মায়ের মৃত্যুর ১৭ দিনের মাথায় বাবা যখন আরেকটা বিয়ে করে আনলেন। সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়ে ছিলাম। বাবা মাকে দেওয়া শেষ কথাটা রাখতে পারেননি ভেবেই সেদিন বাবার প্রতি আমার ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল।
.
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন সবে মাত্র ক্লাস ফোরের গন্ডি পেরিয়ে ক্লাস ফাইভে উঠেছি আর আমার আদরের ছোট বোনটা হুমায়রা ক্লাস টুতে । আমরা সেদিন স্কুলেই ছিলাম। তিনটা ক্লাস করার পর আমার ক্লাস টিচার নাসরিন ম্যাম আমার কাছে এসে তার নরম হাত দিয়ে আমার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলেছিলেন আবির তোমার আজকে আর ক্লাস করতে হবে না।আজ তোমার আর হুমায়রার ছুটি।
.
আমি খুশিতে লাফাতে লাফাতে হুমায়রার ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছিলাম। ম্যাম এর ডাকে মাঝ পথে থামতে হয়ে ছিল। ম্যামের দিকে ফিরে তাকাতেই । ম্যাম আমার কাছে এসে একটু ঝুকে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলে ছিলেন সাবধানে যেনো বাড়িতে যাই।
ম্যাম আগে থেকেই আমাকে অনেক আদর করতেন কিন্তু মা মারা যাবার পর থেকে তা কয়েক গুনে বেড়ে গিয়েছিল।
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যা সুচক ইশারা করে হুমায়রার ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই ম্যাম আমার সামনে হাটুগেড়ে বসে অভিমান ভড়া মুখ করে বলেছিলেন আমার মিষ্টি কই😕😕😕
আমি সেদিন আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ম্যামের ডান গালে একটা চুমু দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে ছিলাম
(এর আগেও অনেক বার ম্যামের গালে চুমু দিয়েছিলাম কিন্তু কেনো যানি সেদিন আমার খুব লজ্জা লাগছিল)
সেদিন আমার দৌড়ানো দেখে ম্যামের ঠোঁটে হাসি ফুটলেও তাঁর চোখ ভড়া ছিল জল। যা অনেক চেষ্টা করেও তিনি আমার চোখের আরাল করতে পারেননি।
.
হুমায়রা কে নিয়ে যখন বাসায় ফিরেছিলাম বাসায় সবাই নতুন নতুন জামা পড়ে তৈরি হয়েছিল তারা যেন আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিল। আমাদের দুজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে দাদি এগিয়ে এসে দুজনের হাতে নতুন জামা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে।
হুমায়রা তার মিষ্টি কন্ঠে দাদিকে প্রশ্ন করেছিলো। দাদুন নতুন জামা পড়ে আমরা কই যাব?
দাদি তার প্রতি উত্তরে বলেছিলেন তোর নতুন মাকে আনতে যাব।
.
নতুন মার কথা শুনে আমার চোখে পানি আসলেও সেদিন হুমায়রার মত খুশি বোধহয় আর কেউ ছিল না। সে সবাইকে ধরে ধরে বলছিল কি মজা কি মজা আমার নতুন মা আসবে। হুমায়রার এমন খুশিতে লাফালাফি দেখে ছোট চাচীর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ছোট চাচী জল-ছল-ছল চোখে হুমায়রার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সেই জলে ভরা চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না।
মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে সেদিন তাদের সাথে আমি আর যায়নি আমার বাবা নতুন বউ মানে আমার সৎ মা দের বাসায়।
কি করে যেতাম আমার যে বড্ড মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মায়ের নিজের হাতে গড়া, সাজানো গোছানো সুখের সংসার। সেই সুখ বোধহয় সৃষ্টিকর্তার পছন্দ হয়নি। তাইতো হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। সেই অসুখ আমাদের সব সুখে গ্রাস করে ফেলল। জানতে পারলাম মার হাতে আর বেশি সময় নেই। মার দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছেছিল। মা মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে শুধু কান্না করত। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতো তুমি আমাকে কথা দাও আমি মরে গেলে তুমি আর বিয়ে করবে না। বাবা হয়তো মাকে খুশি করার জন্যই সেই সময়ে মিথ্যে কথা দিয়ে মাকে সান্তনা দিতেন। তা না হলে কি মা মারা যাবার সতেরো দিনের মাথায় আরেকটা বিয়ে করতে পারতেন। এসব ভাবছিলাম হঠাৎ করে কলিংবেলের আওয়াজ ভাবনার জগৎ ইতি ঘটলো। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাতটা আমি খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তখনো স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় আমি। কোন রকম স্কুলের ইউনিফর্ম খুলে একটা জামা গায়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলাম। ততক্ষণে রহিম চাচা দরজা খুলে দিয়েছেন। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম বাবার পাশে বউ বেশে একজন সুন্দর মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও ওই মহিলা তেমন সাজগোজ করেননি তবুও তাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল। উনি বোধহয় আমার সৎ মা। সেদিন আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম আমার রুমে। সেদিন আমার চোখ কেন জানি কোন বাঁধা মানছিলনা। অঝোরে গাল বেয়ে পড়ছিল চোখের সেই নোনা অশ্রু জল। হঠাৎ হুমায়রা পেছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। কয়েক ঘণ্টা আগে যে খুশিতে লাফালাফি করছিল তাকে কান্না করতে দেখে আমার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। আমি চোখের পানি মুছে হুমায়রা কে আমার সামনের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম কি হয়েছে?
.
হুমায়রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল ভাইয়া বাবা কি আর আমাদের ভালোবাসবে না। আমি বলেছিলাম কে বলেছে ভালোবাসবে না। বাবা কি তার ছোট্ট পরীকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে।
হুমায়রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল তাহলে বড় চাচি যে বললো বাবা নাকি আর আমাদেরকে ভালোবাসবে না। এখন নাকি শুধু নতুন মাকে ভালোবাসবে।
.
আমি সেদিন হুমায়রা কে বুকে জড়িয়ে বলেছিলাম। বাবা ভালো না বাসলে তো কি হয়েছে আমি তোকে ভালোবাসবো। আমরা দুই ভাই বোন সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দিকে কারো নজর ছিল না সবাই তো নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা কোমল হাতের ছোঁয়া ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তবুও আমি চোখ বন্ধ করে সেই কোমল হাতের ছোঁয়া কে অনুভব করছিলাম। কেন জানি সেই কোমল স্পর্শে সাথে আমার মায়ের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। মা প্রতিদিন এমনভাবে আমার ঘুম ভাঙ্গাতো কিন্তু মা তো আর বেঁচে নেই তাহলে এই হাতটা কার। চোখ খুলতেই দেখলাম আমার খাটের পাশে বসে আছে আমার সৎ মা আর আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছি আমার উস্কোখুস্কো চুলগুলোকে। তাকে দেখে আমি লাফ দিয়ে দুহাত পিছনে সরে গিয়েছিলাম সেদিন। আর চিৎকার করে বলেছিলাম খবরদার আপনি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না। আপনি আমার বাবার বউ হতে পারে কিন্তু কখনো আমার মা হবার চেষ্টা করবেন না।
আমার কথা শুনে সেদিন তিনি হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছি কিন্তু আমাকে বুঝতে দেননি।
মিষ্টি হেসে বলেছিলেন ঠিক আছে বাপু এখন উঠ তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে হবে তো।
.
এমন ভাবে কাটতে থাকে সময় এরি মাঝে সৎ মার সাথে বেশ ভাব জমে যায় হুমায়রার। তিনি প্রতিনিয়ত আমার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে কিন্তু আমি সব সময় তার থেকে দূরে দূরে থাকতাম কারণ সবাই যে বলে সৎ কখনো আপন হয় না। আমি তাকে তাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন জিনিস ভেঙে তার নাম দিতাম। #সামিল_ইয়াসার ¡এজন্য বাবা অবশ্য সৎ মাকে খুব বকা দিত একদিন তো তাকে থাপ্পর দিয়েছিল। সেদিন আমি তাকে দেখেছিলাম বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে। সেদিন তিনি সবার সামনে কাঁদেননি চিলেকোঠায় উঠে দরজা ভিড়িয়ে কান্না করেছিলেন। এরপরও আমি তার পিছু ছাড়েনি। একদিন তো বাবার শাট ছিঁড়তে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খায়।
সেদিন তিনি আমার গাল টেনে মিষ্টি কন্ঠে বলেছিলেন ওরে আমার পাঁজি ছেলেরে বাবার শার্ট ছিঁড়ে মাকে বকা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি কিছু বলতে পারি শুধু ভয় কাঁপছিলাম বাবাকে যদি বলে দেয় বাবা নিশ্চিত আমাকে মেরে ফেলবে।
কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে বলেছিলেন ভয় পেয়ো না তোমার বাবা কে কিছু বলবো না। এই বয়সে যদি দুষ্টুমি না করো তাহলে কখন করবে শুনি আমার মত বুড়ি হলে করবে বলেই ফিক করে হেসে দিয়েছিলেন।
সেদিনই প্রথম তাকে আমার ভালো লেগেছিল। এত ভাল কি মানুষ হয়। তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো আমার কানের নিচে একটা চড় লাগিয়ে দিতেন। কেন জানি সেদিন তাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু জড়িয়ে ধরতে পারিনি ওই যে একটা কথা সৎ কখনো আপন হয় না।
দাদির মুখে শুনেছিলাম তার নাকি আগেও একটা বিয়ে হয়েছে। কোন সন্তান না হওয়ায় ডিভোর্স হয়েগেছে। দেখতে দেখতে অতিবাহিত হয়ে গেছে চারটি বছর। এই চারটি বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে আল্লাহর রহমতে আমার সৎ মায়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নিয়েছে ফুট ফুটে এক কন্যা শিশু। সবাই বলে সে নাকি আমার কার্বন কপি। তাই আমার নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছে আবিদা। তিন বছরের পিচ্চি মেয়েটা সারাদিন ভাইয়া ভাইয়া বলে বাড়ি মাথায় করে রাখে। আমাকে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। আমার সাথেই সে খাবে আমার সাথে ঘুমাবে। প্রথমে আমার বিরক্ত লাগলেও এখন আর লাগে না। তার সাথে যে আমার বেশ ভাব জমে গেছে। কিন্তু সৎ মা তখনো আমার সাথে ভাব জমাতে পারেননি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে হার মানতে হয়েছিল। ভাব জমাতে হয়েছিল আমার সৎ মায়ের সাথে।কিন্তু আমি বড্ডো দেরি করে ফেলেছিলাম। সেদিন বাড়িতে সৎ মা আবিদা আর আমি ছিলাম। আমি ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ কারো চুল টানাটানিতে ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। চোখ খুলে দেখলাম আমিদা মা মা বলে কান্না করছে আর হাত দিয়ে সিঁড়ির দিকে কি জানি দেখাতে চাচ্ছে। আমি আবিদা কে কোলে নিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই দেখলাম আমার সৎ মা মেঝেতে পড়ে আছেন। তার মাথার কাছে যেন রক্তের বন্যা বইছে। ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। মা মা বলে চিৎকার করে ডেকে ছিলাম তাকে কিন্তু সেদিন তিনি আর সাড়া দেননি। অথচ আমার মুখে মা ডাকটা শোনার জন্য তিনি সব সময় মুখিয়ে থাকতেন।
আবিদা কে কোলে নিয়ে আমার দুই মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করছে এক মাকে তো আগেই কেড়ে নিয়েছিলো এখন আবার আরেক মা কেউ কেন কেড়ে নিলো। তাকে যে অনেক কিছু বলার ছিল । স্কুল থেকে ফিরে মা মা বলতে বলতে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। তাকে যে কাজী নজরুল ইসলামের “আমি হব সকাল বেলার পাখি” কবিতাটা আবৃতি করে শোনাবে বড্ডো ইচ্ছে ছিল।