প্রথম পিরিয়ড হলো যেদিন অাম্মা বাড়িতে ছিলেন না।বড় দুই ভাইয়ের পরে অামি অার ছোট বোন।অামি হুটহাট কথা বলি,চঞ্চল স্বভাবের।যখন যা মনেঅাসে তাই বলি।সেদিন অামি কেমন যেনো ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। অাব্বা পাশের বাড়ির খালাম্মা কে ডেকে বললেন-
-মেয়ে টা কে একটু দেখে যান।
তখন এমন একটা সময় মেয়ের সাথে মা ও এসব বিষয়ে কথা বলতে ইতস্ততা বোধ করতো। বিকেলে দিকে অাব্বা অামার মাথায় হাত রেখে বললেন কিছু হয়নি,চলো বেরিয়ে অাসি। অাব্বা অামার পছন্দে পুতুল কিনে দিলেন। অাব্বা গাড়ি,ফুটবল কিনলেন। হাই স্কুলে পড়লেও খেলা-ধুলা থেকে তখন ইস্তফা দেবার বয়স ছিলো না। অাব্বা গাড়ি ফুটবল কেনো কিনলেন বুঝতে পারছি না। বাড়ি ফেরার পরে অাব্বা বল অার খেলনা গাড়ি অামাকে দিয়ে বললেন- যে যতো সাহসি তার কাছে ততো বড় দায়িত্ব দেয়া হয়।অাল্লাহতায়ালা মেয়েদের এমন এক শক্তি দান করেছেন যা ছেলেদের দেননি।তুমি সম্মানিত তোমার পদতলে জান্নাত দান করা হয়েছে,তোমার মাঝেই দান করা হয়েছে নতুন অারেক সৃষ্টির কারখানা।ছাড় সবাই দিতে পারে না,যে ছাড় পায় সে ভাবে সে জিতে যায়।ব্যাপার টা অাসলে সেরকম নয়।
সাহস লাগে ছাড় দিতে,হৃদয়ের প্রসস্থতালাগে। ভয়ের কিছু নেই মা,এখন হয়তো অামার কথা গুলো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, কথা গুলো মনেরেখে সাহস নিয়ে চলবা। ভাত খেতে বসে,অামার প্লেট অাসা চিংড়ি মাছ গুলো তুলে রেখে দিলাম তরকারির বাটিতে। অাম্মা চিংড়ি মাছ পছন্দ করেন, কিন্তু কখনোই তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখি না। অাম্মা খেতে বসে সেই মাছ গুলো সব ভাইয়ের পাতে তুলেদেন। দেখে অামার গলাব্যাথা করে, চোখে জল অাসতে দেই না।চোখে জল দেখে যদি ভাবেন অামি হিংসুটে। অাম্মা অামাকে অবহেলা করেন সেটা বলবো না। অাম্মা অামাকে ভালোবাসেন।অামার জ্বর হলে সারারাত বসে মাথায় পানি দেন,লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেন।
ঐসব ভালোবাসা অামার চোখে খুব একটা পরে না,ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসা গুলো বেশ অায়োজন করে চোখে ধরা পরে। বিলেবু নামটা অামার মনে থাকে না।বাড়িতে মেহমান এলে বাড়ির এক কোনে বিলেবু গাছ টা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন- এটা কি গাছ? অামি বিজ্ঞের মতো বলে দেই অাপেল গাছ।ছোট ছোট অাঙ্গুলের মতো টক সবুজ সবুজ অাপেল হয়।অাম্মা মাছ দিয়ে সেই অাপেল রান্না করেন।অনেক মজা হয় সেই তরকারি টা। মেহমান অামার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। মনেনেই কথা টা বলা অামার পছন্দ না।অাবার কথা সংক্ষিপ্ত করাও অামার পছন্দ না। দাদী খুবই বিরক্তি নিয়ে বলেন- তুই কার মতো হইছত এতো বাচাল।এতো তেড়েং তেড়ং করছ, বেটি অার বান্দী এক, বেটা অার বাদশা এক।
মাটির মতো চুপ থাকবি,কাইট্টা ফালাইলেও নড়াচড়া নাই এমন। অামি বলি- কবরে গেলে তো মাটি এমন চাপ দিবো দুই পাঁজর এক করে ফেলবো।সুযোগ পাইলে মাটি কি চুপ থাকবে। দাদী কিছু বলে না, সুপারি কাঁটে অার বিড়বিড় করে। দিন এমন করেই যাচ্ছে অামার অার একটু একটু করে অনেক টা বড় হয়ে গেছি। অামি প্রাইভেট স্যারের প্রেমে পরেছি।স্যার কে দাদী অাধবুড়া ডাকেন।মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন পাঁচ বছর অাগে। দাদীর মতে স্যারের বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে।তাকে বিয়ে করার মতো কোন পাত্রী দেশে নাই। স্যারের হাত টা ছুঁয়ে দেখতে অামার ইচ্ছে হয়।স্যার কে চায়ের কাপ হাতে দেয়া যায় না।টেবিলে রাখতে হয়।তবে টাকার খাম টা তিনি হাতেহাতে নেন।সেই ফাঁকে হাত টা একটু ছুঁতে পারি। অামি স্যার কে দুই বার বেতন দেই।একবার অাব্বার টাকা অারেক বার অামার জমানো টাকা।
অার সে জন্য অামাকে কলেজে হেঁটে যেতে হয়,পছন্দের কানের দুলটা অামার ক্লাসম্যাটট তিথীর কানে শোভা পাচ্ছে,প্রাইভেট পড়াতে হয়। স্যার কে সময় অসময়ে বেতন দিলে কিছু জিজ্ঞেস করে না, চুপচাপ বেতন টা হাতে নেন। হয়তো তিনি ভাবেন এই বাড়িতে প্রাইভেট টিচারের মাস হয় পনেরো দিনে।তাই তিনি খুব বিনয়ী ভাবে দরজায় কিলংবেল থাকাসত্বেও দুইবার টুকা দেন। প্রথম বার টুকা দিয়ে দ্বিতীয় টুকা দেন গুনে গুনে ত্রিশ সেকেন্ড পরে।অামি কান পেতে থাকি অাঙ্গুলের কড়ে গুনি, হয়তো তিনি ও তার হাত ঘড়িটায় সময় দেখে টুকা দেন।হয়তো, তিনি চিন্তা করেন এই পরিবার কে বিরক্ত করলে চাকরি থাকবে না। তাকে নিয়ে অামার অনেক ‘হয়তো’ ধরনের চিন্তা মাথায় অাসে। একবার খামে করে চিঠি দিলাম স্যার কে।
পরেরদিন স্যারের অগ্নি মূর্তি। ইন্টারমিডিয়েট পড়া ছাত্রী স্যার, কে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে পত্র দেয়া বিশাল অন্যায় বুঝিয়ে দিলেন।অার অামাকে পড়াবেন না বলে চলে গেলেন। অামি তার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছি অার ভাবছি ভালোবাসা ও একধরনের অপরাধ। সাতদিন হলো স্যার অাসে না।অামার বিয়ের কথা অনেক অাগে থেকেই চলছে।ইচ্ছে ছিলো স্যার যদি অামাকে ভালোবাসে তবে বাসায়, তার কথা বলবো। না মানলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দরজা বন্ধ করে ম্যারাথন ঘুম দেবো।ফাঁক ফোঁকরে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবো, অামার অাবার ক্ষুদা সহ্য হয় না। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেলো,বিয়ের বাজারের ধুম চলছে।অাঠারো দিন হয়েগেলো স্যারের কোন খোঁজ নেই। অামি ছাদে বসে তাকে মনেকরে কাঁদলাম,চোখ-মুখ ফুলিয়ে ঘরে অাসলাম।অামার ছোট বোন চন্দ্রা কদম ফুল একটা কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়ে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললো-
-তন্দ্রা’পা কাঁদছিস কেনো?
কোন উত্তর দিলাম না।অামার রুমে গিয়ে গায়ে হলুদের শাড়ি টা পরলাম।বর্ষার সিজনে সিনেমার নায়িকার নীল শাড়ি পরে।অামার নিজের কোন শাড়ি নেই,নীল শাড়ি পরার খুব ইচ্ছে ছিলো। চোখে কাজল দিলাম,কাজল দিলে অামাকে দেখতে অনেক মিষ্টিলাগে।ঠোঁটে লিপবাম দিলাম। চন্দ্রার কাছে কিছু টাকা হবে কি না জিজ্ঞেস করলাম।মেয়েদের হাতে লুকানো ভাবে জমানো টাকা থাকে অামার জমানো কোন টা নেই।
কদম ফুল পাতাসহ কানে গুজে কালোক্লিপ দিয়ে অাটকে নিলাম।হাতে চুড়িপরার কথা মনেছিলো না, দৌড়ে গিয়ে চুড়ি পরলাম।অামার হলুদ রেশমি চুড়ি নেই। গায়ে হলুদের জন্য ফুলের চুড়ি,গয়না কেনা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে সাদা রেশমি চুড়ি দুইহাত ভরে পড়লাম। হলুদ শাড়ির সাথে সাদা,রেশমী চুড়িতে নাকি অামাকে কদম ফুলের মতোই অপূর্ব লাগছে।ছোট বোন চন্দ্রা অারো বলেছে তাদের হবু দুলাভাই অামাকে দেখলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে।অাব্বার বড় ডাটের ছাতা টা নিয়ে বিকেলে বেড়িয়ে পরলাম। মেয়েরা এমন ছাতা নিয়ে বাহিরে যায় না,মেয়েদের ছাতা হয় সুন্দর ছিমছাম। অামার ছাতা টা ও ছিমছাম,খয়েরী রংয়ের। এখনো মনের কোনে ক্ষীণ অাশা জ্বলে অাছে । ছেলেদের হাতে ছিমছাম ছাতা মানায় না এমন অগোছালো,বেখাপ্পা জিনিস গুলাই মানায়। অাম্মা চোখ বড় বড় করে বাঁধা দিচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছি?কেন যাচ্ছি?গায়ে হলুদের শাড়ি টা কেন পরেছিস?অাম্মা অামাকে হাজার টা কেনো তে বন্দী করতে চাচ্ছেন। অাব্বা, ছোট্ট করে বললেন –
-একটু নিজের মতো ছেড়ে দাও।ক’দিন পরেই তো বিয়ে মেয়েটার।
টাকা অাছে কিনা অাব্বা জানতে চাইলো।অাব্বার কাছে অামার প্রয়োজনের টাকা নিতাম।যদিও কখনো নিজের জন্য খরচ করতাম না।অাজ অার অাব্বার কাছ থেকে টাকাট নিতে ভালোলাগছে না। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। স্যারের মেসে গেলাম,স্যার নেই মনখারাপ করে বেরিয়ে পরলাম। দূর থেকে স্যার কে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি ভিজে অাসছে।অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে একটা ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তার ঘরে ফিরার দৃশ্য এতো সুন্দর হতেপারে, কখনো চোখে ধরা পরেনি। হয়তো ধরা পরতো।গল্প-উপন্যাস গুলোতে বৃষ্টি ভেজা মেয়েদের সৌন্দর্যের কথাই বলা হয় তাই হয়তো।হয়তো বা তাকে ভালোবাসি এর জন্য। স্যারের হাতে চিঠি দিয়ে বললাম,দ্বিতীয় বারের মতো অন্যায় করে ফেললাম। মাথা টা ভালো পানি দিয়ে ধুয়ে নিবেন,জ্বর অাসতে পারে। সে অামার চলে অাসার পথে একবার ও ডাকে নি,একবারও বলেনি এই বৃষ্টিতে কি ভাবে যাবে।
অামি ও তাকে বলতে পারিনি ছাতা টা অামাদের জন্য এনেছিলাম। চিঠিতে লিখেছিলাম- স্যার, ভালোবাসেননি বলে এক ঝটকায় সরে গেলেন।ভালোবেসে সেই ঝটকা টা সামলানো খুব কষ্ট হয়ে গেল।ধীরে ধীরে চলে যেতে হয় স্যার। যেখান থেকে ভালোবাসা অাসেনি সেখানে অভিমান পষে রাখার কোন মানে থাকে না। স্যার কে ভুলতে না পারলেও,তার জন্য মনপুরে না অার অাগের মতন। অামার জন্য গায়ে হলুদের কাপড় অাবার কিনা হলো। বিয়ের পরে বর কে নিয়ে বাবার বাড়ি অাসলাম। ঘরে ঈদ ঈদ অানন্দ,অামার ভাই-বোনেরা অাড্ডায় মেতে উঠেছি দুপুরের খাবার শেষে। দরজায় খুব পরিচিত একটা টুকার শব্দ শুনে নিজের মতিভ্রমের লক্ষণ ভাবলাম।তারপর ও অভ্যাসগত কারনে গুনতে লাগলাম। অামি পাথর হয়ে যচ্ছি,পা ঠান্ড হয়ে অাসছে। দরজার ওপাশে স্যার হাসি মুখে দাঁড়িয়ে অাছেন।এমনিতেই এই হাসি অামাকে লুটপাট করে দেয়।
-এই অবেলায় শাড়ি পরে অাছো যে,তন্দ্রা। স্যার হয়তো অামার বিয়ের খবর টা জানেন না।বললাম-
-অাপনি অাসতে বড্ড বেলা করে ফেলেছেন স্যার। সে কিছু বুঝেছে বলে মনেহচ্ছে না,তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়রি,অনেক গুলো গোলাপ বের করতে করতে বললো-
-খাইতে পারিনা,যে দিকে তাকাই তোমার মুখ টা ভাসে।ভাবলাম বাড়ি যাই সব ঠিক হয়ে যাবে।সেখানে গিয়ে অারেক যন্ত্রণা দেখা দিলো রাতে ঘুমাতে পারি না।মনে হয়ে তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।কখন যে তোমাকে ভালোবাসে ফেলেছি টের পাইনি। তার হাত ধরার হাজার বাহানা খুঁজতাম ক’দিন অাগেও।অাজ সে নিজে থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বরং অামার ভিষণ অসহ্য না কি অসহায় লাগছে বুঝতে পারছিনা।ভালোবাস না পেয়ে যন্ত্রণায় ছিলাম ।এখন তো দেখছি ভালোবাসা পেয়ে মহা যন্ত্রণায় পরে গেছি। নতুন করে অারেক সমস্যায় স্যার অামাকে ফেলে গেলেন। এর প্রভাব পরলো অামার নতুন সংসারে।
অাম্মা ব্যাপার টা কি ভাবে বুঝতে পারলেন জানি না।হয়তো মা’দের ধর্মই এমন, সন্তানের মুখ দেখে মন পড়ে ফেলা। অাম্মা অামার মাথায় হাত দিয়ে বললেন- “বৈশাখে যে ঝড় অাসে তার প্রস্তুতি নেয়া যায়,তার নাম বৈশাখী ঝড়।বৈশাখের পরে যে ঝড় অাসে তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তা মোকাবেলা করে চলতে হয়।” অাম্মার এই দুই লাইনের কথা সেদিন অামাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলো।অামি অামার সংসারের দিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম।