ডিভোর্স পেপার টা তিথির দিকে ছুড়ে দিয়ে আশিক বললো, “আমার মনে হয় আমাদের আলাদা হওয়া উচিত এভাবে আর চলছে না, এই নাও ডিভোর্স পেপার।”
‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ বলে একটা কথা আছে। তিথির ক্ষেত্রে তাই ঘটলো। কথাটা যেন সে নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারলো না। ভেতরে কেমন যেন একটা ত্রাসের ঝড় বইতে শুরু করলো, সে ভয় ভয় চোখে বললো, “তুমি এসব কি বলছো আশিক। তোমার মাথা ঠিক আছে তো?” আশিক অন্যদিকে তাকালো। কতক্ষণ নীরব থেকে কি যেন ভাবলো। তারপর বেশ শান্ত ভাবেই বললো, “হ্যাঁ তিথি, আমার মাথা ঠিক আছে এবং আমি যা করছি বেশ বুঝে শুনেই করছি।”
তিথি অবাক চোখে বললো, কিন্তু আমি এমন কি করলাম? হঠাৎ ই কেন তোমার এমন সিন্ধান্ত নিতে হলো?
আশিক মাথা নিচু করে বললো, বুঝলে তিথি, ভালোবাসার পরিবর্তন হয়, ভালোবাসার মানুষটার পরিবর্তন হয় ব্যাপারটা আমি আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু শেষে কি না আমার ক্ষেত্রেই এটা হলো। বেশ কিছু মাস ধরেই খেয়াল করছি তোমার প্রতি আমার আগের অনুভূতিটাই নেই। তুমিই যে আমার ভালোবাসার মানুষটি সেটা বিশ্বাস ই হচ্ছে না। তোমাকে আজকাল আমার একদম ই সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সবটাই কেমন যেন একটা অভ্যাস, কিংবা বলতে পারো সামাজিক দায়বদ্ধতা। তুমি আমার বউ, তাই তোমার সাথে আমি সংসার করছি, ভালোবাসি বলে না। এ যেন মনের বিরুদ্ধে, অনুভূতির বিরুদ্ধে এক কঠিন জোর-জবরদস্তি!
তিথির সহজ সরল চোখগুলো টলমল করতে লাগলো, সে বললো, আশিক তোমার কি হয়েছে? তুমি কি অসুস্থ?
আশিক বেশ সহজ ভাবেই বললো, আমি পুরোপুরি ঠিক আছি তিথি, আর যা বলছি সুস্থ মস্তিষ্কেই বলছি। আর সত্যি বলতে তুমি আমার অফিসের কলিগ রিশাকে নিয়ে যে সন্দেহ করতে সেটা ঠিক। আমাদের দুজনের সম্পর্ক চলছে। সেটা প্রায় মাস দুয়েক ধরেই। তিথি আমি রিশাকে ভালোবেসে ফেলেছি, রিশা ও আমাকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। আর আমি তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ও নিয়েছি। এ কারণেই আমি ডিভোর্সটা চাচ্ছি। আশিকের সহজে বলা কথাগুলো তিথির শরীর কোনো এক বিষাক্ত বৃক্ষের কাটার মতো বিঁধলো। আশ্চর্য রকমের একটা ব্যাথায় সমস্ত শরীরটা যেন চিৎকার করে উঠলো। তার দু’চোখের কোণে যেন একটা সমুদ্রের সকল লোনা জল এসে থামলো!
তিথি কাঁদতে কাঁদতে আশিকের পা জড়িয়ে ধরলো, কান্নামাখা কণ্ঠে বললো, আশিক প্লিজ! তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি জানো আমি তোমায় কতোটা ভালোবাসি, তুমিও তো আমায় ভালোবাসো! বলো বাসোনা?
তিথি কেমন যেন পাগল মতো হয়ে গেল, অনেকটা চিৎকার করে আবার বলতে লাগলো, আশিক আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, আমি তোমার তিথি। যার জন্যে তুমি কবিতা লিখে মোটা ডায়েরিটার পাতা শেষ করতে, যার চোখে তোমার পৃথিবীর পুরো আকাশটা থাকতো, যার কাজলের কালিতে তুমি অমাবস্যা খুজেঁ বেড়াতে। আশিক প্লিজ! আমায় ছেড়ে যেও না। তুমি বড্ড ভুলের মধ্যে আছো। আমায় একটু সময় দাও, আমি সব ঠিক করে দেবো। আমাদের এই গুছানো সংসারটাকে তুমি নষ্ট করে দিও না।
তিথির কথাগুলো শুনে আশিকের চোখেও জল চলে এলো। কিন্তু সেটা কিসের জল? ভালোবাসা বিচ্ছেদের, হৃদয়ের সুপ্ত মায়ার নাকি অন্যকিছু? কোনো হিসেব ই সে মেলাতে পারলো না। হয়তো মেলাতে চাইলো না। প্রশ্নবিদ্ধ মন নিয়ে, চোয়াল শক্ত করে, দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ডিভোর্স পেপারটা টেবিলেই রাখা আছে! তালাক কার্যকর হবে ৯০ দিন পর, এ ক’দিন তিথির ভরনপোষণের দায়িত্ব আশিকের উপরেই ন্যস্ত। ডিভোর্স পেপারটা পাওয়ার পরেও তিথি প্রায় মাস-দুয়েক আশিকের বাড়িতেই ছিল। কিন্তু সেটা আশিকের ভরণপোষণ ভোগের আশায় নয়, সে শুধু চেয়েছিল আশিক ফিরে আসুক।নিজের ভুলটা শুধরে নিক। সে ভেবেছিল আশিকের চোখের সামনে সামনে থাকলে হয়তো তার কঠিন মনটা মোমের ন্যায় গলতেও পারে। কিন্তু তিথি ভুল ছিল। তেমন কিছুই হয়নি।
তিথির গলা ছিল ভারি মিষ্টি। যাকে বলে কোকিলকণ্ঠী। আশিক তিথির গলার রবীন্দ্রসংগীত খুব পছন্দ করতো। ব্যালকনিতে গভীর রাতে তিথি যখন “আমারো পরাণ যাহা চায়” সুরটা টান দিত। আশিক পেছন থেকে সুর মিলেয়ে পরের লাইন গাইতো, “তুমি তাই, তুমি তাই গো”। তিথিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতো, তার চুলের ভেতরে নাক ডুবিয়ে দিত, গলায় নাক ঘষতো। এভাবে করেই দুজন একটার পর একটা রবীন্দ্রসংগীত সুর মিলিয়ে গাইতো। চুলের মতো মিশমিশে কালো রাতটা কখন গিয়ে ভোরের সূর্যে গিয়ে কড়া নাড়তো, দুজনের কেউ সেটা টেরই পেত না। এ ক’দিন তিথি বহুবার রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছে। কিন্তু আগের মতো আশিক উঠে আসে নি। গানের পরের লাইনটা সুর মিলিয়ে গায় নি। তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নি। ঘ্রাণ শুকার বায়না করে খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে দেয় নি।
আশিকের প্রিয় রং ছিল আকাশী। কোনো এক শরতের শুরুতে সে তিথিকে একটা আকাশীরঙা শাড়ি দিয়েছিল। দেয়ার সময় বলেছিল, যখনি দেখবে আমার মনটা ভীষণ রকমের খারাপ, তখনি শাড়িটা পড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, দেখবে আমার সমস্ত মনখারাপী গায়েব। প্রথমবার যখন তিথি শাড়িটা পড়েছিল আশিক মন্ত্রমুদ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, মন বিভীষিকা, হৃদয়ের ভার, মিশিলো অচিন দূর।
কে তুমি? কোন অভ্রের মেঘ? কোন স্বর্গের হুর! এ কোন চিত্র, সব নক্ষত্র- তব শুচির ঝলকে ক্ষীণ! বিষাদের গান, ব্যথার প্রাণ, তব সৌন্দর্যে বিলীন! কিন্তু সেদিন যখন তিথি, চোখের পাড়ে কাজল, কপালে ছোট্ট কালো টিপ, আর ঐ আকাশীরঙা শাড়িটা পরে আশিকের সামনে এসে দাঁড়ালো সে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই করলো না। বরং বিরক্তি নিয়ে বললো, কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া শুধু শুধুই শাড়ি পড়ে ঘুরছো কেন? এ রকম অনেক চেষ্টাই করেছিলো তিথি। সে শুধু চেয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটি ভুল শুধরে তার জীবনে ফিরে আসুক।
কিন্তু এক পর্যায়ে তিথি বুঝে গিয়েছিলো যে চলে যেতে চায়, সে যাবেই। জোর করে তাকে আটকানো যাবে না। কারণ মনের ব্যাপারে জোর খাটে না। মানুষের মনটা হলো নদীর স্রোত, আর মানুষ হলো সে নদীর পালতোলা নৌকা। স্রোত যেদিকে যাবে, নৌকাও সেদিকেই যাবে। সেদিন তিথির মা এসে তাকে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সংসারের প্রতিটা জিনিস ছুঁয়ে কান্না করেছিল তিথি। তার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর পবিত্র ঘরটা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
তিথি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময়, আশিক অফিসে ছিল। সে বাড়ি ফিরে দেখে তিথি নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার অবশ্য এক প্রকার আনন্দই লাগলো। এখন সে রিশাকে নিয়ে সানন্দে বাইরে ঘুরতে পারবে, রাতের পর রাত কথা বলতে পারবে, বাসা ফাঁকা, প্রয়োজনে দু’জন ক’দিন ‘লিভ টুগেদার’ করতে পারবে। সব কিছুই কেমন যেন পরিষ্কার। তবুও আচমকা একটা টুকরো বাতাসের ঝাপটা তার গায়ে এসে লাগলো। বাতাসটা কিসের সংকেত? ভয়ংকর কোনো ভুলের? নাকি নতুন জীবনের সূত্রপাতের? রিশার সাথে আশিকের সম্পর্কটা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকলো। একসময় সে বোধ করলো তার মানবজনম শুধুমাত্র রিশার জন্যেই। সে প্রথমে ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিল। প্রণয়ের প্লাটফর্ম থেকে ভুল ট্রেন ধরে ভুল গন্তব্যে যাত্রা করেছিল। এখনকার ট্রেন টা সঠিক।
এর মধ্যে ডিভোর্সের সময়সীমার প্রায় আশি দিন পেরিয়ে গেছে। আশিটা দিন তিথির কিভাবে কেটেছে সেটা বর্ণনাতীত! সে বুঝতে পারতো একটা দিন চলে যাওয়া মানে আশিক কে চিরতরে হারিয়ে ফেলার আরেকটা ধাপ সামনে এগিয়ে যাওয়া।
ছোটবেলায় তিথি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তো, এক সপ্তাহ পর পর একটা দিনের জন্য স্কুল ছুটি পেত। সেই ছুটির দিনটার শেষভাগে সে মন খারাপ করে বলতো, “এই ছুটির দিন, তুমি এত্তো দ্রুত চলে যাও কেন? আর ক’টা দিন থাকতে পারো না?” ডিভোর্সের দিনগুলোর শেষ ভাগেও সে দিনকে না যাওয়ার জন্য ছোটবেলার মতোই আকুতি করতো। বরাবরের মতোই দিন তার কথা শুনতো না।
শোনার কথাও না, সে চলবে তার নিয়মে। তার এই যাওয়া আসাতে জেলখানার কোনো আসামীর শাস্তির দিন কাটায় তার আনন্দ লাগবে, বিদেশে থাকা স্বামীর ফিরে আসার সময় কাছে আসাতে কোন স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটবে, গর্ভবতী স্ত্রীর প্রসবের দিন কাছে আসাতে কোনো স্বামীর বাবা হওয়ার হাসি হাসবে। আবার ছুটির দিনটা চলে যাওয়ায় কোনো খুকী মনখারাপ করবে, বেঁচে থাকার নির্ধারিত সময়গুলো শেষ হওয়াতে কোনো ক্যান্সার রোগীর চোখগুলো জলে টলমল করবে। ডিভোর্সের দিনগুলো কেটে যাওয়াতে তিথির মতো কেউ খুব করে কাঁদবে।
দিনের কিছুই করার নেই। সে চলে সময়ের নিয়মে। সে জানে তাকে যেতে হবে, রাতকে আসার সুযোগ দিতে হবে, তারপর আবার তাকে আসতে হবে। এতে অনেকেই কাঁদবে অনেকেই হাসবে। রিশার মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। অবস্থা ভালো রকমের খারাপ। চিকিৎসার শুরুর দিকেই রিশার সব টাকা শেষ। এখন ফুল ট্রিটমেন্টের জন্য প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা দরকার। সে আশিকের অফিসে, বাসায়, ফোনে দিনরাত শুধু কান্নাকাটি করে।
আশিক কি করবে বুঝতে পারলো না। রিশার কান্নাকাটি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আশিকের সেভিংসে সব মিলিয়ে আট লক্ষের মতো টাকা ছিল। আরো সাত লক্ষ টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিল, জামানত হিসেবে রাখলো বাড়ি। অবশ্য এছাড়া কিছুই করার ছিল না। রিশাকে সে পনেরো লক্ষ টাকা গুছিয়ে দিল। রিশা অবশ্য তাকে টাকা ফিরিয়ে দেবার কঠিন আশ্বাস দিয়েছিলো।
কিন্তু টাকা পাওয়ার পর থেকে রিশা আর অফিসে আসে না। সে কোনো ফোনও দেয় না। আশিক ফোনে অনেকবার ট্রাই করেছে কিন্তু রিশার ফোনটাও বন্ধ। শেষমেশ সে রিশাদের বাসায় গেলো। গিয়ে দেখলো দরজায় বড় একটা তালা ঝুলানো। তালার সাথে একটা চিরকুট, যেখানে লেখা, ” প্রথমেই তোমাকে ঠকানোর জন্য ক্ষমা চাইছি আশিক। সত্যি বলতে ঐ মহিলা আমার মা না, উনার ক্যান্সার ও নেই। উনি শুধু টাকার বিনিময়ে এতোদিন অভিনয় করেছেন। আসলে বিশ হাজার টাকা বেতনে আমার হচ্ছিলো না, আমার আরো বেশি টাকার প্রয়োজন ছিল। তাই তোমার সাথে এই নাটক টা করতে হলো। আর তোমাকেই বা কি করে ভালোবাসতাম বলো? যে ছেলে অন্য একটা মেয়ের জন্য তার ভালোবাসার মানুষটিকে, তার নিজের বউকে ডিভোর্স দিতে পারে; সে যে পরে অন্য কাউকে পেয়ে আমার সাথে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী? পারলে তিথির কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। আমি চলে যাচ্ছি।”
চিঠিটা আশিক প্রায় তেইশবার পড়লো। পাগলের মতো পড়লো। তার মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে গেছে। শেষ পর্যন্ত রিশা? রিশা তার সাথে এটা করতে পারলো! সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার সাথে এতো বড় ধোকা! এটা কিভাব সম্ভব? সে বারবার ব্যাপারটাকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন সত্য, এটা স্বপ্ন নয় যে ঘুমটা ভাঙ্গলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে।
তিন ধরে আশিক অফিসে যাচ্ছে না। এতো বড়ো একটা ঘটনার শক সে এখনো সামলে উঠতে পারে নি। অবশ্য পারাটা সম্ভবও না। নগদ পনেরো লক্ষ টাকা জলে গেল! থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত রিশার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। খোঁজ পাওয়া যাবে বলেও মনে হচ্ছে না। এদিকে আবার সময়মতো লোন পরিশোধ করতে না পারলে বাড়িটাও যাবে। সব হারিয়ে তাকে পথে বসতে হবে!
আহারে, তিথি কতো করে বলেছিলো, সোনার সংসারটাকে ধ্বংস না করতে। কতোবার তার পায়ে ধরে কেঁদেছিলো, রিশার মায়াতে না জড়াতে। কিন্তু সে শুনেনি। আজ জীবনের এই মর্মান্তিক অবেলায়, শুধু তিথির কথাই মনে পড়ছে তার। মেয়েটা তাকে কতো ভালোবাসতো, এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে ফেলে সে রিশার দিকে কেন গেল?
তার কেন জানি মনে হচ্ছে, সে এতোদিন সে একটা বিশাল ঘোরের মধ্যে ছিল। রিশার ঘটনাটার তীব্র ঝড় তার ঘোর ভেঙ্গেছে। তার তিথিকে প্রয়োজন। হ্যাঁ যেভাবেই হোক তিথিকে প্রয়োজন। কিন্তু তিথির সাথে সে যে অন্যায়- অবিচার করেছে, তারপর কিভাবে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?
তবুও আশিক তিথির কাছে গেল। আর যাই হোক ভালোবাসার মানুষ তো। আশিক রিশার পুরো ঘটনাটা তিথিকে খুলে বললো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললো, তিথি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।
তিথি বেশ শান্তভাবেই বললো, আশিক! তোমায় আমি কি করে ক্ষমা করবো বলোতো? তুমি তো আমার কাছে এখন ভালোবাসার টানে আসোনি, আমায় ভালোবাসো বলে আসোনি। তুমি এসেছো রিশা তোমায় ছেড়ে চলে গেছে বলে।
আশিক কিছুই বললো না। সে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলো।
তিথি আমার বলা শুরু করলো, তুমি রিশাকে বিয়ে করতে, সুখের সংসার করতে, ছেলে মেয়ে নিতে। আর আমার? আমার কি হতো বলোতো? তোমার ডিভোর্স পেপার দেয়ার আজ সাতাশি তম দিন। এর ভেতরে তুমি আমার কোনো খোঁজ নাও নি। আর ক’দিন পর তোমার ডিভোর্স কার্যকর হবে। আগে আমি চাইতাম না, এখন আমিও চাই এটা হোক। তুমি চলে যাও!
আশিক কি বলবে, তার কি বলা উচিত, সে কিছুই বুঝতে পারলো না। তার মনে পড়লো তিথি খুব কবিতাপ্রেমী। তিথি যখন খুব রাগ করতো, সে তখন কবিতা শুনাতো। কবিতা শুনলেই তিথির সব রাগ কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যেতো। আশিক কান্নামাখা কণ্ঠে আবৃতি শুরু করলো, প্রিয়তমা, আমায় একটা কাঠের কফিন, কয়েক গুচ্ছ সাদা গোলাপ দাও! তবুও তোমার- তুমিহীনতার শাস্তি দিও না। কবির যে চোখজোড়া ভুল করেছিলো, অভিশপ্ত শরীর ভালোবেসে- সে চোখজোড়া তুমি অন্ধ করে দাও। তুমি পণ্ড করে দাও সে হাত, মস্তিষ্ক, বিষাক্ত শহরের অমর্ষ হৃদয়- যারা রাতদিন অশুচি প্রণয়ের কবিতা গুছাতো। ভেঙ্গে ফেল কবির ভুল কলম, কবিতার ছন্দ- যারা তোমার চোখের নিচে অনিদ্রার কালি এঁকেছে। প্রিয়তমা, আমায় একটা জলন্ত চিতা, জীবন্ত দাহের স্বাদ দাও! তবুও তোমার- তুমিহীনতার শাস্তি দিও না।
কবিতাটা শুনে তিথি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, কবি, তোমার কবিতা ব্যর্থ! তুমি চলে যাও! আশিক কাঁদছে। তিথিকে তার আর কিছু বলার সাহস হচ্ছে না। অশ্রুসিক্ত চোখে সে একাকিত্বের পথে পা বাড়ালো। সে উপলব্ধি করতে পারলো, আজ তার এই অসহায়ত্ব, একাকিত্ব, ভালোবাসাহীনতার জন্য সম্পূর্ণ সে নিজেই দায়ী। ভালোবাসার মতো পবিত্র জলপদ্ম তার হাতে ধরা দিয়েছিলো। কিন্তু সে সেটাকে আপন না করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এতোদিন বোকার মতো শ্যাওলার পেছনে দৌড়েছে। ভালোবাসার যুদ্ধে সে নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।