‘আমি যদি বলি আমি ভার্জিন নই, তারপরও কি আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’ রোজার এহেন কথায় ফারাজ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘পরীক্ষা নিচ্ছেন নাকি? আমার উত্তরের উপর নির্ভর করবে যে আপনি এই বিয়েতে রাজি হবেন কি না? নাকি আপনি এই বিয়েতে রাজি নয় বলে এমনটা বলছেন, যেন আমি বিয়ে ভেঙ্গে দেই?’ ‘না।
আমি পরীক্ষা নিচ্ছি না৷ আর বিয়ে ভাঙ্গার জন্যও বলছি না।’ ‘তাহলে?’ ‘আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, এমনটা বললে বিয়ে করবেন কি না?’ ফারাজ কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, ‘এক-ই কথা যদি আমি বলি, তাহলে কি আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’ ‘এটা কিন্তু আমার কথার উত্তর হলো না৷ আর ছেলেদের ভার্জিনিটি নিয়ে কার মাথা ব্যথা আছে বলেন!’ ‘তাহলে মেয়েদেরটা নিয়ে নিয়ে কেনো কারো মাথা ব্যথা থাকবে।’ ‘আমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি৷’ একটু থেমে রোজা আবার বলল, ‘আচ্ছা এখন উত্তর দিতে হবে না। ভেবে উত্তর দিয়েন। কাল ঠিক এই সময়ে আমি এখানে অপেক্ষা করবো। আপনার উত্তর যাই হোক, এসে আমাকে বলে যাবেন।’
রোজা আর ফারাজের পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা চলছে। এখনো দিন তারিখ ঠিক হয়নি। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই দিন-তারিখ ঠিক হয়ে যাবে৷ রোজা কিছুক্ষণ আগে ফারাজকে মেসেজ দিয়ে বলেছে, ‘আপনার সাথে দেখা করতে চাই৷ রাফা কফি হাউজে চলে আসেন। আমি অপেক্ষা করছি। তবে কাউকে না জানিয়ে আসবেন।’
তাদের আগেই পরিচয় হয়েছে। পরিবারের অন্যান্য সবার সামনেই কথা হয়েছে৷ কিন্তু কাউকে না জানিয়ে এভাবে তারা দেখা করেনি৷ মেয়েটা কেনো এভাবে দেখা করতে চেয়েছে, ফারাজের মনে প্রশ্ন জাগলেও সে কিছু না ভেবে চলে এসেছে। সে বুঝতে পারেনি যে এসে তার এমন এক অদ্ভুত প্রশ্নের মুখামুখি হতে হবে।
প্রশ্নটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। এমন প্রশ্ন করার কারণ কি হতে পারে? কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মন স্থির হচ্ছে না। একেকবার একেক রকম সম্ভাবনা তৈরি করছে। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে বিয়ে আটকে দেক। আবার মনে হচ্ছে, হয়তো মেয়েটা তাকে মেন্টালিটি পরীক্ষা করার জন্য এমন অদ্ভুত কথা বলেছে। বিয়ে আটকানো ঠিক হবে না। তার পুরো দিন বিভিন্ন ভাবনায় কেটে গেলো। পরদিন একই সময়ে সে রাফা কফি হাউজে গিয়ে দেখে রোজা বসে আছে। সে সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই রোজা বলল, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, আমি বাসায় গিয়েই শুনবো যে আপনারা বলেছেন যে আপনারা আর এই বিয়েতে এগুবেন না।’ ফারাজ হেসে বলল, ‘কিন্তু আপনার দুর্ভাগ্য। আপনার এরকমটা শুনতে হয়নি৷’
‘তো বলুন! কি ভেবেছেন?’ ‘আপনি এরকমটা বললেও বিয়ে করে নিবো।’ ফারাজ এক কিছু না ভেবে জটপট বলে দিলো। ‘কেনো?’ ‘আপনি চাইলে কথাটা আমার সাথে লুকিয়ে রাখতে পারতেন৷ লুকিয়ে রাখলে তা আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারতাম না। আপনি নিজ থেকেই বলেছেন তার মানে আপনি একটা ভুল করেছেন। আর তাতে আপনি অনুতপ্ত। যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় বা স্বীকার করে নেয়, সে ভুলের জন্য তাকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’
‘ঠিক-ই ধরেছেন। আমি ভুল করেছি। তার জন্য আমি অনুতপ্তও। আমি আপনাকে বা কাউকে ঠকাতে চাই না বলেই বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই সব সত্য বলে দিচ্ছি।’ রোজার চোখ পানিতে ভিজে উঠেছে। ফারাজ একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চোখ মুছুন!’
সে চোখ মুছে বলতে শুরু করলো, ‘তাকে খুব ভালোবাসতাম। তার জন্য জীবন দিতেও রাজি ছিলাম। আর সে কি করলো জানেন? ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বিছানা অব্দি নিয়ে গেলো। আমি বিয়ের আগে এসব করতে চাইনি৷ কিন্তু ভালোবাসার পরীক্ষা দেয়ার জন্য যে আমাকে করতেই হলো। দ্বিতীয় বার যখন বিছানায় নিতে চাইলো। আমি আর যাইনি। সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। প্রথমবার-ই গোপনে ভিডিও করে রেখেছিলো। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করেছিলো। কিন্তু কোনভাবে আমি শক্ত হয়ে যাই। তার ব্ল্যাকমেইলে কোনো পাত্তা দিলাম না। সে ব্ল্যাকমেইল করলেই বলতাম, তোর যা ইচ্ছে কর গিয়ে। আমি তাকে সত্যি-ই ভালোবাসতাম। আর সে আমার সাথে এভাবে প্রতারণা করলো।’
‘বলুন তো আপনার মতো ভালো মেয়েগুলো এত্তো বোকা হয় কেন? ছেলেদের একটু মিষ্টি কথায় এভাবে পটে গিয়ে নিজের সবচেয়ে দামী জিনিষটা বিলিয়ে দেয়। যে ছেলেরা প্রেমিকাকে বিছানা অব্দি নিতে চায়, তারা কখনো-ই প্রেমিকাকে বিয়ে করে না৷ তাদের প্রেমটাই থাকে বিছানা অব্দি নেয়া পর্যন্ত। আপনারা এটা জেনেও বারবার এই ভুলটাই করেন।’
‘জানিনে কেনো আমরা এত্তো বোকা হই।’ কিছুক্ষণ থেমে সে বলল, ‘আপনার যদি এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে না করে বলে দিতে পারেন৷ কষ্ট করে আপনার না বলতে হতে হবে না। আমি-ই না বলে দিবো। সরাসরি বলতে না পারলে মেসেজ দিয়ে বলে দিয়েন।’ বলে রোজা উঠে গেলো। বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রোজা রিক্সা ঠিক করে উঠতেই ফারাজ সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে৷ অনেক দিন হয়েছে, কারো হাতে হাত রেখে রিক্সায় করে ইট-পাথরের শহরের অলি-গলিতে ভিজতে ভিজতে ঘুরা হয় না৷’ রোজা রিক্সার এক পাশে চেপে বসে মুচকি হেসে বলল, ‘এতো বণিতা না করে সোজা বলে দিন না, আমার সাথে রিক্সায় করে ঘুরবেন।’ ফারাজ রিক্সায় উঠে পরলো, ‘মামা! গন্তব্যহীনভাবে আপনার যেদিকে খুশি ছুটে চলুন।’
রিক্সাওয়ালা তার প্যাডেলে পা ঘুরালো। আকাশ গুরুম গুরুম করে গর্জন করে উঠলো। মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রোজা তার বা হাত বা উরুতে রেখে বলল, ‘কে জানি বলেছিলো, কারো হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভেজা হয় না।’
ফারাজ রোজার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘মানুষ তার অতীতে কেমন ছিলো বা কি করেছে সেটা আমার কাছে কোনো মাইনে রাখে না। সে বর্তমানে কেমন বা কি করছে সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চাইবো যাকে জীবন সঙ্গি করছি সে যেনো কখনোই তার অতীত নিয়ে না ভাবে। মন খারাপ না করে। তার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সব জায়গা জুড়ে যেনো আমি-ই থাকি।’
রোজা ফারাজের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘সব জায়গা দখল করে নিতে তো কেউ বাধা দেয়নি।’ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রিক্সা এগিয়ে চলছে। রিক্সায় বসে এক তরুণ-তরুণী ভালোবাসার স্বপ্ন বুনছে। আর রিক্সাওয়ালা দু-জনার অকৃতিম ও পবিত্র ভালোবাসার স্বাক্ষী হচ্ছে।