ছোটবেলা থেকেই আমার উদ্ভট সব কাজ করার ইচ্ছে হতো। এই ইচ্ছেগুলো হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠতো আবার হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তো। তখন আমি ক্লাশ সেভেনে পড়ি। হঠাৎ একদিন ইচ্ছে জাগলো বিড়ালের খামার করবো। মানুষ হাঁস মুরগির খামার করে আর আমি করবো বিড়ালের খামার। ব্যাপারটা ভাবতেই মনের ভেতর কেমন যেন একটা উত্তেজনার আভাস পেতাম। তো খামার করতে হলে আগে তো বিড়াল পেতে হবে। কমপক্ষে পাঁচটা বিড়ালের বাচ্চা তো লাগবেই। তাই খোঁজাখুজি শুরু করে দিলাম বিড়ালের বাচ্চার। বন্ধুবান্ধব, এলাকার বড় ভাই আপুদের সামনে পেলেই জিজ্ঞেস করতাম,
— আপনাদের কাছে বিড়ালের বাচ্চা আছে? আমার কথা শুনে তারা হেসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতো,
— পাগলামী বাদ দে, যাহ ভাগ।
তাদের এসব কথায় কান দেয়ার সময় ছিল না। আমি খোঁজ করে যেতে লাগলাম। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম যে আমাদের পাড়ার নর্দমার মধ্যে নাকি একটা বিড়ালের বাচ্চা পড়ে গেছে। বাচ্চাটা নাকি ময়লা পানিতে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। এক মূহুর্ত দেরী না করে আমি ছুটলাম ঘটনাস্থলে। সেখানেই আমি প্রথম দেখি মিশুকে, নর্দমার পানিতে ভিজে একাকার। নর্দমার একপাশে একটুখানি শুকনো জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। বারবার তাকাচ্ছে উপরের দিকে। হয়তো আশায় ছিল কেউ একজন তাকে টেনে উঠাবে। কিন্তু এমন কেউ ছিলনা সেখানে তাকে সাহায্য করার জন্য। আমি আমার শার্টে ময়লা লাগিয়ে অনেক কষ্টে তাকে নর্দমা থেকে উপরে উঠালাম। ততক্ষনে তার অবস্থা খারাপ, এই মরে তো সেই মরে।
আমি দেরি না করে তাকে পলিথিনে ভরে সরাসরি আমাদের বাসার ছাদে নিয়ে গেলাম। সেটাই ছিল মিশুর আমাদের বাসায় প্রথম পদার্পণ। ছাদে নিয়ে তাকে গলায় রশি বেধে একটা জায়গায় শুইয়ে দিলাম যেখানে একটু রোদ আছে। তারপর চুপচাপ বসে রইলাম সেখানে এবং একটু পরপর সিঁড়ির দিকে তাকাতে লাগলাম। কারন আম্মু যদি দেখে যে আমি শার্টে ময়লা লাগিয়ে একটা নোংরা বিড়ালের বাচ্চার সামনে বসে আছি তাহলে তো আমাকে! আধাঘন্টার মধ্যেই মিশুর গায়ে লেগে থাকা পানি শুকিয়ে গেল। কিছুক্ষন আগেও মিশুকে দেখে মনে হয়েছিল যে এই বুঝি মরে গেল। কিন্তু এখন সে সর্বশক্তি দিয়ে গলায় বাঁধা রশিটাকে কামড়াতে লাগলো। এবার আমি নিচে নেমে গেলাম। ময়লা জামা পাল্টে আম্মুর কাছে গেলাম। আম্মু তখন রান্নাঘরে রান্না করছিল। আমি তখন আম্মুকে বললাম,
— আম্মু ফ্রিজে দুধ আছেনা?
— আছে। তুই দুধ দিয়ে কি করবি?
— দুধ দিয়ে মানুষ কি করে? আমি দুধ খাবো।
আমার কথা শুনে আম্মু চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকালো। কারন যেই ছেলে দুধ দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যায় সেই ছেলে আজকে দুধ খাওয়ার বায়না ধরছে?
— তুই দাঁড়া আমি দুধ নিয়ে আসছি।
আম্মু তারপর আমাকে দুধ গরম করে দিল। পুরো একগ্লাস গরম দুধ। আমি দুধ নিয়ে আবার ফ্রিজের ভেতর রেখে দিলাম।
— কিরে আবির দুধ আবার ফ্রিজে রাখলি কেন?
— মা এত গরম দুধ কেমনে খাবো? তাই ঠান্ডা করছি।
আম্মু আর কিছু না বলে রান্নায় মনযোগ দিল। আর আমি একটু পরেই একটা ছোট বাটি নিয়ে চলে গেলাম ছাদে। মিশু তখনও রশি নিয়ে টানাটানি করছে। আমি বাটিতে করে একটু দুধ তার সামনে রাখলাম। মিশু প্রথমে একটু ভয়ে ভয়ে বাটির সামনে আসলো। তারপর দুধের বাটি শুঁকলো। তারপর মজা করে দুধ খেতে শুরু করলো। এবার মিশুকে ঘরের ভিতর নেয়ার মিশন শুরু করলাম। প্রথমে রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম আম্মুর সাথে। সেদিন আম্মু মুরগি রান্না করছিল। আর আমি রান্না করা দেখছিলাম। হঠাৎ আমি চিৎকার করে উঠলাম,
— আম্মু ওই দেখো কতবড় একটা ইঁদুর দৌড় দিল। আম্মু আমার চিৎকার শুনে আমার দেখানো জায়গার দিকে তাকালো। তারপর কিছু দেখতে না পেয়ে বললো,
— কই ইঁদুর? আমি তো দেখছি না।
— এইখানেই তো ছিল। ইয়া বড় একটা ইঁদুর ছিল।
— হুম আমিও সেদিন দেখেছিলাম একটা। একটা বিড়াল থাকলে ভাল হতো।
— মা তাহলে একটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে আসি?
আমার কথা শুনে আম্মু হঠাৎ আমার কান চেপে ধরে একটা মোক্ষম মোচড় দিয়ে বসলো। আমি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলাম।
— ছাদের উপর বিড়ালের বাচ্চা রেখে এসে এখন আমাকে রান্নাঘরে ইঁদুর দেখানো হচ্ছে তাইনা? পিটিয়ে তোর ছাল তুলে আমসত্ব বানাবো বদ কোথাকার।
আমি আম্মুর এহেন কথা শুনে একেবারে বোকা বনে গেলাম। কিভাবে যে আম্মু ব্যাপারটা দেখে ফেললো বুঝতেই পারিনি। আম্মুকে বোকা বানাতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেলাম। আমি আর রান্নাঘরে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে ছাদে চলে গেলাম। ততক্ষনে মিশু দুধ শেষ করে সোজা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রথমে তো ভেবেছিলাম এই বুঝে মরেই গেল এবার। কিন্তু যখন দেখলাম ওর পেট উঠানামা করছে তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
— কিরে বিড়ালকে জীবনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখেছিস কখনো? যা এটার বাঁধন খুলে ঘরে নিয়ে ছেড়ে দে। খবরদার সারাদিন এই বিড়ালের বাচ্চার পেছনে পড়ে থাকবি না। তাহলে কিন্তু এইটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো।
আমি মিশুর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে এইটাকে কোথায় সরানো যায়। আম্মু হয়তো এখনি এসে মিশুকে ফেলে দেবে। হঠাৎ পেছন থেকে আম্মু কথাগুলো বলে উঠলো। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পরে আম্মুর কথা শুনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। দেরী না করে মিশুকে আমাদের দরজার সামনে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। মিশু ফুড়ুৎ করে দৌড়ে খাটের নিচে ঢুকে গেল। এটাই ছিল আমাদের ঘরে মিশুর প্রথম পদার্পণ।
প্রথম প্রথম মিশুর জন্য অনেক বকাঝকা শুনতে হয়েছে আমায়। কারণ প্রথম প্রথম মিশু অনেক জ্বালাতন করতো। এই যেমন আমরা খেতে বসলে মিশু ম্যাও ম্যাও করে আমাদের বিরক্ত করে তুলতো। এই আমার প্লেটে মুখ দেওয়ার চেষ্টা আবার আমার বোনের প্লেটে হামলে পড়া। মাঝে মাঝে চুরি করে খাবার খেয়ে ফেলতো।
কিন্তু ধীরে ধীরে মিশু আমাদের ঘরেরই একজন সদস্য হয়ে গেল। খাওয়ার সময় আমাদের বিরক্ত করতো না। চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকতো। আব্বু ওর জন্য একটা ছোট প্লেট কিনে এনেছিল। সেই প্লেটে তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে ওর সামনে দিতাম।
ও তখন খাওয়া শুরু করতো। মিশুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল আম্মু। আম্মু যখন আমাদের পড়াতে বসতো তখন মিশু এসে চুপচাপ আম্মুর কোলে উঠে বসে থাকতো। আম্মু নিজেও মিশুকে অনেক পছন্দ করতো। মিশুর সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল কারো পায়ের নড়াচড়া দেখলে লাফিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল কামড়ে ধরা। আমরা যখন খাটে পা ঝুলিয়ে বসে পা নাড়াতাম তখন মিশু এসে হঠাৎ পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়ো আঙ্গুলে আলতো করে একটা কামর দিয়ে আবার খাটের নিচে পালিয়ে যেত। প্রথম প্রথম আমরা মিশুর এই কান্ডে ভয় পেতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম এবং মাঝে মাঝেই মিশুর এই খেলা উপভোগ করতাম। আমার আব্বু যখন বাইরে থেকে বাসায় আসতো তখন ঘরে ঢুকে মিশুকে ঘরে না দেখলেই জিজ্ঞেস করতো,
— কিরে আবির মিশু কই?
অর্থাৎ মিশুকে কিছুক্ষনের জন্য না দেখলে ঘরের সবাই কেমন যেন অস্তির হয়ে যেতাম। এভাবেই মিশু আমাদের ঘরের একজন হয়ে উঠলো। একদিনের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। সেদিন একজনের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল। তো আমরা মিশুকে রেখে দাওয়াত খেতে গেলাম। খাওয়ার সময় হঠাৎ আম্মু আব্বুকে বলে উঠলো,
— এই আমরা সবাই তো এখানে মুরগির রোষ্ট খাচ্ছি, কিন্তু মিশুকে তো ঘরে আটকে রেখে আসলাম। আমরা ভালমন্দ খেলাম কিন্তু মিশু খাবেনা সেটা কেমন দেখায়?
আম্মুর কথায় আব্বু মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। তারপর খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষে আমরা যখন বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম তখন দেখতে পেলাম আম্মুর হাতে একটা টিফিন বাটি। আম্মুকে জিজ্ঞেস করতেই আম্মু বললো,
— বারে তোরা গরুর মাংস মুরগির রোস্ট খেলি আর তোদের মিশু ডালভাত খাবে তা কিভাবে হয়? তাই চেয়ে নিয়ে আসলাম মিশুর জন্য।
এবার বুঝতেই পারছেন মিশুর গুরুত্ব কতটা ছিল আমাদের কাছে। এভাবেই মিশু বেড়ে উঠতে লাগলো আমাদের মাঝে। সবকিছুই ভাল চলছিল। হঠাৎ একটা ঘটনায় সবকিছু বদলে গেল। সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। মিশু ঘরে নেই। আমি আর আমার বোন অস্থির হয়ে ছিলাম মিশুর ফেরার অপেক্ষায়। আম্মুকে বলতেই আম্মু বললো,
— ছাতা নিয়ে গিয়ে দেখ রান্নাঘরে চুলার নিচে গিয়ে বসে আছে কিনা।
আমি আম্মুর কথায় কালবিলম্ব না করে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। কিন্তু সেখানে মিশু ছিলনা। তারপর একে একে সম্ভাব্য কয়েক স্থানে মিশুকে খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। তখন হঠাৎ মনে হলো বাদলদের বাসায় একবার খুঁজে আসি। কারন বাদলদের বাসায়ও একটা বিড়াল আছে। মিশু মাঝে মাঝেই সেখানে যায়। তাই আমিও বাদলদের বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।
বাদলদের বাসায় যেতে দুই মিনিট লাগে। রাস্তার অপরপাশেই বাদলের বাসা। বেশিদূর যাওয়ার দরকার হলো না। রাস্তার কাছাকাছি গিয়েই মিশুকে পেয়ে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে শুয়ে আছে, মাথা থেতলে গেছে পুরোপুরি। বোধহয় কোন গাড়ির চাকা চলে গিয়েছে ওই ছোট্ট মাথার উপর দিয়ে। আমি ছাতা ফেলে দৌড়ে বাসায় এসে আম্মু আর আব্বুকে মিশুর কথা বললাম। আম্মু আর আব্বু এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতেই বেরিয়ে গেল। তারপর তারাও মিশুকে দেখলো। আমাদের মিশু মারা গেছে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের জন্য। এই ঘটনার পর টানা একসপ্তাহ আমাদের ঘরে একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করেছিল। আম্মু আর আমার ছোটবোন একটু পরপরই মিশুর জন্য কাঁদতো, আমিও কাঁদতাম। আমার আব্বু একটু শক্ত টাইপের মানুষ। তাকেও দেখেছি মনমরা হয়ে বসে থাকতে। একদিন আব্বু আম্মুকে বললো,
— এভাবে কেঁদে আর লাভ কি? মিশু তো আর ফিরে আসবে না। আল্লাহর দেয়া প্রাণ আল্লাহ হয়তো এভাবেই নিয়ে যাওয়ার ফয়সালা করে রেখেছিল। আব্বুর কথা শুনে আম্মু সেদিন বলেছিল,
— আমার কাছে কেমন লাগছে জানো? মনে হচ্ছে আমার কোল থেকে আমার সন্তানকে নিয়ে গেছে কেউ।