বিনিময়

বিনিময়

মা যে এই বয়সে এসে কন্সিভ করেছে, সমাজে তো আর মুখ দেখানোর উপায় থাকলো নারে আপু! রুপার কথা টা শুনে আচমকা চমকে উঠলাম, কিন্তু পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম। ঘটনা কি তবে সত্যি! মা কে একবার জিজ্ঞেস করব? ছিঃ ছিঃ এটা কিভাবে বলব! রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে মা আমার ঘরে এলো।

-স্বর্না ঘুমিয়েছিস মা?
– না মা, ভিতরে আসো।

মায়ের গলা শুনতেই রুপা বিরক্তিভাব নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। জানিনা এটা মায়ের চোখে পড়েছে কিনা!
মায়ের দিকে অনেকদিন ভালো করে তাকানো হয়নি। সত্যি যে মায়ের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে সেটা আমার চোখে ধরা পড়েনি। মা ভিতরে এসে দুদন্ড দাঁড়িয়ে কি যেন ভেবে আবার চলে গেলো। আমিও মাকে কিছু বলতে চেয়েও কেন যেন থেমে গেলাম।

আচ্ছা বাবা মা হঠাৎ এ বয়সে এসে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল? মায়ের সাথে সামনাসামনি এ বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। ইদানীং আশেপাশে থেকে অনেক কটু কথাই কানে আসে। রুপা তো রীতিমতো কলেজ যাওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছি। এমন কি বাড়িতেও কারো সাথে কথা বলে না। তবে কি এর জন্য মায়ের কন্সিভ করা টা দায়ী? আসলে এটা তো খুব স্বাভাবিক। মায়ের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ ঊর্ধ্ব। আমরা দু বোন বিয়ের উপোযুক্ত হয়ে গিয়েছি। আর মা কিনা এ বয়সে এসে আরেকটা বাচ্চা নেয়ার কথা ভাবলো। এখন তো রীতিমতো আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগছে। মা কি একবারো আমাদের কথা ভাবলো না। আর বাবা ই বা কি! তারো কি এবয়সে এসে ভীমরতি ধরেছে।
কদিন হলো মায়ের সাথে টোটালি কথা বলা অফ।

এদিকে মায়ের সময় টাও নাকি ঘনিয়ে এসেছে। সাথে পাড়াপ্রতিবেশি দের যাচ্চেতাই কথা। কি একটা ভেবে যেন মায়ের ঘরে এলাম, দেখি মা ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মায়ের মুখ টা দেখতে কি মায়াবী লাগছে। চোখের নিচে কালিমা বলে দিচ্ছে মা কত রাত জেগেছে। হয়ত দুঃশ্চিন্তা ও করে। আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি রা তো ইদানীং এ বিষয় নিয়ে খুব উপহাসে নেমেছে। এই তো সেদিন বাসায় ফেরার পথে দুসম্পর্কের এক মামি ডেকে বলল, কিরে স্বর্ণা তোর নাকি এ বয়সে আবার একটা ভাই বোন আসছে, লোক লজ্জার ভয় নেই কি তোর মায়ের? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কোনো জ্ববাব না দিয়ে বাড়িতে এলাম। সোজা মায়ের ঘরে গেলাম।

– মা তোমাদের নাহয় লোক লজ্জা বলতে কিছু নাই, কিন্তু আমি রুপা তো বড় হয়েছি মা। এ বয়সে আরেকটা বাচ্চা নেয়ার কি খুব দরকার ছিল? তুমি তো আর বের হওনা, বের হলে বুঝতে রুপা কেন কলেজে যাচ্ছে না। পিছনে ঘুরে দেখি মা কাঁদছে। মায়ের কাঁদোকাঁদো চেহারা টা দেখে বড্ড মায়া লাগছে। এভাবে বলা টা হয়ত ঠিক হয়নি। আমি মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের হাটুর উপর হাত দিয়ে বসলাম।

– মা আমি কথা টা এভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু কি করব বলো।। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে, আমি যদি না থাকি তোরা দু বোন তোদের এই ভাই/বোন কে মানুষ করবি তো?
– মা এসব কি বলছ তুমি? আর কেনই বা বলছ?
– তোর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তোদের একটা ভাই হোক।

বংশের প্রদিপ বলতে যা বুঝাই। কিন্তু আমি তাকে তা দিতে পারিনি। তোর জন্মের পর তোর বাবা তা মেনে নিলেও রুপার জন্ম টা সে মেনে নিতে পারেনি মন থেকে। তার একটা ছেলে চাই। সেই আফসোস টা তার এখনো রয়ে গেছে। হয়ত সে আমায় কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কিন্তু স্বামীর মন তো স্ত্রী বুঝবে। এর পর বাচ্চা কন্সিভ করা টা পসিবল হচ্ছিল না। তোর বাবা কে বুঝিয়েছিলাম আরেকটা বিয়ে করতে। হয়ত এতে তার ইচ্ছে টা পূরণ হতো। কিন্তু সে তা করেনি।

দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে আমি সব কিছু পেরেছি শুধু পারিনি স্বামীর ইচ্ছে টা পূরণ করতে। সেই আফসোস টা যে আমার থেকেই যেতো। তাই এই বয়সে বাধ্য হলাম শেষ চেষ্টা টা করার। কিন্তু ডাক্তার বলেছে, এটা অনেক বেশি রিস্কি। বাকি টা আল্লাহর হাতে। তুই শুধু আমায় কথা দে, আমার কথা টা রাখবি?

মায়ের কথা গুলো শুনে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। ঘরে এসে দেখি রুপা বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে। আমার আর বোঝার বাকি রইলো না যে, রুপা সব টা শুনেছে। সেদিনের পর থেকে আমি রুপা দুজনেই মায়ের কাছেকাছে থাকি। মা এখন হাসে, মন খুলে কথা বলে। মা কে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। ৪ঘন্টা হয়ে গেলো মা ভিতরে। বাহিরে দাঁড়িয়ে দু বোন অপেক্ষা করছি। বাবা এসে এখনো পৌঁছায়নি। মাথার উপর পাহাড়সব দুঃশ্চিন্তা। আল্লাহ আল্লাহ করছি মা ও আমাদের ভাই বা বোন টা যেন সুস্থ থাকে। একটুপর ভিতর থেকে বাচ্চার কান্না ভেসে আসলো। নার্স বের হয়ে এসে বলল, মিসেস রাবেয়ার বাড়ির লোক কে আছেন? আমি রুপা দুজনেই এগিয়ে গেলাম।

– উনার ছেলে হয়েছে।

আনন্দে আমরা দু বোন প্রায় আত্মহারা। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই নার্স বলল ডাক্তার আপনাদের এগিয়ে যেতে বলেছে। ডাক্তার ভিতর থেকে বের হলো, সাথে আমার ফুটফুটে ছোট ভাই টি ও। শুধু ফিরলো না আমাদের মা। মায়ের নিথর দেহ টা একটু পরে এনে আমাদের সামনে রেখে গেলো। ইতোমধ্যে বাবা ও পৌঁছে গেছে।

আচ্ছা মা কি জানতো, তার জীবনের বিনিময়ে সে আমাদেরকে ভাই দিয়ে যাবে? যদি জানতোই তবে আগে কেন বলেনি, বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে কেন আমরা মা হারা হবো৷ মা একটা বার তোমার মনের কথা টা বলতে, দেখতে তোমার মেয়েরা তোমায় রাজ্যের সুখ এনে দিতো। একটা ছেলের বদলে তোমায় কখনো হারাতে দিতো না। আজ বাবা আমাদের মাঝে থেকেও নেই। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এখন দু বোন মায়ের প্রতিচ্ছবি খোঁজার চেষ্টা চালাই। কিন্তু দুজনের পরিবর্তে এখন তিনজন মা হারা সন্তান। মা হারা সন্তানই বোঝে হয়ত মায়ের কদর।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত