অামার স্বামী অার অামি অালাদা রুমে ঘুমাই সেতো অনেকক দিন হল। অথচ ভাবতেই অবাক লাগে সে অামাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
.
তখন সবে মাত্র এস.এস.সি পাশ করেছি। অামি দেখতে কালো। প্রেম ভালবাসাতো অামার কাছে অাষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছুইনা।
হয়তো অন্য অাট দশটা মেয়ের মত কিশোরি মনে স্বপ্ন সাজাতাম।
রাজকুমার পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে না অাসুক, অামার মনের মত একজন স্বামী নিশ্চয় অামাকে বউ করে নিতে অাসবে।
অনেক বিয়ের প্রস্তাব অবশ্য এসেছিল। বাবা মা ফিরিয়ে দিয়েছে। অামিও বলেছি অামি এখনো ছোট, অামি অারো পড়তে চাই।
.
ভাইয়ার এক বন্ধু কবে নাকি কোথায় অামাকে দেখেছিল। ভাইয়ার সে বন্ধু অামাকে বিয়ে করতে চায়।
ভাইয়াকে সরাসরি বলতে না পেরে অন্য বন্ধুকে দিয়ে বলেছে। ভাইয়া বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে সব জানাল।
ছেলে ধনী পরিবারের, অামি সুখে থাকব, এগুলো ভাইয়া বুঝাইতো। তবে ভাইয়ার সে বন্ধুকে কেন যেন অামার মোটেও পছন্দ হয়নি।
কিন্তু বাবা মা ঠিকই রাজী হয়ে গেল। অামি বলেছিলাম বিয়ে করবনা। সেদিন ভাইয়া অামাকে খুব মেরেছিল।
বাবা মা অামাকে কোনদিন মারেনি। অথচ বিয়েতে রাজী হইনি বলে ভাইয়া মেরেছিল।
একটা সময় বাধ্য মেয়ে হয়ে কাঠের পুতুলের মত সে কিশোরী মেয়েটা বউ সেজে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছি।
.
বাবা মা অার তেমন খুঁজ না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিল। ভাইয়ার বন্ধু বলে কথা। কত অাশা কত স্বপ্ন বুকে লালন করে বউ সেজে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছি।
কিন্তু সে স্বপ্ন সে অাশাগুলো কাচের টুকরোর মত ভেঙ্গে ঝরে পড়ল। অামাকে শ্বশুর বাড়ির কেউ পছন্দ করতনা।
ঐ বাড়ির সবাই ফর্সা, অামিই কেবল কালো। সব অবহেলার তীরগুলো দিনের পর দিন অামার শরীরে বিঁধতে লাগল।
যা তা বলত সবাই, অামার স্বামী কোন প্রতিবাদ করতনা। কারন একই অবহেলার ছুঁড়া তীর অামার স্বামীর কাছ থেকেও অাসত।
.
স্বামী, যে হল সারাজীবনের সঙ্গী। সে যদি কারণে অকারণে গায়ে হাত তুলে তখন মনের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে সময় লাগেনা।
কখনো কোন অাবদার করতে পারিনি। অামাকে বলেই দিত, অামার কাজ শুধু রান্না করা, সংসারের কাজ করা।
হ্যাঁ, অামি একটা কাজের মেয়ের মতই থেকেছি দিনের পর দিন।
স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যায়, সিনেমা দেখে, পার্কে যায় এসব বান্ধবীদের কাছে শুনতাম। কখনো গল্প উপন্যাসে পড়তাম।
অামার বিয়ের পর কোনদিন বাইরে যেতে পারিনি স্বামীর সাথে।
.
খুব বেশী মনে পড়ে একবার মাত্রাতিরিক্ত মার খাবার পর অামি বাবা মায়ের কাছে চলে যাই।
একটিবারের জন্য অামাকে ফোনও করেনি, অামাকে অানতেও যায়নি অামার স্বামী।
অামার মা অামাকে বুঝাইত, একটা ছেলে/মেয়ে হোক দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা মা নিজে অামাকে অাবারো স্বামীর বাড়িতে রেখে অাসল।
সম্মানের ভয়ে। স্বামীর বাড়ি থেকে এসে অার মেয়েটি যায়নি।
লোকমুখে এমন কথা শুনতে হবে ভেবে, সংসার ভেঙ্গে যাবে ভেবে অামাকে অাবারো সেই দোযখে পাঠানো হল।
.
অামি কখনো ভাত কাপড়ের কষ্ট করিনি। কাপড় দুইটার জায়গায় পাঁচটা কিনে দিত। কিন্তু স্বামীর ভালবাসা, শ্বশুর শ্বাশুড়ীর ভালবাসা কেমন তা পাইনি।
.
বিয়ে হয়েছে অামার দশ বছর হল। একটি ছেলে অার একটি মেয়ে। বাবা মা বলেছিল অামার ছেলে মেয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
অার হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টোটা। বছর তিনেক ধরেতো অামার স্বামী অালাদা রুমে ঘুমায়। অামার ছেলে মেয়ে অামার সাথে ঘুমায়।
কখনো যদি ছেলে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে অামি অামার স্বামীর রুমে যাইতাম, অামাকে তাড়িয়ে দিত।
যদি দুষ্টুমি করেও বলতাম, অামার স্বামীকে ছেড়ে অামি যাব কেন? তেড়ে অাসত অামাকে মারার জন্য।
দুদিন সাহস করে বলে ফেলেছি, “অাচ্ছা অামাকে না তুমি পছন্দ করে বিয়ে করেছো? অামাকে ভাল লেগেছে তাই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে।
তো এখন অামি কি দোষ করলাম? — “উত্তরে বলত, “তখন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ভাল লাগার কথা।”
হা হা হা, সত্যিই এই কথাটা শুনার পর অামি মুচকি মুচকি হাসি। এটাই নাকি স্বামী স্ত্রীর পবিত্র ভালবাসা।
এখনতো অামার যাবারও জায়গা নেই। রাগ করে বাবা মায়ের কাছে গেলে বুঝিয়ে শুনিয়ে অাবার এখানে রেখে যায়।
অার দুইটা ছেলে মেয়ে রেখে অামিইবা যাব কোথায়…..?
.
অন্য কোন মেয়ের সাথেও অামার স্বামীর কোন সম্পর্ক নেই। কোন বাজে অভ্যেসও নেই। শুধু পাহাড় সমান অহংকার পুষে রেখেছে মনে।
অামাকে বিয়ে করে বড্ড ঠকে গেছে মনে হয় লোকটা। তাইতো এই নিদারুণ অবহেলা অামার প্রতি।
মজার বিষয় হল অামার স্বামী কিন্তু অামার ছেলে মেয়েকে যথেষ্ট অাদর করে। অামার প্রতিই শুধু তার এই অনিহা। অামি এখন কিছু বলিনা।
প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলিনা। কি কি বাজার লাগবে বলি শুধু। রান্না করি, ছেলেমেয়েদের নিয়ে খাই অার ঘুমাই।
কতবার বলেছি, “এভাবে জীবন চলবে?”
উত্তরে বলে, “চলছেতো, যদি মনে হয় তোমার কাছে চলছেনা, তাহলে চলে যাও।”
না, এই লোকটাকে অার কিছুই বলবনা। ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে, ওদের সামনে মার খাবার কোন শখ নেই।
“ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। সবার কপালে তো অার সুখ সয়না। দুঃখকে করেছি তাই অালিঙ্গন।
শত দুঃখই মেনে নিয়েছি। এতকাল সহে গেছি, সইতে পারিব বাকি জীবন।”