প্রথম রাতেই তাহসানকে বললাম, “আই এম সরি। আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না।” সে ঠাস করে আমার গালে একটা চড় কষিয়ে বললো, ফিল্মি ডায়লগ কে শিখাইছে? বিয়ে করেছো বউয়ের মতো থাকবা। ভালোবাসতে পারবা না মানে কি? আগে প্রেম আছে?
এত কঠিন ধমক খেয়ে আমি ভয়ে জবাব দিতে পারলাম না। আমার উত্তরটা ছিল,আমার আগে প্রেম নেই। কিন্তু আমি একজনকে ভালোবাসি। আর তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা এই জীবনে আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি আমার মন প্রাণ হৃদয় সবকিছু দিয়ে শুধু তাকেই ভালোবেসেছি।
তাহসান আবার ধমক দিয়ে বললো, সমস্যা কি? সমস্যা কি? কথা বলছো না কেন? আগে প্রেম ছিল? থাকলে বলো। অবশ্য থাকলেও বা আমি কি করব! এই জামানায় প্রেম ছাড়া মেয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া মা তোমাকে পছন্দ করে এনেছেন। আগে প্রেম থাকলেও কিছু বলবো না। আগে প্রেম থাকলেও ভুলে যাও। “ভালোবাসতে পারবো না,আমি বিছানায় ঘুমাবো আপনি মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঘুমান” এইসব নাটক করবা না। নাটক সিনেমা দেখে দেখে মেয়েগুলো উচ্ছন্নে গেছে! বলতে বলতে সে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। সে বাথরুম থেকে বেরোনো মাত্র আবার ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম, আমার একটু সময় চাই। প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।
সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো, এইতো! লাইনে আসছো। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। কিভাবে দরকষাকষি করে মানুষকে লাইনে আনতে হয় আমি জানি। এইযে প্রথমে বললে,কখনো ভালোবাসতে পারবো না। এখন বলছো,সময় দেন। আচ্ছা! দিলাম সময়। আমার এখনি বাচ্চাকাচ্চার দরকারও নাই। যেদিন আম্মা বলবে,বাবা নাতি-পুতির মুখ কবে দেখবো? তার নয়মাস পর ডেলিভারি চাই। এ আমার ক্লিয়ার কাট কথা।
বিয়ের কয়দিনের মাথায় আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে তাহসান প্রচন্ড মা-ভক্ত। মা ছাড়া কিছু বোঝে না।
একদিন অফিস থেকে এসে ফোঁস ফোঁস করছিল। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কি হয়েছে? তাহসান রাগী গলায় বললো, আমার অফিসের এক কলিগের বউ অফিসে এসেছিলো। দিয়েছি টেনে এক থাপ্পড়। পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। আমি আঁতকে উঠে বললাম, কেন?
– আরে আগেরদিন সেই কলিগ বলতেছিলো ঐ বউ নাকি বারবার বলে, মায়ের সাথে থাকবো না। আলাদা হবো। কত্তবড় বেয়াদব অসভ্য মেয়ে চিন্তা করেছো? আরে মা কি পাঁচটা দশটা বানানো যায়? বউ নাহয় পাঁচটা দশটা বানানো যায়। বৌয়ের জন্য মাকে ছাড়বে মানে? তো সেটা ওদের সমস্যা! তোমার সমস্যা কি হচ্ছিলো শুনি?
-মেয়েটাকে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল দিয়েছি চড় কষিয়ে।
এরপরপরই বাড়িতে পুলিশ এসে তাহসানকে ধরে নিয়ে গেল। সেই মেয়েটা নিশ্চয়ই থানায় জিডি করে দিয়েছে। প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টায় নানা কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ি ফিরলো সে। এই হচ্ছে মা-ভক্ত আমার বর। আমি সারাক্ষন ভয়ে ভয়ে থাকি। না জানি কখন তার মায়ের কোন কথাটা ভুলে অমান্য করে ফেলবো আর তাহসান আমাকেই মেরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবে। যদিও আমার শ্বাশুড়ি মানুষটা খুব ভালো। তার সাথে আমার কখনোই ঝামেলা হয় না। একদিন খেতে বসে শ্বাশুড়িমা বললেন, নিরামিষে বেগুন দিয়েছো নাকি বৌমা? আমার আবার বেগুনে এলার্জি। অবশ্য তোমার দোষ নাই। তুমি তো জানতে না!
আমি কোনো উত্তর দেয়ার আগেই তাহসান তরকারীর বাটি নিয়ে টান দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, স্টার জলসা দেখে দেখে এইসব শিখছে। তরকারীতে বেগুন দিয়ে আমার মাকে মেরে ফেলবে। আজ থেকে ডিসলাইন অফ।
আমি আর আমার শ্বাশুড়ি চোখাচোখি করলাম। আমার থেকে শ্বাশুড়িমাকেই বেশী আপসেট হতে দেখা গেল। কেননা,স্টার জলসা তার প্রিয় চ্যানেল। আমি শুধু তাকে খুশী করতে তার সাথে বসে থাকতাম।
ঈদের শপিং করতে গিয়েও এক কান্ড হলো। আমি পছন্দ করেছি একটা নীল রঙের শাড়ি। সেটা প্যাকিং ট্যাকিং করে ফেলার পর আমার শ্বাশুড়ির চোখে হলুদ রংয়ের একটা শাড়ি পড়ে গেল। তিনি নিচু গলায় বললেন, নতুন বউ! এইটা মানাবে। আর কোন কথা না বলে এইটা প্যাকেট থেকে বের করে প্যাকেটটা দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাহসান বললো, ওটা প্যাক করে দেন।
না দেখেই শাড়ি কেনার কারণেই হয়তো বাড়ি এসে সেই শাড়ির আঁচলের কাছে অনেকটা ছেঁড়া পেলাম। তাহসানকে সেটা দেখাতেই সে গম্ভীর গলায় বললো, পোড়া-ছেঁড়া যাইহোক,মায়ের পছন্দ! কোনো কথা বলবা না এটাই পরবা।
সেই ছেঁড়া শাড়ি পরে ঈদের দিন আমরা তিনজন ঘুরতে বের হলাম। আমি তাহসান আর শ্বাশুড়িমা।আমি বসেছি পেছনে। আর শ্বাশুড়িমা বসেছেন তাহসানের পাশে। বলাই বাহুল্য,আমরা যেখানেই যাই সেখানেই শ্বাশুড়িমাকে সাথে নেয়া হয়। বিয়ের পর হানিমুন হিসেবে আমরা এখনো কোথাও যাইনি। গেলে আমি শিওর সেখানেও শ্বাশুড়িমাকে তাহসান অবশ্যই নিয়ে যাবে। ওর এসব কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশী লজ্জা পান আমার শ্বাশুড়ি। যদিও তিনি মুখে বলেন না কিছু।
আমাকে একদিন ডেকে বলেছিলেন, বাপ মরা ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আমাকে ছাড়া আর কাউকে পায়নি। এজন্য একটু পাগল মতো। তুমি কিছু মনে করোনা। আমি হাসিমুখে বললাম, মা! আপনি এত ভাবছেন কেন? এটা মনে করার মতো কোনো বিষয় না। যাইহোক, দেখতে দেখতে এভাবেই দেড় বছর কেটে গেল। এরপর একদিন আমার শ্বাশুড়িমা পাশের বাসার আন্টির সাথে কথা বলতে বলতে আফসোসের সুরে বলছিলেন, “আমার ছেলেটার কবে যে বাচ্চাকাচ্চা হবে! মনে হয় দেখে যেতে পারবো না!” আর ঠেকায় কে! এর ঠিক নয়মাস এগারো দিনের মাথায় আমার একটা ছেলে হয়ে গেলো।
হাসপাতালে বাচ্চা দেখতে গিয়ে শ্বাশুড়িমা নিচু গলায় বলে ফেললেন, একটা মেয়ে হলে কতো সুন্দর হতো। আমার কোন মেয়ে নাই। এজন্য নাতনীর খুব শখ ছিল আমার! আর যাবে কোথায়! ছোটবেলা থেকে সেই ছেলেকেই চুল বড় করে ফ্রক পরিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে মেয়ে বানিয়ে রেখে দিলো তাহসান। কেউ দেখতে এলে গম্ভীর গলায় বলে,মেয়ে হয়েছে মেয়ে। ঘটা করে মেয়ের আকীকা দিয়ে একটা ইসলামিক মেয়ে নামও রেখে দিলো সে। ঈদে,পহেলা বৈশাখে ওরজন্য ঢাকঢোল আঁকানো শাড়ি কিনে আনে,খেলার জন্য পুতুল কিনে আনে। প্রথম প্রথম ছেলেটা পাড়ার অন্যান্য বাচ্চা ছেলেদের সাথে খেলতে যেত। কিন্তু তাহসান তাকে ধরে এনে পাশের বাসার সেই আন্টির নাতনীর সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়ে আমাকে গম্ভীর গলায় বলেছে, দেশে রেপের সংখ্যা খুব বেড়েছে। কোনো ছেলের সাথে মিশতে দিবা না। ঐ মেয়েটা বাসায় আসবে ওর সাথে খেলবে।
এখন আমার ছেলের(!) বয়স চার। নাম রাখা হয়েছে ‘রাত্রি’। আর ছেলেটার ভেতরেও মেয়ে মেয়ে ভাব চলে এসেছে। সেও হাতে নেইলপলিশ দেয়,চুলে ঝুঁটি করে। টাইট প্যান্টের সাথে টপস পরে গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়ায়।
ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশী চিন্তিত আমার শ্বাশুড়িমা। বারবার গম্ভীর গলায় বলেন, “একে কোন স্কুলে ভর্তি করবা? গার্লস স্কুলে?