– আজ বাইরে যেও না, হাসপাতালে যাব।
এক সকালে গিন্নী এসে ফরমান জারি করে। কিছুটা অবাক হই। এমনিতে তার রোগ শোকের সব খবরই আমি জানি। আমার চিকিৎসা বিদ্যার উপর অগাধ ভক্তি তার। আমি বিষ দিলেও সে অমৃত ভেবে খেয়ে নেয়। তবু একটু খোঁচা মারার লোভ সামলাতে পারি না। চোখ কপালে তোলার চেষ্টা করে বলি,
– তোমার আবার কী অসুখ করল? তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, ছোট খাটো একজন ডাক্তার তোমার ঘরেও আছে!
– ফারুক মামা অসুস্থ। দেখতে যাব।
আমার খোঁচা গায় না মেখে নরম গলায় বলে বউ। খুলনায় বিয়ে করেছি। নদীর এপার এবং ওপারে, কাছের ও দূরের মিলিয়ে, পাড়াতুতো এবং পরতুতো সহ কয়েকশো মামা তার। সবাইকে আমি চিনিও না ভালো করে। তার উপর ত্রিশ বছর ধরে দেশে থাকি না। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি,
– কোন ফারুক মামা?
– ফারুক মামা আবার কয়জন আছে?
ফারুক মামাকে চিনতে না পারায় অভিমানে ভেজা বউয়ের গলা। আর তখনই মনে পড়ে, একদিন বউ বলেছিল, তার নানার আপন চাচাত বোনের ছেলে। আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। আমি ভুলে গেলাম কেমন করে? লজ্জিত ভঙ্গিতে বলি,
– স্যরি। প্রথমে চিনতে পারিনি। তা কী হয়েছে ফারুক মামার?
– আমি কি ডাক্তার নাকি? গেলেই জানতে পারবা। শুনলাম, পেশাবের রাস্তায় কী অসুবিধা। দুই দুই বার অপারেশন করাইছে।
ফারুক মামাকে না চিনতে পারার অপরাধ ক্ষমা করতে পারছে না বউ। মামা শব্দটার মাঝেই কেমন এক মায়া জড়ানো। ডাকলেই খুব আপন মনে হয়। আমি ওকে দোষ দিতে পারি না। আর কথা না বাড়িয়ে তৈরি হয়ে নিই।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড। সারি সারি বেড। দুই বেডের মাঝখানে হাত তিনেক জায়গা। সেখানেও বিছানা পাতা। উপরে রুগী, নিচে এক, দুই কিংবা তিন জন রুগীর আত্মীয়। কেউ কেউ রুগীর বেডেও বসে আছে। সাথে টোপলা টাপলি আরও কত কী। অথচ সার্র্জিকাল ওয়ার্ড ঝকঝকে তকতকে থাকার কথা। থাকার কথা জীবাণুমুক্ত পরিবেশ। যারা আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস করে না, তাঁদের একবার বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো দেখে যাওয়া উচিৎ। আল্লাহ না বাঁচালে একটা রুগীরও এই রকম নোংরা পরিবেশ থেকে বেঁচে বাড়ি ফেরার কথা না।
কংকালসার মানুষটা পড়ে আছে বিছানায় নির্জীবের মত। মুখে বহুদিনের অযত্নে গজিয়ে ওঠা দাঁড়ি, গোঁফ। হাতে স্যালাইন, বুকের হাড্ডিগুলো গোনা যায়। এক সময় যথেষ্ট সুদর্শন ছিলেন। বেশ কবার দেখা হয়েছে রাস্তায়। অথচ এখন চেনাই যায় না। বুঝলাম, অবস্থা ভালো নয়। সালাম দিয়ে জানতে চাই,
– মামা, কেমন আছেন?
– ভালো বাবা। কিছু খাতি পারি না।
বলে ম্লান হাসার চেষ্টা করেন। সে হাসিতে আমি এক পশলা কান্না দেখি। পাশে যথারীতি তিন জন আত্মীয়। মামী, ভারি মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে। বউ পরিচয় করিয়ে দেয়, মামার ছোট মেয়ে, মাস্টার্স করেছে। আর আছে মামার একজন শ্বশুর বাড়ির দিকের একজন আত্মীয়। আমাদের দেশে কেউ অসুস্থ হলে নিজের রক্তের আত্মীয়ের চাইতে শ্বশুর বাড়ির দিকের আত্মীয়দের বেশী দেখা যায়। এ কি আত্মার টানে নাকি স্বার্থের টানে, আমি বুঝতে পারি না।
আমি নার্সিং স্টেশনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে রুগীর ফাইল দেখতে চাই। সিস্টার হন্তদন্ত হয়ে আমার হাতে ফাইল তুলে দেয়। দেখি, মাস ছয়েক আগে প্রস্টেট অপারেশন হয়েছে। বায়োপসি রিপোর্ট বলছে বেনাইন (ক্যানসার নয়)। পরে স্ট্রিকচার হয়েছিল। ডাইলেট করতে হয়েছে। এখন বুকে পানি এসেছে। পিএসএ (ক্যানসার মার্কার)লেভেল একশোর উপরে। বুঝলাম, প্রথম রিপোর্ট ভুল ছিল। না জেনে কেউ ভিমরুলের চাকে যদি কেউ খোঁচা দেয়, ভিমরুলের দল যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ক্যানসারকেও কেউ না জেনে খোঁচাখুঁচি করলে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বুঝলাম, মামার বেলায়ও তাই হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। পিছন ফিরেই দেখি বউ দাঁড়িয়ে। জানতে চায়,
– কী দেখলা?
– খারাপ। ক্যানসার ছড়ায়ে পড়ছে। এন্ড স্টেজ।
– মামার সামনে কিছু কইও না। মামা কিছু জানে না।
ছলছল করে ওঠে বউয়ের চোখ। ওকে বলতে পারি না, যার রোগ, সে জানবে না, এ কেমন কথা? আমি বেডে ফিরে এসে শ্বশুর বাড়ির দিকের আত্মীয়টিকে বারান্দায় নিয়ে যাই। জিজ্ঞেস করি,
– ডাক্তার কী বলেছে?
– কলো তো ক্যানসার হইছে। আরও টেস্ট করতি কলো।
– কী টেস্ট?
– কলো তো ছিটি করতি হবি, হাড্ডির স্ক্যান করতি হবি।
– আমার মনে হয়, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে। টেস্টগুলো হলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। রিপোর্ট হলে আমাকে খবর দিয়েন।
– আচ্ছা।
আবার বেডে ফিরে আসি। মামাকে কী বলব আমি? যে জানেই না, সে আর মাত্র কয়েক দিনের অতিথি। আমি অনেক দূরের আত্মীয়। তার একান্ত আপন জনেরা যখন চায় না, রুগী কিছু জানুক, তখন আমি কী করতে পারি? লোকটার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। তাঁকে কোনো মিথ্যা আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারি না। অনেকটা পালিয়ে চলে আসি। পথে আসতে আসতে বউকে বলি,
– কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
– কোন কাজটা?
– এই যে তোমরা রুগীকে কিছু জানতে দিতে চাও না।
– জানলে তো মামা আরও কষ্ট পাবে।
– তা পাবে। কিন্তু তার রোগের ব্যাপারে সবাই জানছে, শুধু সে জানছে না। এটা অন্যায়। জীবনটা তো তার। অথচ তার জীবনের ফয়সালা করছে অন্য কেউ। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। এটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ।
– তোমার বিলাতি বিদ্যা এখানে চলবে না, এটাই এখানকার নিয়ম।
বুঝলাম, তর্ক করে লাভ নেই। আমি চুপ করে থাকি। দিন তিনেক পরে এক রাতে বসে লিখছি। হঠাৎ খুব বিড়ির নেশা চেপে যায়। গিন্নী ব্যস্ত কিচেনের ওদিকটায়। এই ফাঁকে চুরি করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরাই। চোখ বন্ধ করে যেই সুখ টান দিয়েছি,
– খুব ব্যস্ত? চমকে তাকিয়ে দেখি পিছে স্বয়ং আজরাইল (আজরাইলের স্ত্রী লিঙ্গ কী জানিনা) দাঁড়িয়ে। আমার তো তখন “পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে” অবস্থা। দাঁত কেলিয়ে বলি,
– কিসের ব্যস্ত? তোমার জন্য জান কোরবান মেরি জান।
অবাক কাণ্ড! বিড়ি খাচ্ছি দেখেও আজরাইল আমার জান কবচ করতে চাইছে না। আমার তোষামোদও তাকে স্পর্শ করছে না। শান্ত কণ্ঠে বলে,
– চল, মামা বাড়ি যাব।
– এই রাতে বারাক পুর? আমি আকাশ থেকে পড়ি। ওর মামা বাড়ি বারাক পুর, নদীর ওপারে। বউ তেমনি শান্ত কণ্ঠে বলে,
– বারাক পুর না, ফারুক মামার বাড়ি।
– মামা না হাসপাতালে?
– না, ওরা ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
বউয়ের কণ্ঠে বৃষ্টির ছাঁচ। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনি। আমার ধারণাই সত্য হল! মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তাঁকে জবাব দিয়ে দিয়েছে!
পৈত্রিক ভিটেয় মামার দালান ঘর। চার মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটা মৃত্যু শয্যায়। ঘরের পরতে পরতে অর্থনৈতিক দৈন্যতার ছাপ। আরও ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছেন মামা। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। আমি বিছানায় বসে মামার হাত ধরি। ঠাণ্ডা, ভেজা হাত। আমি শিউরে উঠে পালস দেখি। ঢিমে তালে চলছে জীবনের রেল গাড়ি। “মামা কেমন আছেন?” বলার মত ধৃষ্টতা দেখাতে পারি না। আমি অসহায় চোখে বউয়ের দিকে তাকাই। বউ নীরবে মাথা নাড়ে, কিছু বলো না। ইশারায় পাশের ঘরে আসতে বলে। আমার চোখ ফেটে পানি আসতে চায়। এ কেমন বিচার তোমাদের? খুব শীঘ্রই শেষ স্টেশনে পৌঁছে যাবে যে মানুষটার জীবনের রেল গাড়ি! তাঁকে এখনও যাবে না, তৈরি হয়ে নাও, জিনিষ পত্র গুছিয়ে নাও, সময় আর বেশী নেই বাকি? আমি কিছু না বলে উঠে পাশের ঘরে চলে যাই। সেখানে জড় হয়ে আছে সবাই। আমি ছোট মেয়েকেই জিজ্ঞেস করি,
– ডাক্তাররা কী বলল?
– বলল, বাড়ি নিয়ে যান।
– টেস্টগুলো করিয়েছিলি?
– না। বলল, করা লাগবি না। মনে মনে ধন্যবাদ দেই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের। অহেতুক টেস্ট করিয়ে পয়সা নষ্ট করল না।
– আর কিছু বলল?
– আব্বা যে ক্যানসার স্পেশালিস্টের আন্ডারে ছিল, তাঁরে চেম্বারে দেখাতি বলল।
– দেখিয়েছিস?
– হু, বলল, তার কিলিনিকি ভর্তি করতে। সেই জন্যিই তো আপনারে ডাকলাম, আপনিই কন কী করব?
আমার চোখ ছোট হয়ে যায়। এ কী শুনছি আমি? যেখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জবাব দিয়ে দেয়, সেখানে প্রাইভেট ক্লিনিক কী করবে? এবার বেশ রাগ হয় আমার। জানতে চাই,
– তা শুনিসনি ডাক্তারের কাছে, ভর্তি করলে কী লাভ হবে?
– শুনিছিলাম। বলল, বুকে ইনফেকশন, তাই পানি আসিছে। এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতি হবি।
– আর?
– আর কয়েকদিন কিলিনিকি থাকলি শরীরে শক্তি আসপি। তখন কিমো শুরু করবি।
এবার আর শুধু রাগ নয়, রীতিমত ঘৃণা হয় ডাক্তার হিসেবে নিজের উপর, নিজের পেশার কিছু লোকের উপর। একটা মহৎ পেশাকে আর কত নীচে নামাবে এরা? একজন এমবিবিএস ডাক্তারও বুঝবে, জ্বর নেই, কাশি নেই, বুকে ব্যথা নেই, ব্লাডে ইনফেকশন মার্কার নরমাল, অথচ বুকে পানি এসেছে, এটা আর যাই হোক, একিউট ইনফেকশন হতে পারে না। এতদিন পেপারে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি, মৃত রুগীকে ভেন্টিলেটরে রেখে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতে। আর এখন আমারই এক নিকটাত্মীয় এই বর্বর লোভের শিকার হতে চলেছ। রুগী মারা যাচ্ছে জেনেও স্যালাইন আর ইনজেকশন দেয়ার নামে কিছু পয়সা কামিয়ে নিতে চাইছে! এটা এ কারণেই সম্ভব হচ্ছে যে, রুগীর কিংবা রুগীর আত্মীয়স্বজনের রোগ সম্পর্কে কিংবা রোগের প্রগনোসিস (আরোগ্য-সম্ভাবনা) সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। ডাক্তাররা সত্য খোলাসা করে না বলে মিথ্যা আশার মুলো ঝুলিয়ে রাখে রুগী কিংবা রুগীর আত্মীয়ের নাকের ডগায়। একজন ডুবন্ত মানুষ যেমন খড় কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়, আমাদের দেশের মানুষেরাও তেমনি রোগাক্রান্ত হলে, ডাক্তারের কথার উপর ভরসা করে, ভিটে মাটি বিক্রি করে হলেও শেষ চেষ্টা করতে চায়। সেই ভরসা নিয়ে এ কেমন ছিনিমিনি খেলা?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি জড়ো হওয়া মানুষগুলোকে দেখি। অনেক আশা নিয়ে জোড়া জোড়া চোখ চেয়ে আছে আমার দিকে। অলৌকিক কোনো বাণী শুনবে বলে। আমি কেমন করে মিথ্যা আশার বাণী শোনাই? আবার সত্য বললে তাঁদের চোখের তারায় জ্বলা শেষ আশার বাতিটিও নিভে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে জীবনে বহুবার পড়েছি। এমন অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয়। ইংরেজিতে বলে ব্রেকিং ব্যাড নিউজ। আমি মামীকে ডেকে আমার কাছে বসাই। তার চোখে চোখ রাখি। দেখি সে চোখে উৎকণ্ঠা, সে চোখে ভয়। শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি,
– মামা কি কিছু বুঝতে পারছে? নীরবে মাথা নাড়েন মামী।
– মামা কি কিছু জানতে চায়?
– না বাজান। খালি কয়, কেন সে কিছু খাতি পারে না?
– মামী, আমি এখন যা বলব,
আমি জানি, আপনাদের শুনতে ভালো লাগবে না। সত্য কথা হল, মামার বুকের পানি ইনফেকশনের জন্য না। ক্যানসারের জন্য। আর কেমো সহ্য করার মত শারীরিক শক্তিও মামার অবশিষ্ট নাই। তাঁকে ক্লিনিকে নেয়ার দরকার নাই। বাড়িতে রাখেন। আপনারা তার পাশে থাকেন, ভালো মন্দ খেতে দেন। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। বলে আমি চোখ বন্ধ করি। আশাহত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস আমার নেই। ঘরে পিন পতন নীরবতা। যেন সবাই কথা বলতে ভুলে গেছে। আমি বলার চেষ্টা করি, সবচে ভালো হয় যদি মামাকে বলা যায়, কী হয়েছে তার।
এবার সবাই এক সাথে বলে ওঠে। না না, তাঁরে কিছু কওয়া যাবি না। আমি অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি। মনে মনে বলি, আর কিছু করার নেই আমার। আর কিছু বলার নেই আমার। আমি মামাকে কিছু না বলেই বাসায় চলে আসি।
পরদিন রাতেই পাশের বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। আমি দৌড়ে পিছনের বারান্দায় যাই। পাঁচ তলার ব্যালকনী দিয়ে মামার বাসা দেখা যায়। শুনি অনেকগুলো মেয়ে কণ্ঠে কান্না, আহাজারি। আমি অবাক হই না। এই ভালো হল। যেতেই যদি হয়, বেশী দিন না ভুগে আগে ভাগে চলে যাওয়াই ভালো। সে রাতে মৃত বাড়ি থেকে ফিরে এসে অনেক রাত অবধি আমার ঘুম আসে না। বার বার মনে হচ্ছিল, এ কেমন কালচার এ দেশে? আমরা বিদেশে যাওয়ার সময়, এমনকি এক শর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার সময়ও কত কথা বলে যাই প্রিয়জনদের। যদিও জানি আবার ফিরে আসব। কিন্তু না ফেরার দেশে চলে যাবার আগে কেন জানতে পারব না? কেন এক বুক অতৃপ্তি নিয়ে প্রাণ পাখিটি চলে যাবে বুকের খাঁচা ছেড়ে? বুঝতে পারি, বউয়ের চোখেও ঘুম নেই। বড় মায়ার শরীর তার। দূরের মানুষদেরও খুব আপন করে নেয়। বলি,
– জেগে আছ?
– হুম। আমি শোয়া থেকে উঠে বসি। ওর হাত দুটো নিজ হাত নিয়ে বলি,
– আজ আমাকে একটা কথা দিবি বউ? আমার গলায় কিছু একটা ছিল। ঝট করে উঠে বসে বউ। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ সময়ে তাকে আমি তুই করে বলি। অবাক কণ্ঠে জানতে চায়,
– কী কথা?
– তোমার আগে যদি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, আর তখন যদি আমরা এ দেশে থাকি, আমাকে কথা দাও, সবার আগে যেন ডায়াগনোসিসটা আমি জানতে পারি।
– এ সব কী বলছ তুমি? আঁতকে উঠে বলে বউ। আমি শান্ত কণ্ঠে বলি,
– আমি যেন বুঝতে পারি, মৃত্যু দূত রওনা দিয়েছে আমার ঠিকানায়। আমাকে হাসপাতালের আইসিইউতে কিংবা ভেন্টিলেটরে রেখো না। তোমার পরিপাটি করে বিছানো এই সুন্দর বিছানায় রেখো।
– কী হইছে তোমার? কেন এই সব কথা বলতেছো? হাহাকার করে ওঠে বউ। আমি বলতে থাকি,
– জীবনের শেষ ক’টা দিন আমি একান্তে তোমার সান্নিধ্যে কাটাতে চাই। হয়ত এমন কিছু কথা আছে, যা সাহস করে বলা হয়নি কখনও, বলে যেতে চাই নির্দ্বিধায়।
– চুপ করো। আমি কিছু শুনতে চাই না। ডুকরে কেঁদে ওঠে হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে। আমি ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলি,
– কাঁদিস না বউ। এমন দিন তো একদিন আসবেই। যখন মৃত্যু এসে কড়া নাড়বে দরজায়, তুমি নিজ হাতে দুয়ার খুলে দিও। তোমার কোলে মাথা রেখে, জীবনের শেষ আলোয়, ঐ চাঁদ মুখ দেখতে দেখতে আমি চলে যেতে চাই, আকাশের ঠিকানায়। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বউ। ওর মাথা নুয়ে আসে আমার কোলে। আমার চোখেও উপচে পড়া জল। আমার গাল বেয়ে সে জল ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে ওর ঘন চুলে। ও তা জানতে পারে না।