-কবিরাজ চাচা আপনি বললেন গাছে তাবিজ ঝুলানোর তিন দিনের মধ্যে মিলি আমার প্রেমে সাড়া দিবে। আপনার কথা শুনে তিনদিন পরে মিলির সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, মিলি আই লাভ ইউ। মিলি বললো, ভালোবাসেন তাহলে প্রমাণ দেন। পুকুরে তিনবার ডুব দিয়ে তারপর বলেন মিলি আই লাভ ইউ। আমি ভাবলাম তাবিজ কাজে দিছে নাহলে মিলি তো আমার সাথে কথাই বলেনা। পুকুরে নেমে গেলাম। তিনবার ডুব দিয়ে পুকুর থেকে উঠে দেখি মিলি নাই চলে গেছে। গফুর কবিরাজ চোখ বন্ধ করে মেরাজের কথা শুনছিলেন। মেরাজের কথা শেষ হতেই তিনি চোখ খুলে বললেন,
–একটা তো ভেজাল করে ফেলছিস কাজ হবে কিভাবে।
-কি ভেজাল চাচা?
–তুই তো মেয়ের চুল না এনে ভুল করে মেয়ের মায়ের চুল নিয়ে আসছিস।
-এটা কি বলেন চাচা আমি তো মিলির জানালার নিচ থেকে চুল কুড়ায় আনছি।
–ভুল চুল আনছিস বললাম না। এজন্য কাজ হয়নি। যা মেয়ের চুল নিয়ে আয়।
-আগের যেই তাবিজটা গাছে ঝুলায় রাখছি ওইটার কি হবে?
–খুলে নিয়ে আসবি। নাহলে দেখবে মেয়ে আর মেয়ের মা দুইজনে তোর প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। বিরাট সমস্যায় পড়বি। মেয়ের স্বামী হইতে গিয়ে মেয়ের বাপ হয়ে যাবি।
-আচ্ছা যাচ্ছি।
–নতুন তাবিজের হাদিয়া টা দিয়ে যা। পাঁচশত এক টাকা।
-আগেরবার না দিলাম। কাজ তো হয়নাই।
–কাজ তো হয় নাই তোর ভুলে আর ওইটা তো আগের তাবিজের হাদিয়া। নতুন তাবিজের হাদিয়া লাগবেনা।
কবিরাজ চাচার সবকিছু মেরাজের কাছে ভাওতাবাজি মনে হয় তবুও চাচাই তার শেষ ভরসা। দুবছর মিলির পেছনে ঘুরেছে কিন্তু মিলি পাত্তা দেয়নি। মিলি ইদানিং পশু চিকিৎসক ফয়সালের সাথে ঘুরছে। লোক মুখে শুনেছে তাদের বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। মেরাজ মানিব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে দিলো। গফুর কবিরাজ নোটটা নিয়ে বললেন, “আর এক টাকা?” মেরাজ পকেট থেকে একটা মিল্ক ক্যান্ডি বের করে গফুর কবিরাজের হাতে ধরিয়ে দিলো। গফুর কবিরাজ অবাক হয়ে মেরাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
–এটা কি?
-ডিজিটাল বাংলাদেশের এক টাকা। মুখে দিয়ে চুষতে থাকেন। আমি চুল নিয়ে আসতেছি।
মেরাজ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। গফুর কবিরাজ প্যাকেট ছিঁড়ে চকলেট মুখে দিলো।
মিলি ফয়সালের ফার্মেসীর সামনের বেঞ্চে বসে ফয়সালের জন্য অপেক্ষা করছে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। মা দুবার ফোন করেছেন মিলি ফোন রিসিভ করেনি। ভাবি ভাই আসছে। দোকানের ছোট ছেলেটার কথা শুনে মিলি তাকিয়ে দেখলো ফয়সাল আসছে। হালকা গোলাপি হাফ হাতা শার্টটা ফয়সালকে বেশ মানিয়েছে। শার্টটা মিলির গিফ্ট করা। মা জুতা কেনার জন্য যে টাকা দিয়েছিলো সে টাকা দিয়ে শার্টটা কিনেছিলো মিলি। বাসায় ফিরে মাকে বলেছে টাকা হারিয়ে গেছে। অবশ্য এর জন্য মা অনেক বকাবকি করেছেন। কামরুন্নেছা বলেছেন, আমাকে কি তোর টাকার গাছ মনে হয়। আমাকে ঝাঁকালে টাকা পরে? মিলি মাকে দুহাতে ধরে দুবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলো, নাহ্ টাকা পড়েনি। টাকা মনে হয় এখনো কাঁচা আছে। পাকলে পড়বে। ফয়সাল খুঁটির সাথে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে কাঁধের কালো মোটা ব্যাগটা মিলির পাশে রেখে বললো,
–সরি রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। রোগীর অবস্থা ভালো না তাই ফিরতে দেরি হলো।
-যেভাবে বলছেন মনে হয় বিরাট ডাক্তার আপনি। রোগীকে বাঁচিয়ে তারপর আসলেন। আমাদের গরুটাকে তো বাঁচাতে পারলেন না। ইনজেকশন দিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই তো গরুটা মরে গেলো। বড় ভাই কিন্তু অনেক রেগে গিয়েছিলো। শুধুমাত্র বাসার হবু জামাই বলেই আপনাকে কিছু বলেনি। ফয়সাল হতাশ গলায় বললো,
-হায়াত মউত আল্লাহর হাতে, আমার কি দোষ। ফয়সালের কথা শুনে মিলি খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। কোনরকম হাসি থামিয়ে বললো,
-অনেক দেরি হয়ে গেছে। মা বারবার ফোন দিচ্ছে। চলুন আমাকে এগিয়ে দিন।
–আরেকটু বসো, চা খেয়ে যাও।
-নাহ্ দেরি হয়ে যাবে। চলুন আপনার সাইকেলে করে পৌঁছে দিন। ফয়সাল কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
–সাইকেলে কেন, রিকশা ডেকে দিচ্ছি।
-কেন সাইকেলে করে পৌঁছে দিলে কি সমস্যা। থাক রিকশা ডেকে দিতে হবেনা আমি নিজেই রিকশা নিতে পারবো। যাচ্ছি…
রিকশা নেয়ার পরে মিলির মন খারাপ হয়ে গেলো। মিলির ইচ্ছা করছিলো আরও কিছুক্ষন ফয়সালের সাথে থাকতে। মিলি রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরাতে বললো। ফয়সালের দোকানের সামনে এসে ফয়সালকে ডাক দিলো,
-এই যে রিকশায় আসুন। হুড তুলে দিলে আপনাকে কেউ দেখতে পাবেনা। রিকশা চলছে মিলি আর ফয়সাল দুজনে চুপচাপ বসে আছে। নিরবতা ভেঙ্গে ফয়সাল বললো,
–তোমাদের বাসার অবস্থা এখন কেমন?
-বাসার খবর তো একবার বাসায় গিয়ে নিতে পারতেন। এই দশ দিনে কি একবারের জন্য বাসায় আসা যেতোনা?
মিলির কণ্ঠে অভিমাণ স্পষ্ট।
–যাবো যাবো করে যাওয়া হয়নি। আসলে এতো ব্যস্ত ছিলাম।
-আপনার সব ব্যস্ততা তো গরু ছাগল নিয়ে। তাহলে গরু অথবা ছাগল একটাকে বিয়ে করলে তো পারেন।
–মিলি তুমি কিন্তু বারবার আমার পেশাকে অসন্মান করছো।
-ইচ্ছা হয়েছে করেছি। আপনার কোন সমস্যা থাকলে আমার নামে মানহানির মামলা করতে পারেন। করবেন?
–কি করবো?
-মান হানির মামলা।
–কি সব উদ্ভট কথা বলো তুমি।
-আপনার সাথে উদ্ভট কথা বলতে আমার ভালো লাগে।
–কি?
-কিছুনা।
রিকশা মিলিদের বাসার সামনে এসে থামলো। বাসার ভেতর থেকে উঁচু গলায় ঝগড়ার শব্দ আসে। মিলির মন খারাপ হয়ে গেলো। মিলি চায়না ফয়সাল এসব জানুক। ফয়সাল বললো,
–বাসায় কি কোন সমস্যা। আমি যাবো সাথে?
-না আপনি চলে যান। রিকশা ভাড়াটা দিয়ে দিয়েন।
ফয়সাল চলে গেছে। মিলি বাসার সামনের সিঁড়িতে বসে আছে। বাসায় ছোট মামা এসেছেন। তার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। তিনি বড় ভাইকে শাসাচ্ছেন। বড় ভাই ও উঁচু গলায় গালিগালাজ করছেন। মিলি অপেক্ষা করছে ঝগড়া থামার। পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে সে বাসায় ঢুকবে। অন্ধকারে গাছের আড়ালে কোন একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে মিলির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কয়েকদিন আগে বড় ভাবি মাঝরাতে গাছের ডালে একজনকে ঝুলতে দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সে কথা মনে হতেই মিলির ভয়টা বেড়ে গেলো। মিলি ভীত কণ্ঠে বললো,
-কে, কে ওখানে?
গাছের আড়াল থেকে মেরাজ বেরিয়ে আসলো। মেরাজকে দেখে মিলি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ধমকের স্বরে বললো,
-আপনি এ সময় এখানে কি করছেন। মতলব কি আপনার? মেরাজ থতমত খেয়ে বললো,
–না কিছু করছিনা। তুমি ফয়সালের সাথে কোথায় গেছিলে?
-আমি কার সাথে কোথায় যাই তাতে আপনার কি?
–মিলি সত্যি আই লাভ ইউ। ফয়সাল খালি দেখতেই সুন্দর কিন্তু ছেলে ভালো না। বিরাট লোভি।
-ফয়সাল কেমন সেটা তো আমি আপনার কাছে জানতে চাইনি।
–তুমি ওই গরুর ডাক্তারকে যে কেন ভালোবাসো বুঝিনা। সেদিন পাশের বাসার গরুকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসছিলো। হাতে দস্তানা পরে গরুর পাছায় হাত ঢুকায় দিলো। ছিঃ সালার ঘেন্নাও নাই।
-আর একটা ফালতু কথা যদি বলেছেন থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। এক্ষুনি দূর হন এখান থেকে।
বাসা থেকে একজনকে বের হতে দেখে মেরাজ দৌঁড় দিলো। আজিজার বাসা থেকে বের হয়ে ভাগ্নিকে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে বললেন,
–কিরে এখানে বসে আছিস কেন। রাত বিরাতে বাইরে ঘুরাফেরা করা ঠিক না।
-তুমি কি চলে যাচ্ছো মামা?
–হুম… আচ্ছা ওটা কে দৌঁড় দিলো?
-কেউ না।
–যা বাসায় যা।
মিলি বাসায় ঢুকে দেখলো বাসার পরিবেশ বেশ থমথমে। বড় ধরণের ঝড় বয়ে যাবার পরে যেমন অবস্থা হয় ঠিক সেরকম। বড় ভাই বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছেন। মিলি চুপচাপ মায়ের ঘরে চলে গেলো। কামরুন্নেছা বিছানায় বসে ছিলেন। মেয়েকে দেখেই মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। মিলি অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কামরুন্নেছা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
–কোথায় মরতে গেছিলি। সময় কতো এখন। ফোনটা কি ঢং দেখানোর জন্য কিনেছিস। কতোবার ফোন করেছি
তোকে। কি হলে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন। যা কাপড় পাল্টে রান্না বসা। মিলি মায়ের কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে আসলো। কাপড় পাল্টে রান্না ঘরে চলে গেলো। মিলির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মা মেরেছেন সেজন্য তার কষ্ট হচ্ছেনা। কষ্ট হচ্ছে মায়ের কথা ভেবে। আজ সকালে বড় ভাই মাকে ডেকে বলেছেন এ বাসাটা বড় ভাইয়ের মায়ের নামে লিখে দেয়া। বাজারের দুটো দোকানের একটা বড় ভাই অন্যটা ছোট ভাইয়ের নামে। মা কিছুই বলেননি। বড় ভাই এ কথাটা ছোট মামাকে ফোন করে বলেছে তাই ছোট মামা বাসায় এসেছিলেন।
মিলির বাবা মারা গেছেন দু সপ্তাহ হয়েছে। মানুষটা একদম সুস্থ্যই ছিলেন। বাসায় এশার নামাজ পড়ে মিলিকে ডেকে বললেন, মা বুকটা কেমন যেন ব্যাথা করছে। রাত দশটায় বাবা মারা গেলেন। মিলির কাছে সবকিছুই কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। বাবা বেঁচে থাকতে তার প্রতি মিলির তেমন দুর্বলতা ছিলোনা। কিন্তু তিনি মারা যাবার পরে মিলির কেন যেন মানুষটার প্রতি দুর্বলতা বেড়ে গেছে। লোকটা মিলির আসল বাবা ছিলেন না। মিলি তার মায়ের প্রথম পক্ষের সন্তান। মিলি যখন মায়ের সাথে এ বাসায় আসে তখন সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। অপরিচিত একটা লোক তার মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছে মিলি সেটা মানতে পারছিলোনা।
তার খুব কান্না পেতো। বারবার নিজের বাবার কাছে যেতে ইচ্ছা করতো। কামরুন্নেছা মেয়েকে অনেকবার বলেছেন, এখন থেকে ইনিই তোমার বাবা। কিন্তু মিলি মানতে পারেনি। মিলির আসল বাবা যতোই খারাপ হোক তবুও মিলি বাবা মায়ের ডিভোর্সের পরে নিজের বাবার জায়গা কাউকে দিতে পারেনি। মিলির আসল বাবা যেদিন মারা যান মিলিকে তার ফুপু নিয়ে গেছিলেন বাবাকে শেষ দেখা দেখাতে। কিন্তু মিলি সেদিন একদম কাঁদেনি। লোকজন মিলিকে দেখে বলেছিলো, কেমন মেয়ে বাবার লাশ দেখেও কাঁদেনা। আসলে মিলির বাবা মায়ের ডিভোর্সের পরে তারা যখন নানীর বাসায় গিয়ে উঠেছিলো তখন মামির খারাপ ব্যবহার দেখে প্রতিটা দিন এতো কেঁদেছে যে কান্না কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছিলো।
ছোট মামা একদিন মিলিকে ডেকে বললেন, তোর মায়ের বিয়ে। তারপর থেকে মিলি এ বাসায় থাকছে। অপরিচিত লোকটাকে বাবা ডেকেছে। মিলির নিজেকে সবসময় মনে হয়েছে সে অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপেছে। এটা তার মায়ের নতুন স্বামীর বাড়ি কিন্তু লোকটা তো তার বাবা না। লোকটার আগের স্ত্রীর যে দুটো ছেলে আছে তারা তো তার ভাই না। সে একজন বাইরের মানুষ। সবাই তাকে সে চোখেই দেখে। মিলির সতবাবা মারা যাবার পরে মিলি মা ও যেন বাইরের মানুষ হয়ে গেছেন। বড় ভাই বলেছেন এ বাসা ছেড়ে দিতে। এ বাসা তার মায়ের নামে। এখানে মিলিদের কোন অধিকার নেই। মিলি বুঝতে পারছেনা তারা এখন কোথায় যাবে। ফয়সালের সাথে বিয়ের পরে মিলি নাহয় ফয়সালের সাথে থাকবে কিন্তু তার মা। তিনি কোথায় থাকবেন।
–তুই করছিসটা কি। মন কোথায় তোর। চুলা নিভে ধোঁয়া বের হচ্ছে তো।
মায়ের কথা শুনে মিলি মায়ের দিকে তাকালো। সাদা শাড়িতে মায়ের বয়সটা যেন হুট করেই অনেক বেড়ে গেছে। কামরুন্নেছা মেয়ের হাত ধরে টেনে বললেন,
–যা ঘরে যা আমি রান্না করছি।
মিলি নিজের ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বড় ভাই আর মিলির ঘরটা পাশাপাশি। বড় ভাইয়ের কথাগুলো মিলি এ ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছে। বড় ভাই রাগী কণ্ঠে বলছেন, “বাড়ি থেকে কিভাবে যাবেনা সেটা আমিও দেখে নিবো। বাবা যখন তাদের নিয়ে আসলেন কিছু বলিনি। এটা আমার মায়ের বাসা। মায়ের সতীন কিভাবে থাকে দেখি।”
মিলির নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আজ যদি সে মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তাহলে একটা চাকরি যোগাড় করে মাকে ভাড়া বাসায় নিয়ে যেতো। কিন্তু কি করবে সে। ইন্টার পড়ুয়া গ্রামের একটা মেয়ের কিইবা করার আছে। একটা মানুষই এখন মিলির মন ভালো করতে পারে। সে হলো ফয়সাল। মিলি ফয়সালকে ফোন দিলো,
–হ্যালো মিলি…
-কি করছেন?
–এইতো ফার্মেসীতে বসে আছি। তুমি কি করছো।
-কিছুনা। আমার মন খারাপ।
–মন খারাপ কেন। কি হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে?
-আপনি আমাকে কবে নিয়ে যাবেন এখান থেকে?
–আসলে তোমার বাবা মারা যাবার পরে বাসা থেকে আমার বাসা থেকে বলছে কিছুদিন পরে বিয়ের বিষয়টা দেখা যাক।
-হুম…
কামরুন্নেছা বুঝতে পারছেন না তিনি এখন কি করবেন। আপাদত মায়ের বাসায় গিয়ে কিছুদিন থাকলে হয়। মিলির বিয়েটা হয়ে গেলে পরে কি করবেন সেটা ভেবে দেখা যাবে। মেয়েটার গায়ে হাত তোলার কারনে কামরুন্নেছার খারাপ লাগছে। টেবিলে ভাত রেখে কামরুন্নেছা মিলিকে ডাকতে গেলেন। মিলির ঘরে এসে দেখলেন মিলি ফোনে কথা বলছে। মিলির মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন ফোনের ওপাশে ফয়সাল। ফয়সালের সাথে কথা বলার সময় মিলির চোখে মুখে খুশি খেলা করে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এতো দুঃখে কষ্টেও যেন কামরুন্নেছা এক ধরনের প্রশান্তি পেলেন। তার দ্বিতীয় স্বামীর প্রতি অভিযোগগুলো যেন কিছুটা হালকা হয়ে যায়। মানুষটা তাদের জন্য কিছু রেখে না গেলেও মিলির জন্য যোগ্য ছেলে ঠিক করে রেখে গেছেন। হয়তো মানুষটা তার জন্যেও কিছু রেখে যেতেন কিন্তু সে সময়টা হয়তো পাননি। মানুষটার অনুপস্থিতিটা কেমন যেন পোড়াচ্ছে কামরুন্নেছাকে। মিলি এতোক্ষনে লক্ষ্য করলো তার মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি ফোনটা রাখতেই কামরুন্নেছা বললেন, আয় খেতে আয়।
সকালে মিলি ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হলো। বড় ভাবি পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত আসলেন। মিলিরা বাসা থেকে বের হওয়ার পরে দরজা লাগিয়ে দিলেন। কেউ ঠিকমতো বিদায়টাও জানালোনা। ফয়সালের ফার্মেসীর সামনে মিলি রিকশা থামালো। মিলিকে দেখে ফয়সাল বললো,
–ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
-মামার বাসায় যাচ্ছি। সেখানে থাকবো কিছুদিন। অতোদূর থেকে তো আপনার এখানে এসে দেখা করতে পারবোনা। আপনি আসবেন দেখা করতে কেমন?
–হুম…
-হুম কি? আর এটা কি শার্ট পরেছেন। লাল শার্টে আপনাকে জোকারের মতো লাগছে। এই শার্টটা পরবেন না কেমন?
–আচ্ছা ঠিক আছে।
-আর কিছু বলবেন না?
–সাবধানে যেয়ো। পৌঁছে ফোন দিয়ো।
-হুম…
মিলি চলে আসার আগে একবার থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনি যতোই ব্যস্ত থাকুন আমাকে দেখতে আসবেন কিন্তু। আমি অপেক্ষা করবো।
–আমি আসবো মিলি।
মিলি আসার পর থেকে মিলির মামাতো ভাই মিলির পেছন পেছন ঘুরছে। মিলিদের এ বাসায় আসায় একমাত্র সেই খুশি হয়েছে। মিলিকে নিজের খেলনাগুলো এনে এনে দেখাচ্ছে। কিন্তু ছোট মামি এসে বাচ্চাকে মারতে মারতে নিয়ে গেলেন। এখন তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে ছেলেকে বকছেন। মিলি বুঝতে পারছে তাদের আসার কারনে মামি মোটেও খুশি হননি। ছেলেকে বকাবকি করছেন ঠিকই কিন্তু কথাগুলো যে মিলি আর তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন সেটুকু মিলি বুঝতে পারছে।
ছোট মামা বাসায় ফিরে মাকে অনেক কথা শুনালেন। মিলির নানি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিই বা কি বলবেন। কোথাও জোর খাটাতেও টাকা লাগে। যাদের টাকা আছে তারাই বড় কথা বলতে পারে। বড় কথা তাদের মুখেই মানায়। মিলির ইচ্ছা করছিলো তখনই মাকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়। তাদের তো যাওয়ার কোন জায়গা নেই। মিলি রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়লো।
কামরুন্নেছার ঘুম আসছেনা। তিনি বারান্দায় হাঁটাহাটি করছেন। বাসাটা কতো বদলে গেছে। পূর্ব দিকের আম গাছটা এখনো আছে। বাকি সব গাছ কেটে ফেলেছে। টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে পাকা ঘর তুলেছে তার ছোট ভাই। কামরুন্নেছার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেলো। বারান্দায় কুপির আলোতে চার ভাইবোন পড়তে বসতো। বাবা সন্ধ্যায় বাসা ফেরার সময় মুড়ির নাড়ু নিয়ে আসতেন। রাতে খাওয়ার পরে বাবা চার ভাইবোনকে সাথে নিয়ে বারান্দায় পাটি পেতে বসে গল্প শোনাতেন। সেই দিনগুলো কতো দ্রুত হারিয়ে গেলো। কামরুন্নেছার বড় ভাইটা গতবছর মারা গেলেন। তার পরিবার ঢাকায় থাকছে। বড় বোন শশুড়বাড়িতে বেশ সুখেই আছে। ছোট ভাইটাও বেশ উন্নতি করেছে। শুধু তার জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। ঠিক বেদের জীবনের মতো। প্রথম স্বামীর ঘর করতে পারলোনা। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এসে উঠলো এ বাসায়। তারপর সবাই মিলে আরেকটা বিয়ে দিলো। আবারো সব গুছিয়ে অন্য বাড়িতে উঠলো। এখন আবার সেখান থেকে এখানে এসে উঠেছে। কি অদ্ভুত তার জীবন। কামরুন্নেছার চোখ ছলছল করছে।
মিলি ঘুমাচ্ছিলো। মায়ের ডাকাডাকিতে মিলির ঘুম ভাঙ্গলো। কামরুন্নেছা মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, মা হাত মুখ ধুয়ে শাড়িটা পরে নে। মিলি মায়ের কথা কিছু বুঝতে পারছেনা। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-কেন মা।
–তোর মামা ফোন করেছিলো। তোকে দেখতে আসছে।
-দেখতে আসছে মানে। ও আচ্ছা ফয়সালের পরিবার আসছে বুঝি?
কামরুন্নেছা মেয়ের কথার কি জবাব দিবেন বুঝতে পারছেন না। মিলি আবারো জিজ্ঞাসা করলো,
-ফয়সাল আসছে তাইনা মা?
–তোর মামাকে ফয়সালের কথা বলেছিলাম। তোর মামা ফয়সালের পরিবারের সাথে কথা বলেছে। তোর বাবা নাকি বলেছিলো, ফয়সালকে একটা বাইক দিবে। বাজারে বড় দোকান কিনে দিবে। তারা এসব না পেলে বিয়ে হবেনা।
-মা কি বলছো এসব। ফয়সাল তো কখনো আমাকে এসব বলেনি।
–আমি ফয়সালকে ফোন করেছিলাম। ফয়সাল বলেছে তার পরিবারের সাথে কথা বলতে। ফয়সালের সাথে কি তোর কথা হয়?
মায়ের কথা শুনে মিলি কিছুক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। ফয়সাল দুদিন ধরে তার ফোন ধরছেনা। এখানে আসার পর থেকে কেমন যেন এড়িয়ে চলছিলো তাকে। মিলি ফোনটা নিয়ে ফয়সালকে বারবার ফোন দিচ্ছে। প্রথমে ফোন রিং হলেও এখন ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।
মেহমানদের জন্য নাস্তা তৈরি করছিলো কামরুন্নেছা। মিলির মামি বললেন, আপা গিয়ে দেখেন মিলি রেডি হয়েছে কি না। কিছুক্ষনের মধ্যে মেহমান চলে আসবে। কামরুন্নেছা ঘরে এসে দেখলেন মিলি নেই। পুরো বাসা খুঁজে কোথাও মিলিকে পেলেন না। কাউকে ভয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। বললেন গালি খেতে হবে। সবাই এখন কথা শোনানোর জন্য একটা কারন পেলেই হলো।
মিলি ফয়সালের ফার্মেসীর সামনের বেঞ্চটাতে বসে ফয়সালের জন্য অপেক্ষা করছে। মিলি ফয়সালকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো। ফয়সাল মিলির দেয়া সেই হালকা গোলাপি হাফ শার্টটা পড়েছে। ফয়সালকে খুব সুন্দর লাগছে। মিলিকে দেখে ফয়সাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মিলি বললো,
-কেমন আছেন?
–ভালো তুমি?
-আমিও ভালো। দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে। নতুন শাড়ি পরেছি। আমাকে তো কখনো শাড়িতে দেখেননি আগে।
–হুম সুন্দর লাগছে।
-আচ্ছা আমাকে শাড়িতে বেশি ভালো লাগে নাকি থ্রি পিছে?
–শাড়িতে…
-আচ্ছা ঠিক আছে আমাদের বিয়ের পরে আমি সবসময় শাড়ি পরবো। কিন্তু আমার তো শাড়ি নেই। আপনি আমাকে শাড়ি কিনে দিবেন। ঠিক আছে?
–দেখ মিলি তুমি বাসায় যাও।
-কেন, এখানে থাকলে কি সমস্যা। আমি যাবোনা। এখানেই বসে থাকবো।
–এসব পাগলামির কোন মানে হয়না।
-আমার আপনার সাথে পাগলামি করতে ভালো লাগে।
ফয়সাল বুঝতে পারছেনা সে কি করবে। মিলি চুপচাপ বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফয়সাল কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরে বললো,
–মিলি আমি আসছি।
-আসবেন তো?
ফয়সাল কথার জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলো। যতোক্ষন ফয়সালকে দেখা যাচ্ছিলো মিলি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষন পরে ফয়সালের দোকানের ছোট ছেলেটা বললো, আপু আপনি বাসায় চলে যান। ফয়সাল ভাই আর আসবেনা। মিলি অবাক হলো। ছেলেটা আগে তাকে ভাবি ডাকতো এখন আপু ডাকছে। মিলি ছেলেটাকে বললো, তুমি না আগে আমাকে ভাবি ডাকতা। এখন আপু ডাকছো যে? ছেলেটা চুপ করে আছে। মিলি সন্ধ্যা পর্যন্ত ফয়সালের জন্য অপেক্ষা করলো। তারপর কিছুক্ষন সেখানে বসে কাঁদলো। আশেপাশের দোকানের লোকজন আর বাজারের লোকজনদের একটা ছোট খাটো ভীড় জমে গেলো মিলিকে ঘিরে।
মেরাজ অনেক কষ্টে মিলির মামা বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এসেছে। তাকে বসার জন্য একটা কাঠের চেয়ার দেয়া হয়েছে। চেয়ারে হেলান দিতেই ক্যাঁক্যাঁ শব্দ করে উঠলো। চেয়ারটা মনে হয় ভাঙ্গা। মিলির মা তাকে বসিয়ে চা আনতে গেছেন। মেরাজ এক মহিলার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনতে পেলেন, এই দুপুরে চা আবার কে খাবে।
মিলির মা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মেরাজ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আন্টি মিলি কোথায়?
কামরুন্নেছা বললেন, মিলির তো ওর শশুড় বাড়িতে। মিলির মায়ের কথা শুনে মেরাজের হাত থেকে চায়ের কাপটা পরে ভেঙ্গে গেলো। কামরুন্নেছা লক্ষ্য করলেন তার সামনে বসা ছেলেটার হাত কাঁপছে। মেরাজ নিজেকে সামলে বললো, পাত্র কে ফয়সাল? কামরুন্নেছা অবাক হলেন। এই ছেলে ফয়সালকে কিভাবে চিনে। তিনি প্রশ্ন করলেন,
–তুমি কে বাবা। তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
-আমি মিলির বন্ধু।
–ও… মিলির বিয়ে ফয়সালের সাথে হয়নি। ছেলে ওর মামার পছন্দের।
-কি বলেন এসব। কিন্তু মিলি তো ফয়সালকে ভালোবাসে মেরাজের কথা শেষ হবার আগেই মিলির মামি ঘরে ঢুকলেন। মেঝেতে কাপের ভাঙ্গা টুকরো দেখে বললেন, এসব কি। কাপ ভাঙ্গলো কিভাবে?
মেরাজ বাসা থেকে বের হয়ে আসলো। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। শেষমেষ মিলি সে হারিয়েই ফেললো। মিলিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তার।
মিলি ঘর গোছাচ্ছে। বিছানার উপর হাত পা ছাড়িয়ে তার স্বামী ঘুমাচ্ছে। মিলি নিঃশব্দে কাজ করার চেষ্টা করছে যাতে লোকটার ঘুম না ভেঙ্গে যায়। মিলি ঘর থেকে বের হচ্ছিলো ঠিক সেসময় লোকটা মিলির নাম ধরে ডাকলো। মিলির ইচ্ছা করছে দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু পারলোনা। লোকটা আবারো মিলির নাম ধরে ডাকলো। মিলি লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিলি একটাই প্রার্থনা করে যদি ফয়সাল এসে বলতো, মিলি আমি এসেছি। চলো আমার সাথে। আচ্ছা ফয়সাল কি তাকে কখনো ভালোবাসেনি। একটুও না। ফয়সালকে ছাড়া তার যে এতো কষ্ট হয়। ফয়সালের কি কখনো কষ্ট হয় তার জন্য। মিলির প্রশ্নগুলোর জবাব পায়না। শুধু চোখের জলের বিনিময়ে জীবনের কঠিন সত্যটা মেনে নিয়েছে সে।।