তিথিলার এখনো মনে আছে,যেদিন রফিকরা এসেছিলো তাকে দেখতে।সত্যি বলতে কি,প্রথম দেখাতেই পাত্র হিসেবে রফিককে পছন্দ হয়নি তিথিলার,তার মনে হয়েছিলো-ছেলেটা ওভারস্মার্ট। কিন্তু,তার পছন্দ-অপছন্দের কথা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেনি।কারণ,পাত্রী হিসেবে,তারাও তাকে পছন্দ করেনি।পছন্দ করেছে,তার জময বোন মিথিলাকে।
রফিক ছেলে হিসেবে মন্দ না।কোটিপতির বাবার একমাত্র সন্তান,দেখতেও বেশ।এমন,পাত্র কে হাতছাড়া করে!বাবার হালকা আপত্তি থাকলেও মায়ের এক কথা-তিথি তো ছেলেটার সাথে প্রেম করেনি,যে ছেলেটার সাথে মিথির বিয়ে দিলে তিথি কষ্ট পাবে!
মিথিলার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়ে যাবার পর মা অবশ্য চুপিচুপি তিথিলাকে জিজ্ঞেস করে “কিরে তিথি,তুই কিছু মনে করিসনিতো?কি করবো বল,ছেলেটা খুব ভালো,ওদিকে মিথিও রাজি।”
মায়ের কথা শুনে তিথি হাসতে হাসতে উত্তর দেয় “আরে,মা কি যে বল না তুমি! মন কেন খারাপ করবো?দুলাভাইয়ের সাথে কি আমার প্রেম ছিলো!আর,জানো মা,আমারও না,দুলাভাইকে মোটেও পছন্দ হয়নি।”
তিথির মা কি বুঝেছেন কে জানে! কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে, আর কথা বাড়ান না।
তিথি যতকথাই,বলুক না কেন?দিনশেষে, তার মন কেমন যেন খুঁত-খুঁত করে।হ্যাঁ,রফিক পাত্র হিসেবে মিথির জন্য পারফেক্ট,কিন্তু,মা-বাবা কি অন্য পাত্র দেখতে পারতেন না! বাংলাদেশে কি ভাল পাত্রের অভাব পড়েছে। পরক্ষণেই, নিজেকে নিজে গালি দেয় তিথিলা,ছিঃ,সে এতো হীন-মানসিকতা সম্পন্ন! তার নিজেরই তো বোন,বোনের খুশীতে তো তার খুশী হওয়া উচিত,আর সে তো! তার নাকি রফিককে পছন্দ হয়নি,এখন বোন বিয়ে করছে,তাও তার সহ্য হচ্ছে না! এসমস্ত কথা বলে নিজের মনকে নিজে প্রবোধ দেয় তিথি।কিন্তু দিন শেষে মনের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব হয় তিথিলার।
বিয়ের দিন তিথিলা আবিস্কার করে-তার গলা দিয়ে ভাত নামছে না! নাহ্,মিথির বিয়ে এ দুঃখে নয়।বরং, ক্লাবে আসার পর তিথি আবিস্কার করেছে-বরপক্ষের আত্মীয়গুলো তার সাথে পরিচিতো হচ্ছে,আর একটু দূরে গিয়ে ফিসফিস করে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।তিথিলা যেন তাদের মনের ভাষা পড়তে পারে,তার মনে হয় তারা বলছে “দেখ,দেখ এ মেয়েটাকে দেখতে গিয়েই রফিক,মিথিলাকে পছন্দ করেছে। ওরা নাকি,জময বোন তাও এত অমিল! এ মেয়েটার থেকে রফিকের বউ অনেক সুন্দর না?” তিথিলার কান্না পায়,কিন্তু এখানেতো কান্না করা যাবে না! এখন,কান্না করলে লোকেরা নির্ঘাত ভাববে মেয়েটা বোনের সুখও সহ্য করতে পারছে না।তার জায়গায় অন্য কারো বোন কাঁদলে হয়তো,মানুষ ভাবতো,বোনের বিরহে কাঁদছে,কিন্তু তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন।
জময বোন হওয়ার সুবাদে দুই বোনই সব-সময় একসাথে থাকতো,ঝগড়া-ঝাটিও হতো প্রচুর, মা হাসতেন, বলতেন-সমবয়সীতো, কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায়না।বিয়ের পর দুজন যখন দুদিকে যাবে,তখন কোথায় যাবে এ ঝগড়াঝাটি! যদিও, বিচারে মা মিথিলার পক্ষ নিতেন, তিথিলাকে মা আদর করে বলতেন-তুই বড় না,ছোটবোনকে তুই আদর না করলে কে করবে? মায়ের কথা শুনে,তিথিলা কখনো-কখনো বড় বোন সুলভ আচরণ করলেও মাঝে-মধ্যে তিথিলার রাগ উঠতো।কিসের বড় বোন!মাত্র পাঁচ-মিনিটের ব্যাবধান।মাঝেমধ্যে তার মনে হতো,মিথি তার থেকে সুন্দর বিধায়, মা মিথির পক্ষ নিয়েছে,মিথি যদি তার পাঁচ-মিনিটের বড় হতো,তাহলে হয়তো মা বলতো-তুই ছোট না,বড়-বোনের কথা তুই না শুনলে,কে শুনবে? মনে মনে তিথিলা তখন মা আর মিথিলার মুন্ডুপাত করতো।
মিথিলার বিয়ের পর তিথিলার মনে হয় মা ভুল বলেছেন, যদিও ছোটবেলার মত তারা দু-বোন এখন কথার মাধ্যমে ঝগড়া করে না,তারা এখন ইশারায় ঝগড়া করে! ছোটবেলায় ঝগড়া করতে যেমন উপলক্ষ্য লাগতো না,তেমনি মিল হতেও সময় লাগতো না।কিন্তু,এখন তিথিলার মনে হচ্ছে তারা ছোটবেলার মতো এখনও কোন কারণ ছাড়াই ঝগড়া করছে,কিন্তু, ছোটবেলার মতো তারা সহজে একে অপরের সাথে মিশতে পারছে না। উঁহু, কোন কারণ ছাড়া তারা ইশারায় ঝগড়া করে,একথা বললে মিথ্যা হবে।তিথিলা লক্ষ্য করেছে,মিথির বিয়ের পর থেকে মিথিলা তাকে কেমন যেন এড়িয়ে চলে।কারণটা বুঝতে তিথিলার কষ্ট হয়।কখনো কখনো তিথিলার মনে হয়,মিথি নয়,বরং সেই মিথিলাকে এড়িয়ে চলছে।
তিথিলার সবচেয়ে বেশী বিরক্ত লাগে,যখন মিথির জামাই এখানে বেড়াতে আসে,বেচারার শ্বশুর বাড়ী,সে বেড়াতে আসতেই পারে।কিন্তু ঐ মুহূর্তে ঠিক কোন ধরনের আচরণ করলে সবার মন-রক্ষা করা যাবে সেটা তিথিলার মাথায় আসে না।প্রথমবার,যখন রফিক এসেছিলো,তখন তিথিলার ইচ্ছা না হলেও সৌজন্যতার খাতীরে দেখা করতে গিয়েছিলো, ভাইয়া,কেমন আছেন?বাসার সবাই ভালো আছে? এ টাইপের সাধারণ কিছু কথাবার্তা বলে সে বসার রুম থেকে সটকে পড়েছিলো। কিন্তু,মিথির কেন জানি তার ব্যাবহার ভালো লাগেনি।সে নাকি! মিথির বরের সাথে ফ্লাটিং করেছে।সরাসরি যদিও মিথি একথা বলেনি।কিন্তু, আকার-ইঙ্গিতে, মায়ের মাধ্যমে, এসব কথা মিথিলা ঠিকই তিথিলার কানে পৌছাতে পেরেছে।প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলো তিথিলা এসব কথা শুনে।সে কেন,মিথির বরের সাথে ফ্লাটিং করতে যাবে?মিথির বর,বরং তার সাথে ফাজলামি করছিলো, ঐসময় তার খুব বিরক্ত লাগছিলো, মিথির বরকে কোনমত বুঝ দিয়ে সে ওখান থেকে চলে এসেছিলো।যদিও মিথির বর এমন কোন ফাজলামি করেনি,যার জন্য মিথির রাগ করা উচিত।তাদের খালাতো বোনের বর তিথিলা-মিথিলার সাথে এরচেয়ে ও বেশি মজা করেন।
এ ঘটনার পর তিথি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো,মিথির বরের সামনে আর যাবে না।কিন্তু পরেরবার যখন রফিক আসার পর তিথি তার সাথে দেখা করেনি,তখন শুরু হল, আরেক নাটক!সে নাকি,মিথিকে অপমান করেছে।মিথিলাতো কেঁদে-কেটে অস্থির।তিথি,নাকি মিথিকে শাস্তি দিচ্ছে! রফিককে বিয়ে করার শাস্তি!
এটাতো গেল এক ঘটনা,আর এমন কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বোনের সাথে তার এখন ঝগড়া হয়!মা,তো সেদিন বলেই ফেললেন তুই ও যদি বোনকে হিংসে করিস! মায়ের কথা শুনে তিথিলার মনটা যেন দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলো, তার মা তার সম্পর্কে এধরনের ধারণা পোষণ করে! কেন হিংসে করবে সে তার বোনকে? রফিকের জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না তিথিলা।
কোন ছেলের সাথে তিথিলার বিয়ের কথা-বার্তা চললে তিথিলা তাকে একটা প্রশ্ন করে,যদিও এ পর্যন্ত কোন ছেলেই তাকে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। আজকেও সে একই প্রশ্ন শিহাব নামের ছেলেটাকে করবে। “আচ্ছা,বলুন তো আপনি মেয়ে দেখতে গেলেন,কিন্তু,মেয়ে আপনার পছন্দ হলো না,পছন্দ হলো, তার বোনকে,তখন আপনি কি করবেন?” চায়ের কাপ নিয়ে খেলা করতে করতে তিথিলা প্রশ্ন করে শিহাবকে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শিহাব বলে “কি আর করবো,ঐ বাড়িতে বিয়ে আমার কপালে নেই।”
“কেন?যাকে আপনার পছন্দ হয়েছে,তাকে বিয়ে করার জন্য আপনি প্রস্তাব দিবেন না?” একটু উৎসুক স্বরে জানতে চায় তিথিলা। “কি যে বলেন, আমি প্রস্তাব দিলেও কি,না দিলেও কি! কোন পরিবার কি এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হবে নাকি?” হালকা মেজাজে উত্তর দেয় শিহাব। “কেন?কেন,রাজি হবে না?”আগ্রহভরা কন্ঠে প্রশ্ন করে তিথি। তিথির আগ্রহ দেখে যেন, একটু অবাক হয় শিহাব।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে “রাজি কেন হবে।একজনকে দেখতে গিয়ে আরেকজনকে পছন্দ করাটা কি,যাকে দেখতে গিয়েছি,তাকে অপমান করা নয়? আর কোন পরিবার কি মেয়ের এ অপমান মেনে নিবে।”
হঠাৎ,তিথিলা ঝরঝর করে কেঁদে দেয়,হ্যাঁ, অপমান,অপমানই সে হয়েছে।দেড়টা বছর ধরে সে অপমানিত হচ্ছে।বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে,তার বোন তার থেকে সুন্দরী। কই,তার পরিবারের কেউ তো কখনো বলেনি, মিথির বিয়ে রফিকের সাথে দেয়ার মাধ্যমে তিথিকে অপমানিত করা হয়েছে!বরং, সবাই তো বলে-তিথি, মিথিকে হিংসা করে!মিথিকে রফিক বিয়ে করেছে তো এ কারণে! আজ কোথাকার কোন ছেলে, তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো,তাকে অপমান করা হয়েছে,সত্যিই অপমান করা হয়েছে।