জারজ সন্তান

জারজ সন্তান

রাহাত যখন আমার পেটের সন্তানকে অস্বীকার করলো, তখন মনে হচ্ছিলো এ জীবনটা রেখে আর কী হবে? যে বাচ্চা দুনিয়ায় এসে সে জানতে পারবে সে একজন জারজ! তাকে আমি কী বা পরিচয় দিবো। সমাজের মানুষেরা যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘কী রে, বাচ্চা পেলি কোথায়?’ তখন কী জবাব দিবো? চাচা-চাচীর সামনে কীভাবে মুখ দেখাব?

রেললাইনের মাঝে বসে অাছি। চারদিকটা জনমানবশূন্য। হয়তো ট্রেন আসতে অারো কিছুক্ষণ দেরি হবে। মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। জীবনে কী পেয়েছি আমি? বাবাকে দেখিনি, মাকে ছেলেবেলায় হারিয়ে চাচীর সংসারে মানুষ হয়েছি। বিনিময়ে পেয়েছি কতশত লাঞ্ছনা! ঠিক তখনি তার আগমন, রাহাতের। বন্ধুত্ব থেকে যখন ও আমাকে বললো, ‘মিষ্টি তোমার জীবন-মরণের সাথী হতে চাই। কি বানাবে না?’আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলাম। ওর হাতটা ধরবো কী ধরবো না এ নিয়ে বুকের একপাশটা ব্যথায় চিনচিন করে উঠেছিলো। সময় চেয়ে নিয়েছিলাম তিনদিনের।

মহাবিপদরে পরে নাওয়া-খাওয়া যেন সব ভুলে গেলাম। বারবার ওর একটা কথাই মনে হচ্ছিলো, ‘তোমার জীবন-মরণের সাথী হতে চাই।’ জীবনে ভালোবাসা কি জিনিস বুঝি না, হয়তো না পাওয়ার অাকাঙ্ক্ষা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। একটুর জন্য মনে হচ্ছিলো, আমি ভালোবাসতে চাই, আমার ভালোবাসা প্রয়োজন। রাহাত তোমার হাত ধরতে চাই আমি। ব্যাস, দু’জনের পথচলার শুরু। ভালোবাসা কী, সেটা আমি সঠিকভাবে না বুঝলেও ওর কাছ থেকে এর তালিম পেতাম।

সেদিন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমার বাবা-মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। যাবে না তুমি?’ আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, ‘যাহ, আমার শরম করে না বুঝি।’ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,  ‘শরম কিসের শুনি? আমি আছি না? পছন্দ হলে বিয়ের কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’ আমি ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘যদি আমাকে তারা পছন্দ না করে?’হো হো করে হেসে উঠেছিলো রাহাত। তারপর বলেছিলো, ‘প্রশ্নই উঠে না। আমি তো আর এমনি এমনি তোমাকে পছন্দ করিনি। তোমার মাঝে গুন অাছে বলেই তো তোমার প্রেমে পড়েছি। আমি সেদিন আর কোনো কথা বলিনি। তবুও সারাদিন বুকের ভেতরটা ভয়ে কেমন যেন চুপসে যাচ্ছিলো।

পরদিন রাহাতের সাথে ওর বাড়িতে গেলাম। আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে মা মা বলে ডাকছে। আমি বসে থেকে চারদিক তাকাচ্ছি। বেশ গোছানো একটা বাড়ি। মনে মনে ভাবলাম, ‘রাহাতেরা এত বড়লোক হয়ে আমার মতো এতিম মেয়েকে মেনে নিবে তো?’ ভয় যেন দিগুন বেড়ে গেল। মাঝে মাঝে ঢোক গিলতে লাগলাম। রাহাত আমার পাশে বসে বললো, ‘সরি মিষ্টি, বাবা-মা নাকি জরুরী কাজে কিছুক্ষণ চট্টগ্রাম গিয়েছেন।’ কথাটা বলেই মাথা নিচু করে বসে থাকলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘মন খারাপ করো না। আজ হয়নি তো কী হয়েছে, পরে অারেকদিন নিয়ে এসো।’ রাহাতের মুখে যেন হাসি ফুটে উঠলো। আমিও হেসে দিলাম।  ‘তারচেয়ে চলো আমাদের বাড়িটা তোমাকে ঘুরে দেখাই।’

আমার কেমন জানি লাগছিলো। আমি বললাম, ‘আজ থাক রাহাত, অন্য একদিন। আমার ভালো লাগছে না।’
‘তাহলে অামার রুমটা একবার দেখবা না?’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাহাত জোর করে নিয়ে গেল। অন্যান্য রুমগুলোর মতোই এটিও সুন্দর। বেশ ঝকঝকে, তকতকে। রাহাত আমাকে বললো, ‘সুন্দর না?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘তুমি বোসো, আমি চা অানছি।’ আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাহাত চলে গেল। আমি মনে মনে ওকে পাগল বলতে লাগলাম।

চা খেয়ে কেমন জানি মাথাটা ঘুরাচ্ছে। রাহাত আমার অনেক কাছে এসেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ বাড়িতে কেউ নেই। চলো, একটু ইনজয় করি।’ কথাটা বলেই দরজাটা ভেজিয়ে দিলো। আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম, ‘তুমি কী বলছ তা বুঝতে পারছ রাহাত?’ ‘কেন মিষ্টি! আমি তোমাকে ভালোবাসি না? আমাকে সম্পর্কের এতদিন হয়ে গেল, কই কখনো তো তোমাকে এমন প্রস্তাব দেইনি। তবে আজ কেন? আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো মিষ্টি।’

আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘আমার জীবনের কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? আমি এখন এসব চাচ্ছি না।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন জানি শরীরের শক্তিটা কমে আসছিলো। রাহাত অনেকটা জোরপূর্বক আমার সাথে অন্যায় কিছু করলো। সন্ধ্যায় আমার ঘুম ভাঙলো, বুঝলাম আমার সতীত্ব শেষ। রাহাতের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারিনি। ক্লান্ত হয়েছিলাম। কাঁদতে লাগলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। রাহাত আমার কাছে বসতেই বললাম, ‘এটাই কি ভালোবাসা?’ রাহাত আর কোনো কথা না বলে নিজেই আমার চুল ঠিক করে দিয়ে বললো, ‘চলো, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।’
সারা রাস্তায় আর কোনো কথা বললাম না। খুব ঘৃণা হচ্ছে ওকে।

ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখছি অনেকটা দূরেই তা চিহ্ন। ট্রেনটা যতই কাছে আসছে ততই ভাবছি, ‘বেঁচে থাকলে কী পরিচয় পাবে আমার সন্তান?’ হঠাৎ মনে হলো কেউ আমাকে বলছে, ‘অাত্মহত্যাই কি সব সমস্যার সমাধান?’ পেট থেকে মনে হয় আওয়াজ আসলো, ‘মা আমি বাঁচতে চাই।’ ট্রেনটা অনেকটাই কাছে এসেছে। বুকটা কেঁপে উঠলো। লাইন থেকে সরে দাঁড়ালাম। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। হাঁটতে লাগলাম, অজানা গন্তব্যে। যেখানে আমি নতুন জীবন শুরু করতে পারব। কেউ জিজ্ঞেস করবে না বাচ্চার বাবা কে? কেউ জিজ্ঞেস করবে না, ‘এ বাচ্চা জারজ!’

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত