দেনমোহর

দেনমোহর

বিধাতার নিয়মে যেদিন আলো দেখি পৃথিবীর,
সেদিন অনন্ত এক অন্ধকার ঘিরেছিলো আমায়।
নারী কাটার সাথে সাথে একটি নাম যোগ হলো
দুর্বল সেই ফুটফুটে নবজাতকের দেহের সাথে।
অভিশপ্ত রাক্ষসী
যারা আমায় করুণার চোখে দেখতো ভ্রু ভাজে বলতো
মা ধ্বংসী অপয়া মেয়ে আমি।
যারা নিয়তির বিধান ভেবে ভালোবাসতো আমায়
তারা ডাকতো অভাগী বলে।

কোনো নাম কখনো আঘাত করেনি আমার বুকে
বিষাক্ত তীর ভেবে কখনো কষ্ট পাইনি কোনদিন।
তবে এটা ভেবে কখনো কখনো ভীষণ খারাপ লাগতো
আমার আসল নাম আজো জানা হয়নি।
জানবই বা কিভাবে বলো; নাড়ী কাটার সাথে সাথেই
মা চলে গেলেন ঐপারের বাসিন্দা হয়ে।
মায়ের দুধের স্বাদ কেমন হয়? প্রশ্নটা আমার অনন্ত
বুকের ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে জল হয়ে গড়ালেই মুক্তি।
প্রতিবেশীর মুখে শোনা – অভাগীর যখন ৫ বছর
তখন বাবাও চলে গেলেন মায়ের কাছে।

সৎ মায়ের অগ্নিমুখী অবহেলার আদরে বসন্ত এলো
আমার বুকের বাড়ন্ত নিয়েও সে কি নোংড়া গালি
সেও আমার মা- জন্মের পর যাকে মা ভেবেই বাঁচা।
কখনো কষ্ট পেতাম না- মায়েরা বুঝি এমনই হয়
স্বপ্নেরা কেমন হয় কখনো ছুঁয়ে দেখেনি অভাগী
জোড়া কবুতর জোড়া শালিক দোলা দিতোনা কখনো।
কোকিলের ডাক বেশ ভালো লাগতো,
আমার না ছোঁয়াতে সেই ছিলো দূরে ডালে থাকা বন্ধু
আমার কান্না আর কোকিলের গানের সাথে মিল পেতাম।

অভাগী নামেই সকলে চিনতো আমায়
নতুন পোশাকে আমায় কেমন দেখায়, কখনো দেখা হয়নি
আশাও করিনি কোনোদিন- প্রতিবেশীর দেয়া পুরাতনেই
আমি ছিলাম অতুলনীয়া সুন্দরী
এসব আমার কথা নয়
প্রতিবেশীর মুখের কথা। ভয়ানক সুন্দরী আমি
ভয়ানক কথা শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে।
কারো সাথে ঝগড়া নেই আমার, দন্দ্ব ও নেই কারো সাথে
তবুও কেনো সকলে অবহেলার চোখে দেখে আমায়?
এ প্রশ্নের উত্তরও জানতে চাইনি কখনো।

অতি সাধারণ ভাবেই আমার বিয়ে হলো
অচেনা অজানা এক দারী গোফওয়াল লোকের সাথে
প্রতিবেশী দু চারজন ছিলো বিয়ের আসরে।
দশ হাজার টাকা দেনমহর, কে কাকে দিয়েছে জানিনা
কেউ একজন বলেছিলো দেনমহর দশ হাজার
কাবিননামায় লেখা হলো অভাগী নামের টিপ সই
জীবনের প্রথম নতুন শাড়ী পড়লাম,
জীবনের পরম সুখ,
ভেবেছিলাম অবহেলার দিনের সমাপ্তি হলো আজ।

সৎ মায়ের চোখে ঐদিন একটু জল দেখেছিলাম,
জানিনা তা কিসের জল ছিলো আনন্দের না কি কষ্টের
লোকটার সাথে চলে এলাম ঢাকার শহরে।
সপ্তাহখানেক বেশ আনন্দের ছিলো আমাদের সংসার।
কি খেয়ে বাসায় ফিরতো জানিনা।
এর পর থেকে আমার পাশে পেতাম মাতাল নেশাক্ত স্বামী
একদিন আসি বলে লোকটা চলে গেলো
যাবার সময় বলে গেলো তার বন্ধু আসবে
আমি যেনো আদর আপ্যায়ন করি।
খুশী করতে না পারলে মৃত্যুর হুমকি।

এভাবে একের পর এক বন্ধুর দ্বারা সব লুট হয় আমার
অভাগীর দেহ পরে থাকে একের পর এক শিয়াল কুকুরে খায়
বিনিময়ে কাগজের কিছু বিনিময় মুদ্রা।
আমি আর পারিনা, প্রতিরাত এই দেহ নিয়ে টানাটানি
জড় হয়ে পরে থাকি, কে আসে কে যায় বোধ থাকে না।
ভিতর থেকে কে জেনো বলে ওঠে।
অভাগী পালিয়ে যা, নয়ত শেষ হয়ে যাবি।
এক দিন লোকটাকে কাছে পেলাম। সাহস করে বললাম
আমাকে এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও।
আমি আর পারছিনা।

লোকটা বলে উঠলো দেনমহর দশ হাজার।
টাকা দিয়ে বিদায় হও, নয়ত এভাবেই চলবে।
চোখে জল এলো আমার, কোথায় পাবো এতো টাকা
আমার এই দেহের দাম মাত্র দশ হাজার টাকা?
এ চার মাসে অনেক শিখেছি আমি
ইট পাথরের দেয়ালের ওপাশের কান্নার শব্দ এপাশে আসেনা।
কালো পথের বুকে চোখের জলের মূল্য নেই এতোটুকু।
দশ হাজার টাকা দেনমহর।

আমি অন্ধকার গলির মেয়ে, পথে পথে অলিতে গলিতে খুঁজি
দেনমহরের ১০ হাজার টাকা।
লাখ লাখ টাকা আসে, দেনমহরের দশ হাজার টাকা আসেনা।
দেনমহরের ১০ হাজার খুঁজতে খুঁজতে
এভাবেই হয়তো একদিন শেষ হবো আমি।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত