জেরিন — ওই কই তুই
রিয়াজ– এইতো বাসায়,তুই কই
জেরিন — বাসায়
রিয়াজ — কলেজে আসবিনা?
জেরিন — হুম,তুই আসবিনা?
রিয়াজ — রেডি হচ্ছি
জেরিন — ওকে আয়,আমিও রেডি হতে যাচ্ছি।
( একটু আগে যারা আলাপন করছিলো,ওদের সাথে আগে পরিচিত হয়ে নিন। রিয়াজ আর জেরিন একই কলেজে পড়ে,তার চেয়ে বড় কথা,দুজনই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ছেলে মেয়ে হলেও,ওদের বন্ধুত্ব কলেজের সবার চোখ জোড়ায়। ওরা না অন্য কারো সাথে মিশে,আর না অন্য কাওকে মিশতে দেয়।সেই ষষ্ট শ্রেনি থেকেই তাদের এই সম্পর্ক। রিয়াজ মনে মনে জেরিনকে পছন্দ করলেও,কখনো সাহস হয়নি বলার। বললে যদি ওদের এই মধূর সম্পর্কটাই শেষ হয়ে যায় সেই ভয়ে। প্রতিদিন কলেজের সময় হলে একজন একজনকে এভাবে কল দিয়ে প্রস্তুত করায়। আজকেও ঠিক তাইই হলো। রিয়াজ আজকে একটু প্রস্তুতি নিচ্ছে জেরিনকে কোনো এক ভাবে পটাবে। যদি সফল হয়,তবে তো কথাই নেই। কলেজে আসতেই রিয়াজ খেয়াল করলো জেরিন বসে আছে,কলেজের সামনে থাকা মাঠের এক কোনায়। দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে বসেই রিয়াজ বলল)
— কিরে, মন খারাপ নাকি
— না
— চুপ করে বসে আছিস কেন
— এমনিই
— কেও কিছু বলছে?
— না
— তো মুড এমন প্যচার মতো করে রাখছিস কেন
— তাতে তোর কি
— ওরে,আমার লক্ষী সোনাটা রাগও করতে জানে দেখছি।
— শুন রিয়াজ, মন মেজাজ খারাপ আছে। সর এখান থেকে।
— কি হয়েছে বলবি তো নাকি
— হয়নি কিছু
— তো মন খারাপ কেন
— এমনিই
— দেখ জেরিন,এবার কিন্তু রাগ হচ্ছে
— তো আমার কি।ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।আমি গেলাম।
( এ বলেই জেরিন চোখের সামনে থরথর করে চলে যায়। থরথর মানে,ওর যখন রাগ হয়,তখন পুরো শরীর কাপে।হয়তো কোনো কারণে মন খারাপ।যাইহোক, পরে শুনে নিবো।আমিও ক্লাসের দিকেই যাচ্ছিলাম।কিন্তু হটাৎ শুনতে পেলাম, আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের একটা ছেলে অন্য একজনকে বলছে)
— দোস্ত, আজকে জেরিনকে যেভাবে insult করেছিস।আমি তো পুরাই অবাক
— হা হা হা,বুঝতে হবে,আমার নামও তানিম।
— কিন্তু দোস্ত, মেয়েটি তো নিরপরাধ ছিলো।
— তোর গাল লাল করে ফেলবো।আমি মেজাবিনকে প্রফোজ করেছি,তাকে পটিয়েছি, কতো টাকাও খরচ করেছি, এখন ডেটিং করতে যাবো, কিন্তু সব ওই জেরিন এসে শেষ করে দিলো,এইটা অপরাধ না তো কি
— হুম আমি মানছি তোর কথা।কিন্তু তুই তো মেজাবিনের সাথে সহবাস করে, তাকে ছেড়ে দিতি।জেরিন তাকে বাচিয়েছে।এইটা তো ভালই হয়েছে।
— ওই ব্যাটা,জেরিনের বাপ কি আমাকে টাকা দিয়েছিলো? তখন বলতে পারেনি? এখন কেন বলছে।শাস্তিও কম দেইনি।সবার সামনে পায়ে পা মেরে নিছে ফেলে দিয়েছি। আহা,কি বেইজ্জতিটাই না হলো।
— হা হা হা হা
( কথাটা শুনে মাথার রাগ ১০০ তে ১০০। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে,অথচ জেরিন না বলেই চলে গেলো? তবে এই তানিমকে তো ছাড়ছিনা।আমি ওদের পিছনে গাছের আড়ালে ছিলাম।সেখান থেকে বের হয়ে সোজা তানিমের কলার ধরে, ইচ্ছেমত নাকে আর মুখে ঘুষি মারতে লাগলাম।ওর সাথে যে ছিলো,সে ছাড়াতে এসে কয়েকটা ঘুষিও খেয়েছে।এরপর লোড নিতে না পেরে সে সরে যায়।আমি তানিমকে মারতে মারতে নিছে ফেলে দি,এরপর সেখানে রেখেও ইচ্ছেমত মেরেছি। ওর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। কলেজের অনেকে এসে আমাকে ছাড়াতে যাচ্ছে,কিন্তু গায়ে এতো রাগ ছিলো যে,সবাইকে ধাক্কা দিয়ে আমি তানিমকে মারছিলাম।তানিম মার খেয়ে হাদা হয়ে গেছে। এমন সময় দূর থেকে জেরিন চিৎকার দিয়ে বলল)
— ওই রিয়াজ,কি করছিসটা কি।
( আমি ওর ভয়েস শুনেও না শুনার ভান করে তানিমকে মারছিলাম। জেরিন এসে আমাকে ধরে তুলে নিয়ে যায়।অবশ্য জেরিনকে তো ধাক্কা দিয়ে সরাতে পারিনা।তাই সরে আসলাম।তানিম মাটিতে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্তায়। জেরিন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় কলেজের গেটের সামনে।)
— তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? ওকে এভাবে মারলি কেন
— ঠাসসসসসসসসসসসসসসসস ( জেরিনের গালে কষে এক থাপ্পড় । জেরিন গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
— তুই আমাকেও মারলি..?
— তো কি আদর করবো? তানিম এতো বড় একটা কাজ করে ফেলেছে।আর তুই আমাকে না বলেই এড়িয়ে গেছিস? এই তুই কি আমাকে আপন ভাবিস?
— তোকে বললে তো তুই তাকে মারতে যাইতি,সে ভয়ে বলিনি
— একবারে আরেকটা থাপ্পড় দিমু তোরে কুত্তি। তোর গায়ে হাত দেওয়ার সাহসটাও কারো নেই,আর ও তোকে ফেলে দিয়েছে,কি ভাবছিস,আমি তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো?
— কেন,আমার জন্য তোর এতো টান কেন
— ভালোবাসি তাই…… 😡
( ইসস, কি বলে ফেললাম,জেরিন আমার কথাটা শুনে কি করে আল্লাহ জানে।মনে মনে ভয়ে আমি শেষ। ভাবছি, এখন হয়তো আমিই উল্টো ২ টা থাপ্পড় খাবো। উফফ,আমার মুখে কি কোনো কথা বাজে না..? নিরবতা ভেঙে জেরিন বলল)
— শুন রিয়াজ,আজ থেকে আমাকে আর ফোন দিবিনা।আজ থেকে আমার সাথে কথাও বলবিনা।তোকে আমি চিনিনা আর।
— আরে কি বলছিস, আমার কি হবে তাহলে,আমি থাকবো কিভাবে তোকে ছাড়া ( জেরিনের দুই গালে হাত দিয়ে কথাটা বললাম।জেরিন আমার হাত ছাড়িয়ে বলল)
— তোকে আমি ভালো বন্ধু ভেবেছি, এভাবে যে তোর মন মানসিকতা করে রেখেছিস,তা আমার জানা ছিলোনা। বায়
( জেরিন কথাটা বলে হেটে কলেজের ভিতর চলে যায়। কলেজে সবাই আমাকে ভয় পায়,তাই ভয়ে কিছু করেনি । আমি কলেজে না গিয়ে চোখের কোনে অশ্রুজল নিয়ে সোজা বাসার দিকে চলে আসলাম। পুরোটা পথ কান্না করতে করতে চলে গেছে আমার।
তো এই হচ্ছে রিয়াজের প্রেম কাহিনী। এতোদিন ধরে যে ভয়টা সে পেয়ে এসেছে,সে ভয়টাই আজ প্রকাশ পেলো ওর সামনে। আজ ৮ বছরের রিলেশন হটাৎ ভেঙে গেলো। তাও জেরিন নিজের মুখে বলে দিয়েছে।রিয়াজের চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। চোখমুখ লাল হয়ে যায় কস্টে। কোনো ভাবে সে বাসায় এসে, ব্যগটা টেবিলের উপর ছুড়ে মেরে বিচানায় শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন জেরিন কলেজে এসে দেখে রিয়াজ কলেজে আসেনি। জেরিন আসলে কাল কথাগুলো এমনি এমনি বলেছে।জেরিন যে রিয়াজকে ভালোবাসে না তা নয়, কিন্তু ওদের প্রথম দেখা হয়েছিলো ১৩ই ফেব্রুয়ারিতে। এখন সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ।তাই সে কালকে এমন ভাবে বলেছে,কারণ জেরিন চায়, ১৩ই ফেব্রুয়ারিতে সে নিজেই রিয়াজকে প্রফোজ করবে। জেরিন রিয়াজকে কলেজে না আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়। কিন্তু ভেবে নিয়েছে,হয়তো রাগ করে আসেনি।যাইহোক, জেরিন নিজেও ভেবে নিয়েছে, একেবারে ১৩ তারিখে রিয়াজকে প্রফোজ করবে কলেজের সবার সামনে।আজ ৮ বছর রিয়াজ জেরিনের খেয়াল রেখে এসেছে।প্রতিটি কাজে কর্মে হেল্প করতো।
একদিন ঘটেছিলো এক বিরাট কাহিনী। জেরিন কলেজে আসার পথে একটি ছেলে জেরিনকে “মাল” বলেছিলো। জেরিন রিয়াজকে ব্যাপারটা জানায়। শুনা যায়, সেই ছেলেটি নাকি ১ মাস হসপিটালে বিশ্রামে গিয়েছিলো।রিয়াজ এমন ভাবেই মেরেছে যে ছেলেটির উঠে দাড়াবার শক্তি ছিলোনা।এভাবে আরো কয়েকটি ঘটনাই আছে, জেরিনকে কেও কিছু বললে রিয়াজ তাকে হসপিটালের মুখ দেখিয়ে ছাড়ে।
কোনো এক মধূময়ী বিকেলে, ঠান্ডা গরম মিশ্রিত পরিবেশে জেরিন আর রিয়াজ ফুচকা খাচ্ছিলো,সেদিন রিয়াজকে একটা সাপ কামড় দিয়েছিলো।যা দেখে জেরিন প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলো। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়ে রিয়াজকে সুস্থ করে তুলে জেরিন।নামাজের প্রতি ওয়াক্তেই রিয়াজের জন্য দোয়া করে জেরিন।
কিন্তু আজ কলেজে রিয়াজকে না দেখে জেরিনের মনে হলো কয়েক বছর থেকেই সে রিয়াজকে দেখেনি। মনে হবেওনা বা কেনো,ওরা যে প্রতিদিনই দেখা করতো।শুক্রবার দিনেও তারা এক নজরের জন্য হলেও দেখা করতো।তবে সেটা ছিলো বন্ধুত্বের। ভালোবাসায় পরিণত হতে গিয়েই আজ এই অবস্তা।যাইহোক, জেরিন হচ্ছে আবার এক ঘুয়ে, সে যা বলবে তাইই করবে।রিয়াজ কোনোদিন জেরিনকে অভাব বুঝতে দেয়নি। যখন যা চেয়েছে,সেটাই করেছে। তাই হয়তো জেরিন ফিল করতে পারেনি অভাব জিনিসটা কি। আজ বুঝেও না বুঝার ভান করে চলতে হচ্ছে। এর কারণ একটাই, জেরিন যে এক ঘুয়ে..।
পরেরদিন সকালেও রিয়াজ কলেজে আসেনি। জেরিন এবার বেশ অবাকই হলো। নিজের ফোন বের করে জেরিন রিয়াজকে ফোন দেয়। কিন্তু রিয়াজের ফোনটাও অফ। এখানে আরো একটি অদ্ভুত ঘটনা আছে। জেরিন আজ অব্দি রিয়াজের পরিচয় জানতে চায়নি। রিয়াজ জেরিনের ১৪ গোস্টির সবাইকেই চিনে। এইটা বললে হয়তো কম হবে,জেরিনের বাসার ভাতের পাতিল কোথায় থাকে,সেটাও রিয়াজের মুখস্থ। রিয়াজ এই অব্দি প্রায় ৪০-৪৫ বার জেরিনের বাসায় গিয়েছিলো,কিন্তু জেরিন আসেনি। জেরিনের আম্মু রিয়াজকে খুবই পছন্দ করতো,মনে মনে হয়তো ভেবেও নিয়েছিলো যে,তার মেয়ের জামাই রিয়াজকেই করবে।জেরিন কখনো রিয়াজের বাসায় না আসার কারণে আজ অব্দি ওর বাসা অচেনা।এদিকে রিয়াজের অন্য কোনো বন্ধুও নেই যে তাকে জিজ্ঞাসা করবে। থাকবে বা কি করে,জেরিন ছাড়া রিয়াজের ছিলোই বা কে।
বসায় এসে জেরিন ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে আছে। ওর আম্মু এসে বলল)
— কিরে মা,আজ কয়দিন থেকেই দেখছি তুই খুবই চিন্তিত,কি হয়েছে।
— আম্মু, রিয়াজ আজ ২ দিন থেকে কলেজে আসছেনা।
— কেনো..?
— একটা ছেলে আমাকে বেইজ্জতি করেছে দেখে রিয়াজ ছেলেটাকে অনেক মেরেছে। আর এইটা নতুন কিছুও না।কিন্তু রিয়াজকে আমি এই নিয়ে বকা দিয়েছি,আমার ভয়,ছেলেগুলো যদি আবার ওর কোনো ক্ষতি করে সেজন্য।
— তারপর?
— এরপর আর কি,রিয়াজকে আমি বলেছি আমার জন্য এতো মায়া কেন তার, সে সোজা আমাকে প্রফোজ করে ফেলেছে। কিন্তু তুমি তো জানোই আম্মু,আমি ১৩ই ফেব্রুয়ারি রিয়াজকে প্রফোজ করবো ভেবে রেখেছি। তাই একটু রাগ দেখিয়ে চলে আসি। এরপর থেকে ওর ফোনটাও বন্ধ, দেখাও হয়নি আর। কলেজে তো আসছেই না,অন্যদিকে ওর বাড়ির ঠিকানাও আমি জানিনা।শুধু তো স্কুল কলেজ,আর আমাদের বাড়িতে দেখা হতো।
— রাগ দেখানোর কি দরকার ছিলো তোর।
— না দেখালে ও পিছু পিছু আসতো তাই। আর যদি রিয়াজ আরো দুইবার আমাকে প্রফোজ করতো,হয়তো আমি ফেলতে পারবোনা,তাই রাগ দেখিয়ে চুপ করে দিয়েছি
— এখন হয়েছো তো চুপ।আসলেই আমি আজকালকার মেয়েদের বুঝিনা, এতো ভাব দেখানোর কি আছে।তুই আমার মেয়ে, আমার মেয়ে হয়ে তুইও এসব করছিস?
— তো আমি কি করতাম আম্মু?
— শুন মা, হাতের নাগালে যখন কোনো কিছু থাকে,তখন সেটা ফেলতে নেই। হাতের নাগালেই রাখতে হয়। দেখা যাবে, পরে হাতছাড়া করতে গিয়ে,সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতে হয়।
— এসব কি বলছো আম্মু তুমি?
— ঠিকই বলছি।এখন দেখ রিয়াজের কোনো খোজ পাস কিনা।
— ওকে
( জেরিন দুপুরবেলার খাবার না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে । ওদের আড্ডার জায়গা গুলো দেখে আসে।কিন্তু রিয়াজ কোথাও নেই। রিয়াজকে ছাড়া যেনো এই জায়গাগুলি হাহাকার হয়ে থাকে। এতো হৈ উল্লাস থাকা শর্তেও রিয়াজের জন্য কোন একটা অভাব থেকেই যায়।এভাবে কেটে যায় ১ মাস। রিয়াজের খোজ আজও পায়নি জেরিন।
মন খারাপ করে জেরিন ছাদে বসে আছে। রিয়াজের কথাই ভাবছিলো। হটাৎ জেরিনের নাম্বারে একটা কল আসে।)
— হ্যালো..?
— জেরিন বলছো?
— জ্বী, আপনি কে?
— আমি রিয়াজের আম্মু ( কথাটা শুনেই জেরিন লাফ মেরে উঠে,এরপর অনেকে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে)
— আন্টি রিয়াজ কোথায় বলুন তো? আজ ১ মাস হয়েছে ওর কোনো খোজ পাচ্ছিনা আমি। প্লিজ বলুননা সে কোথায়।
— তুমি আমাদের বাসায় চলে আসো।
— ঠিকানা তো জানিনা
— ( এতো **এতো **এতো**) ঠিকানায় চলে আসো
— জ্বী আন্টি,আমি ঘন্টা খানিকের মধ্যেই আসছি।
( জেরিন তাড়াতাড়ি রুমে এসেই ওয়াশরুমে চলে যায়। এরপর গোসল শেষ করেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আহহ আজ কতোদিন পর রিয়াজকে দেখবে। মনে অনেক খুশির ঢেউ খেলছে জেরিনের। কপালে লাল টিপ,, ঠোটে গোলাপি লিপস্টিক, চোখের নিছে কাজল লাগিয়ে নেয় জেরিন। অবশ্য এই সব কিছুই রিয়াজের পছন্দের। রিয়াজ নিজেই বলতো, জেরিনকে লাল টিপ,গোলাপি লিপস্টিক আর চোখে কাজল লাগালে অসম্ভব সুন্দর লাগে। মনে হয় কোনো ডানা কাটা পরী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াজের পছন্দের নীল শাড়িটাও পড়ে জেরিন। নিজেকে আয়নার সামনে উপস্থিত করে কল্পনায় হারিয়ে গেলো জেরিন।ওর মনে হচ্ছে রিয়াজ ওর পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। এক হাত জেরিনের শাড়ির ভাজ কেটে কোমরে স্পর্শ করতে লাগলো,অন্য হাত দিয়ে জেরিনের গলার পাশের চুল গুলো সরিয়ে চুম্বন একে দেয়। জেরিন সঙে সঙে চোখ বন্ধ করে ফেলে।এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন।
“উফফ,কি সব ভাবছি” বলেই জেরিন নিজের মাথায় নিজেই ঠুকা মারে। সেজেগুজে বের হয়ে পড়ে জেরিন।রিয়াজের আম্মুর দেয়া ঠিকানায় এসে জেরিন কলিং বেল বাজায়। ওপাশ থেকে রিয়াজের আম্মু দরজা খুলতেই দেখে জেরিন এসে হাজির। রিয়াজের আম্মু চিনতে পেরেছে জেরিনকে,কারন রিয়াজের রুমে শুধু জেরিনের ছবি দেওয়ালে আটকানো।)
— ভিতরে আসো মা
— জ্বী আন্টি
— এইজে সোফায় বসো
— ওকে ( বলেই মুখোমুখি রিয়াজের আম্মু এবং জেরিন সোফায় বসে পড়ে।এরপর রিয়াজের আম্মু বলল)
— রিয়াজের ব্যাপারে কিছু জানো?
— না আন্টি।গত এক মাস থেকেই ওর কোনো খোজ আমি পাচ্ছিনা।প্লিজ বলবেন?
— রিয়াজ মারা গেছে আরো ২৫ দিন আগে….
— কিহহহহহহ
( কথাটা শুনেই জেরিন থমকে যায় অদৃশ্যকরণ কোনো ধারাতে।চোখ দুটি টলমল করছে ভিজে, এতক্ষন হাত কচলাচ্ছিলো লজ্জায়, এখন পুরো শরীর ছেড়ে দিয়েই নিথর হয়ে যায় সে। রিয়াজের আম্মু বলল)
— গতো ১ মাস আগে রিয়াজ রাগ করেই বাসায় এসেছিলো।চোখে পানি ছিলো অনেক।প্রায় লাল হয়ে গেছে।রুমে গিয়েই সে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর আমরা অনেক ডাকাডাকি করেও দরজা খুলতে পারিনি।ওর ইচ্ছে হলে বাসা থেকে বের হয়,আবার ইচ্ছে হলে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এভাবে ৫ দিন হয়ে যায়। এই ৫ দিন একফোঁটা পানিও খায়নি সে।পরেরদিন সকালে রুমে এসে দেখি,নিজের হাতের রগ সে নিজেই কেটে আত্মত্যাগ করেছে। আমার একমাত্র ছেলে রিয়াজ। আমাদের বুক খালি করেই চলে যায়। ডাক্তারের থেকে শুনতে পাই,রিয়াজ অনেক নেশা করেছে।অনেক ড্রাগ আর ইয়াবা সেবন করেছে। যার জন্য ওর স্বাভাবিক কোনো জ্ঞ্যান ছিলোনা।আর সেই সুযোগেই এই অবস্তা করে
( কথাগুলো বলেই রিয়াজের আম্মু কান্নায় ভেঙে পড়ে।এদিকে জেরিনের হুশ থেকেও নেই। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিয়াজের আম্মুর দিকে । রিয়াজের আমু কোনো ভাবে কান্না থামিয়ে আবার বলল)
— রিয়াজের ডায়েরী থেকে তোমার নাম্বারটা পেয়েছি।সেখান থেকেই কল করেছি। রিয়াজের রুমে যাও, ডায়েরিটা তোমার জন্য রেখে গেছে।
( জেরিন হেলেঢুলে কোনো রকম রিয়াজের রুমের দিকে যায়। এরপর দেখে পুরো রুমে জেরিনের ছবি লাগানো। এইটা দেখে জেরিন আরো বেশি ভেঙে পড়ে। টেবিলের উপর রাখা সেই ডায়েরিটা খোলে জেরিন।যেখানে লেখা ছিলো)
** জেরিন,আমি জানিনা তুই আমাকে ভালোবাসোস কি না।আমি তো সেই প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছি। জানোস? তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। এরপরেও আমার মনের ফিলিং তুই জাগিয়ে তুলেছিস।শুনেছি প্রথম প্রেম নাকি ভূলা সম্ভব না।তাই হয়তো অনেক কস্ট পাচ্ছি। সেই ৮ বছর থেকে তোকে আগলে রেখেছি আমি।কখনো প্রেমিক বা বন্ধুর অভাব বুঝতে দিইনি আমি তোকে। যখন যা চেয়েছিস,তাই করার চেস্টা করেছি। মনে আছে? একদিন তুই বলেছিস হ্যাপি নিউ ইয়ারে আমি তোকে কি গিপ্ট করবো? তখন আমি একটা স্বর্নের আঙটি তোর হাতে পড়িয়েছিলাম। এরপর আমার বাইক নিখোজ,আমি বলেছি বাইক চুরি হয়ে গেছে।না, বাইক চুরি হয়নি,আমিই বিক্রি করেছিলাম,শুধু তোর খুশির জন্য। মা বাবাকেও বলেছি বাইক চুরি হইছে।
কিন্তু কখনো প্রফোজ করিনি,ভাবতাম এইটা বললে যদি তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাস? সেই ভয়েই চুপ থাকতাম।
তোকে ঝাড়ি দেওয়ার জন্য যে ছেলেগুলোকে আমি মারতাম,জানিস? তোর খুশির জন্য আমি তাদের মারতাম।কিন্তু পরে আমি নিজেই ওদের সামনে গিয়ে ক্ষমা চাইতাম।কেও ক্ষমা করে দিতো,আবার কেও আমাকে অনেক মারতো। তোর কথা ভেবেই আমি মাথা নিচু করে মার খেতাম।
তারপরেও তোর মুখে সব সময় হাসির জোয়ার ধরে রাখতাম।
জানিস..? একজন লেখকের আইডি থেকে কপি করে আমি তোকে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম? তোর মনে নেই? riaz hossain imran নামের আইডি থেকে নিয়েছিলাম, মেসেজটা ছিলো “” যখন তুমি হাসো,মনে হয় মরা নদীর মধ্যস্থলে পদ্ম ফুল ফুটেছে।
যখন তুমি অভিমান করো,মনে হয় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নীল আকাশের মাঝে, কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে।
যখন তুমি কান্না করো, মনে হয় বিশাল সাগরের গর্জন তোমার কান্নার কারনে হুংকার ছাড়ছে।””
আমার এই মেসেজ দেখে তুই খুশিতে আমাকে কিস দিয়েছিলি গালে।আমিও তারপর থেকে সেই লেখকের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।উনি আমাকে বলতেন তুই নাকি আমাকে ভালোবাসিস,কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না।তাই সেদিন মনে জোর এনে তোকে প্রফোজ করেছি। আর তুই সেদিন ৮ বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলি।যেখানে আমি নতুন কিছু গড়ার চিন্তায় ছিলাম,সেখানে সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি সেদিনই সেই লেখককে ব্লক মেরেছি। কস্টে, অভিমানে, রাগে, ক্ষোপে আমি রুমে চলে আসছি। তোকে হারানোর কস্ট আমি মেনে নিতে পারিনি,সেদিনই প্রথম আমি সিগারেট মুখে নিয়েছি।ধীরে ধীরে গাঞ্জা সেবন করেছি,এরপর ইয়াবা,তার পরেরদিন ড্রাগ।
আজ ৫ দিন তোর সাথে দেখা করিনি আমি।তুই বলেছিস বলেই দেখা করিনি। কিন্তু আজ আর এই কস্ট আমি নিতে পারছিনা। ব্লেড হাতে আমার।দেখি নিজেকে আঘাত করে,কস্টকে হারাতে পারি কিনা।
ইতি: তোমার হারামজাদা 😭
( চিঠিপত্রটা পড়েই জেরিন কাদতে কাদতে বাসা থেকে চলে এসেছে।রাস্তার মাঝে কান্না করতে করতে জেরিন ওর বাসার দিকে চলে যায়। এরপর সোজা ছাদে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে জেরিন। আর বলে, আমার উপরেরটাই দেখলি রিয়াজ, ভিতরেরটা কেনো বুঝলিনা) 😭
*** সমাপ্ত****