কিছুদিন যাবত আজম সাহেবের মনে হচ্ছে তার মৃত মেয়ে রিনা তার আসে পাশেই আছে, রিনাকে চোখে না দেখতে না পেলেও তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারতেছেন। এমনটা না যে আজম সাহেব প্রচুর শোকে আর আবেগে এইরকম ভাবতেছেন। আজম সাহেব প্রচুর শক্ত মনের মানুষ, খুব কম বয়সে বাবা মা হারিয়েছেন, বছর খানেক আগে তার প্রথম স্ত্রী মনিকা মারা যায়, আর কিছুদিন আগে মেয়ে রিনা সুসাইড করে, এতোগুলো মৃত্যু জীবনে দেখার কারনে তার মন পাথর হয়ে গেছে।
ইদানিং তিনি বেশ কয়েকবার স্বপ্নে রিনাকে দেখেছেন, রিনা তাকে কিছু বলতেছে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় ঘুম থেকে উঠে রিনার বলা কথাগুলো তিনি মনে করতে পারেন না। কিন্তু আজ সকালে জগিং করার সময় হঠাৎ আজম সাহেবের গতরাতে দেখা স্বপ্নটা পরিস্কার মনে পরে গেলো, স্বপ্নে তার মেয়ে রিনা তাকে সকালে বাড়ি থেকে বের হতে বার বার নিষেধ করছিলো , বার বার সাবধান করছিলো সকালে বাড়ির বাহিরে গেলে অনেক বড় বিপদ ঘটে যাবে।
আজম সাহেব এটাকে স্রেফ দূর্বল মনের চিন্তা বলে উড়ায়ে দিতে চেয়েও পারলেন না, কিছুক্ষন পর সোজা বাড়ির পথে রওনা দিলেন ।
ফেরার পথে রাস্তায় আজম সাহেবের পিছন থেকে একটা ট্রাক প্রায় চাপা দিতে ধরেছিলো, নেহাত ঠিক সময়ে টের পেয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে সরে আসার কারনে বেঁচে গেছেন। এমন ঘটনায় আজম সাহেব বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন, অফিসে গিয়ে সারাদিন মনদিয়ে কোনো কাজ করতে পারেননি। আজকের সকালের ঘটনা আর রিনার স্বপ্ন দুইটা কি কাকতালীয় না এর মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে ? সারাদিন যাবত এই কথাই ভাবছেন আজম সাহেব।
তার মেয়ের রিনার সুইসাইডেরও সঠিক কোনো কারন এখনো পর্যন্ত জানতে পারেননি তিনি। সবাই বলেছিলো টিনএজ বয়স, প্রেম সংক্রান্ত বিষয়ে মনমালিন্যের কারনে সুইসাইড করে। কিন্তু আজম সাহেব মনে করেন রিনার সুইসাইড করার কারন তার ২য় বিয়ে, সংসারের জন্য ২য় বিবাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন আজম সাহেব। তার ২য় স্ত্রী মোনালিসা রিনাকে বেশ ভালোভাবে মেনে নিলেও মোনালিসাকে কখনোই রিনা ভালোভাবে নেয়নি। মোনালিসার সাথে রিনার সম্পর্ক ছিলো খুব শীতল, প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলতো না রিনা।
আজম সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন, খুব ক্লান্ত শরীর, কোনোরকম জুতাটা খুলে বেডে শুয়ে পড়লেন, তার দুই চোখ ভারি হয়ে আসলো ঘুমে কিছুক্ষনের ভিতর গভির ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আজম সাহেব ঘুমের ভিতর আরেকটা স্বপ্ন দেখতেছেন। এই স্বপনে রিনাকে স্কুলড্রেসে দেখা যাচ্ছে, রিনা স্কুল ব্যাগ কাধে করে নিয়ে বাড়িতে ঢুকছে। বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় একটা গোঙ্গানোর আওয়াজ পেলো রিনা, আওয়াজটা হয়েই যাচ্ছে, আর আওয়াজটা আসতেছে রিনার বাবার বেডরুম থেকে । কৌতুহলের বসে রিনা সেই ঘরে উুকি দিয়ে দেখলো, তার সৎ মা মোনালিসা অর্ধনগ্ন অবস্থায় বেডে শুয়ে আছেন আর তার বুকে মাথা গুজে শুয়ে আছে আজম সাহেবের বিজনেস পার্টনার সাহবুদ্দিন আলম । ইনিই আজম সাহেবের সাথে মোনালিসার বিয়েটা ঠিক করিয়েছিলেন , মোনালিসা আর সাহবুদ্দিনকে এভাবে দেখে রিনা চমকে উঠে হাত থেকে স্কুল ব্যাগটা ফেলায়ে দেয়। ব্যাগ পরার শব্দে রিনার দিকে নজর যায় মোনালিসা আর সাহবুদ্দিনের, রিনাকে দেখে তারা খুব একটা বিচলিত না হয়ে তাদের কাজ স্বাভাবিক ভাবে চালু রাখে। রিনা এই দৃশ্য বেশিক্ষন দেখতে পারলো না, সে নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
কিছুক্ষন পর সাহবুদ্দিন সাহেব রিনার ঘরে ঢুকলেন, পিছনে একগুচ্ছ দড়ি নিয়ে মোনালিসা আসলো, তার ঠোটে একধরনের তাচ্ছিল্যের হাসি। রিনাকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই সাহবুদ্দিন তাকে বালিশ চাপা দিয়ে বিছানার সাথে ঠেসে ধরে। কিছুক্ষনের ভিতর রিনা ছটপট করতে করতে মারা যায়, রিনার নিথর দেহটা মোনালিসা ও সাহবুদ্দিন মিলে গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিলো ।
স্বপ্নটা দেখে আজম সাহেবের দম বন্ধ হয়ে আসে, ঘুম থেকে ধরফর করে জেগে ওঠেন , ঘামে গোটা গা ভিজে গেছে। ঘুম থেকে জেগে আজম সাহেব খেয়াল করলেন তার ঘর ও গোটা বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে। বাহির থেকে কয়েকজনের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, হঠাৎ মনে হলো কানের কাছে কে যেনো ফিস ফিস করে বললো – ” বাবা পালিয়ে যাও, ওরা তোমাকেও মারতে চায়। ”
ফিসফিসানি এই আওয়াজে আজম সাহেব চমকে উঠলেন, পায়ের আওয়াজ ঘরের একদম কাছে চলে এসেছে। আজম সাহেব আস্তে করে বেড থেকে নেমে তার রুমের সাথে লাগানো স্ট্যাডি রুমের দরজা খুলে ঢুকে পরলেন, এখানে বড় বড় দুইটা বইয়ের শেলফ আছে, লুকানোর জন্য ভালো একটা জায়গা খোজার আগেই ঘরে সাহবুদ্দিন আর মোনালিসা ঢুকে পরলো। মোনালিসার হাতে একটা মোটা দড়ি, রিনার কায়দাতেই আজম সাহেবকে মারা হবে মোনালিসার হাতের দড়িটা তেমনই ইঙ্গিত করছে। আজম সাহেব খেয়াল করলেন মোনালিসার ঠোটে স্বপ্নে দেখা সেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠেছে, আজম সাহেব তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, কারন ছয়ফুট লম্বা সাহবুদ্দিনের সাথে হালকা পাতলা আজম সাহেব পেরে উঠবেন না। আজম সাহেবের টুটি চিপে ধরে তার গলায় দড়ি লাগানোর জন্য সাহবুদ্দিন পা বাড়াতেই গোটা বাড়ি ভূমিকম্পের মতো দূলে উঠলো, আর চোখের পলকে কাঠের বিশাল বুকশেল্ফটা সাহবুদ্দিন আর মোনালিসার উপরে পরে গেলো। বুক শেল্ফ মাথার পিছনে আঘাত করার কারনে মোনালিসা আর সাহবুদ্দিন স্পটেই মারা যায়। হতভম্ব আজম সাহেব অক্ষত অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে পুলিশে খবর দেন।
বুকশেল্ফ থেকে বই নামাতে গিয়ে গায়ের উপর বুকশেল্ফ পরে মোনালিসা ও সাহবুদ্দিনের মৃত্যু হয়, পুলিশের ফরেনসিক রিপোর্টে এমনটায় এসেছে। সেই রাতের পুরো ঘটনা আজম সাহেব কাউকেই বলেননি, তার মেয়ে সুইসাইড করেনি তাকে খুন করা হয়েছিলো এই কথাও তিনি কাউকে বলেননি। তিনি খুশি এই ভেবে যে তার মেয়ের খুনিরা তাদের প্রাপ্য শাস্তি তার মেয়ের মাধ্যমেই পেয়েছে। আজম সাহেবের দিন খুব একটা খারাপ যাচ্ছে না, কারন তিনি জানেন তার মেয়ে তার আসে পাশেই আছে, আজও তার কানের কাছে ফিসফিসায়ে কেউ বাবা বলে ডাকে।