সেক্রিফাইস

সেক্রিফাইস

হঠাৎ করে কাঁচ ভাঙ্গা শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি নীলা মায়ের শখের এক জোড়া কাপ ভেঙ্গে ফেলল। কাঁচের শব্দ শুনে মাও ছুটে আসলেন। বেশ রেগে গেছে আম্মু। নিয়মমাফিক কিছুক্ষন বকাঝকা করলো। এজন্য নীলা ভয়ে চুপসে গেছে। ছলছল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় যেন বলতে চাই, আসলে আমি কাপটা ইচ্ছে করে ভাঙ্গিনি, হাত ফসকে পড়ে গেছে। এক প্রকার অসহাত্ব ফুঠে উঠেছে মুখে। জানি আজ সারাদিন ঘরের মধ্যে একটা ছোট খাটো সাইক্লোন বয়ে যাবে।

আম্মুকে শান্ত করার উদ্দেশ্য বললাম- আম্মু আসলে কাপটা নীলা ভাঙ্গেনি। ওটা আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি কালকেই আপনার জন্য একসেট দামী কাপ নিয়ে আসবো। এই বিষয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি? যেটা ভেঙ্গে গেছে সেটা কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব। আম্মু যেন কেমন অদ্ভুদ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, পরে লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন। নীলার মুখে কিঞ্চিত হাসি ফুটলো। আমার কাঁদে হাত রেখে মুখোমুখি এসে বলল- আপনি আমার দোষটা আপনার গাড়ে নিলেন কেনো?

আমি: ভালোবাসি যে তাই।

নীলা: আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেনো?

আমি: আরো ভালোবাসবো যদি তুমি আমায় আপনি না ডেকে তুমি বলে ডাকো।

নীলা: আমার তো লজ্জা করে।

আমি: স্বামী স্ত্রী মাঝে কোনো লজ্জা থাকতে নেই। তুমি আমাকে তুমি বলেই ডাকতে পারো অনুমতি দিলাম।

নীলা: জ্বী চেষ্টা করবো।

তার কপালে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দিলাম। মেয়েটি লজ্জায় মাথা গুটিয়ে নিলো। জীবনে একসাথে সুখী হতে হলে স্বামী স্ত্রী একে- অপরকে সেক্রিফাইস করা উচিৎ। তাহলে সম্পর্কটা আরো মধুর হয়। আম্মু একজন হার্টের রোগী প্রতিনিয়ত ঔষধ সেবন করতে হয়। আজ আম্মুর ঔষধ শেষ তাই আব্বু বাজারে গেলো ঔষধ আনতে। কিন্তু বাবার পকেটে কোনো টাকা ছিলো না। তাই বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে আসল। বাসায় এসে চুপি চুপি শুয়ে পড়ল। বিষয়টা আমি খেয়াল করলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সত্যি বাবার পকেটে কোনো ঔষধ নাই। রাতের খাবারে পর আম্মু ঔষধ সেবন করেন। আমি তড়িঘড়ি করে এই শীতের রাতে বাজারে চলে গেলাম। ঔষধ এনে বাবার পকেটে রেখে দিলাম। ঔষধ না পেলে আব্বু আম্মুর সামনে লজ্জাকর অবস্থায় পড়তো। পরেরদিন বাবার মুখে যে আনন্দের হাসিটা দেখলাম সেটা হয়তো আমি কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পারতাম না।

প্রিয়জন দের খুশি করতে দামী কিছু উপহার দিতে হয় না। একটু সেক্রিফাইস করলে অল্পতেই খুশি রাখা যায় বোনকে বলেছিলাম HSC তে এ+ পেলে একটা ল্যাপটপ কিনে দিবো। সত্যিই বোন আমার নিদারুণ প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে। বোন আবদার করেছে ল্যাপটপ কিনে দিতে। যেহেতু বলে ফেলছি দিবো তাই আর না করতে পারিনি। শখ করে মাটির ব্যাংক এ টাকা জমানো আমার ছোট বেলার অভ্যাস। যদিও এটা বাচ্ছা সুলভ আচরন তবুও এই অভ্যাসটা আমি ছাড়তে পারিনি। জমানো টাকা আর কিছু ধার করে বোনের জম্মদিনে একটা ল্যাপটপ উপহার দিয়েছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা অল্পতেই বেশী খুশি। সত্যিই বোন আমার সেদিন এতো খুশি হয়েছিলো যে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। এই ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে বেশী কিছুর প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন একটু সেক্রিফাইস।

বোনকে ল্যাপটপ কিনে দিলাম অথচ ভাইকে কিছু দিলাম না। এ নিয়ে সে কান্নাকাটি শুরু করলো। তার নাকি একটা মোবাইল লাগবে। নতুন কলেজে উঠেছে সবার হাতে মোবাইল কিন্তু তার হাতে মোবাইল নেই। এজন্য মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো। পরিবারের ছোট ছেলে মেয়ে গুলো একপ্রকার জেদী হয়ে থাকে যা চাই তা দিতেই হবে। সংসারের টানপোড়ন আর কিছু ধার দেনার কারনে হাতে কোনো টাকা নেই। তাই নিজের সদ্য কেনা মোবাইল টা ভাইকে দিয়ে দিলাম। মোবাইল পেয়ে ভাই খুশিতে আটখানা। নতুন একটা জামা কিনলে ভাইয়ের চোখে সুন্দর লাগলো তো সেটাও ভাইয়ের দখলে। না করার কোনো অপশন থাকে না। আমারই তো ভাই। ভাইয়ের খুশি মানে আমার খুশি।

জীবনে সুখী হতে হলে সবার সাথে একটু সেক্রিফাইস করে চলতে হয়। একবার আম্মুর জরায়ুতে একটা প্রবলেম হয়েছিলো। যার কারণে ডাক্তার বলল- আম্মু অপারেশন করাতে হবে। যার জন্য ৫-৬ ব্যাগ রক্ত লাগবে। কারণ একজন সুস্থ মানুষের রক্তের হিমোগ্লোবিন এর মাত্রা থাকে ৯-১১ পয়েন্ট সেখানে আম্মুর রক্তের হিমোগ্লোবিন মাত্র ৫ পয়েন্ট। একে তো আম্মু রক্তশূন্যতায় ভুগছেন তার উপর অপারেশন। এজন্য অপারেশনের আগে ৪ ব্যাগ ও পরে ২ ব্যাগ রক্ত ডোনেট করতে হবে। জরুরী মূহুর্তে ৬ ব্যাগ রক্ত পাওয়া আসলেই কষ্টসাধ্য। কাকতালীয় ভাবে আম্মুর রক্তের গ্রুপ আর আমার রক্তের গ্রুপ মিলে গেছে।(এ+)

তাৎক্ষনিক আমি আম্মু কে এক ব্যাগ রক্ত ডোনেট করি। যদিও আম্মু বারবার নিষেধ করছেলো রক্ত না দেওয়ার জন্য। পৃথিবীর সব মায়েরাই এমন নিজে মারা যাবে তবুও সন্তানের ক্ষতি হতে দিবে না। অপারেশনের পর এক ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করতে পারিনি। অবশেষে আমি নিজেই বাধ্য হয়েই ৬দিন পর আরেক ব্যাগ রক্ত ডোনেট করি। যদিও এটা ঠিক না। ডাক্তারা নিতে চাই নি, আমি জোর করাতে আর বাঁধা দেয়নি। (এক্ষেত্রে আপনার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে আপনি ২ব্যাগ রক্ত দিতে পারবেন তবে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়বেন) রক্ত দেওয়ার পর আমি এক সপ্তাহ অসুস্থ ছিলাম। আম্মু সুস্থ হওয়ার পর বাসায় ফিরে যখন শুনল- আম্মু কে দুইব্যাগ রক্ত ডোনেট করেছি, তখন আমার দিকে তাকিয়ে আম্মু নির্বাক, চোখ দিয়ে দুফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল।

আম্মু বলল: তুই কেনো আমাকে দুইব্যাগ রক্ত দিতে গেলি বাবু। যদি তোর কিছু হয়ে যেতো।

আমি কেবল একটু মুচকি হাসলাম। এমন হাজারো সেক্রিফাইস করতে হয় প্রিয়জনের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য। নীলা আজকে খাবারে লবন বেশী দিয়ে ফেলছে। যার কারণে খাবার মাত্রাতিরিক্ত লবনাক্ত হয়ে গেছে। কিছু বললাম না। চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে আসলাম। কিছুক্ষন পর নীলা রুমে এসে চেঁচাচ্ছে,

আমি: কি হয়েছে নীলা এতো জোরে ডাকছো কেনো।

নীলা: তার আগে বলো আজকে রান্না এতো বাজে হয়েছে যে মুখে দেওয়া যাচ্ছে না অথচ তুমি চুপচাপ খেয়ে চলে আসলে একটু প্রতিবাদ ও করলে না কেনো মিরাজ।

আমি: এতে প্রতিবাদ করার কি আছে। তুমি প্রতিদিন কতো কষ্ট করে রান্না করো। দুই একদিন ভুল হতেই পারে স্বাভাবিক।

আমি তোমাকেও ভালোবাসি তোমার ভুলত্রুটি গুলোও ভালোবাসি। তাই প্রতিবাদ করার প্রয়োজন মনে করিনি। যে মেয়ে রাতজেগে না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে তার জন্য তো এতোটুকু সেক্রিফাইস করতেই পারি তাই না। নীলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হয় কেঁদেই ফেলবে। হুমড়ি খেয়ে আমার বুকে এসে পড়ল। বলল- পাগল একটা।

আমি: তোমার মুখে এই পাগল শব্দটি শোনার জন্য আমি হাজারো পাগলামি করতে রাজি।

নীলা আমার হাত দুটি তার পিছনে দিয়ে বলল- আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমায়। আমিও পরম মমতায় জড়িয়ে নিলাম আমার আদুরিনীকে। সত্যিই জীবনে সুখী হতে হলে বেশী কিছুর প্রয়োজন হয় না। প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য একটু সেক্রিফাইস ই যথেষ্ঠ। জীবন মানেই সেক্রিফাইস। আর সেক্রিফাইস মানেই সুখ।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত