ছেলেটার সাথে আমার পরিচয়টা মাঝে মাঝে আমাকে লজ্জায় ফেলে দিতো । আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে সবেমাত্র নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে,একদিন চোখ ট্যারা হয়ে যাওয়ার মত অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা আমাদের বাসায় আসলেন,হাতে মিষ্টির বাটি নিয়ে । কথায় কথায় জানালেন তার ছেলেটা ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছেন তার মিষ্টি দিতে এসেছেন । মিষ্টি দেখে আমি বলে বসলাম, আম্মু আমি তো কালো মিষ্টি খাইনা । বলার সাথে সাথে লজ্জায় পড়ে গেলাম,কতই বা বয়স তখন আমার মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ি । সুন্দরী আন্টি হেসে দিলেন আমার কথা শুনে তারপর আমাকে কোলে করে তাদের বাসায় নিয়ে গেলেন সাদা মিষ্টি খাওয়াবে বলে । গিয়ে দেখি তার ছেলেটা ইজি চেয়ারে দুলে দুলে একটা গাবদা গোবদা বই পড়ছে বিশাল জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ।
আন্টি পরিচয় করিয়ে দিলো আমাদের, ছেলেটার নাম সায়ন । এরপর থেকে রকিং চেয়ার লোভে যাতায়াত আর চুপচাপ সায়নের মৃদুস্বরে বলা কথা। কবে যে সে আমার প্রিয় হয়ে গেলো জানিনি,ওর খেলনাগুলো আমার সাথে শেয়ার করার কারণে ওকে আমি ভালো বন্ধু ভাবতে শুরু করলাম । এভাবে কেটে গেলো ৬টা বছর,সায়ন স্কুলের গণ্ডি কাটিয়ে কলেজে পা দিল । আর আমি তো আমিই সেই আগের মতই চঞ্চল রয়ে গেলাম আমরা মগবাজারের সেই বাসাটা ছেড়ে ওয়ারী চলে আসলাম,কেঁদেছিলাম খুব সেদিন । সব প্রিয় বন্ধু আঙ্কেল আন্টি এমনকি দারোয়ান আবুল ভাইকে রেখে চলে আসবো এই ভেবে কান্না সামলাতে পারিনি । পরের বছরে গেলাম ঐ বাসায় এক নিমন্ত্রণে,সায়নকে দেখে খুব অন্যরকম লাগছিলো বুঝতে পারছিলাম না কিছুই । আমি সায়নকে অনেক পছন্দ করতাম কিন্তু ইতি চলে আসবার আগে চুপিসারে জানিয়ে দিল সায়ন আমাকে পছন্দ করে কিন্তু সেই পছন্দের ভালোবাসা বলে এক অন্য নাম আছে,সায়ন আমাকে ভালোবাসে ।অবিশ্বাসের দৃষ্টিতেতাকিয়েছিলাম আমি ইতির দিকে সেদিন ।
ক্লাস সেভেনে ঐ ভালবাসা ঐ অনুভূতি বুঝতে পারার মত ম্যাচিউরড ছিলাম না আমি। তাই সব এড়িয়ে গেলাম । ঠিক কয়েক মাস পরে সায়ন এসে আমার হাত ধরে বললো সে আমাকে কতটা ভালোবাসে । অবুঝ এই আমি শুধু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম । পিছনে অদ্ভুত ছেলেটি তার সমস্ত ভালোবাসার অবহেলা পেয়ে বিস্ময় নিয়ে সেদিন দেখছিল আমার চলে যাওয়া । ক্লাস এইটে আন্টির সাথে দেখা হলে জানলাম সায়ন হোস্টেলে চলে গেছে । আন্টি আমাকে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,তোর আমার ছেলের বৌ হতে কি সমস্যা?আমার ছেলে কী দেখতে সুন্দর না নাকি আমি শাশুড়ি হিসেবে দজ্জাল?একটা মাত্র ছেলে আমার তোর জন্যে কেঁদে কেটে একশেষ । সেদিনের পর থেকে আমার সায়নের উপর অভিমান বেড়ে গেলো । আগে যাও কয়েকমাস পর পর যেতাম ঐ বাসায় বন্ধ করে দিলাম সব ।
ক্লাস নাইনে উঠে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো । এরমাঝে আমি অভিমানের চোটে সায়নের খবর নেইনি কোন । হঠাত্ একদিন দেখি আম্মু খুব তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে আমাকে তাড়া দিচ্ছে । বাসার বাইরে গিয়ে জানলাম সায়ন অসুস্থ আন্টি ফোন দিয়ে যেতে বলেছেন আজই । ঐ বাসায় যাওয়ার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম,কিন্তু আমার জন্যে আরো বিস্ময় তখনো অপেক্ষা করছিলো । সায়নকে দেখে ধাক্কা খেলাম আমি,এই কি অবস্থা ছেলেটার! শুকিয়ে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে ওর অথচ আমার কাছে সায়ন ছিল গ্রীক দেবতা এপোলোর চেয়েও সুদর্শন একটা ছেলে । পাশে বসলাম ওর,আমাকে দেখে হাসলো । চুপচাপ ছিলাম দুজন । একসময় ও আস্তে আস্তে বলতে লাগলো, তুই যখন চলে গেলি নিজেকে খুব একা লাগছিলো । আমি কেঁদেছি খুব তোকে পাইনি বলে । এরমাঝে একটু জ্বর অসুস্থ হয়ে পড়া,বুঝলাম ডক্টর দেখানো দরকার কিন্তু বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিলোনা নিজেকে অবহেলা করতে লাগলাম ।
বাসায় থাকলে অসুস্থতা টের পেয়ে যাবে তাই হোস্টেলে চলে গেলাম যেখানে খেয়াল করার কেউ নেই । ১০দিন আগে রুমমেটের কাছে ধরা পড়ে যাই ।ডক্টরের কাছে পাঠালো এইতো । ধরা পড়লো অসুখ আমার । এই শোন তোকে আমি এখনো ভালোবাসি রে । তুই বাসিস? আমার চোখে পানি জমছিল ধীরে ধীরে । আমি শুধু “ভালো থাকিস” বলে উঠে চলে আসলাম ওর পাশ থেকে । আমি পিছনে তাকাইনি কারণ জানি ওর দৃষ্টিতে সেই বেদনা থাকবে । আমি আর যাইনি দেখতে সায়নকে কারণ দেখলে কষ্ট বেড়েই যেতো । লিউকোমিয়ার (এক ধরণের ব্লাড ক্যান্সার) লাস্ট স্টেজে থাকা একটা ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি । খুব অদ্ভুতভাবে সব শুন্য করে দিয়ে সায়ন 2017 সালের মে মাসের ২০তারিখ মারা গেলো ।
আমি নিজেকে খুনী ভাবতে শুরু করলাম,যে কিনা আঙ্কেল-আন্টির একটামাত্র সন্তানকে খুন করেছে । অথচ ঐ দিন ১৩ফেব্রুয়ারী আমি হাতটা ছাড়িয়ে না এসে যদি বলতাম ভালবাসি ছেলেটা আজ বাঁচতো । আমার উপর অভিমান করে দূরে সরে না থেকে ফার্স্ট স্টেজে চিকিত্সা করে আজ জীবিত থাকতো । এই চিন্তাগুলো আমাকে খুন করে ফেলতে লাগলো,নির্ঘুম একটা একটা রাত কাটাতে লাগলাম ।আজ আমি ইনসমনিয়াক সাড়ে তিনবছর ধরে । দেখতে দেখতে আরেক ফাল্গুন এসে পড়লো, লাল কৃষ্ণচূড়া হয়তো সায়নের ভালবাসার কথা আমাকে পৌছে দিবে “কাছে তুমি বুঝিনি তুমি কার আজ তুমি নেই যাই করি যেদিকে যা দেখতে পাই সবকিছুই তুমিময় ভুল আমারই আমি বুঝিনি,হারিয়ে খুঁজি তোমায় শেষ দেখা,মাথা নত করেছো, ‘ভালো কি আমায় বাসো?’ জবাবে আমি না বুঝেই বলেছি, ‘ভালো থেকো’ ”
পরিশিষ্ট : সায়নের মৃত্যুর পর আমাকে আন্টি সায়নের সব ডায়রিগুলো দিয়ে দিয়েছিল । প্রতিটা পৃষ্ঠায়,প্রতিটা শব্দ কি পরিমাণ ভালোবাসা জড়ানো যা আমাকে কাঁদিয়ে দেয় । আমি আমার প্রতি ওর উজাড় করা ভালোবাসা দেখেছিলাম । আমি এখন অসম্ভব পরিমাণে ভালোবাসতে পারি,মরে গিয়ে সায়ন আমাকে এই ক্ষমতাটুকু দিয়ে গেছে । আজ আমি ভালবাসতে পারি কিন্তু কেউ জানবে না কার কাছ থেকে আমি এই ভালবাসতে শিখেছি সায়ন ডায়রিতে লিখে রেখেছিল আমি যেনো ওর মৃত্যুর পর ওকে চিঠি লিখি প্রতিদিন । মাঝে মাঝে লিখি,ইনসমনিয়াক হয়ে রাত জেগে আকাশে তারাদের মাঝে খুঁজি । আমার কান্না পায় খুব কান্না পায় ।