আয়শার সাথে বিয়ে টা হুট করে হয়েছিল।পাত্রী হিসাবে দেখতে গিয়ে সেদিনই বিয়ে করে এনেছিলাম আয়শাকে।মেয়ে হিসাবে সে অতীব সুন্দরী।আর স্ত্রী হিসাবে তার মত কাউকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।আমি আয়শা আর আমার আব্বু আম্মুকে নিয়েই আমাদের সংসার।একটা নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরী আমার।এক বছর দু বছর তিন বছর বেশ সুখেই কেটে গেছে আমাদের সংসার।সামান্যতম ঝামেলাও হয়নি এই কয় বছরে।আয়শার প্রতি আমার ভালবাসারও কমতি ছিল না।নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার কোন ত্রুটি রাখিনি।
আমার কাজে সন্তুষ্টি হয়ে আমাকে প্রমোশন দেওয়া হয়।এখন আমি প্রতিষ্ঠানের সিইও।অফিস থেকে একজন পি এস নিয়োগ দেওয়া হয় আমার জন্য।আমার পি এস এর নাম মনিকা।যেমন মডার্ণ তেমনি সুন্দরী।শারীরিক গঠন যেকোন পুরুষকে আকর্ষণ করার মত।পোশাকেও আধুনিকতার ছোঁয়া।মোট কথা নিজেকে বেশ খোলামেলা ভাবেই উপস্থাপন করে মনিকা।প্রথমটাই মনিকাকে আমার বেশ বিরক্ত লাগতো।ওতটা খোলামেলা অন্তত আমার কখনও পছন্দ ছিলনা।তবুও অফিসের খাতিরে সহ্য করতে হত তাকে।কাজের ফাকে সারাক্ষণ আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত নির্লজ্জের মত।আর আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন করত।এভাবে সময় কেটে যেতে লাগল।মনিকা তার হাবভাবে এটা বোঝাতে চাইতো যে সে আমাকে পছন্দ করে কিন্তু সে ভালো করেই জানে আমার ঘরে স্ত্রী আছে।
তবুও তার এই রকম ব্যবহারের হেতু খুঁজে পেতাম না।এক সময় মাত্রাতিরিক্ত করার ফলে তাকে একদিন ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,’মনিকা,তোমার সমস্যা কি?আমার কাছে কি চাইছো?আমার স্ত্রী আছে জানার পরেও এরকম করার মানে কি?’ ‘মানে কি আপনি বুঝেন না?’খুব সহজ ভাবে বলল মনিকা। ‘আমি কি বুঝি না বুঝি সেটা দিয়ে তোমার দরকার নাই।তুমি সরাসরি বলো কি চাচ্ছো।’আমি আবারো জোর গলায় জিজ্ঞেস করলাম। ‘আমি আপনাকে ভালবাসি।আপনাকে পেতে চাই,আমার এই আগুন ধরানো যৌবন আপনাকে বিলিয়ে দিতে চাই।’নির্লজ্জের মত কথাগুলো বলল মনিকা। ‘কি বলছ তুমি!মাথা ঠিক আছে?’আমি বললাম। ‘আপনার স্ত্রী থাকলেও আমার কোন সমস্যা নেই।আমি আপনাকে ভালবাসি।’মনিকা বলল। ‘বের হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।আমাকে একা থাকতে দাও।’বিরক্তি ভরা মুখে বললাম।…
অফিসের নতুন একটা প্রজেক্টের কারণে সাত দিনের একটা ট্রেনিং এ আমাকে পাঠানো হল।সাথে মনিকাও আছে।অফিস কর্তৃপক্ষ তাকেও ঠিক করেছে।একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবকিছু মেনে নিতে হল।তবে এই সাত দিন আমার জীবনকে এলেমেলো করে দিয়েছে।এই সাত দিন একসাথে থাকার সুবাধে সে আমার খুব কাছে কাছে থাকার সুযোগ পেয়েছে।আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে।মনের অজান্তেই আমি দূর্বল হয়ে পড়েছি মনিকার উপর।ওর ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গেছি।আমি ভুলে গেলাম আমার স্ত্রীর কথা আমার পরিবারের কথা।কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে দিয়ে এই পাপ কাজ করিয়ে নিচ্ছে।আমি কিছুই করতে পারছি না।আবার মনিকাকে ভুলতেও পারছি না।ওর সাথে এতদিনের বিরক্তি,রাগ,খারাপ ব্যবহারগুলো সব ভালবাসা হয়ে ফুটে উঠেছে।আমার মনে গেঁথে গেছে মনিকা।এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল।মনিকার ভালবাসায় আমি অন্ধ হয়ে গেছি…।
ইদানিং আয়শার সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করছি।ওকে সহ্য হচ্ছে না।ঠিক মত খোঁজ খবর নেই না।ও কি করল কি করল না সেদিকে আমার খেয়াল নেই।আমার অবহেলায়,এরকম অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে যে আয়শা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে সেটা আমি বেমালুম ভুলে গেলাম।তার কষ্ট আমার মনে কোন ভ্রুক্ষেপ করল না।আমার বারবার মনে হতে লাগলো আয়শাকে আমার জীবন থেকে কিভাবে সরাবো।আয়শা থাকলে আমি মনিকাকে পাব না।দিনের পর দিন আয়শার সাথে অমানবিক নির্যাতন করতে লাগলাম।বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতে লাগলাম।এতকিছুর পরও আমার প্রতি আয়শার ভালবাসা একটুও কমল না।আমার সব নির্যাতন সে নিরবে সয়ে যায়।প্রতি রাতে কারো চাপা কান্নার স্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায়।জেগে দেখি আয়শা কাঁদছে কিন্তু তবুও তার প্রতি আমার কোন দয়া হয় না।যে আয়শাকে এতটা বছর এক মিনিটের জন্যও চোখে পানি আনতে দেইনি সেই আয়শা এখন অঝরে কেঁদে যাচ্ছে অথচ আমি নির্লজ্জের মত দেখছি।
এদিকে মনিকার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ চলছে।আমার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান সব মনিকাকে নিয়ে।অফিসের সবাই জেনে গেছে আমার এই ঘৃণিত অনৈতিক সম্পর্কের কথা।সবাই আমাকে যাচ্ছেতাই বলছে কিন্তু তাতেও আমার ভ্রম দুর হল না।আমি একটা নরপশুতে পরিনত হয়ে গেছি।ঠিক ভুল বিচার করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।এসবের জন্য দায়ী কে?আমি?না অন্য কেউ?
অফিস থেকে ফিরলাম রাত করে।মাতাল হয়ে আছি।মনিকার কাছ থেকে মদের নেশা শিখেছি।প্রথম প্রথম লুকিয়ে খেতাম এখন ওপেনলি খাই।বাসায় আসার পর আমার নেশা কেটে গেল।ঘরে ঢুকেই দেখি আয়শা কাঁদছে।আমার মাথাটা কিঞ্চিৎ ব্যাথা করে উঠল।আজ হুট করে আয়শার প্রতি মায়া হল।জানতে ইচ্ছা হল ওর কান্নার কারণ।কি জিজ্ঞেস করব?ওর কান্নার কারণ তো আমি!আমার পশুর মত ব্যবহার!মনিকার সাথে অবৈধ সম্পর্ক।তাহলে?ওকে আমি কি জিজ্ঞেস করব?তবুও দুহাতে আয়শাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম,কি হয়ছে? ‘তুমি আমাকে কষ্ট দিছো সেটা আমি নীরবে সহ্য করেছি এবং তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই এরজন্য কখনও দোষারোপও করব না তবে আমার গর্ভের সন্তানের সাথে অবিচার করো না!ও তো তোমারই রক্ত!আজ তিনমাস হল সে আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে।তোমার এরকম ব্যবহারে এরকম খুশির খবরটাও এতদিনে বলতে পারিনি।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।মিনতি করছি তোমার কাছে।আমি গর্ভের সন্তানকে নিয়ে তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।’কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল আয়শা।
আয়শার এই মহানুভবতা দেখে আর ওর গর্ভে আমার সন্তান এটা শুনে আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না।নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।আমি যে আয়শার প্রতি,আসন্ন নতুন অতিথির প্রতি চরম অন্যায় করেছি এতদিন তা বুঝতে পেরেছি।আমার ঘোর কাটতে শুরু করেছে।নিজের এই কুকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আমি।কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল!মনিকার সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।তবুও আমাকে পারতে হবে।জিততে হবে জীবনের এই খেলায়।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কালই মনিকার সাথে সবকিছু শেষ করব।তাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিব দুরে।কিন্তু বারবার নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো।এই অপরাধের ক্ষমা কি পাব!আয়শা কি আমাকে ক্ষমা করবে?সে কি আমাকে আবার আগের মত আপন করে নিবে?তার প্রতি যে অবিচার করেছি তা কি বিধাতা সহ্য করবে?দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে ধরলো।
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ,আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।আমাকে শাস্তি দাও…শাস্তি দাও!’আমার লজ্জিত দু’চোখ বেড়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।দু’হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি আয়শার কাছে।আমার হাত দু’টো নিয়ে আলতো করে চুমু খেল আয়শা।বলল,’তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই তোমার ক্ষমা।’ আমি আয়শাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলাম সারা মুখ ভরিয়ে দিলাম চুমুতে। তখন মধ্যরাত।রুপোর থালার মত চাঁদ পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে রেখেছে।বাইরে শাঁ শাঁ আওয়াজ করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে।অপার্থিব বন্ধনে আমি আর আয়শা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হারিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।
পরেরদিন।খুব সকালে উঠে গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরেছে আয়শা।আমিও পাঞ্জাবি পরেছি।দুজনে ডাক্তারের কাছে যাব।আয়শাকে আজ বড্ড মায়াবী লাগছে।সেই প্রথম দিনের মত ভীষণ সুন্দরী।লাল পাড়ের নীল শাড়িটা তাকে গিফট করেছিলাম আমাদের প্রথম এনিভার্সারিতে।এত বছর পর আজ আবার পরেছে শাড়িটা। ডাক্তারের কাছে সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল আয়শার গর্ভে একটা মেয়ে ভ্রুণ।দিন,সপ্তাহ,মাস ধরে মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠছে সে।আসন্ন নতুন অতিথিকে নিয়ে আমাদের খুশির সীমা রইল না।তাকে ঘিরে কত পরিকল্পনা করছি আমি আর আয়শা রিক্সাতে বসে।খোলা আকাশের নীচে হিমেল বাতাসে হাতে হাত রেখে দুজন আপন নীড়ে ফিরছি আর গর্ভের সন্তানকে ঘিরে শত স্বপ্ন দেখছি।আমি এক হাত দিয়ে আয়শাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি।
লজ্জাবতীর কপালে চুমু খাওয়ার জন্য যেই মুখ বাড়িয়েছি অমনি সবকিছু শেষ হয়ে গেল।পেছন থেকে ভারী কোন যান সজোরে ধাক্কা দিল।আমি আয়শা দুজনে দুদিকে ছিটকে পড়লাম।ক্ষণিক পরে ব্যাথাতুর মাথা তুলে দেখি আমার থেকে আট-দশ হাত দুরে নিথর হয়ে পড়ে আছে আয়শার রক্তাক্ত দেহ।সমস্ত শক্তি এক করে দৌড়ে গেলাম আয়শার কাছে।তখনও শ্বাস চলছে ধিক ধিক করে।মাথাটা থেতলে গেছে বিশ্রীভাবে।ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।গায়ের পাঞ্জাবি খুলে পেচিয়ে দিলাম ওর রক্তাক্ত মাথায়।হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করতে লাগলাম। থমথমে প্রকৃতি সার্থপরের মত উঁকি দিচ্ছে পড়ে থাকা আয়শার নিথরে দেহে,উপহাস করছে আমাদের।মাথার উপরে সূর্যটা স্বীয় তাপ দিয়ে জানান দিচ্ছে আয়শা আর নেই।আমার চোখ থেকে নির্গত পানি গড়িয়ে পড়ল আয়শার গালে।জমাট বাঁধা রক্তে চোখের পানি কেমন চিকচিক করতে লাগল।