বড় রাস্তা থেকে একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। সাথে ছোট একটি ছেলে। হয়তো তার ছোট ভাই হতে পারে। দুই তিনবার ডাকার পরেও আমি যাচ্ছিনা দেখে চলে যাচ্ছে। মেয়েটিকে আমি চিনি তবে নাম জানিনা। আমাকে ডেকেছিল নৌকা নিয়ে যাওয়ার জন্য। বড় লোকের মেয়ে, তাই হয়তো শখ জেগেছে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবার। আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে নাকি যে নৌকা দিয়ে আমি ঘুরাব, আর আমি মাঝি নাকি? ২০০৪ সাল, আমি নবম শ্রেনীতে পড়ি। তখন ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। আমার দেখা সবচেয়ে বড় বন্যা। বন্যায় পানিবন্দী মানুষ কতটা অসসহায় হতে পারে তা নিজে উপলব্ধি করেছি। যা জীবন থেকে কখনো মুছে যাবার মত নয়।
আমাদের নৌকা কেনার মতো সামর্থ্য ছিলনা। তাতে কী? আব্বু আর আমি মিলে কলা গাছ দিয়ে ভেলা তৈরী করেছি। শাকিলদের বাঁশ ঝাড় থেকে বারো টাকা দিয়ে একটি বাঁশ কিনে এনেছি সেই ভেলা বেয়ে চলার জন্য। তবে এখন যে নৌকায় বসে আছি, সে নৌকাটি সরকার বাড়ির। আশরাফউদ্দিন সরকারের পারিবারিক নৌকা। আমার নৌকা চালাতে অনেক ভালো লাগে। বন্যায় স্কুলও বন্ধ, তাই সারাদিনই নৌকা নিয়ে ছুটে চলি। হঠাৎ সরকার বাড়ির কেউ এলে পার করে দেই, নয়তো সারাদিনই নৌকা আমার দখলে। আমি মেয়েটির চলে যাওয়া দেখছি আর মুচকি মুচকি হাসছি। ছোট ছেলেটি মনে হয় যেতে চাচ্ছেনা, মেয়েটি জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
শাপলা তুলে নৌকায় রাখছি। নীল শাপলাকে আমরা মিনি শাপলা বলি। আঁকারে ছোট হয়তো তাই। এই শাপলাগুলো দেখতেও অনেক সুন্দর লাগে। বাচ্চারা শাপলা দিয়ে মালা গেঁথে গলায় দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি শাপলা তুলছি রান্না করে খাওয়ার জন্য। সকালে নৌকা দিয়েই কচুরিপানার ভিতরে বড়শি পেতে বসেছিলাম অনেকক্ষন, একটা মাছ ঠোকরও দেয়নি। দুপুরে খেয়েছি ঘরে অল্প চিনি ছিল, আর ভাতের মার দিয়ে। বাবা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক। ট্রেক্সটাইল মিলের ভিতরে কোমড় অবধি পানি। মিল বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন হল। মজার মজার খাবার বন্যা না গেলে যে আর জোটবেনা সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি। উপর থেকে এক লোক চেচাচ্ছে, এই ছেলে এই, এদিকে এসো। এই সেরেছে, মেয়েটি তার বাবাকে নিয়ে এসেছে। এখনতো আর না গিয়ে উপায় নেই। নৌকা নিয়ে বড় রাস্তার কাছে গেলাম।
— নাম কি তোমার? (লোকটি)
— জ্বি, শ্রাবণ
— আমার মেয়ে ঘুরতে চেয়েছিল নৌকা দিয়ে, তুমি আসোনি কেন?
— আসলে নৌকা তো সরকার বাড়ির আমি ঘুরাব কী করে?
— আশরাফকে আমি বুঝিয়ে বলব, বিকেলে আমার মেয়ে আর ছেলেটা আসলে ওদের একটু ঘুরাইবা। এই নাও এই টাকাটা রাখো।
— না, না টাকা লাগবেনা।
— ধরো বলছি, এই শাহিদা সৈকতকে নিয়ে নৌকায় ওঠ। সন্ধার আগে বাড়ি আসবি।
শাহিদা নামের মেয়েটি আর তার ছোট ভাই সৈকত নৌকায় বসা আর আমি বেয়ে যাচ্ছি। শাহিদার বাবা আমাকে দশ টাকার একটি নোট দিয়েছিল। মনে মনে ভাবছি কাল সকালে দশ টাকার বাজার করব। দেড় টাকা কেজি টমেটো, ৬টাকা কেজি আলু থেকে আধা কেজি নিলেই হবে। আর ঘরে মাছ আছে, রাতেরবেলা লাইট আর কুচ দিয়ে মাছ ধরেছিলাম। শাহিদা হঠাৎ বলে ওঠল, তুমি জোরে চালাতে পারোনা? কথাটি শুনে একটু জোরে চালাচ্ছি, তবে বেশি না। কারন সৈকত ভয় পেতে পারে। শাহিদার প্রশ্ন..
— তুমি কিসে পড়ো?.
— নাইনে, তুমি?
— আমিও নাইনে পড়ি।
—ও
আবার চুপ, নাইনর পড়ে। আমার সমবয়সী হবে তাহলে। আমি ভয়ে ভয়ে একটু পর পর তাকাইতাম শাহিদার দিকে, বড়লোকের মেয়ে কি যেন ভেবে বসে। সন্ধায় বাড়ি ফিরছি, শাহিদা আর সৈকতকে নামিয়ে দিয়ে আসলাম।
শাহিদা দেখতে কালো, এটাকে কালো বলে নাকি শ্যামবর্ণ বলে আমার ধারনা নেই। তবে ওর দিকে একটু পর পরই তাকিয়েছি আমি। কালো হলেও মেয়েটির মধ্যে একটি আকর্ষনীয় দিক ছিল তার চোখ। আমাদের এলাকায় কেউ বিলাই চোখ বা নারকেলি চোখ বলে। অসম্ভব সুন্দর লাগে এই চোখগুলো। সাধারন মানুষের সাধারন চোখগুলোর সাথে এই চোখগুলোর মিল নেই। এই চোখ আমি আর কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাঁ মনে পড়েছে, শুক্রবারে ছবি দিত টেলিভিশনে। ছবির ফাঁকে যখন বিজ্ঞাপন আসত তখন একটি বিজ্ঞাপনে প্রায়ই দেখি। রোমানা পেইন্ট, একটি রংয়ের বিজ্ঞাপনে রোমানা নামের মেয়েটির চোখগুলো হুবহু এমনই।
নৌকায় যতক্ষন ছিল, ততক্ষনই একটু পর পর চোখগুলোকে দেখেছি। যখন ওরা নেমে পড়ে তখন মনটা খারাপ হয়েছিল, পরক্ষনেই দশ টাকা পেয়েছি মনে পড়তেই আনন্দে বাড়ি ফিরছি। পরেরদিন বিকেলে চারটার দিকে শাহিদা ডাকছে, সৈকতও সাথে আছে। বড় রাস্তার কাছ থেকে দুজনকেই তুলে নিলাম নৌকায়। শাহিদা আমার দিকে একটি দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল,
— কিসের টাকা?
— বাবা বলছে তোমার নৌকায় ওঠলে দশ টাকা দিতে।
হাত বাড়িয়ে টাকা নেয়ার সময় চোখগুলোকে আবার দেখে নিলাম। বিধাতা কত নিপুণ করে কত সুন্দর করে চোখগুলো তৈরী করেছে । এবার আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিনা, তাকিয়ে আছি চোখের দিকে। ছল ছল চোখে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। শাহিদার তাকানো দেখে আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। হঠাৎ শাহিদা বলে ওঠল,
— শ্র্রাবণ, আমাকে শালুক তুলে দিবা?
— আচ্ছা, বসো আমি তুলে দিিচ্ছি।
স্কুল ড্রেসের নীল পেন্ট পড়নে নেমে পড়লাম পানিতে। গলা সমান পানি, তাই শালুকের জন্য ডুব দিতে হল।
অনেকগুলো শালুক তুলে দিয়েছি তাদের। প্রচন্ড জ্বর এসেছে আমার। গতকালকে রাত থেকেই জ্বর। সম্ভবত অবেলা ডুবিয়ে শালুক তোলার কারনেই জ্বর এসেছে। শুয়ে আছি চৌকিতে। ঘরে হাটু পরিমান পানি থেকে চৌকি বাঁচাতে চৌকির চার কোণার খুটির নীচে ইট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। আম্মু একটু পর পর মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কমানোর চেষ্টা করছে। জ্বরের সময় সব খাবার কেমন যেন পাংসে আর তিতা মনে হয়। একদম খাওয়া যায়না।
দুদিন পর আবার নৌকা নিয়ে বের হয়েই দেখি শাহিদা একা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কত দুঃখে না জানি আছে এমন একটা ভাব। দূর থেকে আমাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমারও ভাল লাগছে, দুইদিন পর আবার সুন্দর চোখগুলো দেখব। তবে আজ সৈকত নেই কেন বুঝতে পারলামনা।
— তুমি এই দুদিন আসোনি কেন?
— আমার জ্বর ছিল
— ও, ঐদিন পানিতে নামার জন্যই মনে হয় হইছে।
— না, এমনি আসছে।
— এই নাও তোমার টাকা
— এত টাকা কেন?
— তিনদিনে ত্রিশ টাকা
— আমিতো দুদিন আসিনি।
— আমিতো আসছি, আর আসার সময় বাড়ি থেকে টাকাও নিয়ে আসছি।
আর কথা বাড়ালামনা। আজকে একটু সাহস পেলাম, তাই ইচ্ছে করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। শাহিদা তাকালেই চোখ ফিরিয়ে নিতাম। প্রায় বিশ দিন পর, রাতে কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বারবার শুধু শাহিদাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি জানি এই দেখতে চাওয়াটা অন্যায়, শাহিদাকে ভালোবাসা অন্যায়। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো কথা। তবুও একটি বাউল গানে শুনেছিলাম, গায়ের জোরে প্রেম চলেনা, প্রেম করতে হয় মন দিয়া, হাত বান্দিবি, পা বান্দিবি মন বাঁধবি কি দিয়া?
এই মনটাকে তো আর বুঝাতে পারিনা যে এই ভালোবাসা অন্যায়। মন তো ঠিক শাহিদাকে ভালোবেসে ফেলেছে। জানি, কখনো এই কথাটি কেউ জানবেনা যে আমি শাহিদাকে ভালোবাসতাম। জুতো ছিড়ে গেলে তারকাটা দিয়ে লাগিয়ে নেই, শার্ট ছিড়ে গেলে সুই সুতা দিয়ে সেলাই করে পরি। সেই আমি কী করে বলব যে শাহিদাকে আমি ভালোবাসি? ২০০৪ সাল, দশ টাকার বাজারে আমাদের একদিন চলে যেত। ভাবতেই মনের অজান্তেই বলে ওঠলাম, না, না আমি শাহিদাকে ভালোবাসিনা। এটা আমার কিশোর মনের ভালোলাগা। শাহিদাকে ভালোবাসা আমার অপরাধ।
বন্যা শেষ হয়ে গেছে, তবুও হাটু পানিতেই নৌকা করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য শাহিদা আমার কাছ থেকে প্রতি বিকেলে দশ টাকার টিকেট কিনত। কোনো টিকিট দিতামনা, শুধু নৌকা বেয়ে চালাতাম আর সেই মন ভোলানো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
তবে কখনো কোনোদিন তাকে ভালোবাসার কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভবনা। আস্তে আস্তে লোকচক্ষুর কাছে ধরা পড়া শুরু হয়ে গেল, তাই আমি আর নৌকা নিয়ে যাইনা। শুকনো রাস্তা ধরে বিকেলে হয়তো বড় রাস্তায় ওঠতাম, তবে নৌকায় ওঠতামনা। একদিন রাস্তায় দাড় করিয়ে শাহিদা প্রশ্ন করেছিল,কি ব্যাপার তুমি আসোনা কেন? আমি বলেছিলাম, সামনে এস এস সি পরীক্ষা, পড়ার চাপ বেশি, তাই আসিনা। আর সেদিন বুঝেছিলাম হয়তো শাহিদাও আমাকে পছন্দ করত। সে নাকি এতদিন বিকেলে প্রতিদিনই এসে বসে থাকত নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কিজানি, হয়তো আমার ধারনা ভুলও হতে পারে।
সৈকত এসে আমাকে খুঁজে বের করল। আমার হাতে একটি চিঠি দিয়ে চলে গেল, আমার বুঝতে বাকি নেই যে এটা শাহিদার চিঠি। কারন গত পরশুদিন শুনেছি শাহিদা ঢাকায় চলে যাচ্ছে, ওর খালার বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে। দুদিন আমার সাথে দেখা করার চেষ্টাও করেছে, আমি সুযোগ দেইনি। তাই শেষ চিঠি যে দিবে সেটা ভাবছিলাম।
চিঠি খুলে পড়তে যাব, অমনি দেখি চিঠির ভাজে একটি দশ টাকার নোট। টাকার মধ্যে একটা লাভ আঁকা।
এর ভিতরে লিখা (শ্রাবণ+শাহিদা) বুকের ভিতরে একটা মোচড় দিয়ে ওঠল। চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম.. শ্রাবন,, আমি চলে যাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে। আর হয়তো কখনো তোমার জন্য বড় রাস্তায় পথ চেয়ে বসে থাকবনা। কখনো আর বায়না ধরবনা নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবার। শালুক তুলে দেয়ার কথাও বলবনা। তবে খুব বেশী ইচ্ছে ছিল তোমাকে যাওয়ার আগে একটিবার দেখব, দেখতে পারিনি। আমি জানি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তুমি চাওনি আমি আর দেখা করি তোমার সাথে। আর কোনদিন দেখা হবে কিনা তাও জানিনা। যদি কখনো পড়ার ফাঁকে বাড়িতে আসি, আমি বড় রাস্তার সেই নৌকার কাছে অপেক্ষা করব। যদি আসো আবার হবে দেখা।
আরেকটি কথা, তুমি যে নৌকায় বসে অনবরত তাকিয়ে থাকতে, সে তাকানোর ভাষা আমি ভুল বুঝেছিলাম। তাই মনের ভিতর হঠাৎ গজিয়ে উঠা সুপ্ত ভালোলাগার ছোঁয়াটুকু বালিচাপা দিয়েছি, তবুও কেন যেন সেই বালি ছেদ করে কিছু একটা প্রাণরস খুজে পেয়ে গজাতে চায়। যদি এটা ভালোবাসার কোন অধ্যায়ে পড়ে তাহলে ধরে নিও হয়তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। না বলা কথাটুকু খুব যন্ত্রনা দিচ্ছিল, তাই আজ প্রকাশ করে দিলাম। ভালো থেকো তুমি অনেক বেশী ভালো থেকো।
এখন ২০১৯ সাল। সৈকত অনেক আগে থেকেই আমার ফেইসবুকেরর লিস্টে ছিল। সৈকতের সূত্র ধরেই আজ এত বছর পরে শাহিদাকে দেখেছি। শাহিদার বাবাও বাড়িটা বিক্রি করে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। তাই শাহিদা আর কখনো এই অজো পাড়াগায়ে আসার সুযোগ পায়নি। আজ এত বছর পর মোবাইলের স্ক্রীনে দেখলাম শাহিদাকে। একটু মোটা হয়ে গেছে, তবে চোখদুটো একটুও বদলায়নি। তার এক মেয়ে এক ছেলে। ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়েই ফেইসবুকে ছবি দিয়েছে। আমি এখনো বিয়ে করিনি , গ্রামেরই প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছি।
চৈত্রমাসে খরাতাপে মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির। বিকেলে সেই বড় রাস্তায় হাটছি। একটি ভাঙ্গা নৌকা শুকনায় পড়ে আছে। পুরোনো কথাগুলো মনে পড়তেই ভাঙ্গা নৌকার কোণায় বসে ভাবছি, আমার মনকি কারো জন্য ভেঙ্গেছিল? এমন নৌকার মত করে। আমি যেন নৌকার ঐ মাথায় শাহিদাকে দেখছি, সেই অবাক করা চোখদুটো, সারাজীবন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মানিব্যাগ থেকে পুরোনো চিঠিটা বের করলাম। অনেক বছর আগের চিঠি। হাত বুলিয়ে দেখে দেখে এখনো পড়ি মাঝে মাঝে। চিঠির ভাঁজে সেই দশ টাকার নোটটি। যে নোটে লাভের ভিতর লেখা ছিল…শ্রাবন+শাহিদা…