নির্জনা

নির্জনা

পর্ব – ০১)

রাত ৯ টা । বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে মাত্র ল্যান্ড করলো ফ্লাইটটি । আমেরিকাতে মাইগ্রেশন হওয়ার পর সজলের এই প্রথম দেশে ফেরা । দীর্ঘ চার বছর পর বাবা, মা, বোনের সাথে দেখা হবে । দেখতে পাবে তার নিজের দেশকে। যেখানে কেটেছে সজলের ২৫টি বছর। রয়েছে শতশত স্মিতি। অসম্ভব ভালো একটা অনুভূতি হবার কথা, কিন্তু কেন জানি বিষাদে ভরে যাচ্ছে সজলের মনটা ।ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে আবার আমেরিকায় । আসতে চায়নি সজল মোটেও, একরকম বাধ্য হয়েই আসা । বাবা-মা খুব দেখতে চাচ্ছে তাদের একমাত্র ফুটফুটে ২ বছরের নাতনী প্রিয়তী্কে। বিয়ের পরপর সেই যে চলে গেছে স্ত্রীকে নিয়ে, আর ফেরা হয়নি দেশে।অনেক অনুরধের পর আর বাবা-মার কথা ফেলতে পারেনি সজল । তাইতো শত অনিচ্ছা সত্তেও স্ত্রী জয়ীতাকে নিয়ে চলে আসে ক্ষনিকের জন্য তার নিজের দেশে । এয়ারপোর্টের সব নিয়ম কানুন শেষ করে বেরুবার পথেই দেখতে পায় বাবা-মা দাড়িয়ে আছে হাসি মুখে । সজল খুব কষ্ট করে একটু মলিন হাসি ফুটিয়ে তোলে তার মুখে, আর মনে মনে বলে, কেন আমাকে নতুন জীবন দিলে বাবা, কেন আমাকে আবারো সুখের রাস্তায় ছুড়ে দিলে স্বার্থপরের মত তমরা। আমি তোমাদের সন্তান বলে । শুধু সন্তানের কথাটাই ভাবলে; কেন??? আর যদি এতটাই স্বার্থপর হলে তবে আজ কেন আবার নিয়ে এলে আমায় এই দেশে ফিরিয়ে। আমি ত আসতে চাইনি কখনই।

এক ঘন্টা পর

গাড়ি ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কিন্তু সজলের মন যেতে চাচ্ছে অন্য পথে, অন্য এক গন্তব্যে । যেটার ভয়ে এতদিন দেশ থেকে দূরে থেকেছে সজল সারথপরের মত। আজ এতদিন পর সজল কে যেন সেদিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে নিওতি।

বাবা-মা খুব খুশি তাদের নাতনীকে পেয়ে । প্রিয়তী যেন বাবা-মার সেই নির্মম শূণ্যতাকে পূরন করে দিয়েছে, যে শূ্ন্যতা তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর আগে । সজল সেটা দেখেই নিজের মন কে বুঝ দেয়ার অযথা চেষ্টা করল। গারিতে সজলের পাশেই বসা জয়ীতা । এক মমতাময়ী নারী, অসম্ভব মমতার সাথেই সজলের একটি হাত ধরে রেখেছে, যেন বুঝতে পেরেছে সজলের মনের মধ্যে কি চলছে । আর সে জন্যই বুঝাতে চাচ্ছে, ‘যত কিছুই হোক – আমিতো তোমার পাশে আছি । কেন এত ভয় তোমার। আজ সব ভয় সব দুঃচিন্তা আমায় দিয়ে তুমি একটু শান্তিতে থাক।‘

চার বছর আগে বাবা-মা অনেকটা জোর করেই বিয়ে দেন জয়ীতার সাথে । তারপরপরি মাইগ্রেট করে আমেরিকাতে পাড়ি দেয় সজল, সাথে জয়ীতা । বিয়ের প্রথম দিকে কোনভাবেই জয়ীতাকে মেনে নিতে পারেনি সজল ।জয়ীতার দিকে তাকাতেই চেতনা সজল। কিন্তু জয়ীতা হার মানেনি । প্রতিটা মুহূর্ত ছায়ার মত পাশে ছিল। সজলের সব কষ্ট মুছে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে সবসময়। এত গভীর ছিল সেই ভালবাসা যে শেষমেষ সজলও হার মানতে বাধ্য হয়েছে জয়ীতার ভালোবাসার কাছে । সব কষ্ট আরাল করে জয় হয়েছে জয়ীতার ভালবাসার। কষ্টগুলো যেন ভালোবাসার আড়ালে দুমড়ে পড়ে ছিল এতদিন । আজ সজলকে সেই কষ্টগুলো আবারো তাড়া করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সেই পথে, যে পথে একদিন সজল তার জীবনের অর্থ খুজে পেত । ভালোবাসার স্বাদ পেত । মেতে থাকতে সেই ভালবাসার গন্ধে…।

পরদিন

হসপিটালের করিডর দিয়ে হাটছে সবুজ । মনের ভিতর অজস্র উত্থান-পতন চলছে । বারবার পিছনে পা চলে যাচ্ছে সজলের।মন চাচ্ছে ফিরে যেতে। কি দরকার কষ্ট টা আবার বারানোর। পরক্ষনেই আবার মনে হচ্ছে, এসেছি যখন একবার দেখেই যাই। তবুও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সজল, সত্যি কি যাবে সে ওই রুমে নাকি ফিরে যাবে বাড়ীর দিকে । শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল সজল । এসেছে যখন, তখন একবার অন্তত দেখে যাবে সে তাকে । সেই মানুষটাকে যাকে সজল পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ভালোবেসেছিল । কথা দিয়েছিল আর যাই হোক, কখনো সজল তার হাত ছেড়ে দিবে না, সবসময় পাশে থাকবে ।ছায়া হয়ে রবে চিরকাল। চিরকাল!!! সেই নির্জনা ……………।

(পর্ব – ০২)

হসপিটাল এ আসার পর থেকেই সজলের বুক টা দুরুদুরু করে কাপছে। অসস্তি্টা কোনভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ডাক্তারদের সাথে কথা বলে সজল জানতে পারল এখন আর কেউ ই আসে না নির্জনার সাথে দেখা করতে। প্রথম দিকে ওর ভাই কয়েকদিন এসেছিল। এখন শুধু হসপিটালের খরচ টা পাঠিয়ে দেয়। নিজে আসেনা কখন। অনেক ব্যাস্ত হয়ে গেছে। একটা হতাসা ভরা নিঃশাস বের হল সজলের বুক থেকে। একি অবস্থা নির্জনার। একমাত্র বোন কে কতই না আদোর করতো ওর ভাই। আজ শুধু এভাবে ফেলে রেখেছে কিছু টাকা দিয়ে। আর কাকেই বা দোশ দিবে সজল। ও নিজেও তো পালিয়ে বেচেছে সব দায়িত্ত থেকে।

হসপিটালের কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করার পর একজন নার্স সজল কে সেই রুমের দিকে নিয়ে চললো, যে রুমে নির্জনা থাকে । নার্স সজল কে দরজা পর্যন্ত দিয়েই চলে গেলো । সজল দরজা খুলে দাড়ালো । ছোট্ট একটা রুম । বিছানাটা এলোমেলো আর দেয়ালে অনভিজ্ঞ হাতে কিছু আকিবুকি ।চারদিকে চোখ বুলাল সজল। দেখল রুমের এক কোণায় বসে আছে নির্জনা, এলোমেলো চুল । পড়নে হসপিটালের নীল রঙের গাউন ।ছিপছিপে হয়ে গেছে শরীরটা। কেউ যত্ন নেয় না হয়ত। নার্স হয়ত সামান্য দায়িত্ত টুকু পালন করে চলে যায়। হায়রে অভাগী। সজল কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাকলো – নির্জনা……… ।

নির্জনা একবার আলতো করে মাথা তুলে তাকালো সজলের দিকে । সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো । দেখে মনে হলো ও যেন অনেক দূরে তাকিয়ে আছে, ওর চোখ অনন্তকাল দূরে চলে গেছে । বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলো । সজল আবারো ডাকলো নির্জনা…নির্জনা…..

কিন্তু নির্জনা আর একটিবারের জন্যও ফিরে তাকালো না । সজল কিছুই বুঝতে পারলোনা, নির্জনা কি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল নাকি সজল কে চিনতেও পারেনি । প্রায় একঘন্টা এভাবেই কেটে গেল । সজল অনেকবার চেষ্টা করল নিরজনার সাথে কথা বলতে। পারল না।

হঠাৎ সজলের মোবাইল বেজে উঠল । জয়ীতা ফোন করেছে । “হ্যালো, সজল, তুমি কোথায়? ছোট খালা-খালু এসেছেন । তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন তাড়াতাড়ি বাসায় আসো ।“

সজলের এত তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছা ছিলনা । আরো কিছুক্ষন থাকতে চেয়েছিল নির্জনার সাথে । কিছু বলতে চেয়েছিল ওকে । বলা হল না আর। বাধ্য হয়েই উঠতে হলো ।ফিরে যেতে হবে বাসায়। ফিরে আসার আগে নির্জনার বেডে একটি কথা বলা পুতুল রেখে এলো । অনেকবছর আগে নির্জনা আবদার করে বলেছিল-সজল যখন আমেরিকা যাবে, তখন যেন ওকে একটা কথা বলা পুতুল কিনে দেয় । ওর আবদার ফেলেনি সজল । কিন্তু বড় অসময়ে সেই আবদার রাখলো । নির্জনাকে পিছনে ফেলে সজল তার সাজানো সংসারের দিকে পা বাড়ালো । আর কখনো দেখা হবে কিনা নির্জনার সাথে, জানেনা সজল । অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন নির্জনাকে না দেখে এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না । দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেম করেছে নির্জনার সাথে । কলেজ লাইফে পুরোটাই নির্জনার সাথে ছায়ার মত ছিল সজল । সবকিছুই অন্নরকম ছিল তখন। সব ভাল লাগত সজলের তখন। নির্জনার হাত ধরে কাটিয়ে দিতে পারত ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু সজলের পরিবার মেনে নেয়নি এই প্রেম। বাড়ীর সবার সাথে রাগারাগি করে একদিন বের হয়ে জায় সজল। তারপর পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে । প্রথমে কোন পরিবার-ই মেনে নেয়নি । অনেক কষ্ট করতে হয়েছে সজল কে তার মা-বাবাকে রাজি করাতে । তারপর এক সময় তারা মেনে নেয় । কিন্তু কোথায় যেন একটা বাধা থেকেই যায় । নির্জনা কে হয়ত মন থেকে কখনই মেনে নিতে পারেনি বাবা মা। তাইতো মা আর নির্জনার মধ্যে কলহটা দিন দিন বেড়েই চলছিল । একসময় বাধ্য হয়েই আলাদা হয়ে যায় সজল । এরই মধ্যে নির্জনার কোল জুড়ে আসে ছোট্ট শিশু দীপ্ত………

(শেষ পর্ব )

৭ বছর আগে

তখন সজল পুরোদমেই প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত। স্ত্রী সন্তান কে বাসায় একদমই সময় দিতে পারে না। তবে সুখের একটুও কমতি ছিল না ওদের। বাসায় নির্জনা তার ফুটফুটে শিশু দীপ্ত কে নিয়ে সারাক্ষন ব্যস্ত থাকে। আর সজল তখন মাইগ্রেশনের প্লানিং শুরু করেছে মাত্র । নির্জনা তার ভবিষ্যতের একটু একটু করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে্‌, ,… আমেরিকা গিয়ে ছোট্ট একটা বাসা নিবে, দীপ্তকে আমেরিকার ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে, প্রতি সপ্তাহে বেড়াতে যাবে , আরো কত কি ।

এমনি একদিনে সজল সকালবেলা অফিসের পথে বের হয় । সারাদিন অফিসের কাজে এতই ব্যস্ত ছিল যে একবার নির্জনা আর দীপ্তের খবর নেয়া হয়েনি, ফোন করা হয়নি ওদের। সন্ধ্যায় সজল ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফেরে তখন অনেকবার কলিংবেল বাজানোর পরও দরজা খোলেনা নির্জনা ।প্রায় আধা ঘন্টা এভাবেই দরজার বাহিরে দারিয়ে থাকে সজল। শেষে সজল বাধ্য হয়েই এক চাবিওয়ালাকে এনে ঘরের লক খুলে ঘরে প্রবেশ করে । কিন্তু একি, পুরো বাড়ি যে চুপচাপ । সজল চিৎকার করে ডাকে, নির্জনা………

কোন উত্তর আসেনা । তবে বেডরুম থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসে । দৌড়ে যায় সজল । দেখে বেডরুমের বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো । আর ভিতর থেকে নির্জনা দরজা খুলতে বলছে বারবার। অবাক হয় সজল । এটা কিভাবে সম্ভব। নির্জনাকে কে বন্দী করবে বাথরুমে, আর দীপ্তই বা কোথায় । তাহলে কি ডাকাত পরেছিল বাসায় । কিন্তু ঘরের কিছুই তো এলোমেলো নেই। তাহলে!!! ক্লান্ত নির্জনাকে বাথরুম থেকে বের করে সজল । নির্জনা বের হয়ে প্রথমেই জানতে চায়…… দীপ্ত কোথায়???…

সেদিন নির্জনা যখন বাথরুমে গোসল করতে যায়, তখন দীপ্ত বাথরুমের বাইরের লক নিয়ে খেলতে থাকে । দুই বছরের দীপ্ত কিছুতেই বুঝতে পারেনি – কিভাবে করলে লক খুলে আর লেগে যায় । ও যে ওর আম্মুকে ভিতরেই আটকে ফেলেছে সেটা বুঝতেও পারেনা । লক নিয়ে খেলা শেষে ও ওর নিষিদ্ধ এলাকার দিকে পা বাড়ায় । যেখানে ওর মা কড়া করে বারণ করে দিয়েছে না যেতে । রান্নাঘরের আগুন দীপ্তর অনেক পছন্দ । ও ওর ছোট ছোট জামা এনে একটা একটা করে আগুন লাগাতে থাকে আর খুশিতে হাসতে থাকে । অবুঝ দীপ্ত কিছু বোঝার আগেই ও ওর গায়ে আগুন লাগিয়ে ফেলে । দীপ্ত চিৎকার করতে থাকে । কিন্তু ওর চিৎকার ওর মা পর্যন্ত পৌছেনি সেদিন । বাথরুমের পানির আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায় । তারপর সজল যখন বাসায় ফেরে আর সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজে শেষে রান্নাঘরে যায়, তখন শুধুই একগাদা ছাইয়ের স্তুপ আর একটি শিশুর দেহের অংশবিশেষ দেখতে পায় ।

নির্জনা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায় । ওইদিনের পর থেকে নির্জনা আর স্বাভাবিক হয়নি । সজলের সাথে কখনোও কথা বলেনি । সারাক্ষন শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলে । মাঝে মাঝে অনভিজ্ঞ হাতে দেয়ালে একটি শিশুর ছবি আঁকতে চেষ্টা করে । সজল প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। তাই বাবা মা একরকম।।জোর করে বাধ্য করে আবার বিয়ে করতে। মা বাবার জন্য আবার বিয়ে করে সজল, মা বাবার পছন্দের মেয়ে কে…

বর্তমান

আজ সজল আবারো আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছে । সাথে স্ত্রী জয়ীতা আর মেয়ে প্রিয়তী । খুব সুখেই আছে সজল তার স্ত্রী সন্তান কে নিয়ে । বাবা-মায়ের জোড় করে বিয়ে দেয়াটা কাজে লেগে গেছে অনেক । একজন সুখি দম্পতির যা যা থাকার কথা সবই আছে আজ সজলের। সুন্দর স্ত্রী, ফুটফুটে একটা মেয়ে, আমেরিকার সিটিযেনশিপ। আর কি লাগে একটা মানুষের লাইফএ।

তবুও মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে । মনে পড়ে যায় একসময় নির্জনাকে কথা দিয়েছিল সজল, ওকে ছেড়ে কখনো যাবেনা । শুধু ওকেই ভালবাসবে যতদিন দেহে প্রান থাকবে।

অথচ আজ নির্জনাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে সজল, শুধুই নিজের কথা ভেবে, নিজের সুখের জন্য। অনেক দূরে ……………………….

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত