বাড়িওয়ালা একটু আগে এসে বলেগেছেন “এক সপ্তাহ সময় দিলাম অন্য বাসা খুঁজেন। এখানে আর আপনাদের থাকা যাবে না। এক সপ্তাহ পর এই বাসায় তালা ঝুলবে। কথাটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়।এসব অহেতুক ঝামেলায় আমি পড়তে চাই না। অন্য জমিদার হলে সাথে সাথেই বের করে দিত।” উনার কথা শুনে আমি একবার বলতে চেয়েছিলাম “এক সপ্তাহের নোটিশে বাসা ছাড়া যায় নাকি? আমিও বাড়িওয়ালার মেয়ে। একটা সমস্যায় না পড়লে এই ফাউল মার্কা বাসায় উঠতাম না।
না ঠিকাছে বাসার দরজা, আর না ঠিক আছে বাসার দেয়ালের রং গুলা। খসে খসে সব পড়ছে। আর ঠিক মত পানিও পাওয়া যায় না। আবার বড় গলায় বলেন এক সপ্তাহ পর বাসা ছাড়তে। সমস্যা কি?” কিন্তু আমি জাহেদ এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও কিছুই বললো না। ওর কিছু না বলাতে আমারও আর কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি।বাড়িওয়ালা চলে যাওয়ার পর আমি ওকে বললাম “আপনি একটা পুরাই বলদ।কিছু বলেন নি কেন?” সে আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো “দেখো এমন করে বলবে না। বলদ হলে তোমাকে নিয়ে এমন করে পালানোর সাহস কোথা থেকে পেলাম?”
আমি অনেকক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভাবতে লাগলাম এই কথার কি প্রতিভাষ দেওয়া যায়। মাঝে মাঝে উনি এমন একটা কথা বলবে তখন আমার অনেক রাগ থাকলেও সামান্য একটা কথায় কেমন যেন হয়ে যাই।আমি আর কিছু না বলে মেঝেতে বিছানো চাদরটায় গিয়ে চুপ করে বসে দেয়ালে খসে পড়া রং গুলোর মাঝে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি।জানালা দিয়ে কেমন শান্ত বাতাস এসে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি শুধু চুপ করে অনুভব করছি। বাসায় ফেনও নেই। কিছুই নেই। শুধু নিজেদের কিছু জামা কাপড়, আর ব্যাগ। নিচ তলার ভাবী কি মনে করে যেন পানির গ্লাস, জগ, আর একটা চাদর, দুইটা বালিশ দিয়ে গেছে প্রথম দিনেই। প্রথম যেদিন উনার সাথে কথা হলো তার কিছুক্ষন পরই উনি বলে ফেলেছেন “সমস্যা নেই।
ভয়ের কিছু নেই। ভালোবাসা যদি মজবুত থাকে কোন বিপদই আসবে না। একটা সময় পরিবার এমনিই মেনে নিবে। আমিও পালিয়ে বিয়ে করেছি বুঝলে মেয়ে। একটু অভিজ্ঞতা তো আছে বটে।” এটা বলেই উনি হাসছিল। কিন্তু এই পালানোর ব্যাপারটা আমি উনাকে বলিনি। কাউকে বলিনি। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় মিথ্যে কথা বলে বাসা ভাড়া নিয়েছি। উনি কি করে বুঝেছিলেন? আর ভালোবাসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমাদের মাঝে কি কোন ভালোবাসা আছে? আমি যাকে ভালোবাসি সে মানুষটা অনেক দুরে থাকে।তাকে অনুভব করা যায় কিন্তু চাইলে ছোয়া যায় না, দেখা যায় না।সে আমাকে দুর দেশের গল্প শোনায়। সত্য বলতে কি সে গল্পকে অনুভব করে আমি অনেকটা সময় পার করে দিতে পারি। কিন্তু আমার তখন খুব খারাপ লাগে।ভাবি মানুষটা যদি পাশে থাকতো।
অর্ক একদিন আমাকে ফোন দিয়ে বললো “জানো ইবনাত এই প্যারিস নগরীটা একদম ভিন্ন, একদম অদ্ভুত। ইশ তোমাকে যদি এখানের জোৎস্নাটা দেখাতে পারতাম।এখানের জোৎস্নাগুলো চোখের সামনে ভাসে।যখন তুমি ঘুমাতে যাবে তখন মনে হবে এই জোৎস্নাময় আলো তোমার চারপাশে উকি ঝুকি মারছে। লাস্ট উইকে আমরা কয়েকজন মিলে সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। চারপাশে তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। এখানে যখন সন্ধ্যা নামে তখন কত গল্প, কত স্বপ্ন ঘুরে বেড়ায়। একেকটা স্বপ্নে একেকটা মেঘ ভেসে যায়। বিশাল দালানের এই চমৎকার লাইব্রেরীটা নিজের চোখে যখন আঁকলাম তখন আমার মাথা ঘুরে গেলো বুঝলে? লাইব্রেরির সামনেই বিশাল ফোয়ারাসহ চত্বর। তার পাশেই বিশাল দেয়ালচিত্র।
আমার মনে হয়েছিল এই দেয়ালচিত্রটা যে একেছে সে মানুষটার মনটা কেমন। যে মন আর গভীর মমতা নিয়ে এমন করে আঁকতে পারে?এই দেয়ালচিত্রে মুগ্ধকর কারুকাজের এই ওয়াল পেইন্টিং যা মানুষকে একটু হলেও গভীরতার মাঝে নিয়ে যেতে পারে বুঝছো?” আমি চুপ করে শুধু অনুভব করছিলাম। তখন গভীর রাত।রাতের আকাশকে উপভোগ করার মাঝে একটা আশ্চর্য রকমের আনন্দ আছে। কিন্তু আমি তখন রাতের আকাশে কোন আলো খুঁজে পাইনি, উপভোগ করতে পারিনি রাতটাকে।আমাকে বিষণ্নতা ছুয়ে যায়। আমি বলি “এই রাতের আকাশ আমার একা উপভোগ করতে ভালো লাগে না।কবে আসবে তুমি অর্ক?” সে অনেকক্ষন সময় নিয়ে আমার কথার ঠিকঠাক প্রতিভাষ না দিয়ে বললো “কতদিন তোমার গলায় গান শুনি না। একটু শোনাবে?”
আমার এমন চুপ করে মেঝেতে বসে থাকা দেখে জাহেদ বললো “সুহাসিনী তোমার সাথে আমার আসাটা ভুল হয়েছে।আরও বেশি নিচ তলার ভাবীর সাথে ফুসুর ফুসুর করো। আমি বুঝতেছি না কেন তেমার সাথে বাহির হলাম। এখন বাড়িওয়ালা জেনে গেছে আমরা স্বামী স্ত্রী না।” যদিও আমার নাম ইবনাত। কিন্তু জাহেদ আমাকে সুহাসিনী বলে ডাকে। কেন এই নামে ডাকে আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি।কিন্তু সে নিজেই একদিন বললো “তোমাকে এই নামে কেন আমি ডাকি জানতে চাও না?” আমি বলি “জানার কি দরকার? আপনার ভালো লাগে তাই ডাকেন।” সে বললো “এই নামে ডাকার কারন হচ্ছে তোমার কষ্ট গুলো আমি বুঝি।অনুভব করতে পারি। কিন্তু এতো কষ্টের মাঝে থেকেও তুমি খুব সুন্দর করে হাসতে পারো। তুমি কি জানো তোমার হাসিটা কতটা সুন্দর?”
আমি চুল কানে গুজে ইতস্তত করে জাহেদকে বললাম “আপনি আমাকে বকা দিচ্ছেন কেন? আমি কি জানি তিন তলার ভাবী বিষয়টা অনুমান করতে পারবে?” সে কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো “তোমার অর্কের সাথে আর কথা হয়েছে? তাকে আইসা এই মামলাটা সমাধান করতে বলো। আর আমিও উদ্ধার হই।এতোক্ষনে হয়তো তোমার বাবা আমার নামে মামলা ঠুকে দিছে। তুমি খুব ভালো করেই জানো তোমার বাবা মা আমাকে কতটা ভালো ছেলে মনে করে। আন্টির সামনে মুখ দেখাবো কেমন করে আমি? আর আমার বাবা মায়ের কাছেও হয়তো এই খবরটা চলে গেছে।” আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না।মাথাটা হঠাৎ করে ঝিম ঝিম শুরু করতে লাগলো।চারপাশের ভয়গুলো আমাকে কেমন করে যেন ঘিরে ধরতে লাগলো।আমি জানি এমন কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি। আমার এই ভালোবাসার ব্যাপারটা জাহেদ জানে।অবশ্য আমিই বলেছি। আর এসব কিছু জেনেও আমার সাথে পালাতে রাজি হলো কেন?” আমি ওকে বললাম “কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে পালাতে কেন রাজি হলেন? আমি বললেই কি আমাকে নিয়ে পালাবেন? আমি তো অন্যজনের। অন্যজনকে ভালোবাসি।আর পালানোর আগে এসব কথা মাথায় আসলো না? এই দেখুন না আপনার কতবড় ক্ষতি হয়ে গেলো।”
আমার কথা শুনে ও একটা কথাও বললো না। শুধু কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আমি বুঝতে পারলাম এই দীর্ঘশ্বাসের কারণটা। যতবার আমি অর্কের কথা জাহেদকে বলতাম ঠিক ততবার ও দীর্ঘশ্বাস নিত। আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি এতো ঘনো ঘনো দীর্ঘশ্বাস কেন নেন?” আমি বললাম আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?” সে মাথা নিচু করে ঝিম মেরে থাকলো অনেকক্ষন। আমি হাসলাম এবং তার এই চুপ থাকাটা খুব ভালো করেই বুঝলাম। যদিও আমি অনেক আগেই বুঝেছি। আমি বললাম “আপনি যাকে পছন্দ করেন সে মানুষটা অন্যজনের কাছে বাধা। অন্যজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।এটা বুঝেন না? আপনাকে কিছুক্ষনের জন্য তুমি করে বলি হ্যাঁ?” সে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর আমি বলতে লাগলাম “সেই কলেজ লাইফ থেকে ছেলেটাকে একটু একটু করে ভালোবাসলাম। বয়স কতই বা হবে তখন।
ঐ বয়সে ভালোবাসাটা গভীরভাবে কি করে অন্তরালে পোষ মানাতে হয় আমি জানতাম না। বুঝতাম না ভালোবাসাটা নিজের কাছে কিভাবে যত্ন করে রাখে।আমি শুধু অনুভব করতাম ভিন্ন একটা সত্তাকে নিয়ে আমি বার বার হারিয়ে যাচ্ছি। তাকে নিয়ে ভাবছি। কি একটা অদ্ভুত অবস্থা হয়েছিল আমার।একদিন কি করলাম জানো? খুব সাহস আর লজ্জা নিয়ে নিজেই একটা চিঠি লিখে ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।তার চেহারাটায় আমি ভয়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। অবশ্য আমিও পরে ভয় পেয়েছি এবং ভেবেছি একজন মেয়ে হয়েও এই কাজটা আমি কি করে করলাম? পরে মনে করেছিলাম এটা নিয়ে কলেজে ও সবাইকে বলে বেড়াবে, আমাকে নিয়ে মজা করবে। এই ভয়ে ভয়ে আমি এক সপ্তাহ কলেজে যাইনি। কিন্তু আমি তাকে নিয়ে ভাবতাম।এরপর যখন ওর সাথে কলেজে দেখা হলো আমি লজ্জায় মাথা নিচু করেছিলাম। সে হাসতে হাসতে কি বলেছিল জানো? কবিতা বলেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর…
“এই যে বাইরে হু হু ঝড়, এর চেয়ে বেশী বুকের মধ্যে আছে কৈশোর জুড়ে বৃষ্টি বিশাল, আকাশে থাকুক যত মেঘ, যত ক্ষণিকা মেঘ উড়ে যায় আকাশ ওড়ে না এরপর বললো “চকলেট খাবা? নতুন কিছু শুরু করতে হলে মিষ্টি মুখ করতে হয়।” আমার তখন মনের ভিতর একটা ঝড় বয়ে গেলো। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ছলোছলো চোখে। তারপরই আমাদের ভালোবাসাটা শুরু হয়।জীবনটা জীবনের মতই চলতে থাকলো। যত সময় যায় আমাদের ভালোবাসাটা তত বাড়ে।গভীর ভাবে বাড়ে। ভার্সিটিতে উঠার কয়েক বছর পর আমাদের জীবনে অনেক কিছু হয়ে গেছে। শুনতে চাও?” জাহেদ কিছু বললো না। আমিও কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম। বুঝতে পারলাম মুহুর্তেই ওর চেহারাটায় কেমন বিষণ্নতায় ছুয়ে গেছে। এই বিষণ্নতটাকে আরও গভীর করার জন্য আমি বললাম “মন দিয়ে শুনো এবং কষ্ট অনুভব করো। দেখো তোমাকে কষ্ট কেমন করে ছুয়ে দিয়ে যায়।
আমাদের ভালোবাসার মাঝে শারিরীক চাহিদা প্রবেশ করেছিল। এই যে তোমার সামনে যে মানুষটা বসে আছে সে মানুষটাকে তুমি পছন্দ করো তার শরীরের মাঝে অর্ক কতবার মিশেছে।আমি একটা বারও বাধা দেইনি তাকে।” এই কথা শুনেই জাহেদ কি বলবে হয়তো বুঝতে পারে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম সে কাপতে লাগলো। তার চোখ জোড়ায় আমি ভয়ানক যন্ত্রনা দেখতে পাচ্ছি।বুঝতে পারছি ওর ভিতরটা এখন কেমন করে উঠছে।আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটা হাসি দিয়ে বললাম “কষ্ট লাগছে বুঝি? তোমার সাথে আমি এখানে আসছি আজকে সহ তিনদিন।তোমাকে বলেছিলাম আমাকে একটা বাসা ঠিক করে দিতে। সবার থেকে আলাদা হয়ে যাবো। নিজের মত করে চলবো।কোন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, বান্ধবী কারও কাছে যাবো না। কিন্তু একা একটা মেয়েকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইলো না। তুমি নিজেকে স্বামীর পরিচয় দিয়ে এই বাসাটা ঠিক করে দিলে।আমাকে এখানে নিয়ে আসলে।
আমার সাথে দুইটা দিন থাকলে কিন্তু একটা বারও ছুয়ে দেখলে না। আমি জানি না তোমার সাথে বের হতে কেন রাজি হয়েছিলাম। আর কেনই বা তোমাকে এমন করে বললাম।আর কেনই তোমার সাথে এতো কথা বলি, আমার সব কিছু শেয়ার করি। বাড়িওয়ালা এক সপ্তাহ সময় দিয়ে গিয়েছে।তার আর দরকার নেই। কিছুক্ষন পর আমাকে সিএনজিতে উঠিয়ে দিলেই হবে বাসায় চলে যাবো। আমার কপালে যা হবার হবে। অবশ্য হলেও বা কি? এই জীবনটাকে আমি এখন জীবন মনে করি না। আমি আমার বাবা মাকে বলবো একটু একা থাকতে চেয়েছি তাই কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছি। অবশ্য আমি জানি বাবা কিছু বলবে না। মা, বাবার পক্ষ থেকে দু গালে দুটো চড় মারবে। আর তুমি সোজা তোমার বাবা মায়ের কাছে যাবে।ওখানে কয়েকটা দিন থেকে তারপর আসবে।তাহলে তোমার উপর কেউ সন্দেহ করবে না। বুঝতে পেরেছো কি? আর এতোক্ষন তুমি করে বলাতে দুঃখিত।”
বাংলা সিনেমার প্রতি আমার বেশ এলার্জি আছে।এতো এলার্জি থাকার পরও কিছু কিছু সিনেমা আছে যা মনকে একদম শিহরত করে দেয়।মাঝে মাঝে ভাবায় জীবনটা অনেকটা সিনেমার মত। মায়ের পাশে গিয়ে যখন বসলাম দেখলাম মা “হঠাৎ বৃষ্টি” দেখছে।মা শুধু আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সিনেমা দেখাতে মনোযোগ দিল। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বললো “আজকাল অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠা হচ্ছে। এটা খুব খারাপ অভ্যাস। টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে।” আমি কিছু না বলে কিছুক্ষন পরই উঠে যাই।
বাসায় আমার বিয়ে ঠিক করেছিল।আমি না পারছিলাম অর্কের কথাটা বাবা মাকে বলতে, আর না পারছিলাম অর্ককে বুঝাতে।মাকে যখন অনেক ইতস্তত আর ভয়ে ভয়ে বললাম “আমি একজনকে পছন্দ করি।” মা আমার দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে বললো “তুমি জানো তোমার বাবা কেমন। আশা করি তোমাকে বুঝাতে হবে না।” আর যখন অর্ককে বললাম “আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিব।” সে শুধু বললো “একটু ব্যাস্ত আছি। পরে ফোন দেই?” কিন্তু সে পরে ফোন দেয়নি। ফোন দিল তার ঠিক দুদিন পর।ফোন দিয়েই বললো “মন ভালো?” আমি মন ভরা অভিমান নিয়ে বললাম “তুমি বুঝতে পারছো না? আমার সাথে এমন করছো কেন? কি চাও তুমি? আমি কি মানুষ না? আসলে কি জানো আমার প্রতি তোমার কোন আগ্রহ নেই” সে চুপ করে থাকে। আমি নরম হয়ে বললাম “অর্ক শোন না, তুমি তোমার বাবা মাকে আমাদের বাসায় পাঠাতে পারো না?
বা আমি আমার বাবা মায়ের ফোন নাম্বার দেই তুমি কি একটু কথা বলবে? একটু বুঝিয়ে বলবে? কত সুন্দর করে কথা বলো তুমি। বাবা মা নিশ্চয় বুঝবে।” সে আমাকে বললো “ইবনাত বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবছি না এখন।” কথাটা শুনেই মনে হলো কেউ আমার গলাটা চেপে ধরেছে। একটা মানুষ তার সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে তাকে আপন করতে চাচ্ছে আর সে মানুষটার এই ব্যাপারে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারপরও আমি বললাম “আচ্ছা বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে এখন না ভাবলেও চলবে। কিন্তু পরিবাকে মানাতে তো পারি?” সে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। আমি ফোনটা ছুড়ে ফেলে দেই।ভালোবাসার বিচিত্র রুপ-রস-গন্ধ মানুষকে যেমন করে মুগ্ধ করে আবার ঠিক তেমন করে সব তছনছ করে দিতে পারে আমি তখনি উপলব্দি করলাম। সে ভালোবাসাটা একটা বছর ধরে আমার সাথে ঠিক মত কথা বলে না। বলে না “তোমার চুলের গন্ধটা এখনো আমি অনুভব করি।” ভালোবাসাটা এমন করে পালটে যায় কেন?
বর্ষার এই সময়টা কেমন যেন।মায়ের কথা সত্য আজকাল আমি খুব দেরিতে ঘুম থেকে উঠি। বর্ষার এই সময়টায় ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না।বর্ষার এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মত আমার চোখেও পানি ঝড়ে।কি একটা বিচ্ছিরি অবস্থা। মনে হয় ওয়াসার পানির লাইন আমার চোখ দুইটা। যখন পানি আসে তখন মনে হয় চোখ দুইটা উপড় ফেলি। ফাউল এই সব ওয়াসার পানি আসার লাইন যদি সব বন্ধ হয়ে যেতো। দুমাস হলো আমি বাসায় এসেছি। যেদিন বাসায় এলাম বাবা আমাকে দেখে কান্না করে দিয়েছিল। বললো “কিরে মা এইভাবে না বলে কোথায় গিয়েছিলি? তোর এই বিয়েতে মত নেই আমাকে বললেই পারতি? এইভাবে কেউ বাসা থেকে বের হয়ে যায়? বাবা চিন্তা করবে বুঝিসনি?” আমি কি বলবো বুঝতে পারিনি। কেঁদে দিয়েছিলাম বাবার এমন কথা শুনে। কাঁদতে কাঁদতে আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছিলাম।মা মুখ বাকা করে বললো “ঢং করেন মেয়েরে নিয়া? দুইটা থাপ্পড় লাগান। রাতের ঘুম হারাম করে ফেলছে।” এটা বলে মাও কান্না করে দিল। আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারিনি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু বাবা আমাকে কিছুই বলেনি। উলটো বাবা বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিল।
অর্কের সাথে আমার এখন কথা হয় না বললেই চলে।গত দশদিন আগে একবার ফোন করেছিল। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। আমি বুয়াকে ধরিয়ে দিয়ে শিখিয়ে দিলাম বলো ঘুমাচ্ছে।ওর সাথে কথা বললেই এখন নিজেকে ছোট মনে হয়।যন্ত্রনা হয়।দুঃখ বাড়ে।আকাশ কেপে ওঠে।চোখে বৃষ্টি ঝড়ে।
এই বৃষ্টিটা ইদানিং পুরো শহরকে ভিজিয়ে দিয়ে সব কক্সবাজার বানিয়ে ফেলেছে।বর্ষার সময় আকাশ থাকে গুরুগম্ভীর। কালো মেঘের ভারে এই আকাশ সব সময় সেজে গুজে থাকে। এই সেজে গুজে থাকা আকাশের মেঘ ছুঁয়ে দেখতে কার মন না চায়। এসব ভাবতে ভাবতেই জাহেদ ফোন করে বললো “সুহাসিনী তুমি কি ঘুম থেকে উঠেছো? শুনতে পাচ্ছো আকাশ কেমন করে ডাকছে?” আমি কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললাম “এই আপনি ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলেন কেন? সোজা সুজি বলেন না, আমাকে আপনি ডাকছেন বৃষ্টিতে ভিজার জন্য।দুই দিন আগেও ভিজেছি। এখনো সর্দি। একটু লাইনে থাকেন। ন্যাকড়াটা কোথায় যেন রেখেছি।” সে আমার কথা শুনে হাসতে লাগলো। আমি শুধু অনুধাবন করলাম আমার সমস্ত কিছু জানার পরও জাহেদ আমার সাথে আগের মতই কথা বলছে।
আমি যখন কিছু দিন আগে ছাদে গিয়ে ওকে বললাম “আমি সুইসাইড নোট লিখেছি। এই জীবনটা আমার ভালো লাগে না। একটু স্বাধীনতা চাই, আকাশে উড়তে চাই। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে চাই। মারা যাবার পর আমার ভালো বাবা মাকে একটু দেখে রাখবেন? আমি ছাড়া বাবা মায়ের কেউ নেই। একটা মাত্র মেয়ে আমি।বাবা মা সহ্য করতে পারবে না।” সে আমার কথা শুনে অনেকক্ষন চুপ থাকার পর বাচ্চা ছেলের মত কান্না করে দিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে বললো “আমাকে কে দেখে রাখবে বলো তো সুহাসিনী?” আমি ওর কথায় বিষম খেয়ে গেলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। রাগ দেখিয়ে বললাম “ছাতার এইসব ভালোবাসার আবেগ আমার সাথে দেখাবেন না। ভালোলাগে না।” তারপরই ওর সামনে থেকে চলে এসেছিলাম। ও আমাদের বিল্ডিং এর একদম ছাদের রুমটায় থাকে।একটা চাকরি করে। কিন্তু এসব আমাকে ভাবায় না।
কিছুক্ষন পর ছাদে এসেই নিজেকে যখন বৃষ্টিতে মেলে ধরলাম জাহেদ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আমি বললাম “আপনার কথায় কেন বৃষ্টিতে ভিজতে আসলাম? আমার তো আপনার কথা ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল এবং আপনাকে কড়া ভাষায় ছ্যাচড়া বলে একটা গালি দেওয়ার উচিৎ ছিল তাই নয়কি? কিন্তু জানেন আপনি মানুষটা অনেক ভালো। আমিই একটা বেহায়া মেয়ে।” সে স্থির হয়ে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলো।আমি আবার বললাম “ইদানিং অনেক কষ্ট লাগে। কিন্তু আমি পারছি না নিজেকে শেষ করে দিতে।” সে আমাকে বললো “আমি তোমার অর্কের মত হয়তো এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারি না সুহাসিনী। এই গুনটা আমার মাঝে নেই। আমি খুব সহজ সরল একটা মানুষ। বাবা মা আর ছোট একটা বোন আছে।
আমাকে তুমি খারাপ ভাবতেও পারো। তোমার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছি বার বার এবং নিজেকে শান্তনা দিয়েছি এই ভালো লাগার অধিকার আমি রাখি না। যে মানুষটার মনে আমার ছায়াও নেই তাকে এড়িয়ে চলাই ভালো। কিন্তু আমি বার বার ব্যার্থ হয়েছি। বুঝতে পারি না তোমার সাথে কেন কথা বলতে ভালো লাগে। তোমাকে তো আমার এড়িয়ে চলা উচিৎ তাই না?” আমি বৃষ্টির মাঝে চুপ করে থাকলাম। আমার চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। এমন চুপ থাকা দেখে জাহেদ বললো “বৃষ্টিকে অনুভব করো আর আমার কথা মন দিয়ে শুনো। অর্কের মত প্যারিসের সুন্দর সুন্দর জায়গা গুলো হয়তো তোমাকে দেখাতে পারবো না বা এর বর্ণনা বলতে পারবো না। তবে আমাদের এই দেশটা আছে না তার গন্ধ কেমন তোমাকে বলতে পারবো। গ্রামে যখন এই বৃষ্টি হয় তখন চারপাশে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। এই বৃষ্টি হয় আবার এই থামে। যখন বৃষ্টি হয় তখন এক রকম সৌন্দর্য দেখা যায় আবার যখন বৃষ্টি থেমে যায় তখন আরেক রকম সৌন্দর্য দেখা যায়। বৃষ্টি থামার পর বৃষ্টির জল ধুয়ে গ্রামের মাঠ ঘাট, লতা পাতা, সবুজ ধান ক্ষেত আরও সবুজ হয়ে ওঠে। চারপাশে চোখ বুলালেই শুধু সবুজ আর সবুজ দেখা যায়।
এতো সৌন্দর্য চোখে আঁকা কি যায় বলো? এই সামান্য একটা সৌন্দের্যের কথাই বললাম। অন্য গুলা নাই বা বললাম। কিন্তু বিশ্বাস করো অন্য দেশের সৌন্দর্য থেকে নিজ দেশের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। যেটা অর্ক বুঝতে পারছে না। আমি জানি অর্ক একদিন এই ভালোবাসাটা বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে তুমি ওকে কতটা পাগলের মত ভালোবাসো। ও কতটা ভাগ্যবান তোমার মত একজন সুহাসিনী পেয়েছে।বিদেশের মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তো একটু রঙ বাতাস হয়তো শরীরে লেগেছে তাই এমন করছে। একটু ধৈর্য্য ধরো যখন ও বুঝতে পারবে তুমি কতটা ওর জীবনে মূল্যবান, দেখবে ও ফিরে আসবে। তোমাকে আর হারাতে দিবে না। দুরে দুরে থাকতে দিবে না।” আমি কিছুক্ষন গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থেকে হাসলাম আর বললাম “আপনি দেখছি কবি সাহিত্যিকদের মত কথা বলছেন।” ও শুধু আমার হাসিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।ও হয়তো প্রায় অবাক হয় এসবের মাঝেও আমি হাসি কি করে?
কয়েকটা দিন ধরে আমার বুকটা হঠাৎ করে দুরদুর করে কাপেঁ। আমার তখন মনে হয় অর্ক ভালো নেই। কিন্তু আজকাল ওকে নিয়ে আমার আর ভাবতে ইচ্ছে করে না।সন্ধ্যা যখন নেমে পড়লো সূর্যটা আস্তে আস্তে লুকিয়ে যেতে শুরু করেছে সেই কখন। সন্ধ্যা হলেই সূর্যটা লুকাতে পছন্দ করে।মানুষও যদি নিজেকে কারো কাছ থেকে লুকাতে পারতো? সন্ধ্যা হলেই রাস্তার সোডিয়াম হলুদ বাতিগুলো জ্বলতে থাকে তখন এই নগরীটা নতুন রুপে সাজে।কিন্তু মানুষ কি সাজাতে পারে তার ভিতরটাকে? আমি এখন সারাদিন এসব ভাবি।এই সেই নিয়ে ভাবি।এই ভাবতে ভাবতে পাঁচটা মাস কেমন করে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলো আমি কিছুই বুঝতে পারি না। ঠিক গতকাল এমন সন্ধ্যায় অর্ক ফোন করেছিল।আমি তেমন কিছু বলিনি। জানালার শিক ধরে এই সন্ধ্যার আকাশটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার আকাশে চাইলে মানুষ হারাতে পারে। কিন্তু এই ইচ্ছেটা কেন যেন আমার মনের ভিতর আর জেগে ওঠে না।
এসব ভাবতে ভাবতেই মা এসে বললো “ইবনাত ঝালমুড়ি বানালামরে মা। তুই তো ঝাল খেতে পছন্দ করিস তাই একটু বেশি ঝাল দিয়েছি জলদি আয়। আর জাহেদকে কি একটু দিয়ে আসবি?” আমি শুধু হুম করে শব্দ করলাম। জাহেদকে মা খুব দেখতে পারে। ও যখন আমাদের ভাড়াটিয়া হয়ে আসলো ওর সাথে তো আমি কথাই বলতাম না। মা এই সেই রান্না করে বলতো “এটা একটু জাহেদকে দিয়ে আয়তো। ছেলেটা কি খায় আর না খায়।” আমি বুঝতে পারতাম না এই ছেলের প্র্রতি এতো দরদ কেন লাগতো মায়ের।আমার প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগতো। যখন ওকে মায়ের এটা ওটা রান্না করা খাবার দিয়ে আসতাম তখনো ওর সাথে কথা বলতাম না। খাবারটা দিয়েই চলে আসতাম। আর ও মাঝে মাঝে হাবিজাবি বাজার করে এনে দিত। মাঝে মাঝে মাকে বলতো “আন্টি,আপনার হাতের মাসকলাই এর ডালটা আমার খুব প্রিয়। একদম আমার মায়ের হাতের রান্নার মত।” মায়ের মুখটা তখন একেবারে চকলেটের মত হয়ে যেতে দেখতাম। আমি বুঝাতে পারতাম না মাকে, এসব শুধু পাম দিচ্ছে এই ছেলে। আর বাবাকেও দেখতাম যেদিন বার্সেলোনার খেলা হতো তারা দুজনই রাত জেগে জেগে খেলা দেখতো। আর আমার কাজ ছিল ওদের চা করে দেওয়া। আমার ভীষন রাগ হতো এই ছেলের প্রতি।
একদিন আমায় বললো “তুমি মনে হয় আমাকে সহ্য করতো পারো না ঠিক বলেছি?” আমি একটু রেগে গিয়ে বলেছিলাম “একদম ঠিক বলেছেন আপনি একটা অভদ্র।কারো সাথে প্রথমে কথা বললে আপনি করে বলতে হয় জানেন না?” সে একটু সময় নিয়ে তারপর যেটা বলেছিল আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কথার প্রতিভাষ না দিযে বললো “তুমি নিশ্চয় রাতে ঘুমাও না। রাতে নিশ্চয় অনেক কান্না করো। তোমার উদাসীন এই চোখ আর চোখের নিচের কালো দাগ দেখেই বুঝা যায়। কি ঠিক?” আমি আর একটুও ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকিনি। চলে এসেছিলাম। কিন্তু পরে আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলতে গেলাম। বলতে গেলাম কেন আপনার এমন মনে হলো। তারপর থেকেই ওর সাথে আমি দিনের পর দিন কথা বলেছি। আমার সমস্ত ভালো মন্দ জীবনের কথা শেয়ার করেছি। যে মানুষটা অন্যকে পড়তে পারে, অনুভব করতে পারে তার কাছে আমার মনের কথা গুলো বলতে একটুও কার্পণ্যবোধ হয়নি। আমার নিজেকে একটু হালকা মনে হতো।
আমি রুমের দরজাটায় টোকা দিয়ে বললাম “আসতে পারি?” জাহেদ শুনতে পেয়েই বললো “হ্যা অবশ্যই।” আমি ভিতরে গিয়ে টেবিলে ঝালমুড়ির প্লেটটা রেখে বললাম “আম্মু ঝালমুড়ি বানালো।আপনার জন্য নিয়ে আসলাম।অবশ্য আম্মুই পাঠালো। কি করছিলেন আপনি?” জাহেদ তার হাতের একটা বইটা বন্ধ করে বললো “দ্য লস্ট সিম্বল” বইটা পড়া শুরু করবো ভাবছিলাম। কি অদ্ভুত দেখোই না এই বইটা আমার পড়া হয়নি। অফিসে আমার কলিগ আফসার ভাই থেকে এই বইটার সম্পর্কে জেনেছিলাম। উনি ছোট করে এই বইটার কথা আমাকে বলেছিলেন।যখন বললেন পড়ার আর লোভ সামলাতে পারিনি।উনার কাছে বইটা ছিল।আজকে অফিসে আমার জন্য নিয়ে আসলো।বইটার লেখক হলেন ড্যান ব্রাউন।
এই বইটার সম্পর্কে আফসার ভাই যা বললো তা হলো “রবার্ট ল্যাংডন একটা চরিত্র আছে।এই রবার্ট ল্যাংডনকে একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। তিনি অনুরোধটা ফিরিয়ে দেয়নি। কারণ অনুরোধটা তার একজন পুরানো বন্ধু করেছিল।কথা মত সে অনুষ্ঠানে যায় কিন্তু গিয়ে কিছুই দেখতে পায় না। সে অনেক ভাবতে থাকে তার বন্ধু তাকে কেন এমন মিথ্যে অনুরোধ করলো।তারপর সে তার বন্ধুকে ফোন করে।কিন্তু যখন ফোনের ওপাশ থেকে কেউ কথা বললো তখন শব্দটা অনেক ভয়ানক ছিল এবং পরে সে একটা উপহার পায় যা ছিল তার সেই বন্ধুর হাতের কাটা কব্জি।তারপর সেই ভয়ানক কন্ঠসর লোকটার কথা মত চলতে থাকলো কারন তার বন্ধুকে কারা এমন করেছে কি জন্য এমন করেছে আর কেনই বা তাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে তার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরতে থাকলো। তার কারণ তো আছে। আর সেটা বের করার জন্য এভাবেই সে একের পর এক রহস্যের মধ্যে আটকে পড়ে যায়।”
আমি শুধু শুনে গেলাম জাহেদ এর কথা গুলো। আমার এমন চুপ থাকা দেখে ও বললো “তোমার কি মন খারাপ? মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।” আমি কিছুকক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে এই কথার প্রতিভাষ না দিয়ে বললাম “অর্ক দেশে আসছে। গতকাল ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করেছে।আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। এসেই আমাকে বিয়ে করবে। আমাকে নাকি সে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।আমাকে আর হাতছাড়া করতে চায় না।” জাহেদ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তার সেই দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে বললো “তা তো খুশির কথা। কিন্তু মুখ গোমড়া হওয়ার কথা না।” আমি বললাম “ও একটা স্বার্থপর জানেন।ওখানে ওর সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক হয়েছে। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। মেয়েটার নাম ফিউনা।কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি এই ব্যাপারে তাকে কিছুই বলিনি।
আমার কি বলা উচিৎ ছিল না, অর্ক কেন এমন করছো? আমি এই মানুষটার যে অনেক কষ্ট হয় বুঝো না? সে গতকাল ফোন করে নিজেই এই বিষয়টা যখন বললো আমি তখন ইতস্তত হয়ে বলেছিলাম “এটা আমি অনেক আগেই জানি অর্ক।” সে অনেক কান্না করছিল।ফিউনার সাথে তার কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে পুরানো মানুষটাকে অনুভব করেছে বুঝলেন। আসলে কি জানেন ভালোবাসা জিনিসটাই অনেক ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার কোন রং নেই। এটা বর্ণিল।যখন যেখানে বিস্তার করে সেখানেই আগাছা ছড়িয়ে পড়ে। না পারা যায় এটা দেখতে আর না পারা যায় এটাকে ছুয়ে দিতে।কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে একদম শেষ করে দেয়। এই ভালোবাসা এতো অদ্ভুত কেন? আজকাল আমার কিছুই ভালো লাগে না। কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। আসি, আপনি বই পড়ুন।”
দিনের বিকেলের আকাশটা আমার ভীষণ প্রিয়। এই বিকেলের দিকে তাকালে নিজেকে এই বিকেলের মত শান্ত মনে হয়। মাথার উপর বিশাল বিশাল মেঘ ভাসতে থাকে। এই মেঘ যখন ভাসতে থাকে আমার তথন গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে। কতদিন এমন করে গাই না। আমার বোধ-বুদ্ধি একদম সংকীর্ণ।কিভাবে নিজের কাছের মানুষকে নিজের মাঝে ধরে রাখতে হয়, তা হয়তো আমার জানা নেই।কিন্তু আজকের এই বিকেলটা আমার কাছে একটু অন্য রকম। কিছুক্ষন পর যখন সন্ধ্যা নামবে আঁধার আর আলোর ঝলকানী নিয়ে একটু হারাবো। দেখবো ভালোবাসা গুলো কেমন। অর্ক দেশে এসেছে চার দিন হলো।আজকের এই সন্ধ্যায় আমি একবার ওকে আসতে বলেছি।
ঠিক যখন সন্ধ্যার লালচে আলোটা চোখের সামনে থেকে উদাও হয়ে গেলো অর্ককে আমি দাঁড় করালাম জাহেদ এর সামনে। আমি শুধু দুজনের চোখ গুলোকে ভালো করে দেখলাম। দুজনের চোখেই অনেক প্রশ্ন। অর্ক একবার বলে ফেলেছে হঠাৎ তোমাদের বিল্ডিং এর ছাদে কেন নিয়ে আসলে। আর উনি কে?” আমি এই কথার কোন প্রতিভাষ দেইনি। জাহেদ সামনে থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। সে হয়তো আশা করেনি এমন করে অর্ককে তার সামনে দাঁড় করাবো। আমি বলেছি যাবেন না।
কিছুক্ষন সময় নিয়ে আমি মাথা নিচু করে যখন অর্ককে বললাম বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল সেটা তোমাকে বলেছি কিন্তু একটা বিষয় জানানো হয়নি তার জন্য আমি দুঃখিত। বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। সব কিছু ছেড়ে। তোমার সামনে যে মানুষটাকে দেখছো সে মানুষটার সাথে আমি তিনটা দিন ছিলাম।তিনটা দিন বুঝো? এই মানুষটা আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।” এই কথাটা শোনার পর অর্ক চোখ বড় বড় করে আমার দিকে একবার আর একবার জাহেদ এর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কেমন করে কেপে ওঠে দু কদম পিছনে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম ওর ভিতরটা কেমন করে নেড়ে উঠেছে। এমন করে আমিও কতবার কেপে উঠেছি ঠিক নেই অর্ক। জাহেদ বলতে থাকলো “না তুমি উনাকে এমন করে কেন বলছো? তোমার বলার ধরনটা ঠিক ছিল না।
বিশ্বাস করেন বাসা থেকে বের হয়েছিল ঠিকি। কিন্তু আমাদের মাঝে কিছু হয়নি। এটা অন্তত বিশ্বাস করুন। আপনাকে ও কি পরিমাণ চায় আপনি এটা হয়তো জানেন না। ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে ভাইজান।” এই মানুষটা অস্থির হলে বাচ্চাদের মত হয়ে যায়।কিন্তু আমি তাকিয়ে থাকলাম অর্কের দিকে। সে কিছুক্ষন পর “ছিহ ইবনাত” এই শব্দটা করে সামনে থেকে চলে গেলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে হাসলাম। যাওয়ার সময় জাহেদ ওকে আটকাতে চাইলে আমি বললাম “একদম আটকাবেন না।” জাহেদ ঝিম মেরে থাকলো কিছুক্ষন তারপর আমাকে বলতে লাগলো “এটা তুমি ঠিক করোনি। কেন এমনটা করলে?” আমি জাহেদ এর দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলাম তারপর চোখের কোনের জল মুছে বললাম “আমি কি একটা কথাও মিথ্যে বলেছি? এই বিষয় গুলো অর্কের জানার দরকার ছিল। বলেন দরকার ছিল না?
আমার ছোট্ট রুমের বারান্দায় বসে চিঠিটা পড়ার পরই আমার চোখ এক গাদা জল গড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষন আগে বুয়া এসে এই চিঠি দিয়ে বলে গেলো “আপামণি, ছাদে থাকে যে ভাইজানটা হে আপনারে এই চিঠিটা দিতে কইছে।যাওয়ার সময় দেখলাম কাধে ব্যাগ। জিগাইলাম কই যান? কিছু কয় নাই।” চিঠিটা খুলতেই বড় বড় অক্ষরে নীল কালিতে ছোট্ট করে লিখা ছিল…
খুব কল্পনা করতে ইচ্ছে করে গ্রামের টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ, আর রাতের তারাদের নিয়ে জীবন গাথার গল্প গুলো আঁকতে। তোমাকে দেখাতে, আমার এই সস্তা জীবনের গল্প গুলো কেমন। এই গল্প গুলোতে তেমন কোন চাওয়া পাওয়া নেই। আছে শুধু একটু ভালোবাসা। আমি নিজেও জানি না সুহাসিনী হঠাৎ তোমাকে আমার এতো ভালো লেগে গেলো কেন? আমি জানা সত্বেও সাগর পারে ভুল বৃষ্টি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার বুঝার উচিৎ ছিল এই ভুল বৃষ্টি বিশাল সাগরের জন্য কিছুই না। এই সাগরের গভীরতা অনেক। এই গভীরতা অনুভব করার কোন অধিকার আমি রাখি না। তোমার অর্ককে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। দুদিন হলো তাকে বিষয়টা বুঝাতে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। আমাকে খুঁজো না। ভুল বৃষ্টিদের খুজতে নেই। তোমার হাসিটা আমি ভুলবো না। এটা ভুলার মত না। আমার বিশ্বাস তুমি যেমন করে অর্ককে ভালোবাসো ঠিক তেমন করে আমাকে এমন একজন ভালোবাসবে। তার পুরো আকাশ জুড়ে আমি সাদা মেঘ হয়ে থাকবো। খুব ভালো থেকো।
ইতি
ভুল বৃষ্টি
চিঠিটা পড়ে আমি স্থির হয়ে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ালাম। আমি বুঝিনা এই মানুষটার জন্য আমার চোখ দিয়ে পানি কেন পড়ছে? এই মানুষটা হঠাৎ করে আমার জীবনে এসে সব কিছু কেমন উলোট পালট করে দিয়ে গেলো।গতকাল রাতে অর্ক ফোন করে ফের কান্নাকাটি করেছে। আমি কিছুই বলিনি। ভালোবাসার রংধনু গুলো বর্ণিল কেন? এমন বিমর্ষ কেন? ভুল বৃষ্টি আপনি না জাহেদ সাহেব। আমিই ভুল বৃষ্টিকে ভালোবেসেছি আর ভুল বৃষ্টির মাঝেই আমাকে সারা জীবন ভিজতে হবে…