প্রবাস জীবন

প্রবাস জীবন

গরিবের ঘরে জন্ম আমার।বাবা সামান্য একটা ব্যবসা করে কোনো রকম আমাদের সংসার চালান।আমাদের পরিবারে ৫ বোন দুই ভাই।সকলের বড় আমি এরপর আমার দুই বোন তারপর ছোট ভাই এবং আরো তিন বোন।আমার বাবা এই ছোট একটা ব্যবসা করে আমাদের সংসার চালান এবং সবার লেখাপড়ার খরচ চালান।কিন্তু আমি কোনো ভাবেই লেখাপড়া করতে ইচ্ছুক না। কারণ যে ঘরে ভালোভাবে খাবার ঝুটে না সে ঘরে কিভাবে লেখা পড়া করব।তাই চিন্তা করলাম বিদেশে চলে যাব।বাবা তার ছোট ব্যবসা টা দিয়ে কোনো রকম সংসার চালাবে এবং ভাইবোনদের লেখাপড়া করাবে। আর আমি বিদেশে গিয়ে টাকা উপার্জন করব।বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করলাম।টাকা বাবার কাছে কিছু ছিল।কিন্তু বিসার টাকা কোথাই পাব।এগুলো পরে ভাবা যাবে।

পাসপোর্ট জমা দিলাম।সাথে ৫০,০০০ টাকা ও দিলাম।এই ৫০,০০০ টাকা আমাদের নানার বাড়ি থেকে দিছে।এর চেয়ে বেশি এক টাকাও দিতে পারবে না। যাই হোক অপেক্ষায় রইলাম কবে বিসা আসবে।যতদিন পর্যন্ত বিসা না আসবে ততদিন কাজ করব,চিন্তা করলাম।একটা কাজও পেয়ে গেলাম।রাজমিস্ত্রি, প্রতিদিন হাজিরা দিবে ২৫০ টাকা। যাক ভালই হলো।প্রায় ২ মাস পরেই বিসা এসেছে।বিসার দাম ৫ লক্ষ টাকা। বাবা অনেকের কাছ থেকে লাক্ষ খানিক টাকা জোগাড় করেছে।আর আমি ২০,০০০ হাজার টাকা কোনো রকমে জোগাড় করলাম।বাকি টাকা বাবা জমার হারে সুদ আনছে।বছরে ৩০,০০০ টাকা সুদ দিতে হবে।

অনেক কষ্টের পর সব কিছু ছেড়ে চলে আসলাম প্রবাসে। ছোট বেলা শুনতাম বিদেশে নাকি অনেক টাকা, গেলেই নাকি পাওয়া যায়।কিন্তু আজ বুঝতে পারতেছি বিদেশ জীবন যে কি…? যাই হোক যারা আমাকে বিদেশে আনছে,তাদের কাছে আমাকে সাপ্তাহানিক রেখে পরে তাদের কাছ থেকে দূরে দিয়ে দিছে।আমাকে তারা বলেছিল মার্কেটের কাজ দিবে কিন্তু তারা আমাকে দিল দুম্বা মাঠের মধ্যে চড়ানোর জন্য।কি আর করা এই কাজটাই করতে হলো।তারা বলেছিল মাসে ৫০ কি ৬০ হাজার টাকা বেতন দিবে।কিন্তু এখানে তারা আমাকে বেতন দেয় মাত্র ২৪ হাজার টাকা।যদি বলি এসব কাজ করব না,তারা আমাকে বলে, না করলে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিবে। একদিন আমার সাথে একজনের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বাবার কাছে ফোন করলাম।

-আব্বা কেমন আছেন
-হু বাবা ভালো আছি,তুই কেমন আছত
-আমি অনেক ভালো আছি বাবা (কিন্তু আমি যে কতটুক ভালো আছি সেটা আমিই জানি,বাবাকে তা বুঝতে দেয় নি)
-বাবজান সেখানের খাবার-দাবার কেমন
-বাবা অনেক ভালো খাবার,দামি দামি খাবার,এগুলো খেতে খেতে আমার গলা পর্যন্ত এসে যায়
-আচ্ছা বাবজান টাকা পাঠাবিনা
-হু, আব্বা সামনে মাসের ২ তারিখ টাকা পাঠাব

এভাবে নিজের কষ্টগুলো চাপা দিয়ে বাড়িতে বাবা মায়ের সাথে কথা বলি। কখনো তাদের কে বুঝতে দেয় নি যে আমি কষ্টে আছি। প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম থেকেওঠে,খাবার ছাড়াই মাঠে যেতে হয় দুম্বা চড়াতে। সকাল ১০ টা বাজার পর কিছু খাবার দেয়,যা খেয়ে পেট ভরে না। সারাদিন রৌদ্রে পুড়ে মাঠে মাঠে ঘুরে দুম্বা চড়ায়।দুপুর তিনটা বাজলে ভাত দেয়।সেই রৌদ্রের মাঝেই গাছের নিচে বসে ক্ষুদার্থ পেট নিয়ে দ্রুত খেতে হয়।কি সব খাবার দেয়, যা কখনো কল্পনা করতে পারি নাই। বাড়িতে কত যত্ন সহকারে মা খাবার খাইয়ে দিত।ভালো খাবার ছাড়া কখনো কোনোদিন খাই নাই।আর বিদেশে এসে আজ এগুলোই খেতে হচ্ছে।কষ্টে আছি গো মা অনেক কষ্টে আছি এই প্রবাস জীবনে। সন্ধা ৭ টা বাজার পর আবার ফিরে আসি আমাদের গন্তব্যে। ছোট একটা কুড়ে ঘর। এখানে আমরা ৮ জন থাকি।আর দেশে নিজের বাড়িতে এর চেয়ে বড় একটা রুমই ছিল আমার একা।আর এখানে খুব চাপাচাপি করে রাত কাটাতে হয়।

রাত্রে যখন খাবার দেয় তখন,বড় একটা থালি দিয়ে আমাদের ৮ জনকে খাবার দেয়।কোনো কোনো দিন ভালোভাবে খেতেই পারি না।যার যার ইচ্ছে মতো খেয়ে নেয়।কিন্তু আমি এই ৮ জনের মাঝে খেতে পারি না।বাড়িতে মা জোড় করে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিত। কিন্তু তখন খেতে চাইতাম না।প্রবাস জীবনে এসে মার হাতের রান্না করা খাবার খেতে অনেক মিস করি।কখনো ভালোভাবে নতুন কোনো কাপড় পড়তে পারি নাই। অনেক কষ্ট করে প্রবাস জীবন কাটালাম। আজ প্রবাসে আমার তিন বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখনো টাকার ঋন সুদ করকে পারি নাই।এই তিন বছরে কখনো একটু আরাম পাই নাই।কখনো নিজের টাকা থেকে একটা টাকাও বাজে খরচ করি নাই।নতুন কোনো কাপড় পড়তে পারি নাই।ঈদ আসলে ছুটি দিত না।শুধু নামাজ টুকু পড়ার জন্য ছুটি দিত। নামাজ পড়ে সাথে সাথে আবার কাজে চলে যেতে হতো।বাড়িতে থাকা কালে ঈদের দিন বন্ধুদের সাথে কত জায়গায় ঘুরতে গেছি।আর প্রবাসে এসে ভালো ভাবে ঈদটাই করতে পারলাম না।

যারা বিদেশে থাকে তারাই একমাত্র বুঝে বিদেশ জীবনটা যে কি।দেশের বাড়িতে সবাই মনে করে বিদেশে অনেক সুখ।কষ্ট নাই।টাকা বেশি রোজি করা যায়।কিন্তু যারা বিদেশে থাকে তারা যানে টাকা রোজি করতে যে কত পরিশ্রম করতে হয়। তিন বছর হয়ে গেল এখনো সব টাকা সুদ করতে পারি নাই।কিভাবে বাকি টাকা সুদ করবে চিন্তায় মাথা ধরে না।ছোট ভাইটা বাইনা করছে তাকে একটা মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য।এখন কি করব।আজ তিন বছর হয়ে গেল আমি নিজেই মোবাইল কিনতে পারি নাই।অন্যের মোবাইল দিয়ে এতদিন বাড়িতে ফোন করে আসছি।

বিদেশ যে কতো কষ্টের একমাত্র সেই জানে যে বিদেশে আছে।টাকা রোজি করা এত সহজ না।নিজের জন্য ভালো একটা কাপড় কিনতে পারি নাই,বাড়িতে মা-বাবা, ভাই বোনদের কথা মনে করে। অনেক সুখে আছি গো মা,প্রবাস জীবনে অনেক সুখে আছি।মায়ের সাথে যখন ফোনে কথা বলি তখন, নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।বিদেশ নামক এই জেলখানায় অনেক কষ্ট, যা কেউ বুঝে না। কেউ দেখে,কেউ দেখে না,কেউ দেখেও দেখে না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত