দূরত্ব

দূরত্ব

ভোরের আলো ফুটেছে। খোলা জানালা দিয়ে চোখে মুখে সূর্যের রশ্মি পড়ছে। ঘুম জড়ানো চোখে নতুন ভোরকে দেখছে। মুচকি হাসছে। পাশের রুম থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে।

– ‘নবাব জাদার কী ঘুম ভাংছে?’ সাথে সাথে মুচকি হাসিটা মলিন হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
– ‘যদি ঘুম ভেঙ্গে থাকে তাহলে খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন। আমার অনেক কাজ পরে আছে।’ তার বোনের কন্ঠ শুনতে পায়। তার বোন বলছে
– ‘তোমার ছেলেকে বইলো খাওয়ার পর খাতা কিনে নিয়ে আসতে।’ আবার তার বাবার কন্ঠ শুনে
– ‘তোমার নবাব জাদারে বইলো খাতা কিনে আসার সময় আইরনের দোকান থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আসতে। আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি বাথরুমে ঢুকলাম।’ তাওহীদ চুপ করে জানালার পাশে দাঁড়ায়। এই পৃথিবীর মায়া ভালোবাসা আজও বুঝলো না। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। এখন আর কষ্ট হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। রুমে ঢুকতেই বাবার কন্ঠ ভেসে আসে আসে।

– ‘এতোক্ষণ লাগে দোকান থেকে আসতে? আমি কি অফিসে রাতে যাবো?’
– ‘আব্বা আমি কোথাও দাঁড়ায়নি। আমি যাওয়ার পর আপনার কাপড় আইরন করেছে।’
– ‘কতদিন বলেছি মুখে মুখে কথা বলবি না।’
– ‘আব্বা আমি—-‘
– ‘চুপ একদম চুপ। আর কোন বানানো কথা শুনতে চাই না।’

মলিন মুখে একবার বাবার দিকে তাকায়। তার কথাটা শেষ করতেই দিলো না। কাপড়গুলো রেখে মাথা নিচু করে চলে আসে। তাওহীদের মা একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু উনার সমস্যা একটা। উনি একবার যা বোঝেন সেটাই ঠিক। যদি সেটা ভুলও হয়। কারো সাধ্য নেই সঠিকটা বোঝানোর। তাওহীদের বাবা রগচটা মানুষ। তিনি সব সময় সময় মেনে চলেন। সময়ের একটু এদিক সেদিক হলেই তুলকালাম লাগিয়ে দেন। তাওহীদের বোন সে শুধু সব সময় নিজেরটা বুঝে। মুখে যা আসবে তাই বলবে। যা মন চাইবে তাই করবে। তার ব্যবহার অন্যজন কিভাবে নিচ্ছে সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। তাওহীদ খুব শান্ত, রাগী ও অভিমানী ছেলে। সহজে কিছু বলেও না করেও না। যখন রেগে যাবে তখন তাকে থামানো যায় না।

আকাশে মেঘ জমেছে। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘের ভেলা। তাওহীদ এক মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছা করছে। মেঘেদের সাথে মুক্ত আকাশে হারিয়ে যেতে। হঠাৎ মনটা হাহাকার করে ওঠে। মনে প্রশ্ন জাগে। পরিবারের প্রত্যেকে কেন তার সাথে অন্য রকম আচরণ করে? তাওহীদ উত্তর পায় না। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে মেঘলা আকাশে তাকিয়ে থাকে। অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির প্রতিটা ফুটায় ফুটায় নিজের সত্তাকে ভিজিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। হঠাৎ ম্যাসেঞ্জারের শব্দে বাস্তবে আসে। ‘আসসালামু আলাইকুম। কোন ভাব ভনিতা না করে বলছি- আমি শুধু আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড হতে চাই না। আপনার বাস্তব জীবনের ফ্রেন্ড হতে চাই। প্রশ্ন করতে পারেন। আপনাকে কোথায় পেয়েছি? উত্তর হলো: আপনাকে বিভিন্ন গ্রুপে পেয়েছি। আমি কি হতে পারবো আপনার ফ্রেন্ড? উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।’ তাওহীদ অনেক ভেবেও উত্তর খুঁজে পেল না। ম্যাসেজ সীন করেই রেখে দেয়।

– ‘কুত্তার বাচ্চা। কোথায় গেল কুত্তার বাচ্চা? গতকাল বার বার বললাম। বাজারগুলো নিয়ে আসতে। কিন্তু নিয়ে আসলো না । তা কি এমন মহাকাজ ছিল উনার? উনি নিয়ে আসবেন কেন? উনার বাপ আছে না।’ মুহূর্তের মাঝে পরিবেশটা অন্যদিকে মুর নেয়। তাওহীদ বার বার তার বাবাকে বলেছে মুখের ভাষাটা যেন উনি ঠিক রাখেন। কিন্তু উনি বার বার নিজের মত করেই বলেন।

– ‘বয়স তো অনেক হয়েছে। আর কত বয়স হলে নিজের ভাষা ঠিক করবেন?’
– ‘কি বললি? তুই আমারে কি বললি? তোর কাছ থেকে আমার ব্যবহার শিখতে হবে?’
– ‘আমি বলছি না আমার কাছ থেকে শিখতেন।’
– ‘মুখে মুখে কথা বলছিস। চিৎকার করেও কথা বলছিস। অনেক বড় হয়ে গেছিস?
– ‘হ্যাঁ বড়ই হয়েছি।’
– ‘তাওহীদ চুপ কর।’
(মা এসে বলেন)

– ‘কি চুপ করবো? উনাকে এই কথাটা কতবার বলা হয়েছে আপনিই বলেন? আর ভালো লাগে না। এমন বাপ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।’
– ‘তাওহীদ।'(ঠাসসসস) তাওহীদ একবার বাবা মার দিকে তাকিয়ে রুমে চলে আসে।
– ‘দেখলে তোমার ছেলে কত বড় হয়েছে। এখন মুখে কথাও ফুটেছে।’
– ‘ভুল তো কিছু বলেনি। আপনাকে কতবার নিষেধ করেছে গালিগালাজ না করতে। তার কথা কখনও শুনেছেন?’
তাওহীদের বাবা চুপ হয়ে যায়।
– ‘জীবনে ছেলেটাকে একবার ভালো করে ডাক দিয়ে দেখেছেন? একটু ভুল করলেই তো শুধু বকে এসেছেন। কখনও ভালো সুরে ডেকে কাছে নিয়েছেন? যদি নিতেন তাহলে আজ গল্পটা অন্যরকম হত। উনি চোখে জল নিয়ে রুমে চলে যান। তাওহীদের বাবা নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। স্মৃতির পাতায় বউ এর প্রশ্ন গুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে বেরাচ্ছেন।

তাওহীদের চোখে পানি। অন্তরটা কষ্টে পুড়ছে। ছোট বলা থেকেই বাবার সাথে তার বনে না। ছোট থেকেই তার সাথে এমন আচরন করে আসছে। কিন্তু কেন এমন আচরন করে উত্তর জানে না। এক মনে রাতের শহরে তাকিয়ে আছে।
ফজরের আজানে তাওহীদের ঘুম ভাংগে। পাখিদের কিচিরমিচির কানে আসে। আধো আলো আধো অন্ধকার ঢাকা আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। তাওহীদ পৃথিবীর সকল সুখ চায় না। সে প্রিয় জনদের কাছ থেকে, একটু ভালো ব্যবহার, একটু মুখের হাসি, একটু ভালোবাসা চায়। পৃথিবীর সকল ব্যথা সহ্য করা যায়। কিন্তু প্রিয় জনদের কাছ থেকে পাওয়া ব্যথা সহ্য করা যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

– ‘ম্যাসেজ সীন করলেন। কিন্তু উত্তর দিলেন না যে?’
– ‘উত্তর কী দিব জানা নেই। আর যদি বলেন বন্ধু হতে? আমি সেটা পারবো না।’
– ‘ঠিক আছে। নামাজ পড়েছেন?’
– ‘জ্বী। আপনি যদি আর কখনও আমাকে ম্যাসেজ না দেন তাহলে আমি খুশি হবো।’
– ‘তাই? কিন্তু আমি ম্যাসেজ দিলে আপনি কি করবেন?’
– ‘ছিহ!, আপনার লজ্জা বলতে কিছু নেই? মাত্রই বললাম ম্যাসেজ না দিতে আপনি আবার ম্যাসেজ দিলেন?’
– ‘হাহাহাহা।

তাওহীদ সাহেব একটি কথা শুনে রাখুন। আপনি উত্তর দিলেও বা না দিলেও আমি ম্যাসেজ দিবো। আপনি হাজার বার না বা ইগনোর করলেও ম্যাসেজ পাঠাবো।’ তাওহীদ বলার মতো খুঁজে কিছু পেল না। নতুন ভোরের অপেক্ষায় আছে। ‘ভাইয়া ভাইয়া ভাইয়া— দেখে যাও। তাড়াতাড়ি দেখে যাও।’ যখন বোন তাকে ভাইয়া বলে ডাক দিবে। তখন তাওহীদের আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। তার যে কত ভালো লাগে বলে বোঝাতে পারবে না।

– ‘কি হয়েছে?’
– ‘এই যে দেখো মরা ইঁদুর।’
– হাহাহাহা
– তুমি হাসছো।
– তোর সকালের নাস্তাটা ভালোই হবে।
– ওয়াক ওয়াক ছিঃ ছিঃ—-
– হাহাহাহাহা বোন যতো রাখতে থাকে। ভাই ততো হাসতে থাকে।
– ‘আম্মা আমাকে পাঁচশো টাকা দেন।’
– ‘এতো বড় ছেলে হয়েছিস! মায়ের কাছ থেকে পকেট খরচ নিতে লজ্জা করে না?’ তাওহীদ রেগে যায়। রাগের সুরে বলে

– ‘না করে না।’
– ‘কতবার বললাম অন্তত একটা প্রাইভেট পড়া। তাহলে নিজের পকেট খরচটা তো নিজের টাকা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু কথা কে শুনে!’
– ‘আমি কতবার বলবো! এসব আমার ভালো লাগে না।’
– ভালো লাগবে কেন? বাবার টাকা আছে না? আমি টাকা দিতে পারবো না। যা বাবার কাছ থেকে চেয়ে নে।’
– ‘আমি পারবো না। তুমি টাকা দিবে কিনা বলো?’
– ‘না।’ সামনে একটা কাঁচের জগ পায়। ঐটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে
– ‘আমাকে আর কারো টাকা দিতে হবে না।’

তারপর বাসা বের হয়ে চলে আসে। তার মা নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে। দিন দিন ছেলেটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? কিন্তু উত্তর পাচ্ছেন না। তাওহীদ মাথা নিচু করে রাস্তায় হাঁটছে। পরিবারের মায়াজাল তার আর ভালো লাগে না। সে মুক্তি চায় মুক্তি! একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। এই পৃথিবীর মায়া কাটাতে চায়। সকল বন্ধন ছিন্ন করতে চায়। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে পড়ে।

– ‘একি করছিলেন আপনি? এই মাত্র তো মরতে বসেছিলেন। কখন থেকে ডাকছি আপনি শুনছেনেই না। কোন জগতে ছিলেন?’ তাওহীদ এক নজরে মেয়েটাকে দেখছে।
– ‘আমি দুঃখিত আপনাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য; এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। এই যে উঠুন।’
– ‘আপনি আমার হাত ধরলেন কেন? আমি আপনাকে বলছি আমার হাত ধরতে?’ ফারাহর হাসিখুশি মুখটা মলিন হয়ে যায়।
– ‘আমি—-‘  ফারাহ বাক্যটা সম্পন্ন করতে পারলো না।

– ‘আমি কি? আপনাকে কে বলছিল আমাকে বাঁচাতে? রাস্তায় তো অনেক মানুষ ছিল। কোথায় তারা তো আসলো না। তাহলে আপনি আসলেন কেন?’ ফারাহর জীবনে ফারাহকে কেউ কখনও এভাবে অপমান করেনি। ফারাহর চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে।

– ‘আমার ভুল হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।’

তাওহীদ চুপ থাকলো কিছু বললো না। তাওহীদ সামনের পার্কটিতে গিয়ে বসে। তার চোখে রাগে আগুন ঝরছে।
বাসা থেকে রাগ করে বের হয়েছে। সেটা ভালো কথা, কিন্তু মেয়েটা কী দোষ করেছিল? কেন তাকে শুধু শুধু রাগ দেখালো? কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তার রাগ হচ্ছে। তাওহীদ তাকিয়ে দেখে মেয়েটা এখনও আছে। সে দূর অজানায় তাকিয়ে রয়েছে। নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। এখন কোন মুখে ক্ষমা চায়বে?

– ‘আমি দুঃখিত। মেজাজটা ঠিক ছিল না। তাই ঐ রকম ব্যবহার করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দেন।’
ফারাহ ফিরে তাকায়। ফারাহর চোখে পানি। তাওহীদ অস্বস্তিতে পরে যায়।

– ‘ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করেনি।’
– ‘আপনি কাঁদছেন? আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না?’
– ‘না না।’
– ‘একটা কথা বলবো!’
– ‘হ্যাঁ বলেন।’
– ‘আমরা বন্ধু হতে পারি?’

তাওহীদ জিহ্বায় কামুড় মারে। কি বলতে চেয়েছিল আর কি বলে ফেললো!’ ফারাহ এক নজর। ভেজা চোখে মুচকি হেসে বলে

– ‘হ্যাঁ। এমন একটা একরোখা রাগী বন্ধু হলে মন্দ হয় না।’
– ‘আপনি কিন্তু এখন আমাকে অপমান করছেন।’ ফারাহ শব্দ করে হাসছে। তাওহীদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।
– ‘নবাব জাদার বাড়ি ফিরার সময় হয়েছে? সারাদিন কোথায় ছিলেন? কোন কুটুম রাতে রাখলো না?’
তাওহীদ কিছু না বলে রুমে চলে যায়।
– ‘বাবার সম্পদ নষ্ট করতে অনেক মজা তাই না? যেদিন বাবা থাকবে না। সেদিন কিভাবে চলবেন? একবার চিন্তা  করেছেন?’
– ‘কি এমন খরচ করে ফেলেন শুনি? আমার পিছনে আর খরচ করতে হবে না। এখন দয়া করে চুপ থাকেন।’
– ‘কথা গায়ে লাগে?’
– ‘চুপ করেন না হলে বের হয়ে যাবো।’
– ‘যা না বের হয়ে দেখি কোন কুটুম তোকে পালে।’
– ‘হ্যাঁ বের হয়ে যাচ্ছি। আর ফিরবো না। যদি ফিরে আমার লাশ ফিরবে লাশ।’
– ‘ভাইয়া ভাইয়া এই ভাইয়া রাগ করে চলে যাইস না।’ কিন্তু তাওহীদ ফিরেনি।
– ‘ভাইয়াকে এই কথাগুলো না বললে হতো না? এখন যদি রাগের মাথায় কিছু করে বসে? তখন কি করবে?’
– ‘চুপ কর। আমাকে জ্ঞান দিয়ে আসবি না।’

মাওয়া অসহায় ভাবে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে রুমে চলে যায়। ছেলে যেদিকে চলে যায় ঐ দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটাকে একদম বুঝতে পারেন না। একটু কিছু হলেই রাগ করে বসে। মা হয়ে তিনি কি এইটুকু কথা বলতে পারবেন না? শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ গুজে কাঁদছেন। রাতের শহর।নীড় হারা মানুষগুলো দূরন্ত গতীতে নীড়ে ফিরার চেষ্টা। কত তাড়া তাদের! কিন্তু তার? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

– ‘সারাদিন কোথায় ছিলেন? আপনাকে কতবার ম্যাসেজ দিয়েছি একবার দেখেছেন?’ মন ভালো নেই। মেজাজ ঠিক নেই। আবার নতুন প্যারার উৎপত্তি?
– ‘আপনার সমস্যা কি? আপনাকে না বললাম ম্যাসেজ না দিতে। ব্লক খেতে ইচ্ছা করছে?
– ‘এই না না ব্লক দিবেন না।’

ছায়া বুঝতে পারে না। তাওহীদকে একদম বুঝতে পারে না। ছায়া ভাবছে কেন তার সাথে এরকম ব্যবহার করে। ফারাহ বেলকনিতে বসে আছে। বার বার সকলের ঘটনাটা মনে পড়ছে। ফারাহর জীবনে এমন একটা ছেলে জীবনে দেখেনি। তার হাতে হাত ধরতেই এতো রাগ? অন্য আট- দশটা ছেলের মত তার আচার ব্যবহারের কোন মিল নেই। কিছু ভাবার আগেই বন্ধু হয়ে পরলো। সারাদিন ঘুরলো, শেষে নাম্বারটাও নিলো। কিন্তু নাম বললো না। অদ্ভুদ সব ঘটনা ঘটালো এবং ব্যবহারও করলো। তার নামটা জানার সুযোগও হলো না। মনে মনে বলে একবার ফোন দিয়ে দেখি উনি কি করেন।

– ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওলাইকুম আসসালাম। কোথায় আছেন? ফারাহর সুরে একটু অভিমান ভাব। অভিমানটা তাওহীদ ধরতে পারে।
– ‘রাস্তায় হাঁটছি।’
– ‘কেন?’
– ‘ভালো ছেলে যে তাই। জানেন না ভালো ছেলেরা বাসায় থাকতে জানে না।’
– ‘আপনার কথাটা বুঝলাম না।’
– ‘মায়ের সাথে ঝগড়া করেছি। এখন ঘর ছেড়ে রাস্তায় পরবাসী হচ্ছি।’ ফারাহ কি বলবে কথা পাচ্ছে না।
– ‘আপনি এতো রাগ করেন কেন?’
– ‘জানি না।’
– ‘সারাদিন ঘুরলাম এখন পর্যন্ত নামটা জানতে পারলাম না।’
– ‘হাহাহাহাহা। তাওহীদ।’

ফারাহ নামটা শুনে একটা ধাক্কা খেল। নামটা পরিচিত। বলার ভঙ্গিটাও পরিচিত। কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না।

– ‘আমি ফারাহ।’একটু চুপ থেকে ফারাহ বলে
– ‘আজ রাতে বাসায় ফিরবেন না, তাই তো?’
– ‘কিভাবে বুঝলেন?’
– ‘একটু সময় আপনার সাথে থেকে যা চিনলাম। ঐ ধারণা থেকে বললাম।’

তাওহীদ কিছু বলছে না চুপ হয়ে আছে। ফারাহ কিছু বলছে না। কিছু অনুভব করছে। অল্প অল্প করে সময় চলে যায়। হঠাৎ দুজনের কথার গতি বেড়ে যায়।

দু’চোখে ঘুম নেই। ঘুরন্ত ফেনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাওহীদ স্বাধীনতা চায়, একটু স্বাধীনতা। নিজের স্বপ্নগুলো বাস্তব করতে চায়। নিজের মতো করে জীবন সাজাতে চায়। কিন্তু পারছে না। ইদানিং তার কেন যেন মনে হয় সে বেশিদিন আর বাঁচবে না। এরকম অনুভূতি কেন হয় সে নিজেও জানে না। যদি আমি মরে যাই! আমার জন্য কি বাবা মা বোন কষ্ট পাবে? আমার জন্য চোখের জল জড়াবে?

ছেলে বাড়ি ফিরেনি। দুঃখিনী মা কেঁদে যাচ্ছেন। তাওহীদের বাবা বাড়ি ফিরলে সব ঘটনা খুলে বলেন। উনি শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছেন ছেলের সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। স্ত্রীর চোখ মুছে একটা বাক্যই বলেন, ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু তিনি জানেন না, এই দূরত্ব কমবে না বরং বাড়বে।

আজ তিন দিন হলো তাওহীদ বাসায় ফিরছে না। বন্ধুর সাথেই থাকছে। এখনও তার রাগের বাটা পরেনি। তাই বন্ধুও কিছু বলছে না। কারণ তাওহীদকে সে ভালো করেই চিনে। তার বাবা মা বোন অনেক বার ফোন করেছে। কিন্তু সে ফোন ধরেনি। শেষে শুধু একটা কথা বলেছিল। ‘আর একবার ফোন করলে আমার লাশ পাবেন।’ এরপর থেকে তারা ওর বন্ধুর কাছ খবর নিচ্ছেন।

এই তিন দিনে বাসার পরিবেশটা পাল্টে যায়। সবার মাঝেই একটা শূন্যতা বাসা বেঁধেছে। বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যে মা ছেলেকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না। সেজন্য তিনি কখনও ছেলেকে দূরে কোথাও পাঠান না। আজ সেই মা? যে বাবা ছেলেকে সব সময় গালাগালি দিয়ে আসছেন। আজ সেই বাবাও অন্তরে অন্তরে কষ্টে পুড়ছেন। বোনটাও মনমরা হয়ে গেছে। সারাদিন যতই রাগ অভিমান গালাগালি করুন। ভাইকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না। তাই তার এই ভালোবাসা ভাই ও বোঝে না। কিন্তু কেন বোঝাতে পারে না, সে জানে না। ভেজা চোখে ভায়ের রুমে তাকিয়ে থাকে। গোধূলী লগ্ন। দুই বন্ধু উদাস মনে হাঁটছে আর জীবনটাকে নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ ছায়ার ম্যাসেজ গুলো তার মাথায় চড়ে বসে। তাকে নীল বলে ডাকে। তার বাবা মাকে, বাবা মা বলে ডাকে। বোনকে ছোটকি বলে ডাকে। তার এভাবে ডাকার মানে কি? সে তাকে কি বোঝাতে চায়? তাকে কি বলতে চায়?

– ‘কিরে বন্ধু কোন জীবনে হারালি?’ তাওহীদ মুচকি হাসে। যার কথা ভাবছিল তার ম্যাসেজ চলে আসে।
– ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওলাইকুম আসসালাম।
– ‘কি করছেন?’
– ‘তেমন কিছু না।
– ‘একটা ঘটনা বলবো দয়া করে শুনবেন?’
– ‘বলেন।’

ঐ দিনের ঘটনাটা তাওহীদকে ম্যাসেজ করে পাঠায়। তাওহীদ লেখাটা পড়ে পাথরে পরিণত হয়। ছায়ায় ফারাহ! কিন্তু কিভাবে সম্ভব?

– ‘এই যে কোথায় হারালেন?’
– ‘জ্বী বলেন।’
– ‘উফফ! আপনাকে কি বলবো। ছেলেটার চোখ দুটোয় কি যে মায়া। আর তার রাগটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এমন ছেলেই তো জীবনে চাই। জানেন যারা রাগী থাকে তাদের ভালোবাসাও বেশি থাকে।’

– ‘ভালোই তো এক ছেলের গুন আর এক ছেলের কাছে শুনাচ্ছেন। আমাকে আর কখনও নক দিবেন না।ফারাহ বলেই যাচ্ছে।
– ‘ইশশশ আপনি যদি ঐ ছেলেটা হতেন তাহলে কত ভালো হতো!’

তাওহীদ আর উত্তর দেয়নি। ছায়া বিষন্ন মনে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাওহীদ তার অনুভূতি গুলো কেন বুঝতে চায় না? ফারাহ উত্তর জানে না।

– ‘বন্ধু কেরে ঐ ম্যাসেজ ওয়ালী?’
– ‘হুম।’

দুই বন্ধু হাঁটছে অনির্দিষ্ট পথে। দুই বন্ধু আপন মনে সিগারেট টানছে। সিগারেটের ধোঁয়া রাতের আকাশে উড়ছে। তাওহীদ সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে নিজের কষ্টগুলো উড়িয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। ফারাহর ফোন আসে।

– ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওলাইকুম আসসালাম।’
– ‘কাল একবার দেখা করতে পারবেন?’ একটু ভেবে তাওহীদ বলে
– ‘ঠিক আছে।’

রাতের আকাশ। দমকা হাওয়া বইছে। যেকোন সময় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। তাওহীদ চুপ করে শেষ বারের মত শহরটাকে দেখছে। এই শহরের মায়ায় নিজেকে আর জড়াবে না। সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে পাড়ি দিবে অন্য কোন শহরে। পড়ন্ত বিকেল। দুজন চুপচাপ বসে আছে। নীড় হারা পাখির দল। দলে দলে নীড়ে ফিরছে। তাওহীদ বার বার আড় চোখে ফারাহকে দেখছে। ফারাহর এক অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। যে অনুভূতিটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না।

– ‘এই যে আড় চোখে বার বার তাকালে নজর লাগবে।’ তাওহীদ মুচকি হাসে।
– ‘আমাকে কেন ডাকলেন?’
– ‘যদি বলি আপনাকে দেখতে?’ তাওহীদ কি বলবে বুঝতে পারে না। একদম চুপ হয়ে যায়।
– ‘কি হল চুপ কেন?’
– ‘জানি না।’

ফারাহ রাগ দেখায়। তাওহীদ হাসে। ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়। এটা সেটা নিয়ে অনেক কথা হয়। ফিরার সময় তাওহীদ বলে।

– ‘ভালো থাকবেন। যদি কোন ভুল করে থাকি ক্ষমা করে দিবেন। আজ আসি।’

তাওহীদ চলে আসছে। ফারাহ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। থাকবো না কারো মায়াতে চলে যাবো অজানাতে। কি লাভ আলো আঁধারের মায়ার দুনিয়াতে? আপন মনে বিড় বিড় করে না না কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে পড়ে। তাকে বাঁচাতে লোক জন দৌড়ে আসছে। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। চোখ দুটো ভিজে আছে। গাড়ি করে তাওহীদকে নিয়ে ছুটছে। তার রক্তে রাস্তাটা রক্তবর্ণ হয়ে আছে।

“আমি তোমার কে তুমি জানো না। আমি তোমার সে। যে তোমার ঠিকানা। আমি তোমার তাওহীদ আমিই তোমার নীল। আমি তোমার স্বপ্নে আসা স্বপ্ননীল। তোমার আমার হবে না দেখা। ভালো থেকো সুখে থেকো নতুন করে জীবন সাজিয়ো। খোদা হাফেজ।”ম্যাসেজটা পড়ে ফারাহ বাকরুদ্ধ হয়ে পরে। সে এটা কি পড়ল? এই তার সেই নীল! ফারাহ আর ভাবতে পারছে না। দুচোখ পানিতে ভিজে যায়। ম্যাসেজ পাঠায়। উত্তর আসে না। ফোন দেয় কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ পায়। কী করবে এখন? চুপ করে বসেই থাকে। বিষন্ন মনে নীল আকাশে তাকিয়ে আছে। তার ফোনে কল আসে। তাওহীদের নাম দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলে।

– ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওলাইকুম আসসালাম। আমি হাসপাতাল থেকে বলছি। তাওহীদ এর এক্সিডেন্ট হয়েছে।

ফারাহর খুশি মুখটা মলিন হয়ে যায়। পুরো শরীরটা পাথরে পরিণত হয়। চোখ গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা তরল পড়ে।দুঃখিনী মা আজও ছেলের পথ চেয়ে বসে আছেন। ছেলে সব রাগ অভিমান ভুলে এক সময় বাড়ি ফিরবে। কিন্তু ছেলের ফিরার কোন নাম নেই। ফোনটা বেজে ওঠে।

– ‘কে বলছেন?’
– ‘হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে।’

তাওহীদের মা পাথর হয়ে যান। চোখ দুটো জলে ভেসে যায়। এখনও তাওহীদের জ্ঞান ফিরেনি। তারা তার জ্ঞান ফিরার অপেক্ষায় আছে। নতুন ভোর নতুন সকাল। কিন্তু নতুন ভোরের সাথে সাথে পুরনো তাওহীদের মৃত্যু হয়েছে। নতুন তাওহীদ জন্ম নিয়েছে। তাওহীদ চোখ মেলে তাকাতেই; তার বাবা মা বোন বন্ধু ও ফারাহকে দেখে। কিন্তু কাউকে চিনতে পারছে না।

– ‘তাওহীদ বাপ আমার কেমন আছিস?’
– ‘কে আপনি? কেন আমাকে ছেলে বলে ডাকছেন?’
– ‘ডাক্তার সাহেব! ও এসব কি বলছে? কেন আমাকে চিনতে পারছে না?’
– ‘আপনার ছেলে মাথায় আঘাত পাওয়ায় পুরনো স্মৃতি ভুলে গেছে।’কথাটা শুনে তাওহীদের মা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকেন।
– ‘ভাইয়া আমাকে চিনতে পারছিস?’
– তাওহীদ মাথা নাড়ায়।

মাওয়ার হৃদয়টা কেঁদে ওঠে। ফারাহ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কাঁদতেও পারছে না। আর বন্ধু নীরবে চোখের জল ফেলছে।

অনেক দিন হয়ে গেছে। তাওহীদ তার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাচ্ছে না। তাওহীদের স্মৃতি ফিরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। আজ তাওহীদ তাদের মাঝে থেকেও মৃত। তাওহীদ আগের মত আর হাসে না, কাঁদে না, কথা বলে না। রাগ অভিমান ঝগড়া কিছুই করে না। সারাক্ষণ চুপ হয়ে থাকে। ফারাহ আসে এক নজর দেখে। কত চেষ্টা করে মনের কথাগুলো বলতে। কিন্তু তার মনের কথাগুলো তার মনেই থাকে। তাওহীদকে আর হয় না বলা। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তারপর কাঁদতে কাঁদতে চলে যাবে। তাওহীদ! তাকিয়ে থাকে আর কি যেন ভাবে। ‘বাবা ও বাবা আমাকে একবার শুধু একবার আম্মা বলে ডাক।’ কিন্তু ছেলে অভিমানে এখন কথাও বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকবে।

দুঃখিনী মা মনে মনে বলবে আর এভাবে কেঁদে যাবে। ‘বাবা ও বাবা আমি তোর সাথে আর বাজে ব্যবহার করবো না। শুধু আমাকে একবার আব্বা বলে ডাক।’ কিন্তু ছেলে চুপ থাকে কিছু বলে না। এভাবে মনে মনে বলবে আর একা একা কাঁদবেন। ‘ভাইয়া এই ভাইয়া আমাকে বোন বলে ডাকবি না? এই ভাইয়া ডাকনা একবার ফোন।’ কিন্তু তার ভাই আজ পাথরে পরিণত কথা বলে না। রুমের অন্ধকারে একা একা বলবে আর কাঁদবে। ছায়া রাতের আঁধারে কাঁদে আর ভাবে কোনদিন সোনালী দিন আসবে। আর তাওহীদ তাকিয়েই থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। আজ তার সকল অনুভূতির যেন মৃত্যু হয়েছে। আজ তাওহীদ কাছে থেকেও অনেক দূরের। বেঁচে থেকেও মৃত্যু লোকের। দূরত্ব! এই দূরত্বের অবশান কখন হবে? কেউ জানে না। তবুও স্বপ্ন দেখে আশা নিয়ে বেঁচে আছে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত