‘আপনি বোঝার চেষ্টা করুন যে আমি ডিভোর্সী।’ কথাটা এর আগেও শুনেছি কয়েকদিন কয়েকবার, একবারও বিস্মিত হই নি। এটা থেকেই যে আমারও ভালোলাগার শুরু এটা আমিও বোঝাতে পারিনি। ‘আর নতুন কিছু বলার নেই আপনার?’ ‘না, নেই। শুধু এ কথা বলতেই এসেছি।’ অর্পার আজকের কণ্ঠ স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীর কাছে ফিরবার ব্যাকুলতা অর্পার মাঝে বেশ প্রকট। ‘একটা কথা বলি?’ অর্পার দিকে তাকিয়েই উত্তরের আশায় রইলাম। ‘জি’-অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর জানালো অর্পা।
‘আপনি ডিভোর্সী এটা আমি জানি, অথচ জানা কথাটা জানানোর জন্য আপনি এখানে আসলেন?’ মুখ ফেরালো অর্পা, দৃষ্টিতে অসহনীয় মাত্রা। ‘এখানে আসাটাকে যদি আপনার প্রতি আমার দূর্বলতা ভেবে থাকেন তবে সেটাই হবে আপনার দূর্বলতা। আর একটু নিঃশ্বাস বিরতী নিলো অর্পা, তাকিয়েই রইলাম। কিছু রাগ নিঃশ্বাস স্বরূপ, এটাও আমার কাছে তাই। ‘আর সংসার ভাঙ্গা মহিলাকে মেয়ে ভাবতে যাবেন না।’ চলে যাওয়াটা দেখলাম, কোন পিছুটান নেই। হয়তো নেই কোন দূর্বলতাও। তবুও তার মাঝে একটা পিছুটান সৃষ্টির আশাতে এই বিরক্ত করা। লেকের ধারটায় অনেকের মাঝেও নিজেকে একা লাগতে শুরু করলো। হয়েছে পাখি দেখা, হয়েছে অর্পা দর্শণ, এবার ফিরবার পালা। ফিরবার সময়ও অদৃশ্য ভালোলাগার কাছে পরাজিত হলাম, একটু দাঁড়িয়ে দূরদৃষ্টিতে ‘প্রীতিলতা’কে দেখে নিলাম। জানি অর্পাকে খুঁজে পাব না, তবুও।
প্রায় চার মাস থেকে জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছি অর্পাকে, পরিচয় থেকেই। ‘দর্শণ’-এর শিক্ষার্থীর দর্শণ যে ‘রসহীন আলোচনা’ তা বুঝেছি প্রতিবারই। সাংবাদিক বন্ধুর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আসা, সেদিনই ঝাঁঝালো পরিচয়। পরিচিত কিছু ছোট ভাই-বোন আমাদের সহযোগিতা করেছিলো, তার মাঝে ‘মোহনা’; অর্পার পাশে আজকের দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবী। প্রায় সারাটা বেলা আমাদের সাথেই ছিল অর্পা, কিন্তু খেয়ালে আসেনি। বিদায় বেলায় মোহনাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে পরিচয় হলাম অর্পার সাথে। ‘আপনি কিছু দিলেন না?’ পরিচয়ের ফাঁকেই বললাম অর্পাকে। ‘আমার টাকা নেই, তাই সময় দিয়ে সাহায্য করলাম।’ কথাটায় আকৃষ্ট হয়েছি, তারপর ধীরে ধীরে বক্তার দিকে। মোহনা’র কাছেই ফোন নম্বরটা নিয়েছি, ‘বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো’ এই আশ্বাসে। কথাও বলেছি দু’দিন, অনেক প্লিজ প্লিজ বলে। দেখাও হয়েছিলো দু’দিন, সেটা নিতান্ত আমার প্রতি সৌজন্যতা দেখাতে গিয়ে। নিজের ভালোলাগার কথা জানিয়েছি দ্বিতীয় দিনেই।
হেসেছিলো অনেক, চোখে জল রেখে। ‘আপনি জানেন আমি ডিভোর্সী?’ ‘জি, জানি। মোহনার কাছেই জেনেছি।”যেহেতু সবই জানেন, সেহেতু এ বিষয়ে আর কিছুই বলবেন না প্লিজ।’ ‘আপনাকে না বললেই কি আমি ডিভোর্স ছাড়া মেয়ে পাবো?’ ‘সেটা আপনার বিষয়।’ ‘আপনি তো ডিভোর্সী, সংসার করেছেন, শারীরিক সম্পর্ক করেছেন, সব কিছুরই বৈধতা ছিল আর সব জেনেই আমি আপনাকে বলেছি। কিন্তু যারা সংসারের বৈধতা ছাড়াই প্রেমের দায়মুক্তির জন্য রাত কাটাচ্ছে তারা কি ডিভোর্সী নয়? আপনি বৈধ ডিভোর্সী আর তারা অবৈধ ডিভোর্সী।’ কথা বাড়ায়নি অর্পা, পিছুও ফিরেনি।তারপর এই আজ।
দিনগুলো পরিকল্পনাহীনভাবেই কাটতে শুরু করেছে আজকাল। দুইদিন আগেই অসুস্থ্য বন্ধুটি মারা গেছে। আজ প্রায় বিশদিন হলো অর্পা ফোন ধরছে না, সেদিনের পর থেকেই। ফোন দিয়েছি, দিয়ে চলেছি প্রতিটি মূহুর্তই। মোহনাকেও অনুরোধ করেছিলাম, অনুরোধ রাখতে পারেনি সেও। শুধু বলেছে ‘বাড়ি গেছে’। ‘ফিরবে কবে?’ ‘কিছু কথা হয়েছে কী?’ ‘বাড়ি কোথায়?’ ‘ফিরেছে কী?’ এগুলো প্রশ্ন শুনতে শুনতে মোহনারও যে আমার প্রতি বিরক্তি এসেছে, তা নিজেও বুঝতে পারি। নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি আত্মজিজ্ঞাসায়। ‘তবে কী আমার জন্যই ওর লেখাপড়া শেষ হলো?’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি প্রতিক্ষণ, উত্তরই আবার প্রশ্ন হয়ে উঠে বারবার। অর্পার বাড়ির ঠিকানা পেলাম আজ মোহনার কাছে, আটত্রিশ দিনের মাথায়। মা-বাবাকে কোনভাবে পাঁচ-সাত বুঝিয়েই বেড়ুলাম।ভোর পেরিয়ে সকাল হওয়ার বাকি। রিকশা এসে বাড়ির আঙ্গিনায় নামিয়ে দিয়ে গেছে।
এতটা সকালে কাউকে না দেখতে পেরে বাড়ির ভেতরটায় প্রবেশ করার মূহুর্তেই দেখতে পেলাম অর্পাকে। বাড়ির ভেতরটায় ঝাড়ু দিচ্ছে, বাড়ির পোশাকেই। ‘অর্পা’ নিজেই ডাকলাম। চমকেই উঠলো অর্পা। ঝাড়ুটা রেখে পোশাকের খেয়াল নিলো। বিস্ময় না ভয় ওকে ছেঁপে নিয়েছে তা বোঝার সাধ্য হলোনা। ‘মা’ ‘বাবা’ বলতে বলতে ঘরের দিকে ফিরলো অর্পা। করণীয় ধারণা না থাকায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব বেশি সময় লাগেনি পরিবারে মিশে যেতে। সকালের খাবার শেষে অর্পার বাবা কাজে গেলো, ওর মা আবারোও রান্নায় ব্যস্ত। দুপুরের কিছুটা আগে অর্পা নিজেই বাড়ির বাহিরে নিয়ে আসলো। ঘনবসতির দেশে এখনোও এমন দূরত্ব বজায় রেখে বাড়ি আছে তা জানলাম। ‘এবার বলুন, আপনি কেন আসলেন?’ পুকুরটা অনেক ছোট, পাড়ে দাঁড়িয়ে উত্তর খুঁজে চললাম। ‘বলুন তাড়াতাড়ি, বাড়ি ফিরতে হবে এখুনি।’
এখুনি তো বেরুলাম।’ ‘কেন আসলেন?’ একই কথা বলেই যাচ্ছে অর্পা। ‘আপনাকে ভালোবাসি তাই। আর ফোন ধরেন না কেন?’ ‘ভালোবাসেন? আপনি না বলেছিলেন আমার সব কিছুই জানেন, তাহলে বাড়ির ঠিকানা জানেন না কেন?’ ‘এখন জানি তাই আসতে পেরেছি। বলুন ফোন ধরেন না কেন?’ ‘ধরি না? আমি তো ফোন ধরি। মনে মনে কথা বলি। ডিভোর্সী তো, তাই হয়তো ভাষা বুঝেন নি।’ এর আগেও শুনেছি অনেকবার, কিন্তু এবার কথাটায় কেন জানি আঘাত পেলাম বেশ। ‘আমার দিনরাত প্রায় সমান হয়ে গেছে। ঠিকানাও জানতাম না, ঢাকাতেও ফিরেন না।’ হাসলো অর্পা, কটাক্ষ মনে হয়। ‘জানিয়েছি তো ঠিকানা।’ ওর কথায় রাগ উঠছে কেন জানি বারবার। ‘আপনি জানান নি, মোহনা জানিয়েছে।’
‘আপনার কি মনেহয় মোহনা আমার ঠিকানা জানতো না? জানতো। দিতে নিষেধ করেছিলাম। ভেবেছিলাম সরে যাবেন। গেলেন না, আমাকেও সরতে দিলেন না। তাই ঠিকানা দিতে বলেছিলাম।’ তাকালাম অর্পার দিকে, সরল। চোখে জল আছে কি না বুঝতে পারলাম না। কিছু বলার আগেই আবার বললো-‘আপনি ফোন দিতেন, আমিও ধরার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। ধরেছি, কেঁদেছি, বলেছি, আপনি বুঝেন নি। আপনি কাঁদলে প্রেম কান্না হয়, আর আমি কাঁদলে জলের কান্না হয়। কেউ বুঝেনা।’ সব বুঝেই ভালোবেসেছিলাম, তবুও একটা জানা হলো অবশেষে। ‘জলের কান্না’।