তামান্না আজকের ভিতরে ইমার্জেন্সি ভাবে আমার ১০ হাজার টাকা লাগবে। তুমি টাকাগুলো বিকাশে পাঠাও। মনে রেখো আজকের ভিতরে টাকা না দিলে তোমার ১৮+ ছবিগুলো আমি ফেসবুক এবং ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবো। তোমার আদরের ছোট ভাইকেও ইনবক্স করতে ভুলবোনা।
রিয়াদের কাছ থেকে এমন ব্ল্যাক মেইল আর হুমকিস্বরূপ ম্যাসেজ পাবে তামান্না কখনো কল্পনাও করেনি। মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারেনা ভালোবাসার মানুষটি তাকে এ ভাবে ব্ল্যাক মেইল করবে। কিছুটা সময়ের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। তামান্না রিপ্লে দিলো;
-তুমি এসব কি বলতেছো! তুমি না আমাকে ভালোবাসো? আমাকে বিয়ে করবে? তাহলে আমাকেই আবার এসব ম্যাসেজ করো কেনো?
-যা বলছি তাই করো। ভালোবাসা সেতো টাকা হলে পতিতালয়েও পাওয়া যায়! আর তোমার মত মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? বেশি কিছু বলবোনা। সময় কিন্তু আজকের দিন।
-তুমি আমায় বিয়ে করবা না?
-‘হ্যাঁ’ বিয়ে আমি করবো। কিন্তু তোমার মত মেয়েকে না। যে মেয়ে বিয়ের আগে আরেকজনের আমানত খেয়ানত করতে পারে, নিজের সতীত্ব বেগানা-পুরুষকে দেখাতে পারে তার মত মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? ইম্পসিবল!
আর একটা কথা, আমি তোমায় যে ছবি দিয়েছি সেগুলো আমার ছিলোনা। ওই ছবি গুগুল থেকে ডাউনলোড করা ছিলো। সো বাড়তি কোনো চিন্তাভাবনা না করে টাকা দাও তাড়াতাড়ি!
-প্লিজ রিয়াদ পাগলামো করোনা! আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি; তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা।ভালোবাসি বলেই আমার সবকিছু তোমায় সঁপে দিলাম। ভালোবাসি বলেই তো তোমার বিপদের সময় নিজের কাছে জমানো টাকা যা ছিলো সব টাকা তোমায় দিয়ে দিলাম। এই মূহুর্তে- “এতো টাকা কোথায় পাবো?” তুমি এমনটা করোনা প্লিজ “টাকা দিতে না পারলে আমার কিছুই করার থাকবেনা।” লাষ্ট এই মেসেজটার সাথে একটা বিকাশ নাম্বার দিয়ে মেসেঞ্জার থেকে ব্লক মেরে দিলো! তামান্না আর রিয়াদের পরিচয়টা ফেসবুকের মাধ্যমেই হয়েছে। কয়েকদিন চ্যাটিং তারপর বন্ধুত্ব এরপর প্রেম। প্রেম নয় শুধু;- গভীর প্রেম। রাত জাগা পাখির মত প্রায় সময়ই সারারাত কথা বলতো। ফোনের টাকা ফুরিয়ে গেলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা হতো। পরিবার মেনে না নিলে কিভাবে বিয়ে করবে, বিয়ের পর কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে, কয়টা বাচ্চা নিবে, ছেলে হলে কি নাম দিবে, মেয়ে হলে কি নাম দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতো।
তামান্নাকে আবেগপ্রবণতা দেখিয়ে ১৮+ ছবি নিতো। সেও ভাবতো বিয়ে তো আমাকেই করবে। এই ভেবে সহজেই ছবি তুলে দিতো। ভিডিও কলে আসতো। প্রেমের বয়স যখন ৩ মাস তখন তামান্না তার কিছু বান্ধবী কে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে রিয়াদের সাথে ফেসবুকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
এদিকে তামান্নাকে দেয়া রিয়াদের পরিচয় ছিলো; সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে জব করে। তার বাবা নেই। বাড়িতে মা ছোট একটা বোন আর একটা ভাই আছে। তার বাবাও নাকি সরকারি চাকরি করতো। বাবার চাকরির সুবাদে তার চাকরিটা হয়ে যায়। এমন একটা ছেলে যার ভবিষ্যত উজ্জল তার প্রেমে না পড়ে থাকা যায়। আহা শুধু তামান্না কেনো? এমন ছেলে যে মেয়েকে প্রপোজ করবে সেতো আর ‘না’ করতে পারবেনা! কারণ, সব মেয়েই চায় তার স্বামী ভালো কিছু করুক! অন্তত দু’মুঠো ভাত, পরনে কাপড় পেতে যেনো অসুবিধে না হয়।
অথচ রিয়াদের আসল পরিচয় হলো, তার বাবা একজন কৃষক! বাড়িতে বাবা-মা ছোট বোন আর এক ছোট ভাই থাকে। সে কোনো-রকম এইচএসসি পাস করে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব নিয়েছে। ফেসবুক প্রোফাইলে তার কোনো ছবি নেই।সে তামান্নাকে যে ছবিগুলো দিয়েছে সেগুলো গুগল থেকে ডাউনলোড করা ছিলো। রাত রাত যখন তারা ভিডিও কলে কথা বলতো;- “তখন তার কলিগরা ঘুমাচ্ছে, লাইট জালানো যাবেনা, এতো রাতে বাহিরে যাওয়া নিষেধ” এমন ধরনের অসংখ্য অজুহাত দেখিয়ে কোনোদিন ক্যামেরার সামনে আসতোনা।
এখন তো কিছু করার নেই। যাকে বিশ্বাস করে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছে সে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে তা কখনো তামান্নার মাথায়ও আসেনি। ভালোবাসা কোনো অন্যায় নয়। তবে অন্ধভাবে কাউকে ভালোবাসার শেষ পরিণামটাও ভালো হয়না। ভালোবাসায় শেষ বলে ও কিছু নেই।তামান্নার বেলায়ও হয়তো এমনটা হয়েছে।
রিয়াদের কথাগুলো শুনে তামান্না কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। “ভাবলো একটা মানুষ কতটা পাষান আর বর্বর হলে” এমনটা করতে পারে। নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারেনা। দোষটা তামান্নারই ছিলো। সবাইকে ভালোবাসা যায় কিন্তু বিশ্বাস করা যায়না। কথাটি সে জানেনি।জানলেও হয়তো মানেনি। মানলে হয়ত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া লাগতোনা। ভালোবাসার জন্যে কিছুটা সময় সে অন্ধ হয়ে গেছে।
সমাজে মুখ দেখানো আর নিজের ইজ্জত সম্মান বাচানোর দায়ে তামান্না তার মায়ের জন্যে বাবার রেখে যাওয়া কিছু গহনা ছিলো। সেই গহনা গুলো চুরি করে। বিক্রি করে রিয়াদকে টাকা দেয়। টাকা পাওয়ার পর রিয়াদ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যদিও পরে তামান্না যোগাযোগ করতে যেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন পর তামান্নার মা গহনার ব্যাপারে টের পেয়ে যায়! অনেকটা ধরা খাওয়ার মতই পরিস্থিতি তৈরি হলো। তামান্নাকে অনেক বকাঝকা করে। তবুও সে রিয়াদের কথা বলেনি। তার বৃদ্ধ মা অনেক কষ্ট পায়। তার বাবার রেখে যাওয়া সম্বলটুকু এভাবে চুরি হয়ে যাওয়াতে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলতেছিলো! শুধু ওর কথা ভেবে ভেবে রাতের আধারে বোবা কান্নায় বালিশটা ভিজে যায়। দিনের বেলায় একটা হাসি দিয়ে মনের ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড়গুলোকে আড়াল করে দেয়। নিজের দুঃখ অন্যের সাথে শেয়ার আর কাঁদলে নাকি মনটা হালকা হয়। কিন্তু সে কারো সাথে শেয়ার ও করতে পারেনা। নিজের কাছেই খারাপ লাগে। সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। তাই অন্ধকারে শুধু কান্নাই করাকেই বেছে নিয়েছে।
আজকাল তামান্না ও নিজেকে যতবারই ঘুচিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে ঠিক ততবারই ব্যর্থ হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। নতুন কলেজ। নতুন জায়গা। কিছু নতুন ফ্রেন্ড। সবার সাথে পরিচয় হলো। প্রতিদিন আড্ডা দেয়। সেই সুবাদে রিয়াদ নামক প্রতারককে সাময়িক সময়ের জন্যে ভুলতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেম। মেয়েরা যাকে একবার ভালোবেসে মনে জায়গা দেয়, তাকে সে কখনোই ভুলতে পারেনা। যদিও সময়ের পরিপেক্ষিতে অন্য কারো সংসার করতে হয়। কিন্তু কোনো এক সময় সেই প্রথম ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে পড়েই।
আজ একমাস পার হয়ে গেলো! এই একমাসে রিয়াদকে ভুলার জন্যে এমন কোনো কাজ ছিলোনা যা তামান্না করেনি! কত অস্থিরতা আর পাগলামোর মধ্য দিয়ে পার করলো। তারপরও কিছুটা ভুলতে পারলো। কিন্তু ছবিগুলো সত্যিই কি ডিলেট করেছে? কথাগুলো ভেবে মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব ঘৃণাও হয়! ১ মাস ৬ দিন পার হলো। আজকে সকালে আবারো রিয়াদের ফোন। হুমকি দিয়ে বললো,- “দুইদিনের ভিতরে ২০ হাজার টাকা লাগবে। না দিলে ওর বান্ধবীদের ট্যাগ দিয়ে ফেসবুকে তার মেসেঞ্জারে করা খারাপ ভিডিও ছেড়ে দেবে”। প্রমাণস্বরূপ- রিয়াদের “লাশ মামা” নামক ফেইক আইডি থেকে ভিডিওটা তামান্নার মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। কথাটি শুনার পর তামান্না মেসেঞ্জারে ডুকে দেখে রিকোয়েস্ট ম্যাসেজ অপশনে একটা নতুন ম্যাসেজ। ওপেন করার পর তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো! এটাতো তারই ভিডিও। এই অবস্থায় কোথায় যাবে? কার সাহায্য নিবে?
রিয়াদকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে। তার জীবন নিয়ে এভাবে না খেলতে। তার জন্যে কি রিয়াদের মনে বিন্দু পরিমান অনুশোচনাবোধ হয়না? সে কখনো তাকে ভালোবাসেনি? তার কৃতকর্মের জন্যে অনেক কান্নাকাটি করে ক্ষমা চায়। সমাজে সবার সাথে থাকতে চায়। বাঁচতে চায়।
সবে মাত্র নতুন কলেজে ভর্তি হলো। তার অনেক নতুন ফ্রেন্ড হয়েছে। তাদের সামনে দাড়াতে চায়। সমাজের সাথে বাস করতে চায়। রিয়াদকে হাজারবার বলেও বুঝাতে পারেনি। ওই যে, তার এখন টাকার প্রয়োজন। তাছাড়া “চোরে কি শুনে ধর্মের কাহিনি”? তামান্নার এসব কৃতকর্ম ডাকার জন্যে এতো টাকা কোথায় পাবে? কিছুই মাথায় আসেনা। সারাক্ষণ নিজের ভিতর ভয় ভয় কাজ করে। আর ভাবে তাহলে কি সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে? সমাজে আর কখনো দাঁড়াতে পারবেনা? নাকি সে আত্মহননের পথ বেচে নেবে?
একমাত্র সম্বল মা। তামান্না তার মায়ের সাথে সব কথা শেয়ার করে। সাথে গহনা চুরির কারনটাও। নিজের পেটের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনার জন্যে তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কোনো বাবা-মায়েই প্রস্তুত থাকেন না। নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। মেয়েকে বকা দিতে দিতে নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন! হাসপাতালে গিয়ে এক’দিন ভর্তি ছিলেন। ওই দিকে রিয়াদও বার বার ভিডিও ছাড়ার হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। মাকে দেখবে নাকি রিয়াদকে সামলাবে? বয়সও বেশি হয়নি। সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। একটি মেয়ের উপর এই বয়সে এতোটা চাপ! কিভাবে সহ্য করবে?
তার মা এখন কিছুটা সুস্থ। সুস্থ হয়ে ও কোনো লাভ নেই। টকার অভাবে সন্তানের ইজ্জতহানী হচ্ছে কথা মাথায় আসলে আবার অসুস্থ হয়ে যান। মায়েরা তো এমনই হয়। সন্তানের সুখের জন্যে নিজের জীবনকেও বিসর্জন দিতে বিন্দুপরিমান দ্বিধাবোধ করেননা। অনেক সন্তান তো সুখের দেখা পেয়ে নিজের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন।
আজ তামান্নাদের পাশে বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়াটার খুব দরকার ছিলো। কিন্তু কি করার সবিই বিধাতার খেলা।
“জন্মালে মরতে হবে” কথাটা ও তো ‘বৃথা’ নয়। তিন বছর আগে তার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। তার ছোট ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে। চাচা আর মামারা মাসিক কিছু টাকা দেয় সেই টাকা দিয়েই কোনোরকমে পড়াশোনা আর সংসারের খরচ চলে।
পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গেল; “না পারে এলাকার গুণীজন কাউকে কিছু বলতে, না পারে সইতে”। তামান্নার বিয়ের জন্যে তার বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা ছিলো। সেই টাকার একটা অংশ রিয়াদকে দিয়ে দেয়। শর্ত হিসেবে,- ছবি, ভিডিও ডিলেট করতে হবে।আর কখনো টাকা চাইতে পারবেনা। চাইলে পুলিশে দিবে। রিয়াদও শর্ত মানে।
আজ কয়েকদিন তামান্নার কোনো খোঁজখবর নেই। কলেজে যায়না। কারো সাথে দেখা করেনা। ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভ। মোবাইলে ফোন দিলে রিসিভ করেনা। স্কুল জীবনে সবসময় সবাইকে মাতিয়ে রাখা মেয়েটা হঠাৎ এতোটা নিশ্চুপ হয়ে যাওয়াটা বান্ধবীরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তার বান্ধবীরা ওদের বাড়িতে আসে।
তেমন কিছু না। মন ভালো নেই তাছাড়া আম্মুর শরীর খারাপ কথাগুলো বলে আসল সত্যিটা বান্ধবীদের কাছে লুকিয়ে ফেলে।
আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্যেই করেন।এরকম কিছু সান্ত্বনামূলক কথা আর কলেজে আসতে বলে সব বান্ধবী চলে যায়। থেকে যায় স্কুল জীবনে সবচেয়ে কাছের বান্ধবী লামিয়া। তামান্নাও বুঝে গেছে আসল সত্যটা জানা ছাড়া লামিয়াও তার পিছু ছাড়বেনা। তাছাড়া রিয়াদের ব্যাপারে সে জানে। এই কয়েকদিনে লামিয়ার দেখা হলেও মনের ভিতরে লুকায়িত কথাটি বলা হয়নি। আজ কাউকে না বললেও লামিয়াকে বলাই লাগবে সবকিছু শুনে লামিয়া একটা অস্বস্থীকর নিশ্বাস ফেলে। তার চোখের কোনে কয়েক ফোঁটা পানি। নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ওই মূহুর্তে লামিয়াকে ধরে হাউমাউ করে দুজনেই কাঁদলো। প্রতিদিন লামিয়া আসে, তাকে সময় দেয়, গল্প করে। অতীত ভুলতে গিয়ে বার বার অতীত সামনে চলে আসে। রিয়াদের সাথে লামিয়া যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তার ফোন বন্ধ। ফেসবুক থেকেও ব্লক করে রেখেছে। নির্ঘুম রাত, লুকিয়ে থাকা দুঃখ, মিথ্যে হাসি, বোবা কান্না, না পাওয়ার বেদনা! মোটামুটি এভাবেই আরো কয়েকটা দিন অতিবাহিত হতে লাগলো তামান্নার…!
কিছুদিন পর…….
রাত ১২ টার দিকে রং নাম্বারে ফোন। “শেষ বারের মত কিছু টাকা দাও। আর কখনোই টাকা চাইবোনা। বেশি না এবার ৩০ হাজার টাকা হলেই চলবে। এই টাকার বিনিময়ে চিরদিনের জন্যে তোমায় মুক্ত করে দেবো”। রিয়াদ একসাথে কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিলো। সাথে সাথে তামান্নার দু-চোখ দিয়ে বৃষ্টির মত অঝোরে পানি গড়াতে থাকে। জীবনে কি ভুলটা না করলো। একটা মানুষ এতোটা নিচুর হয় কিভাবে? আজ টাকা দিলে কালকে আর চাইবেনা এটারও তো কেনো গ্যারান্টি নেই। হঠাৎ করেই কম্পাসের সূত্রটি মনে পড়ে গেলো।
কম্পাসের কাঁটার একটা প্রান্ত পৃথিবীর উত্তরে সুমেরুর দিকে এবং অপর প্রান্ত দক্ষিণে কুমেরুর দিকে স্থির হয়ে থাকে। কেউ কম্পাসের ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনা। নাড়াচাড়া বা জোরজুলুম করে সময়িকভাবে কম্পাসের কিছু ব্যত্যয় ঘটালেও, ছাড়া পেলে কাটা স্থির হয় গিয়ে সাবেক কেন্দ্র বিন্দুতে। রিয়াদ তামান্নাকে ছাড়বে না। আজ এটা, কাল ওটা বলে বার বার তাকে ব্ল্যাক মেইল করবে। ওকে দেবার মত তামান্নার কিছুই ছিলোনা।
তামান্না পরেরদিন লামিয়ার সাথে দেখা করে। তাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথা খুলে বলে। বার বার আত্মহত্যা করবে বললে ও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে লামিয়া তাকে সান্ত্বনা দেয়। যাওয়ার আগে লামিয়াকে বলা তামান্নার শেষ কথা ছিলো, লামিয়া বোন আমার ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি। সুখে দুঃখে তুই আমার পাশে ছিলি। যদি কখনো কোন অঘটন হয়ে যায় তবে আমাকে তুই মাপ করে দিস। কথাটি বলে ওড়নার আচলে মুখ ডেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে চলে গেলো। ডাক্তারের কাছ থেকে আম্মুর অসুস্থতার কথা বলে ঘুমের ওমাষ্টিন(২) দুই পাতা ট্যাবলেট নিয়ে আসে।(ডাক্তারের ভাষ্যনুযায়ী) পোস্ট মার্ডাম রিপোর্টে বলা হয়; পুরো বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ার পর সাথে সাথে ঘরম পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘরেই মৃত্যু হয়েছে। ঘরম পানি খাওয়াতে ঔষধগুলো খুব কার্যকরীতার ভূমিকায় ছিলো। সুইসাইড নোটে লেখা ছিলো “আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমিই করলাম। ধোঁকাবাজ নামক তুমিটাও ভালো থেকো। প্রিয় গর্ভধারিণী মা আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও। সিয়ামের(আপন ছোট ভাই) দিকে খেয়াল রেখো ” এতটুকু পর্যন্তই লিখা ছিলো লামিয়ার ডায়রিতে..
তারপর….
২ মাস পার হয়ে যায়। রিয়াদ যে নাম্বারটাতে ফোন দিতো তামান্নার সুইসাইডের পর সেটা তার মা বন্ধ করে দেয়।
কিসের মামলা কিসের প্রতিশোধ; বরং মেয়ে হারানোর শোকে তার বৃদ্ধ মা একেবারেই বিছানায় পড়ে যান। বিচার হবে মামলা হবে বলে অনেকেই আশ্বস্ত করলেও টাকার ভয়ে চাচা-মামারাও কয়েকদিন পর সবকিছু ভুলে গেলেন। লামিয়ার ডায়েরিতে যা লেখা ছিলো তার মধ্যে কিছু লেখা আমি সংগ্রহ করি। কিভাবে করি একটু পরেই টের পাবেন। লামিয়ার ডায়েরিতে একটা পরিচিত শব্দ ছিলো “লাশ মামা।” ইদানিং ওই আইডি থেকে কয়েকটা ম্যাসেজ আসছে।কিন্তু সিন করিনি। রিকোয়েস্ট ম্যাসেজ অপশনেই ছিলো। কৌতুহল ভাবেই আজকে ওপেন করলাম।
রিয়া, তামান্না কেমন আচে? ওর ফোন বন্ধ কেনো? ওর কাছ থেকে নেয়া টাকা আমি ফেরত দিতে চাই। ওকে বলো আমাকে একটা ফোন দিতে। রিপ্লে দাও রিয়া? এধরণের অনেকগুলো ম্যাসেজ। আগ্রহ নিয়ে ওর টাইমলাইনে ডুকি। দেখি আমাকে এড দিয়ে রেখেছে। তখনও তার কোনো ছবি ছিলোনা। তবে ওর টাইমলাইনে ক্যাপশনসহ কয়েকটা লিংক শেয়ার করা ছিলো।
লিংক গুলো হলো “জুয়া খেলার টাকা নিয়ে মারামারি, প্রতিশোধ নিতে বোনকে ধর্ষণ”। শেয়ার করা লিংকে রিয়াদের ক্যাপশন ছিলো, আমার বোনকে যারা সামান্য কিছু টাকার জন্যে ধর্ষণ করেছে তাদেরকে আমিও ছাড়বোনা। লিংকের ভিতরে ডুকে সাংবাদিকদের কল্যাণে রিয়াদের আসল পরিচয় জানলাম। রিয়াদের দেশের বাড়ি ছিলো নোয়াখালী। তামান্নাকে বলা নাম ছাড়া সবিই ছিলো তার বুয়া পরিচয়। আমারও বুঝতে আর বাকি রহিলো না “ওই টাকার কারনেই” রিয়াদের বোন আজ অন্যের হাতে ধর্ষিত হয়েছে।
নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিলাম। যাক আল্লাহ নিজের হাতে ওর বিচার করে দিয়েছে। অন্যের বোনকে ব্ল্যাক মেইল করতে গিয়ে যারা নিজের বোনের কথা ভুলে যায় তাদের জন্যে এমনটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের বোনের নিরাপত্তা দিয়ে ঘরের বাহির হয়ে যারা অন্যের বোনকে ধর্ষণ করে তাদের বিচার আল্লাহ কোনো না কোনো ভাবে করেই থাকেন। খারাপ লাগলো এই ভেবে যে, ওর মত একটা কুলাঙ্গার ভাইয়ের জন্যে একটা নিস্পাপ বোন ধর্ষিত হয়েছে। কথাটা সব বান্ধবীর সাথে শেয়ার করি। ওরা আমাকে ব্লক দিয়ে দিতে বলে। কিন্তু আমি ব্লক দিবোনা। প্রোফাইল ও লক করবোনা। আর ব্লক দিলেতো এই রহস্য টাও জানতে পারতামনা। আজ তিনদিন ফেসবুকের বাহিরে ছিলাম। মেসেঞ্জার অন করে দেখি “লাশ মামা” নামক আইডি থেকে গতকালকে আরো কয়েকটা ম্যাসেজ আসছে। “রিয়া এর আগের ম্যাসেজগুলো সিন করছো বলে তোমাকেই বলছি;- তুমি ছাড়া তোমার সব বান্ধবীরা আমার আগের আইডি ব্লক করে রেখেছে। প্রোফাইল লক বলে নতুন আইডি থেকে ম্যাসেজ যাচ্ছে না।
রিয়া আজ আমার জীবন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুচরে আটকে গিয়েছে। এর জন্যে আমিই দায়ী। জানি তামান্নাও আমাকে অনেক অভিশাপ দিচ্ছে। আজ আমার আদরের ছোট বোন ধর্ষিতা শুধু আমার জন্যে। রিয়া তামান্নাকে সত্যি সত্যি আমি ভালোবেসেছি। ওকে একটু বুঝিয়ে বলিও। জুয়া খেলার টাকার জন্যে কিছুটা সময়ের জন্যে অন্ধ হয়ে গেছি। নিজের ভালোবাসাকে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছি। বিক্রি করেছি নিজের মনুষ্যত্বকে। টাকার দরকার হলে মাঝে মাঝে ওকে ব্ল্যাক মেইল করে টাকা আনতাম। আমি ওর টাকা ফেরত দিতে চাই। রিয়া আমি অনেক ভালো হয়ে গেছি। তামান্নাকে বলো আমার আগের সিমে যার শেষে ৯৫ ওই নাম্বারটাতে ফোন দিতে। টাকা নিতে কথা বলতে না চাইলে তুমি তাকে বলে দিও সে যেনো আমাকে ক্ষমা করে দেয়। ওর আইডির টাইমলাইনের ভিতরে ডুকে দেখি ” রিমেম্বারিং লাশ মামা”। অনেকেই কিছু লিংক শেয়ার করে ট্যাগ করেছেন।
লিংকে লিখা ছিলো; “জুয়া খেলার টাকা নিয়ে মারামারি, প্রতিশোধ নিতে বোনকে ধর্ষণ, সহ্য করতে না পেরে ভাইয়ের আত্মহত্যা।” শেয়ার লিংকের ক্যাপশন ছিলো, বন্ধু ওপারে ভালো থাকিস আমরাও এটার শেষ দেখিয়ে ছাড়বো”। আজকেই তামান্নার কবরের পাশে যাবো। চিৎকার করে বলবো, শুন তামান্না, তোর হত্যার বিচার কোনো গুনীজন, কোনো মেম্বার, কোনো চেয়ারম্যান, কোনো আদালত করেনি। স্বয়ং আল্লাহ নিজের হাতে করেছে। তুই ওপারে ভালো থাকিস। পাপ বাপকেও ছাড়েনা। কিছু কিছু পাপের শাস্তি আল্লাহ এই পৃথিবীতেেই দিয়ে থাকেন। ভোগ করতে হয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব।