নাইই, অভাব হচ্ছে ওর স্বামীর সময়ের।
।।
বিয়ের পর নিহার পড়া শুনা বন্ধ হয়ে যায়, সংসার এর কথা ভেবে সেটা মেনে নেয়, কিন্তু এখন এই বাড়ী যেন একটা জেল খানা মনে হচ্ছে।
।।
আজ সত্যি সিমেলের ঐ কথা গুলো বড্ড বেশি মনে পড়ছে।।
কয়েক দিন পরের কথা!
নিহা গ্রামের বাড়ী বেড়াতে গেছে!
নিহার এক মামাতো বোন বলল, আপু কালকে কলেজ যাবেন? আমাদের কলেজে অনুষ্ঠান আছে, এমপি সাহেব আসবে।
নিহা ভাবলো অনেক দিন সে কলেজে যায় নি, এক বার ঘুরে আসতে ক্ষতি কি?
।।
নিহা আর ওর মামাতো বোন কলেজে বসে আছে, আজ নিহার অনেক ভালো লাগছে প্রায় ৮ বছর আগে সে এই কলেজ ছেড়ে চলে গেছিলো।।
অনুষ্ঠান শুরু হলো!
নিহার মামাতো বোন বলল,
সিমা- আপু ঐদিকে দেখো, উনি আমাদের গণিত টিচার, অনেক ভালো এবার মনে হয় ওনার গনিতের ওপর পিএইচডি করা শেষ হলো।
নিহা- তো পিএইচডি করে এই গ্রামে পড়ে থাকবে কেন?
সিমা-কি জানি? আমাদের স্যার টা অনেক ভালো এই দুই বছরে ১৩২ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন অংকে ফেল করেছে,
অথচ এর আগের বছরই ফেল করে ২৫ জন। উনি আবার প্রাইভেট পড়ান না। যার সমস্যা আছে সে কলেজের শেষে বুঝে নেয়, সেটাও ফ্রি।
।।
একটু পর এমপি সাহেব স্টেজে এসে কথা বলা শুরু করে সাথে অনেক জন কে প্রাইজ। অবশেষে উনি নাম ধরে ডাকলেন সিমেল আহমেদ।
নিহা চমকে গেলো নামটা শুনে।
নিহা- এই সিমা তোর স্যারের বাড়ী কোথায় রে?
সিমা- ঐ তো বাজারের ঐ পাশে।
নিহা বুঝে যায় এটা সেই সিমেল।
।।
এমপি সাহেব- সিমেল! আপনাদের সবার পরিচিত একজন মানুষ! সিমেল আমার ছেলের মতো।
দুই বছর আগে ও এই কলেজে এসেছিলো খণ্ড কালীন শিক্ষক হিসাবে কিন্তু ওর ব্যাবহার আর জ্ঞানের
যে পরিধি ওতে আমাদের কলেজের যে উন্নতি হয়েছে সেটা আমারা সবাই জানি, বিগত বছরে আমাদের কলেজের রেজাল্ট
যে ভালো হয়েছে সেটা আমারা সবাই জানি, এই উপলক্ষে সিমেলকে তার চাকুরী স্থায়ী করা হলো।
।
আপনারা হয়তো অনেক কেই জানেন না যে উনি পিএইচডি কমপ্লিট করলেন, আমি ওনাকে বলেছিলাম যে সে কি ঢাকা চলে যাবে?
নাকি অন্য কোথাও যাবে? সে বলল, আমি গ্রামে থাকতে চাই, আপনি আমার চাকুরী স্থায়ী করে দিলেই আমি খুশী হবো।
আমি ওনার কথা শুনে শক খেলাম, যেখানে আমারা সবাই নিজের চিন্তা নিয়ে ব্যাস্ত আর উনি সবার চিন্তা করছে।
।।
এই সাথে আপনাদের আরেকটা ভালো খবর আছে, আমার ছোট ভাইয়ের এক মাত্র মেয়ের সাথে সামনে সপ্তাহে সিমেলের বিয়ে হবে।
এমন একটা সোনার টুকরা ছেলেকে জামায় হিসাবে পেয়ে আমরা সত্যি অনেক গর্বিত। সামনে শুক্রবার আপনাদের সবার দাওয়াত থাকলো।
আমি দু কথা বলার জন্য সিমেল কে এখানে আসতে অনুরোধ করছি।
।।
সিমেল- আসসালামুআলাইকুম… এমপি সাহেব আমার বাবার মতো, আর বাবা কখন ও ছেলের নামে খারাপ কিছু বলবে না,
আমি যে অনেক ভালো তা না, প্রত্যেক মানুষ ভালো খারাপ দুই দিক নিয়েই গঠিত, আমার যারা ছাত্র আছে আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই,
জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট আসবে। কিন্তু কখনও ভেঙ্গে পড়লে চলবে না, পাওয়া না পাওয়ার মাঝেই আমাদের জীবন,
চাইলেই আমরা যে সব পাবো সেটা কিন্তু না, আজ হয়তো যেটা না পেয়ে কান্না করছেন, ভাবছেন আমার সব কিছু শেষ।
আল্লাহ্ হয়তো এর চাইতেও বড় পুরষ্কার আপনার জন্য রেখেছে। তাই অপেক্ষা করতে হবে, আর চেষ্টা করে যেতে হবে। সফলতা আসবেই।
।।
আর সব থেকে বড় কথা, লোভ করলে আপনি কখনও জীবনের লক্ষ্যে পৌছাতে পারবেন না। যে কোন সম্পর্কে টাকার চাইতে ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিবেন।
যদি সম্পর্ক টা শুধু টাকার ওপর নির্ভরশীল থাকে তবে সে সম্পর্ক একটা মরুবালির ফাঁদ।
জীবন এমন ভাবে তৈরি করুণ যেন আপনি সব কিছু দিতে পারেন। তাহলে জীবন অনেক সুখের হবে।
সিমা- কথা গুলো আপু জানো কাদের উদ্দেশ্য করে বলল?
নিহা- কাদের?
সিমা- আমাদের কলেজের মেয়েদের, কারণ অনেক মেয়েই স্যারকে পছন্দ করে। আর করবেই না কেন এতো ভালো মানুষ উনি।
কাল দেখবা আপু অর্ধেক মেয়ে কলেজে আসবে না। সবাই বাড়ীতে বসে কান্না করবে।
নিহা আর কিছু বলল না, কিছু বলার নাই সুখে থাক সিমেল, অবশ্য আমি চাইলেও সে সুখে থাকবে।
।।
সিমা- চলো আপু, বাড়ী যায়।
নিহা- হ্যাঁ চল।
..
নিহা তার স্বামীকে ফোন করে!
আতিক- কি ব্যাপার! বার বার বিরক্ত করছো কেন? আমি ব্যাস্ত আছি। এখন ফোন রাখো।
নিহা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আতিক ফোনটা কেটে দিলো।
অজান্তেই নিহার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো।
সিমা- কি হলো আপু? কাঁদছো কেন?
নিহা-কিছু না চল, বাড়ী।
…………………………………….সমাপ্ত…………………………….