অভাব

অভাব

ভাইয়া??
— কি??
— মা তোরে ভাত খাইতে ডাকে।
— যা, আইতাসি।
— তাড়াতাড়ি আয়, মা ভাত নিয়া বইয়া আছে।
— আইতাসি কইলাম না?? যা ভাগ এইহান থাইকা।

এতক্ষণ খুব মনযোগ দিয়ে একটা অংক সমাধান করতে চেষ্টা করছিল মুকুল । সামনে ওর এইচ.এস.সি পরীক্ষা। পরীক্ষা সামনে অথচ, একটা পারা অংকের সমাধান করতে না পারায় মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে আছে তার। এই সময়ে পেছন থেকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকতে আসা ছোট বোনের ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে মাথাটা গেল গরম হয়ে। নাহ, এখন আর কিছুতেই এই অংক মেলানো যাবে না। ভাতের কথা শুনে পেটের ভেতর কেমন যেনডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। তাই আর অংক মেলানোরবৃথা চেষ্টা না করে খেতে চলে গেলমুকুল। কিন্তু খাবার টেবিলে গিয়ে মাথাটা যেনআরও বেশী গরম হয়ে গেল মুকুলের। খাবার টেবিলে মায়ের সাথে তাই আবার কথা কাটাকাটি শুরু হয় মুকুলের,,,,,

— এগুলা কি??
— কি মানে?? চোখে দেখস না এগুলা কি??
— প্রত্যেকদিন এই এক তরকারি দিয়া ভাত খাইতে মন চায় না কতদিন কমু??
— কেন পারবি না??

তোর বাপ কি রাজা বাদশা যে তোরে প্রত্যেকদিন পোলাও কোরমা খাওয়াইব?? আমরা খাইনা?? যা দিসি এগুলা দিয়া তাড়াতাড়ি খাইয়া ওঠ।

— আমি খামুনা এগুলা। প্রত্যেকদিন এক তরকারি খাইতে ভাল্লাগে নাআমার।
— না খাইলে বাইর হইয়া যা ঘর থাইকা। এহ আইসে নবাবের বেটা পোলাও কোরমা খাইব। এত খাইতে মন চাইলে নিজে ইনকাম কইরা খাইতে পারস না??

— হ থাকুম না আমি এই ঘরে। যামুগা আমি সব কিছু ছাইড়া। এই কথা বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে মুকুল। মাও আর বাঁধা দেয় না মুকুলকে। জানে রাগ কমে গেলে সন্ধ্যার পর ঠিকই ফিরে আসবে সে। এমনটাই হয় সবসময়।

এদিকে মেজাজ গরম করে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেও পেটের ক্ষুধাটা যেন বেড়েই চলেছে। শার্টের বুক পকেট হাতড়ে কোন রকমে ২৭ টাকা খুঁজে পেল সে। এর মধ্য থেকে ১০ টাকা দিয়ে একটা রুটি আর এক কাপ চায়ের সাথে ২ গ্লাস পানি খেয়ে কোনরকমে ক্ষিদেটা চাপা দেয় সে। এরপর ৫ টাকা দিয়ে একটা গোল্ডলিফ কিনে ধীরপায়ে এগিয়ে যায় ষ্টেশনের দিকে। মন কিংবা মেজাজ যখন খুব খারাপ থাকে তখন রেল লাইন ধরে একা একা হেঁটে বেড়ায় মুকুল, আর মনের সুখে সিগারেট ফুঁকে। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে যেন মনের সব রাগ পুড়িয়ে দেয় সে। ৫ টাকা দিয়ে কেনা সিগারেটটা শেষ হওয়ার পর রেল লাইনের এক কোণে বসে পড়ে মুকুল। এখন মেজাজ কিছুটা শান্ত। পেছনে হাত নিয়ে হাত দুটোর উপর ভর দিয়ে বসে, আর আশেপাশের মানুষগুলোর কান্ড কারখানা দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেল মুকুলের।

রেল লাইনের ধার ঘেষে গড়ে ওঠা বস্তিতেবসবাসকারী এক মা পরম স্নেহে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে তার সন্তানকে। সামান্য পানিভাত, ডালআর আলুরভর্তা দিয়ে কি তৃপ্তি নিয়েই না ভাত খাচ্ছে ছেলেটি। অথচ এই খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ নেই ছেলেটির। বরং মায়ের হাতে এই খাবারই তার কাছে অমৃত মনে হচ্ছে। হঠাৎ বুকের মাঝে কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে মুকুলের। ছোটবেলায় সেও তার মার হাতে এভাবেই ভাত খেত। কই তখনতো কখনো খাবার নিয়ে অভিযোগ করেনি সে। তবে আজ কেন এতটা বদলে গেল সে। অনুশোচনায় ভোগে সে। কোন ভুল করেনিতো মুকুল???  সন্ধ্যার একটু পরে বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয় মুকুল। বাসায় ঢুকতে যাবে এমন সময় বাবা-মার কিছু কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে মুকুল।

— মুকুলের মা কয়টা বাজে?? এত রাইত হইল মুকুলতো এহনও আইলো না।
— আইয়্যা পড়ব অহনি। আপনে চিন্তা কইরেন না।
— পোলাটা সারাদিন না খাইয়া আছে।

এত রাইত হইল এহনও আইতাসে না কেন?? আইলে ভাল মত খাইতে দিও। মাছের মাথাটা দিও তারে। মুকুলের আবার রুই মাছের মাথা অনেক পছন্দ করে। অনেকদিন পর পোলা রুই মাছের মাথা দেইখা খুশী হইব।

— আইচ্ছা দিমুনে।
— অভাবের সংসার আমার।

যে কয়টা টাকা কামাই করি, ঘর ভাড়া দিয়া, পোলা মাইয়ার লেখাপড়ার খরচ চালাইয়া কোন রকমে দিন পার করি। ভালমন্দ খাওয়াইতেও পারি না তোমগোরে। কাপড় চোপড় কিনা দেওয়াতো দূরের কথা।

— থাক এসব কথা কইয়া আর কষ্ট পাইয়েন না। আল্লাহ একদিন সব দিব আমগোরে।
— হ আল্লাহ যেন তাই করে।

দেখবা একদিন মুকুল অনেক বড় চাকরী করব। দেখবা আর কোন অভাব থাকব না আমাগো। কথাগুলো শুনে যেন বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল মুকুলের। কোন রকমে কান্না চেপে রেখে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল মুকুল। একটু পর মা এসে ঢুকল মুকুলের ঘরে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

— আয় বাপ, ভাত খাইতে আয়। তোর আব্বা তোর লাইগা বাজার থাইকা রুই মাছ নিয়া আইছে।
— (নিজের কান্না আর ধরে রাখতে পারল না মুকুল,

মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল আমারে মাফ কইরা দাও মা। আমি ভুল কইরা ফালাইসি। আমারে মাফ কইরা দাও। আর কোনদিন তোমগো লগে খারাপ ব্যবহার করুম না আমি। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মমতাময়ী মা। শাড়ির আচল দিয়ে পরম স্নেহে ছেলের চোখের পানি মুছে দেয় সে। এরপর ছেলেকে নিয়ে গিয়ে নিজের হাত ভাত খাইয়ে দেয় সে। পাশের ঘরে নীরবে চোখের পানি মুছে মুকুলের বাবা। এই পানি কোন কষ্টের পানি নয়, এই পানি সুখের পানি। তার অভাবের সংসারে আজ একটুখানি সুখ দেখা দিয়েছে..!

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত