অন্য ঠিকানা

অন্য ঠিকানা

–সকালে বাজারে এলাম কিছু শপিং করতে । শপিং শেষ করে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় রওনা দিলাম ।

রিক্সাকিছুদূর গেলেই মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আমার স্ত্রী মাহির কল । আমি কলটা রিসিভ করলাম ।

সে তখন জিজ্ঞেস করে , কোথায় তুমি বাসায় আসতে আর কত সময় লাগবে ।

আমি বললাম , এইতো কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব , রিক্সার মধ্যেআছি এখন ।সে তখন বলে , আচ্ছা ঠিক আছে জলদি করে আসো ।

এই বলে ফোন রেখে দেয় ।

—বাড়ির কাছাকাছি রিকশা পৌছালে দেখি রাস্তার ওপর অনেক মানুষেরভিড়, রিকশাটাও যেতে পারছে না।

তাই অামি রিক্সা থেকে নেমে রিকশাওয়ালা কে তার ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দিলাম। ভাবলাম বাকি পথটুকু হেঁটে হেঁটে় চলে যাবো বাসায় ।

তারপর আমিভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক কে জিজ্ঞেস করলাম ভাই কি হয়ছে এখানে।

তখন লোকটি বলে, রাজনীতিক দুই দলের কিছু ছেলেদের ঝগড়া হয়ছে।আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।

যখনি বাসায় যেতে হাটা শুরু করতে যাবো তখনি হঠাৎ করে রাজনীতি করা কিছু ছেলেরা সেখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে মারা শুরু করে।

আমি ভয়ে দৌড় দিলাম, আমার সাথে অন্যরাও যে যেভাবে পারলো দৌড়ালো। দুর্ভাগ্যবশত আমি দৌড়ে পালাতে পারলাম না ।

অামাকে ধরে মারতে শুরু করলো। অামি অাশে পাশে থাকিয়ে দেখলাম।

সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই লোহার রড, ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে ।

আমার মত সাধারণ লোকেরা ও বাদ পড়ে নাই। ।

আমি জানি না সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের মাঝে কোন রাজনীতি করা কোন লোক ছিলো কিনা, নাকি সবাই অামার মতো সাধারন লোক ছিলো।

—আমার মাথায় যখন রড দিয়ে তারা আঘাত করেছিলো, আমি তখন তাদের পায়ে ধরে বলেছিলাম, ভাই আমার বাবা মা নাই ,

বাসায় একমাত্র অামার স্ত্রী আর একটা ছেলে সন্তান আছে , যার বয়স মাত্র তিন মাস ।অামি ছাড়া তাদের দেখার কেউ নাই।

আমাকে প্লীজ ছেড়ে দেন। আমি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত না ।

তখন ১৭ বছরের একটা ছেলে আমার চুল ধরে বললো,শালা মেয়েদের মত কাঁদলে মনে করছোস ছেড়ে দিবো ।

আমাদের দলের ছেলেদের যখন তোরা মারছিলিতখন তোর স্ত্রী আর সন্তানের কথা মনে ছিলোনা ।এই বলে সে ছুরি দিয়ে অামাকে অাঘাত করে।

আমার সামনে অামি অামার মৃত্যুকে নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম এরা আমাকে ছাড়বেনা, এদের চোখে এখন খুনের নেশা।

ওরা যখন রড চুরি দিয়ে এলোপাথারী মারছিলো অামাকে, আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললাম…,

“আল্লাহ আমার মাহি কে আমার সন্তানকে তুমি দেখো রেখো “।

—আমার শরীরটা একসময় মৃত্যুবরণ করে।মারা যাওয়ার ঠিক একটা পলক আগেও আমার চোখে ছিলো আরো কয়েকটা সেকেন্ড বাচার আকুতি।

একবার মাহিকে দেখার একবার তাকে জরিয়ে ধরার , একবার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করার ।

আর একটাবার বাবা মা এর ফ্রেমে বাধানো ছবিটা দেখার প্রবল আকাংক্ষা।

কেউ আমাকে বাঁচাতে আসেনি কেউ একটি বার বলেনি, এই ছেলেটার কোন দোষ নাই।

ওকে আমরা মারছি কেনো একে বাঁচতে দিই ।আমি মারা যাওয়ার পরও আমাকে তারা রড ছুরি দিয়ে আঘাত করে চলছিলো।

আমার আত্নাটা তখন পাশে বসে কাঁদছিলো।যে শরীরে তার বসবাস ছিলো এতগুলো বছর তার আঘাতে কেনইবা কাঁদবেনা আত্নাটা ।

—কিছুক্ষণ পরে অামার দেহটা রাস্তার ওপর রেখে তারা চলে যায়, আমার দেহটার আশেপাশে তাকিয়ে দেখি ।

আরো অনেকগুলো মৃতদেহ রাস্তার উপর পড়ে আছে ।আমার মত তাদেরও কখনো আর ফিরে যাওয়া হবেনা তাদের পরিবারের কাছে ।

তাদের আপনজনের কাছে ।

—কিছুক্ষণ পরে কিছু লোক এসে অামার লাশটা রাস্তার উপর থেকে তুলে আমাদের বাসার সামনে এনে রাখে।

মাহি তখন দৌড়ে ছুটে এসে আমার লাশটা কে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো ।

কি দোষ করছিলো ওকে এমন করে কেন মারলো ।ও তো রাজনীতী করতো না। কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল না ।

তাহলে কেন তাকে জীবন দিতে হল । কেন তাকে এত নিষ্ঠুরভাবেমারা হল ।

—আমি মাহির পাশে বসে আছি, এটা কি সে টেরপাচ্ছে না।

সে শুধু কেঁদে চলছে। পাগলীটার কাঁন্না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো খুব বেশি। কিন্তু অামি কিছুই করতে পারছি না।

অামার খুব ইচ্ছে করছে পাগলীটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।তাকে একটি বার জরিয়ে ধরতে।

অাদর করে তার চোখের জলের ফোঁটাগুলো মুচে দিতে ।

চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে চাঁদ একে দিয়ে বলতে। পাগলী কাঁদছো কেনো, অামিতো তোমার পাশে অাছি।

কিন্তু অামি পারি নাই কিছুই করতে পারি নাই।

শুদু পাগলীটার সাথে আমার আত্মা ও কেঁদে চলছে। অামি তাকে ছোয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু কি দিয়ে ছোব।

অামার হাত নেই পা নেই, মানব শরীরে কোন অঙ্গ নাই। অামার শুধু অস্তিত্বটাই অনুভব করতে পারছি যে ।

—এক সময় আমি ঘরে ঢুকলাম , ফ্রেমে বাঁধানো মা বাবার ছবির সামনেএসে দাঁড়ালাম ।

মা-বাবার ছবির পাশেই আরেকটা ছবি ফ্রেমে বাঁধানো রাখা হবে , আর সেই ছবিটা হবে আমার । তারপর আমি পৌছে গেলাম আমার রুমে ।

রুমে এসে দেখি বিছানার মাঝখানে আমার সন্তান মারুফ শুয়ে আছে । সেও কান্না করে চলছে । মারুফকে কখনো আমি ঠিক মত করে কোলে নেইনি ।

কখনও বুকের সাথে তাকে জড়িয়ে ধরে নি । কারন ওকে কোলে নিতে আমার খুব ভয় করত ।

কোলে নিলে মনে হত যে আমার কোল থেকে মাটিতে পড়ে যাবে । মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করত ।

মাঝে মাঝে মাহি মারুফকে আমার কোলে দিলে , আমি তাড়াতাড়ি কোল থেকে নামিয়ে তাকে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে রাখতাম ।

কিন্তু আজকে খুব ইচ্ছে করছে তাকে একটিবারকোলে নিতে। একটি বার তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে ।

কিন্তু আমি পারছিনা তাকে কোলে নিতে ,তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে।

—এরপর আমি আবার মাহি কাছে ফিরে আসলাম, সে তখনও আমার দেহটাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে কেঁদে চলছে ।

জানি সে আমার কোন কথাই শুনতে পাবেনা।

তারপরও আমি তাকে বললাম ,কাঁদবেনা মাহি কাঁদবেনা , যে নিষ্ঠুর মানুষ গুলোর জন্য অাজ তোমার চোখে চল।

যে নিষ্ঠুর মানুষ গুলো অামাকে তোমার পাশে থাকতে দিলোনা , যে নিষ্ঠুর মানুষ গুলোই তোমাকে করেছে বিধবা ।

যে নিষ্ঠুর মানুষ গুলো মারুফকে করেছে এতিম।

দেখো আল্লাহ একদিন তাদের বিচার করবেন,অাল্লাহ কোনদিন তাদের মাফ করবেনা কোনদিনওনা।

—তারপরে আমার চারপাশটা হঠাৎ করে বদলে যায়।আমি আর কাউকে দেখতে পাই না।কাউকে না, মাহি কেও না।

অামি বুঝতে পারি, এই পৃথিবী ছেড়ে এখন অামায় অন্য ঠিকানায় যেতে হবে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত