লাঞ্চের পর ঘুম ঘুম চোখে শুয়ে আছি। হঠাৎ ফোন এলো। ফোন রিসিভ করতেই
–আগামী কাল তুমি সব কিছু ত্যাগ করে আমার কাছে আসতে পারবা পৌষী? হুট করে এমন একটা কথা শুনে আমার পৃথিবীটা ঘুরে গেলো। বললাম-
–মানে?
–মানে হলো আমরা কাল পালিয়ে যাবো।
–হুটহাট পালিয়ে যাওয়া যায় নাকি?
–যায়, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। কাল যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে না আসো তবে তোমার আর আমার পথ আলাদা হয়ে যাবে।
–এসব কি বলছো তুমি? স্পর্শ তুমি তো আমাকে ভালোবাসো তাহলে এমন কঠিণ পরীক্ষাতে কেনো ফেলছো আমাকে?
–ভালোবাসি বলেই তো আমার কাছে আসতে বলছি পৌষী। আমি আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।
–তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও খুব কষ্ট হয় কিন্তু আমার আরো সময় লাগবে।
–সময় লাগবে বলে বলে তো অনেক দিন পার করেছো। আর কত সময় নিবা? তোমার ফ্যামিলি আমাকে কোনো কালেও মেনে নিবে না তাই আজ হোক কাল হোক তোমাকে পালাতেই হবে। সেই পালানোটা কালকেই হোক।
–পালিয়ে যাওয়াটা আমাদের বংশে নেই। এটা আমি কি ভাবে করবো?
–এত কথা শুনতে চাই না, হয় কালকের দিনের মধ্যে আমার কাছে চলে আসবে নয়তো আমাকে ভুলে যাবে। আমি আগামী কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
–আমাকে আর একটু সময় দাও।
–সময় দিলাম তো। আগামী কাল সন্ধ্যে অব্দি তোমার জন্য সময়।
কথা গুলো বলেই সে ফোন কেটে দিলো। আমি চুপচাপ পাথরের মূর্তির মত বসে রইলাম। কি করবো কিচ্ছু ভেবে পেলাম না। দু’চোখের ঘুম উড়ে গেলো। ঘুম কি আর এ চোখে আসবে কোনো কালে? একদিকে আমার ভালোবাসার মানুষটি আর অপর দিকে আমার ফ্যামিলি। আমি কোনটাকে বেছে নেবো?
স্পর্শর জীবনের প্রথম প্রেম আমি। ক্লাস ফাইভ থেকে সে আমাকে ভালোবাসে। এত গুলো বছর সে আমাকে এক তরফা ভালোবেসেছে, তার অপেক্ষার দাম দিয়ে কলেজ জীবনে এসে আমি রাজী হয়েছি। এমন ভালোবাসা পৃথিবীতে বিরল। আমি কতটা ভাগ্যবতী যে এমন ভালোবাসা আমি পেয়েছি! এরপর থেকেই আমি তাকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া শ্বাস নেয়ার কথা ভাবতেই পারি না। অথচ আমি একটা বিরাট বোঝাপড়ার মুখোমুখি দাড়িয়ে আছি। আমার আম্মু স্পর্শকে মেনে নেয়নি। বিশেষ কোনো কারণ নেই, পৃথিবীর সব বাবা মা-ই ভালোবাসার বিপক্ষে, এই টুকুই কারণ। আমার আত্মীয় স্বজনও এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। আমাদের বংশে প্রেমের বিয়ে নেই। আম্মুর কথা, “প্রেমের বিয়ে কখনো সুখের হয় না। পৃথিবীতে প্রেম করে বিয়ে করে কখনোই কেউ সুখী হয়নি তাই প্রেমের বিয়ে চলবে না।”
আমাদের বাসায় আম্মুর কথাই শেষ কথা। আব্বু কখনোই আম্মুর ইচ্ছের বাহিরে কথা বলেন না। আমার আম্মু বুদ্ধিমতী এবং জেদী বংশের মেয়ে। তার জেদের কাছে আমরা সবাই নতো। স্পর্শর সাথে আমার সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে গেছিল। আমাদের সব আত্মীয় স্বজনও জেনে গেছিল। জানাজানির পর থেকেই আম্মু আমাকে সাবধান করেছে, যদি পালিয়ে যাই তাহলে আম্মু সুইসাইড করবে। অন্য দিকে স্পর্শকেও থ্রেট করা হচ্ছিল দিন রাত, যেন সে আমার জীবন থেকে সরে যায়। সব মিলেই কিচ্ছু ঠিক ছিল না। আমি পড়ে ছিলাম ভীষণ বিপাকে। আম্মু দিন রাত আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
আর আব্বু বার বার বলতেন, “আমার মেয়ের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।” আর এখানেই আমি মরেছি। বিশ্বাস না করলে বিশ্বাস রাখার দায়টা আমার থাকতো না। কেউ যদি প্রচন্ড বিশ্বাস করে তবে সেই বিশ্বাস ভাঙা যায় না। আজ সেই বিশ্বাসের দ্বার প্রান্তে দাড়িয়ে আমি ভাবছি, বাহিরে যাবো নাকি বিশ্বাসের ভেতরেই থাকবো? আব্বুর বিশ্বাস যদি ভেঙে দিই তবে কি আমার আব্বু আর বেঁচে থাকবে? আমি যে আব্বুর পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্বলতম স্থান। আব্বু বেঁচে থাকবে না, এটা আমি এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবতে পারি না। কিন্তু স্পর্শর কি হবে? এত গুলো বছর ধরে মানুষটা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া কি সে ভালো থাকবে? কার ভালোবাসা শ্রেষ্ঠ্য? বাবার নাকি প্রেমিকের? এত গুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাড়িয়ে আমি নির্বাক। বিকেলে আব্বু ডেকে বললো-
–কি রে মা কি খাবি বল সেটা কিনে আনবো।
–কিছু না আব্বু।
–তোর কি হয়েছে খুকু? এত মন মরা হয়ে আছিস কেনো মা?
–আব্বু আমাকে না দেখে কি তুমি থাকতে পারবা না?
–তুই তো আমার কলিজা, আমার হৃদপিন্ড, তোকে না দেখে বাঁচবো কি করে? আব্বুর কথায় চোখ ছলছল হয়ে গেলো। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে চোখ মুছে ম্লান হেসে বললাম-
–নারিকেল ফ্লেবারের চকলেট খাবো আব্বু।
আব্বু খুশি হলো। জানি না কেনো আমি আব্বুর কাছে কিছু চাইলে আব্বু ভীষণ খুশি হন। পৃথিবীর সব বাবারাই বোধ হয় সন্তানদের চাওয়া পাওয়াতে এমন খুশি হয়। রাত এগারোটায় আব্বু রুমে এসে বললো-
–কি রে খুকু এখনো ঘুমাসনি?
–এই তো এখন ঘুমাবো। তুমি কখন ঘুমাবা আব্বু?
–তোর বিছানায় মশারী টাঙিয়ে দিয়ে তারপর আমি ঘুমাবো।
যবে থেকে আলাদা ঘরে ঘুমাই তবে থেকেই আমার রুমে আব্বুই মশারী টাঙিয়ে দিয়ে যায়। আমার অভ্যেস হলো পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাওয়া। কখনোই মশারী লাগাই না আমি। প্রচন্ড গরমে যখন মশারীর ভেতরে ঘুমাতে পারি না তখন আব্বু কয়েল জ্বালিয়ে দেয়। আমার প্রতি আব্বুর খেয়ালের সীমা নেই। পৃথিবীর বাবা গুলো কেনো এত সীমাহীন ভালো হয়?
আব্বু মশারী টাঙিয়ে চলে গেলো। ডীম লাইটের আলোতে আমি দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়ির কাঁটা দৌড়ে পেরিয়ে যাচ্ছে আর আমার হাতের সময়ও কমে যাচ্ছে। আর চব্বিশ ঘন্টা সময়ও আমার হাতে নেই। আমাদের বংশে প্রেম করে পালিয়ে যাবার ইতিহাস নেই। আমিই হয়ত প্রথম এই ইতিহাস রচনা করতে চলেছি। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো। একটা মিনিটের জন্যও চোখ বুজিনি।
সকালে রুম থেকে বের হলাম না। চার বার আব্বু ডেকেছে ব্রেকফাস্ট করার জন্য কিন্তু আমি যাইনি। মনে হচ্ছে আর কিছু সময় মাত্র আছি আমি, মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? কিন্তু আব্বু আমাকে ছাড়া নাস্তা না করে বসে আছেন। সারাটা জীবনই আব্বু আমাকে পাশে বসিয়ে খায়। আমি যতক্ষণ খেতে না যাবো ততোক্ষণ আব্বু খেতে বসে না। আম্মুর সাথে রাগ করে যে এক বেলা না খেয়ে থাকবো, আব্বুর জন্য সে উপায়টিও নেই।
আমার জীবনের কোনো ইচ্ছেই আমার আব্বু অপূর্ণ রাখেনি। সব সময় আব্বু আমার খুশিটাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আম্মু বকলে আব্বুর কাছে মুখ লুকিয়েছি। আম্মু ভাইকে বেশী ভালোবাসলেও মায়ের ভালোবাসার সেই অভাবটা আব্বুই পূরণ করেছে। সেভেন এ উঠেও আমি পুতুল খেলেছি। আব্বু পুতুল কিনে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। এই সারপ্রাইজটা কলেজ জীবনে এসেও থেকে গেছে। কারণ আব্বু জানে যে, পুতুলের চেয়ে সেরা উপহার আমার কাছে আর কিছু নেই। আব্বুর কাছে আমি চিরকাল অবুঝ শিশুই থেকে গেছি। সেই আমি একজনকে ভালোবেসেছি যাকে আমার ফ্যামিলী মেনে নেয়নি। আর আমি আমার আব্বুর ভালোবাসাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে যাবার জন্য চিন্তা ভাবনা করছি। আব্বু হয়ত মেনে নিতো কিন্তু আম্মু মানতে দেয়নি। আব্বুর বিশ্বাস আমি এমন কিছু করবো না, যেটাতে তার উচু মাথা নিচু হবে। আমি যদি পালিয়ে যাই তবে আমার আব্বু স্ট্রোক করবে নয়ত সুইসাইড করবে। ঐ সরল মনের মানুষটি এত বড় লজ্জা সইতে পারবে না। পৃথিবীতে সবাই ভালো প্রেমিক পায় না কিন্তু সবাই ভালো একজন বাবা পায়। যে বাবা তার সন্তানের জন্য কলিজাটাও বের করে দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় স্পর্শকে ফোন করলাম।
–স্পর্শ আজ থেকে আমাদের পথ আলাদা, জীবন আলাদা, আকাশ আলাদা এবং পৃথিবীটাও আলাদা। আমাকে ক্ষমা করো এবং ভুলে যেও। আর ক্ষমা করতে না পারলে অভিশাপ দিও।
–পৌষী তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
–আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি। যিনি আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন। যার গোটা পৃথিবীটা জুড়েই আমি।
–সবাই তার বাবাকে ভালোবাসে, প্রেমিক আর পিতার প্রতি ভালোবাসা আলাদা হয়। আমি জানতে চাই তুমি কি আমাকে ভালোবাসো কি না? হ্যা অথবা না বলো।
–না বাসি না। আমি ভালোবাসতে পারি না। আমাকে ঘেন্না করো প্লীজ!
–আমার সাথে এমনটা করলে কেনো পৌষী? আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।
–ভুল জানো তুমি। সঠিকটা হলো পৌষী ভালোবাসতে পারে না। পৌষী একজন বিশ্বাস ঘাতিকা। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। রাখি।
ফোন কেটে দিয়ে মুখে বালিশ চেপে আর্তনাদ করে কাঁদলাম। আমার প্রথম প্রেম ভেঙে গেলো। আমার সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। আমার যে আর কিছুই রইল না। মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে গেলো ইয়া আল্লাহ তাকে ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে? এই মুহূর্তেই আমার মৃত্যু দাও! সারাটা জীবন পুড়ে পুড়ে খুঁড়ে খুঁড়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ। এরপর বাথরুমে সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে কাঁদলাম আর চোখের জল ধুয়ে দিলাম। ধুয়ে দিলাম কষ্ট কষ্ট এবং কষ্ট।
কষ্ট কি আসলে ধুয়ে শেষ করা যায়? ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর আক্ষেপটা কি এক জীবনে শেষ হবার মত? কত রঙবে রঙের স্বপ্ন ছিল যার সব গুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্বপ্ন পোড়ার কষ্টটা শ্বাসরুদ্ধ, যেটা বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করা যায় না। সব স্মৃতি মুছে গেলেও দুটো মানুষের এক সাথে দেখা স্বপ্নের স্মৃতি গুলো কখনোই মুছে যায় না। সেই দিনের পর থেকে হুট করেই আমার চোখে খরা শুরু হলো। অনেক চেষ্টা করেও কোনো ভাবেই আমি কাঁদতে পারতাম না। মাঝে মাঝে কাঁন্নার পিপাসায় আমি ভয়ানক অস্থির হয়ে যেতাম। মনে হতো যদি একটু কাঁদি তবে আমার বুকে চেপে থাকা পাহাড়টা সরে যাবে কিন্তু কিছুতেই কাঁদতে পারিনি।
আমি স্পর্শের বাহিরে নতুন করে জীবন শুরু করলাম। সেই জীবনটাতে আমার সঙ্গী হলো ডিপ্রেশন। আমি গভীর ডিপ্রেশনে আধ মরা হয়ে গেলাম। এর চেয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেটার। স্পর্শকে ছাড়া সত্যি সত্যিই আমি পুড়ে পুড়ে খুঁড়ে খুঁড়ে বেঁচে রইলাম। মাঝে মাঝে সুইসাইড করতে খুব ইচ্ছে করতো কিন্তু আব্বু এটা সইতে পারবে না তাই কখনোই সুইসাইড করার চেষ্টা করিনি। জীবন থেকে অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। স্পর্শকে ছাড়া বাঁচতে না পারা পৌষী আজও বেঁচে আছে। স্বপ্ন নেই, অপেক্ষা নেই, অনেক কিছু ছাড়াই পৌষী বেঁচে আছে। অনেক কিছু ছাড়াই হয়ত পৌষী আরো অনেক দিন বেঁচে থাকবে। অনেক বছর পর এক দিন….
–আর কত বছর এ ভাবে উদাসীন পড়ে থাকবে তুমি পৌষী?
–কে বললো আমি উদাসীন পড়ে আছি?
–জীবনটাকে গুছিয়ে নিচ্ছো না কেনো? কেনো বিয়ে করছো না?
–বিয়েতে আকর্ষণ নেই। আর আমার বিয়ে নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যাথা কেনো?
–সুখের থাকার জন্যই তো আমাকে ত্যাগ করেছো তাই আমি তোমাকে সুখীই দেখতে চাই।
–কে বললো যে আমি সুখে নেই? বিয়েটাই কি জীবনের এক মাত্র সুখ নাকি?
–লেখালেখিটাই কি তাহলে জীবনের একমাত্র সুখ?
–আমি লেখালেখিতে আসক্ত, সুখ দুঃখ কি না জানি না, আত্মতৃপ্তির জন্যই লিখি।
–লেখালেখি নিয়েই কি জীবন চলে? একজন সঙ্গীরও তো দরকার হয়। খুব মন খারাপের রাতে মুখ লুকানোর জন্য একটা বুকেরও তো দরকার হয়।
–আমার মন খারাপ হয় না স্পর্শ। তোমার বউ কেমন আছে?
–ভালো আছে।
–তোমার আর কিছু বলার না থাকলে আমি এখন রাখবো, আমার কাজ আছে।
–আমি তোমার প্রতি কোনো অন্যায় কিন্তু করিনি। আমি বিয়ে করার আগের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। বিয়ে করার আগের দিনও তোমাকে ডেকেছি চলে আসার জন্য। না আসতে পারাটা তোমার অক্ষমতা। আমার কোনো অক্ষমতা নেই।
–জানি আমিই অক্ষম, মানি এবং স্বীকারও করি।
–আমি চাই তুমি নিজের মত করে জীবনটাকে সাজিয়ে নাও।
–জীবনটা তো সাজানোই। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাও পর্যন্ত সব ডিসিপ্লেন এর মধ্যে। তাই অগোছালো ভাবার কোনোই কারণ নেই। আর তুমি আমাকে আর কখনো ফোন করবে না। রাখি।
স্পর্শ মাঝে মাঝে ফোন করে কিন্তু আমি রিসিভ করি না। তাকে কিছু বলার মত ভাষা কথা কিচ্ছু খুঁজে পাই না। অথচ এক দিন এই মানুষটার সাথেই আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেও কথা শেষ করতে পারিনি। কথা বলার পিপাসা থেকেই গেছে। আসলে স্বপ্ন না থাকলে কথাও থাকে না। সে সুখে আছে নাকি নেই তাও আমার জানতে ইচ্ছে করে না। সব কিছুকেই অহেতুক মনে হয়। মনে হয় দুটো মানুষের পৃথিবী তো দুটো। তার স্বপ্ন আছে, আমার নেই। তার কথা বলতে ইচ্ছে করে, আমার করে না। তার আমাকে মনে পড়ে, তাকে আমার মনে পড়ে না। মনে পড়লেই তো বুকের বাম পাশে ঘুনপোকাটা কুরতে শুরু করে। আমি বিশ্বাসঘাতিকা, হ্যা আমি পৃথিবীর সেরা বিশ্বাস ঘাতিকা।মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার বৃষ্টিতে ভেজা সেই দশ টাকা দামের রুমালটাকে বের করে দেখি আর মনে মনে ভাবি, এটাতে স্পর্শর স্পর্শ আছে। আমি যে তাকে ছাড়া ভালো নেই, একটুও ভালো নেই, এই কথাটা চিরকাল অপ্রকাশ্যই রাখতে চাই। কিছু দিন আগে স্কুল জীবনের বন্ধু রানার সাথে দেখা হয়ে ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে।
–স্পর্শর সাথে এমনটা না করলেও পারতি পৌষী। সে আজও তোকে ভালোবাসে।
–বিবাহিত ছেলে বউকে ভালো না বেসে আমাকে কেনো ভালোবাসবে?
–সাট আপ পৌষী। নিজে তো ভালোবাসিসনি আবার অন্যের ভালোবাসা নিয়ে ট্রল করছিস?
–আমি তো ভালোবাসার মানেই বুঝি না রে দোস্ত।
–তোর স্থানটা সে কাউকে দেয়নি আর দেবেও না।
–আমি তো স্থান চাই না।
–ভাবতেই পারিনি এমনটা ঘটবে। আর তুই কেনো এখনো বিয়ে করিসনি?
–বিয়ে, সংসার ,সম্পর্ক, বন্ধন, এই সব আমার সাথে যায় না। একাই বিন্দাস আছি।
–মাঝে মাঝে তোর লেখা পড়ি, হ্যাপী এন্ডিং নেই। এমন কেনো করিস?
–হ্যাপী এন্ডিং এ আমার এলার্জী আছে তাই।
–ফোন দিলে রিসিভ করিস না কেনো?
–ফোন রিসিভ না করাটা হলো আমার দূরারোগ্য ব্যাধি। ঠোট নড়াতেও আলসে লাগে।
–আজও তোকে বুঝে উঠতে পারলাম না রে দোস্ত।
–খামাখা বুঝার চেষ্টা করিস না, মাথা এলোমেলো হয়ে যাবে। আর আমি চাই না কেউ আমাকে বুঝুক।
–স্পর্শর সাথে যোগাযোগ আছে?
–নেই, সে ফোন করে কিন্তু আমার দূরারোগ্য ব্যাধির কারণে কথা হয় না। আজ চলি, ভালো থাকিস।
আমার জীবনে সব আছে, শুধু বিয়েটাই নেই। তাই সবাই আমাকে অগোছালো ভাবে। আম্মুও সেটাই ভাবে। সে ভাবুকগে। কষ্টের মহাসাগরটা পেরিয়ে এসেছি। আম্মুকে সে সময় বলে ছিলাম, স্পর্শকে ত্যাগ করবো তবে তার বিনিময়ে একটা জিনিস চাইব। তবে সেটা সময় মত। আম্মু আর আমি একে অপরের মাথায় হাত রেখে প্রমিস করে ছিলাম। স্পর্শকে ত্যাগ করার বিনিময়ে এই একলা জীবনটাকে বেছে নিয়েছি। এটা ছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় নেই। স্পর্শকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবো বা তাকে ভালোবাসতে পারবো এমন আত্মবিশ্বাস নেই আমার। আম্মু আমাকে বিয়ের জন্য জোর করতে পারবে না, এটাই ছিল স্পর্শকে ত্যাগ করার বিনিময়ে আমার প্রাপ্তি। আব্বু আম্মু খুব কষ্ট পায় আমার এই ছন্ন ছাড়া জীবনটাকে নিয়ে। আম্মু নিজেকে অপরাধী মনে করে। এখন আম্মু মাঝে মাঝে বলে, “অনেক বড় ভুল করেছি। অন্যায় করেছি তোর সাথে। তোর সুখের ঠিকানাটাকে আমি নিজ হাতে নষ্ট করেছি।”
আম্মুর কথা শুনে আমার হাসি পায় কিন্তু হাসি বাহিরে আসে না, আমি নির্বাক থাকি। কি বলবো? কি বা বলার আছে আমার? আমার জীবনের প্রথম প্রেম যেটা আমার ভাগ্যেই নেই। আমি ভাগ্যকে মানি। আমি ভাগ্যকে বিশ্বাস করি। ভাগ্যে না থাকলে অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি অনেক বছর ধরে স্পর্শের বাহিরে চলে গেছি। কারো ভুল স্বীকারোক্তিতে স্পর্শ ফিরে আসবে না। সাজবে না আমার মন আর কোনো কৃষ্ণচূড়ার রঙে। স্পর্শের বাহিরটা ভীষণ বিবর্ণ। এই বিবর্ণতা নিয়েই আমি বেঁচে আছি, থাকবো। এই তো ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস নিচ্ছি, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি বেঁচে আছি?