আমি মেঘার সামনে গেলেই কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করি এটা আমি নিজেও জানি না। আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে শিরা উপশিরা গুলো দপদপ করতে থাকে। হার্ট তার রক্ত পাম্প কার্য তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমার মনে হয় এই বুঝি হার্ট তার কার্যক্রম বন্ধ করে আমার থেকে বিদায় নিবে।
মেঘা আর আমি পাশাপাশি বাসায় থাকি সেই ছোট্র থেকেই। মেঘার বাবা এবং আমার বাবা একই জায়গায় চাকরি করার সুবাদে আমাদের দুই পরিবার এর মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। আমি যখন ছোট্র ছিলাম তখন প্রতিদিন মেঘার সাথে হাড়ি-পাতিল এসব খেলায় মেতে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমরা (বর,কনে) বিয়ে দেওয়া খেলতাম। আমার পুতুল টা ছিলো বর পুতুল। আর ওর টা ছিলো কনে পুতুল। ফ্ল্যাট অন্য ছেলে-মেয়েরা আমাদের সাথে খেলায় অংশ-গ্রহণ করতে চাইলে তা মেঘার জন্য আর হয়ে উঠতো না। সে-ঐ ছেলে-মেয়েদের সাথে ঝগড়া করতো। কখনো কখনো ঝগড়া এমন পর্যায়ে চলে যেতো যে ও রাগে ওদের হাতে কামড় বসিয়ে দিতো। কখনো বা হাত খামচে ধরতো। এই ঘটনার পর থেকে আর কেও আমাদের সাথে খেলতে আসেনি। মেঘাকে দেখলেই ওরা রুমের দিকে পা বাড়াতো। এমন কি আমার সাথে পর্যন্ত কথা বলতে আসতো না।
সময় বড়ো অদ্ভুত কতো সহজেই না সেই দিন গুলোকে আজ আমার অতীত বানিয়ে দিলো। চোখ বুজ লেই আমি সেই দিন গুলো আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। আমার মনে হই এই বুঝি মেঘা আমার পাশ থেকে ওই ছেলে-মেয়েদের আচ্ছা করে বকে দিবে যাতে আর কোনদিন আমাদের সাথে খেলতে না আসে। কিন্তু হায় আফসোস সময় যতো পেরিয়ে যাচ্ছে ততো যেনো আমার কাছে সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে। কখন যে আমি আনমনে বেখেয়ালে মেঘাকে ভালোবেসে ফেলি নিজেও জানি না। বহুবার তাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে আমি থমকে দাড়িয়েছি আমার নিজের ই তা অজানা।
একদিন সাহস করে বলেই ফেলি মেঘা আমি তোকে ভালোবাসি। আমার ঐদিন মনে হয়েছিলো আমার বুকের মাঝ-খান থেকে কোন শক্ত বোঝা নেমে গিয়েছিল মেঘা সরু চোখে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলেছিলো নিরব আমি শুধু তোকে আমার বন্ধু ভাবতাম সব-সম। আর তোকে নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবিনি আমি। আর তাছাড়া আমার বয়ফ্রেন্ড আছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার৷ আমি তাকেই বিয়ে করবো। তোর তো কিছুই নেই যা গিয়ে তোর নিজের যোগ্যতার কাউকে খুঁজে নে।
আমি চুপ করে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। কথাগুলো বার বার আমার কানে বাঁজছিলো। আমার হৃদয়ের রক্ত-ক্ষরণ ঐদিন কেউ দেখেনি, দেখতে পারে নি। কাউকে কিছু বলিনি সেদিন। ফিরে এসেছিলাম তার শহর থেকে। মনের মাঝে এক অজানা জেদ চেপে বসেছিলো বারংবার। আমি কেনো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলাম না?
এক অজানা শহরে চলে আসি চট্রগ্রাম মামার বাসায় ঢাকা থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চট্রগ্রাম বিশ্ব-বিদ্যালয় এ। আমার ডিপার্টমেন্ট টা ছিলো “হিসাববিজ্ঞান”। আমার মামাতো বোন ও একই ভার্সিটিতে পড়তো। ও আমার ব্যাপারে সব জানতো। আমাকে মানসিক মনোবল টা ও দেয়। আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে থাকি। দিন শেষে মেঘার কথা- খুব মনে পড়তো আমার। নিরবে চোখের জল ফেলতাম। হঠাৎ একদিন মামাতো বোন মায়া তা দেখে ফেলে। আমার কাভহে এসে জিজ্ঞেস করে ওকে অনেক ভালোবাসিস তাইনা রে? আমি আমার মাথা টা উপর নিচে দুলিয়েছিলাম কেবল।
দিন যায় রাত আসে আমার ভাবনাগুলো আমার থেকে বিদায় নেয় না,আমাকে আরো জাপটে ধরে যেনো। মা প্রায় ই ফোন দিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য বলতেন আমি হ্যা, না, বলে পার করে দিতাম। গতমাসে মা আসলেন মামার বাসায় আমায় দেখতে। বলে গেলেন মেঘার বিয়ে হয়ে গেছে জামাই নাকি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আমি ভাবতে লাগলাম হয়তো সেই ছেলেটি। বুকের ভিতর কেমন যেনো তীরের ফলা টা ঢুকে গেলো। আমি মেঘাকে আমার ভেতর থেকে মুছে ফেলতে লাগলাম। নিকের লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার জন্য (আঁদা-জল) খেয়ে নেমে পড়লাম। আমার কষ্টের ফল আমি পেয়েছি। অবশেষে সেই কাঙখিত দিন টা এলো।
আমার নামের পাশে বসলো পদবী, অনেক সাধনার ফল। (নিরব মাহমুদ – চার্টার্ড একাউন্টেন্টস)। আর ওদিকে মায়া হয় প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। কোনদিক দিয়ে যে জীবনের এতগুলো বসন্ত পার হয়ে গেলো বুঝি নি। দু’একটা চুলে পাঁক ধরেছে। মায়ার চোখেও একটা চশমা জায়গা পেয়েছে। বসেছিলাম কোন এক সন্ধ্যায়। মায়া পাশে এসে ধোয়া উঠা কফি বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো যে যাবার সেতো যাবেই, আর কতো এভাবে জীবন পার করবি? আমি ওর দিকে তাঁকিয়েছিলাম এক দৃষ্টিতে। ও ওর মাথার সামনের নিচু হয়ে যাওয়া চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিলো। মুখে একটা লজ্জার আভা এনে বললো আমাকে আপন করে নে একবার।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যেতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন ফিরে বললাম মামাকে বল মা কে ফোন দেওয়ার জন্য। আমাদের বিয়ের প্রথম কার্ড টা মেঘাকেই দিলাম। ও আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। ওর জামাইকেও দেখে আসলাম। বেশ ভালো মানিয়েছে তাদের। ওদের একটা মেয়েও আছে। আমাকে বলেছিলো চা-খেয়ে আসার জন্য। কাজের দোহায় দিয়ে চলে আসি। হঠাৎ করেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।