নীল বিষাদের শব্দ

নীল বিষাদের শব্দ

— তোমার কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?

— আমার বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি?

— সেদিন যে দেখলাম জুয়েলার্সের দোকানে গিয়ে গহনার ট্রায়াল দিচ্ছিলে।

— ওমা গহনার ট্রায়াল দেয়া মানেই বুঝি বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া?

— না আমি তা বলিনি। তবে বিয়ে না হলে এমন ঘটা করে পরিবারের লোকজন নিয়ে গহনার দোকানে সচরাচর কেউ যায়না।

— আপনার এই ধারনাটা মিলে গেছে। আমার এক কাজিনের বিয়ে আগামী মাসে। তাই গিয়েছিলাম সেখানে। কাজিনের ট্রায়াল দেয়া শেষ হওয়ার পর আমার ইচ্ছে হচ্ছিল গহনাগুলো পরে নিজেকে আয়নায় দেখতে কেমন লাগে তা দেখার।

— তা কেমন দেখলে নিজেকে?

— মনে হচ্ছিল স্বর্গের পরী মাটিতে নেমে এসেছে।

— ওওওওও!

— আচ্ছা আপনি কি সেখানে ছিলেন?

— আমি দোকানের বাইরে ছিলাম। যাচ্ছিলাম টিউশনে। তখনই দেখলাম তোমাকে।

— আমাকে ডাক দিলেন না কেন? ডাক দিলেই তো পারতেন।

— সেই অধিকার তো হারিয়ে ফেলেছি। কোন মুখে ডাক দিতাম? তোমার পরিবারের লোকজনও তো ছিল।

— অধিকার ফিরে পেতে ইচ্ছে হয়না?

— কিছু কিছু অধিকার ফিরে না পাওয়াটা দুই পক্ষের জন্যই মঙ্গলের।

কিছুক্ষন নিরবতা। কেউ কিবোর্ডে আঙ্গুল ছোঁয়াচ্ছে না। তিনটা বিন্দু উঠানামা করছে না আর। ছেলেটা তাকিয়ে থাকে। ভাবতে থাকে কি লিখবে। মেয়েটাও ভাবতে থাকে।

— আচ্ছা যদি শুনতেন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তবে কি করতেন?

— কিছু করার অধিকারটাও তো নেই। কিছুই করতাম না। শুধু অপেক্ষা করতাম।

— কিসের জন্য অপেক্ষা করতেন?

— দামি কাগজে ছাপা তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের। কি নিমন্ত্রণপত্র দিবে না আমাকে?

মেয়েটার চোখে জল জমতে শুরু করে। ভাগ্যিস ভার্চুয়ালে কেউ কারো চোখের জল দেখতে পায় না। নয়তো মেয়েটাও দেখতো ছেলেটার চোখ চকচক করছে। মেয়েটা ছলছলে চোখে লিখতে শুরু করে,

— হ্যা হ্যা অবশ্যই দিব। আমার বিয়ের প্রথম নিমন্ত্রণপত্রটা আপনিই পাবেন।

— সত্যিই বলছো নাকি মন রাখার জন্য বলছো?

— আপনার মন রাখার জন্য বলবো কেন? সত্যিই বলছি।

— নিমন্ত্রণপত্র পেয়েও যদি না আসি তবে?

— আপনি আসবেন আমি জানি। আপনাকে যে আসতেই হবে।

— তুমি কি ভেবেছো? বিয়ে বাড়ির মুখরোচক খাবারের লোভে আমি আসবো তোমার বিয়েতে?

— খাবারের প্রতি আপনার লোভ কখনোই ছিলনা এটা আমি জানি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কতো এখন?

— সতেরো কোটি।

— এই সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে আমার জানামতে আপনিই একমাত্র মানুষ যে কিনা বিরিয়ানি পছন্দ করে না। যে মানুষ বিরিয়ানি পছন্দ করে না সেই মানুষ যে খাবারের লোভে আমার বিয়েতে আসবে না তা আমি জানি।

— তবে? তবে তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি তোমার বিয়েতে যাবো?

ছেলেটার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। মোবাইলের স্ক্রীন কাজ করছে না। কারণ দুইফোটা জল যে মোবাইলের স্ক্রীনেও পড়েছে। অপরপাশের মেয়েটার নামের পাশে জ্বলতে থাকা সবুজ বাতি হঠাৎ নিভে গেল। ছেলেটা তবুও তাকিয়ে থাকে রিপ্লাই পাবার আশায়। কয়েকমূহুর্ত পর মেয়েটার কাছ থেকে রিপ্লাই আসে।

— চাকরি পেয়েছেন?

— এখনো পাইনি। তবে আজ একটা ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম। বললো তিনলাখ হলে চাকরি হয়ে যাবে। ভাবছি তিনলাখ টাকায় চাকরিটা কিনে নেয়াই ভাল হবে।

— এত টাকা কোথায় পাবেন?

— জানি না। তবে যেভাবেই হোক ব্যাবস্থা করবো। মাঝে মাঝে জানো আমার খুব হাসি পায়।

— হাসি পায়? কিন্তু কেন?

— ছোটবেলায় একটা ছড়া পড়েছিলাম না আমরা? পড়ালেখা করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে! এই ছড়াটার কথা মনে পড়লে হাসি পায়।

— হাসি পায় কেন?

— কারণ ছোটবেলা থেকেই ভুল শিখে বড় হয়েছি আমরা। ছড়াটা হওয়া উচিত ছিল এমন,

পড়ালেখা করে যে, সুইসাইড করে সে। পড়ালেখা করে যে, জুতোর তলা খোয়ায় সে। পড়ালেখা করে যে, ফাইল নিয়ে ঘোরে সে। পড়ালেখা করে যে, ভালবাসার মানুষ হারায় সে। মেয়েটা ছড়াটা পড়ে হাসে। সত্যিই তো ছোটবেলায় আমাদের মায়ের আমাদের ভুল ছড়া শুনিয়ে স্কুলে পাঠাতো, সন্ধ্যায় পড়তে বসাতো। মেয়েটা লিখে,

— চাকরি হয়ে গেলে আমাকে একটু জানাবেন?

— কেন নয়? আমার চাকরি হলে সবার আগে তুমিই জানতে পারবে। তবে ততদিনে হয়তো আমি মামা হয়ে যাবো।

— মামা হয়ে যাবেন মানে?

— তিনলাখ টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই এই চাকরিটাও হচ্ছে না। টাকা ছাড়া যতদিনে চাকরি জোগাড় করতে পারবো ততদিনে তোমার বিয়ে হয়ে দুই একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাবে। তো তখন তো তোমার বাচ্চারা আমাকে মামা বলেই ডাকবে।

মেয়েটা অনেকক্ষন ধরেই কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছিল। কারণ তার পাশেই তার ছোটবোন ঘুমাচ্ছে। কাঁদলে ছোটবোনের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু এখন আর নিজেকে সে আটকাতে পারছে না। ছেলেটাকে ব্লক করে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়। তারপর পাশ ফিরিয়ে শুয়ে নিরবে অশ্রুবর্ষন করতে শুরু করে। ছেলেটা ততক্ষনে কিছু একটা লিখে পাঠাতে গিয়ে বুঝতে পারে যে মেয়েটা তাকে ব্লক করেছে।

ছেলেটা মোবাইল রেখে দিয়ে কাগজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কালকে একটা ইন্টারভিউ আছে। এদিকে ছেলেটার মা বিছানায় কাতরাতে শুরু করে। ছোটবোন মায়ের মাথার পাশে বসে নিরবে কাঁদে। ছেলেটা বোনটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এতটুকু একটা মেয়ের মাথায় সংসারের সকল কাজের বোঝা চেপে গেছে। তারপর ছেলেটা চলে যায় বিছানায়। কালকে দশ তারিখ। বাড়িওয়ালা আসবে ভাড়া চাইতে। পকেটে বিশ টাকার একটা ছেঁড়া নোট ছাড়া কিছুই নেই ছেলেটার কাছে। মেয়েটা কিছুক্ষন নিরবে কাঁদার পর হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠে। মেয়েটার ছোটবোন ঘুম থেকে জেগে উঠে।

— আপু কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? মেয়েটা তখন সচকিত হয়ে চোখ মুছে ছোটবোনকে বলে,

— কিছু হয়নি আমার। তুই ঘুমিয়ে পড়। কালকে না তোর পরীক্ষা?

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত