তিনতলা বাড়িটাতে, নীচের তলার ভাড়াটিয়া সেতু আর রাশেদ এর মধ্যে তুলকালাম ঝগড়া চলছে রাত দশটায়, খাবার টেবিলে। “তরকারিতে লবণ কম হয়েছে। ” খেতে খেতে রাশেদ বলে উঠে। “কম হলে লবণ দানি রাখা আছে, নিয়ে খাও।” সেতু’র বাঁকা জবাব। “তুমি জানোনা, আমি ছিটা লবণ খাইনা!” রাশেদের মেজাজ গরম হতে শুরু করে। “না খেলে লবণ ছাড়া খাও।” সেতু পাত্তাই দেয়না। ” লবণ কম দিয়েছো, আবার ঝাঁজালো কথা বলছো কি ভেবে!” উত্তেজনায় কাঁপা স্বর তার। “রাঁধবো বাড়বো, আবার কথাও শুনবো, তা কেনো?” সেতুও রাগে গরগর করতে বলে। তারপর তারপর, অর্ধেক খাওয়া, বাটি উল্টিয়ে ফেলা, মাটিতে ঝনঝন চামচ পড়ার শব্দ। বিছানায় ঘুমন্ত বাচ্চা মেয়েটি হঠাৎ ঘুম ভাঙায়, চিল্লানি দিয়ে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। সেতু দৌড়ে গিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামায় তার।
রাশেদ রাগে গজগজ করতে থাকে। কিন্তু চিৎকার আর করেনা। মেয়ে উঠে যাওয়ায়, সে কিছুটা দু:খিত হয়। অনেক কষ্টে হেঁটে হেঁটে তাকে ঘুম পাড়িয়েছিলো সেতু। সেতু এসব পরিষ্কার না করেই, মেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। মেয়ের মুখে বুকের দুধ পুড়ে দেয়। সেতু আর রাশেদ, দুইজনেরই মনে হয়, বিয়ের আগে দীর্ঘ তিন বছরের প্রেমের কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। দুইজনই কেমন খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। অথচ, বিয়ের বয়স, প্রেমের বয়সের চেয়েও কম! পাশের ফ্লাটে অসুস্থ রমিজা খাতুন খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। সেতু’র ঘরের দেয়ালের ঐপাশের রুমটাতেই তার ঘর। স্বামীহীন এই বৃদ্ধা, দুই তিনবার করে ছেলে আর ছেলে বউয়ের নাম ধরেও ডেকেছেন। ঐ ফ্লাটে কি হচ্ছে, তা দেখার জন্য। ছেলেকে বলতে হবে, তাকে প্রয়োজনে ড্রয়িংরুমে বিছানা করে দিতে, এই রুমে আর নয়। প্রতিদিন ঐ বাসায় ঝগড়া, বাসন মারামারি, সব তার কানে আসে।
তাদের করা শব্দ মাথার ভেতর ঢুকে যায়। বাকি রাত ঐ ঝনঝন শব্দ মাথার ভেতর বাজতে থাকে, থামতে চায়না। মৃত্যু রোগের আলামত, নইলে এমন হবে কেনো! বউ বা ছেলে একজনও আসছেনা। রঙঢঙ করছে মনে হয়! রাগ লাগে তার, তাই মনে মনে গালি পাড়ে। ভাবে, বুড়ি হয়ে যাওয়ায়, আর কেউ পাত্তা দিচ্ছেনা। একমাস হলো, বড় ছেলের বাসা থেকে ছোট ছেলের বাসায় এসেছে। কাল বিকেলে মেজ ছেলে আসবে, নিয়ে যেতে। প্রতি এক মাস, একেক ছেলের ঘরে থাকেন তিনি। চার ছেলের বাসায় ঘুরে ঘুরে নিয়ে রাখে। বুড়া মরার পর থেকে এই করে তার দিন কাটছে।
সবার সামর্থ্য আছে একেবারে রেখে দেয়ার। কিন্তু বুড়া মানুষকে মনে হয় একনাগাড়ে এতোদিন কারো সহ্য হয়না। অবশ্য কেউই তার সাথে বেয়াদবি করেনা, এটা একটা ভালো দিক। রমিজা খাতুন, অস্ফুটস্বরে আরেকবার ছেলে বউকে ডাকেন। ঐ ঘরে আওয়াজ কবেই থেমে গেছে, এরপরেও কথাটা না বলে তিনি ঘুমাতে পারছেননা। সারারাত শব্দের মতো না বলতে পারার জ্বালাটাও মাথায় থেকে যাবে। “অ বউ অ বউ…” বউ অনেক কষ্টে আসে, সে পোয়াতি। সাত মাস চলছে। “জ্বি মা, বলেন।” “ডাকি শোনো নাই?” বিরক্ত হয়েই জানতে চান। “বাথরুমে ছিলাম।”
“আইচ্ছা শোন, পরের বার আসলে আমি কিন্তু এই রুমে থাকবোনা। ঐ ঘরের চিল্লানি সারারাত আমার মাথায় ঘুরে। ঠিক আছে?” “জ্বি, আপনার ছেলেকে বলবো। আর কিছু বলবেন?” ” না, যাও। আচ্ছা দাঁড়াও, ওষুধের ডিব্বা থেকে প্যারাসিটেমল দিয়ে যাও, কোমর ব্যথা বাড়ছে।” বিল্ডিং এর উপরতলায় বাস,আশরাফ সাহেবের। তিনি পরিবারের সবার উপর খুবই বিরক্ত। দুই তলার দুইটা ফ্লাটই তিনি ভাড়া নিয়েছেন। ছেলেমেয়ে সব বড় হয়ে গেছে, এক ফ্লাটে হয়না। আর এই বড় হয়ে যাওয়ায় কেউই কথা শুনছেনা। বড় ছেলে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে, বাসায় যতক্ষণ থাকে, রুম থাকে সারাক্ষণ। তাও দরজা বন্ধ করে। মেয়ে একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে, তার রুমও ভেতর থেকে বন্ধ থাকে সবসময়। আরেক ছেলে কলেজে পড়ে। সে থাকে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। বাসায় থাকলে পড়ালেখার চাইতে, ল্যাপটপ, মোবাইল, মুভি এসব নিয়ে বেশি সময় কাটে তার। তাদের মা, তার সবকিছুতেই উদাসীনতা। ঘর অগোছালো থাকলেও গল্প বই নিয়ে পড়ে থাকবে। গল্পবইই যেন তার পৃথিবী। নিজের হাতে কাজ করার চেয়ে বুয়া নির্ভরশীলতা বেশি তার। তাই সব ছেলেমেয়ে এমন হয়েছে, আশরাফ সাহেব ভাবেন।
স্বামী, সন্তান, সংসার সব ভেসে যাক, তার তাতে কিছুই যায় আসেনা। এভাবে ত্রিশ বছর পার করলেন আশরাফ সাহেব। অতীতে বউয়ের এই স্বভাব মধু’র মতো লাগতো তার। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়, টাকা বানানোর চিন্তায় সংসারে সময় দিতে পারতেননা তিনি। বউয়েরও কোনো উচ্চ বাচ্য ছিলোনা তাতে। কিন্তু এখনো তিনি সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে ছয়দিন, সারাদিনই ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। একটা দিন সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন, তাও পাননা। বয়স হবার সাথে সাথে সবার সান্নিধ্য পাওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে তার। কিন্তু তাতে কি! অন্যদের এক বিন্দু আগ্রহ নেই, তার প্রতি। তাই রাতের দশটায় মলিন মুখে টিভি’র রিমোট হাতে চ্যানেল বদলাচ্ছেন।
তিনি মনে মনে খুব চাইছেন, বউ পাশে এসে বসুক। সাথে বসে একটা নাটক দেখুক। বাচ্চারা ছোটবেলার মতো হৈহৈ না করলেও কিছুক্ষণ আশেপাশে থাকুক, সামান্য কথাবার্তা বলুক। কিচ্ছুই তার মনের মতো হয়না আজকাল। তৃতীয় তলায়, মামুনদের বাসায় তার মামা মামি বেড়াতে এসেছেন। সে খুব খুশি। পুরো বাসা রান্নার খুশবোতে মৌ মৌ করছে। মামুনের খুব খিদে পেয়ে গেলো। এমনিতেই তাকে সাড়ে নয়টার ভেতর ভাত খেতে দেয় মা। আজ দশটা পেরিয়ে যাচ্ছে, মায়ের খবর নেই। সে ছোট্ট মামাতো ভাইয়ের সাথে খেলছিলো এতোক্ষণ। খেলা ফেলে রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি মারে। মা রান্নায় এখনো ব্যস্ত! সাত বছরের মামুন তার উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। “আম্মু বেশি খিদে পেয়েছে।”
“আরেকটু বাবা, দেখছোনা, ঘরে মেহমান।” তিনি সান্ত্বনার সুরে বলেন। “আমার খিদে লেগেছে তো।” মামুন ক্ষুধায় অস্থির। “পাঁচ মিনিট সোনা, পোলাওটা নামিয়ে এখনই দিচ্ছি। তোমার মামারা শুনলে বলবে, মামুন রাক্ষুসে ছেলে, আগে খেয়ে নিয়েছে। বেবির সাথে আরেকটু খেলো, যাও মানিক ছেলে।” মামুন অনিচ্ছায় আবার খেলতে চলে যায়। মামি, তার বরকে বলে, “আমরা কিন্তু যতো রাতই হোক, চলে যাবো, ঠিক আছে?” “আপা কি যেতে দিবে! বাবুর ঠাণ্ডা লেগে যাবেতো।” মামুনের মামা বলেন। “তোমার থাকার ইচ্ছে আছে, তাই বলো।
এখানে থাকলে, তোমার থেকে আলাদা হয়ে, আপার সাথে থাকতে হয়। রুম কম। আমার অস্বস্তি হয় খুব।” “ধুর, মাত্র তো একটি রাত, কিচ্ছু হবেনা। আদর করেই থাকতে বলে, বুঝছো? দেখছোনা, আপা তোমার জন্য কতো কিছু রাঁধছে মামুনদের পাশের ফ্লাটটা চৈতালি’র। কয়দিন আগেই এক্সিডেন্ট করে তার বর স্বর্গে চলে গেছেন। চৈতালিও হয়তো আর বেশিদিন এই বাসায় থাকতে পারবেনা। চৈতালি’র মা বাবা, তাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে ফেলে যেতে মন চাইছেনা। মাত্র দুইবছরের মাথায় বরটি চলে গেলো! বাচ্চাকাচ্চাও হয়নি তাদের। শ্বশুররাও গ্রামে চলে যাবে, এতো ভাড়া দিয়ে কে পড়ে থাকবে এখানে! চৈতালি’র আজ বড্ড মন খারাপ।
তার বরের প্রাণপ্রিয় বন্ধুটি আজ তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে! সে ফোন কেটে দিয়ে তাকে ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছে আর মনে মনে ইচ্ছামত গালিও দিয়েছে। আজ খেতেও ইচ্ছে করছেনা চৈতালি’র। ভাবছে উপোষ দেবে। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে খাইয়ে দিয়েছে সে, রাত নয়টা হতেই। তারা গ্রামের মানুষ। তাড়াতাড়ি খেয়েই শুয়ে পড়েন। সে পরে খাবে বলেও খেলোনা। তার খুব ইচ্ছে করছে ছাদে যেতে। চৈতালিরা সবার উপরের ঘরে থাকায়, তাদের ছাদে যাবার সুবিধা খুব বেশি। চৈতালি, তার বরের সাথে প্রায়ই যেতো। অনেকক্ষণ গল্প করে, অনেক রাত করে ফিরতো তারা। অবশ্য পরের দিন যদি বরের ছুটি থাকতো। আজ তার বরকে বড্ড বেশি মনে পড়ছে! চৈতালি, বুকে বালিশ চেপে হুহু করে কাঁদতে থাকে।
হঠাৎ পুরো বিল্ডিং টা দোলে উঠলো। চোখের পলকেই হুড়মুড় করে, তিনতলা’র বিল্ডিংটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ছোট একখানা পাহাড়সম ময়লা আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয় যেন। স্তুপের নিচে কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি। আচ্ছা, মৃত্যুর আগে, সেতু রাশেদের কি সন্ধি হয়েছিলো? বাচ্চা মেয়েটির মুখে কি তখনো দুধের বোঁটা ছিলো? আচ্ছা, রমিজা খাতুনের অন্যান্য সন্তানেরা কি তার মৃত্যুতে শান্তিবোধ করেছিলো নাকি মাকে নিয়ে যেতে না পারার আফসোস ছিলো তাদের? রমিজা খাতুনের ছোট বউ কি তৎক্ষণাৎ তলপেটে হাত দেয়নি নিজের মাথা না বাঁচিয়ে অনাগত সন্তানটির দুশ্চিন্তায়?
মামুন কি ভাত খেতে পেরেছিলো কিংবা মায়ের মনে কি একবার চিন্তা এসেছিলো, আহা, আমার ছেলেটাকে তো খাওয়াতে পারলামনা! চৈতালি মরে যাওয়ায় কি ভালো হলো? আর তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির চলে যাওয়াটা? এমন কোনো দূর্ঘটনায় হঠাৎ এতোগুলো মানুষ মারা গেলে খুব জানতে ইচ্ছে করে, মৃত্যুর কিছু আগের সময়টাতে তারা কে কি করছিলো, কেমন লেগেছিলো তাদের! অনেকসময় তা বর্ণনা করার জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকেনা।