প্রত্যয়

প্রত্যয়

প্রত্যয় আর না করতে পারল না।মিজান আহমেদ সম্পর্কে অফিসের বস হলেও তিনি সব সময় ওকে নিজের ছেলের মতোই দেখে এসেছেন।আজ ওনি এতবার করে যখন বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন তখন প্রথমে কয়েকবার ইনিবিনি করলেও পরে তাকে ঠিকই রাজি হতে হল।এমন মায়া নিয়ে কেউ ওকে কোনো কথা বললে সেকথা কখনোই ফেলতে ইচ্ছে করে না।আবার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা রাখতেও ইচ্ছে করে না।কি একটা অবস্থা।

পাজেরো গাড়িটা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের সামনে এসে থামল।সময়টা রাতের বেলা হলেও বাড়িটা যে রাজকীয় তা প্রত্যয়ের কাছে স্পষ্ট!বাড়ির ভেতর ঢুকে প্রত্যয় ধাক্কার মতো খেল।মনে হচ্ছে সাদা মেঘের কোনো দলের ভেতর ঢুকে পড়েছে সে।বাড়ির ভেতরের দু একটা জিনিস বাদে প্রায় সব কিছুই ধবধবে সাদা!কি অদ্ভুত সুন্দর্য!প্রত্যয় সিঁড়ির দিকে তাঁকাল!বয়স আনুমানিক ২০-২২ হবে,সাদা চুরিদার পড়া চমৎকার সুন্দর্যের অধিকারী একটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।মেয়েটিকে মেঘরাজ্যের রাজকন্যার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।প্রত্যয় অনুমান করলো,এটিই মিজান আহমেদের একমাএ মেয়ে।আর খুব ভূল না হলে মেয়েটির নাম রুমি।মিজান আহমেদ প্রায় প্রায়ই মেয়ের ব্যাপারে বলতেন।মেয়ের ব্যাপারে ওনি যা বলতেন তা যে কানায় কানায় পরিপূর্ণ সত্য তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না প্রত্যয়ের। রুমি সামনে এসে বেশ সহজ গলায় বলল,

– আপনিই নিশ্চই প্রত্যয় সাহেব?কেমন আছেন আপনি?বাবা আপনার কথা প্রায়ই বলেন।প্রায়ই বলেন বললে ভূল হবে ওনার মুখে আপনার প্রশংসা শুনতে শুনতে আপনার উপর আমার হিংসে ধরে গিয়েছিলো।আপনি এই,আপনি সেই, আপনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ,কাজের ব্যাপারে আপনার সামান্যতম কোনো ভূলও তিনি আজ পর্যন্ত ধরতে পারেন নি।বাবা এও বলেছেন,বিয়ে-শাদী, সংসারী জীবন নিয়ে আপনার নাকি বিশেষ ধরনের এলার্জি আছে।মেয়েলি ব্যাপার থেকে আপনি যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কথা শেষ করেই রুমি হাসল।প্রত্যয় কিছুটা লজ্জা পেল।মেয়েটা যে মিশুক প্রকৃতির তা সচ্ছ পানির মত পরিষ্কার।তারথেকেও বড় কথা,অন্যান্য বড়লোকি মেয়েদের মাঝে সাধারনত যে সব বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয় সেসবের বিন্দুমাত্র এই মেয়েটির মাঝে নেই। মিজান আহমেদ বিরক্তির সুরে বললেন,

– আহা,কি শুরু করলি!প্রত্যয় তুমি এসো। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হবে এসো। খাবার টেবিল রকমারি খাবারে সাঁজানো।প্রত্যয়ের মনে হল আজ এখানে না আসলে বোধহয় বড় ধরনের ভূলই হত।কেনো হত তার পেছনে বেশ কয়েকটা লজিক আছে।লজিক গুলো সব পেটেই এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেরাচ্ছে।গুছানো যাচ্ছে না।তাই আপাদত লজিকের ব্যাপারটা বাদ।রুমি মেয়েটা নিজেই খাবার বেড়ে দিচ্ছে।খাবার বেড়ে দিতে দিতে মিষ্টি গলায় বলল,

– প্রায় বৃহস্পতিবারেই অফিসে যাওয়ার আগে বাবা বলে যান,ছেলেটাকে দাওয়াত করব।আপনাকে বোধহয় আর বলেন না।না কি বলেন, আপনিই আসেন না? প্রত্যয় আবার লজ্জা পেল।মেয়েটি কেমন মিষ্টি ও ফুরফুরে গলায় কথা বলছে।কথায় কোন প্রকার আড়ষ্ঠতা নেই আর ও কিনা লজ্জা পাচ্ছে এটাই তো বড় লজ্জার ব্যাপার।প্রত্যয় সহজ হবার জন্য বলল,

– তুমি কিসে পড়?
– এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিক্সে পড়ছি।
– ওহ আচ্ছা,বেশ ভালো। রুমিকে চমকে দিয়ে প্রত্যয় আবার বলল,

– তুমি যেমন ভাবছ তেমনটা নয়।আমি কারো মনের কথাই বলতে পারি না।আঁধারে ঢীল ছুরলে মাঝেমাঝে লেগে যায় এই আর কি।আমার মধ্যে একটা ক্ষমতাই আছে।তা হল,আমি নির্লিপ্ত।আর এই নির্লিপ্ততা সাধারন কোন কোনো ক্ষমতা নয়।এছাড়া আমার মধ্যে অস্বাভাবিক এমন কোনো ক্ষমতা নেই যেমনটা মানুষ ধারনা করে।

মিজান আহমেদ সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ করে হেসে উঠলেন।রুমি চোখ বড় বড় করে তাকাল।কি অদ্ভুত মানুষ!কি অদ্ভুত কথা!গড়গড় করে সব কথা বলে দিল, আবার বলে মনের কথা বলতে পারি না!এমন মানুষ নিয়ে তো বিপদের শেষ নেই।মহা যন্ত্রণা! রুমি রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে প্রত্যয়কে পর্যবেক্ষক করছে।কি তিক্ষ্ণ দুটি চোখ।মুখে কি গভীর মায়া!একটা মানুষের মুখে এতো মায়া এর আগে ও কখনো দেখে নি। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে প্রত্যয় মিজান আহমেদের উদ্দেশ্যে বলল,

– স্যার,আজ তাহলে উঠি।
– আজকে রাতটা এখানেই থেকে যাওয়া যায় না?
– অবশ্যই যায় স্যার!তবে থাকব না।দুটো কারন আছে বলব? মিজাদ আহমেদ হাই তুলতে তুলতে বললেন,
– না বলবে না!শেষে দেখা গেলো এমন দুটি উদ্ভট কারন বললে যা শুনেও টেনশনে পড়ে যাব। রুমি আবার হাসল!কি অদ্ভুত সুন্দর সে হাসি।সে মিষ্টি ফুরফুরে গলায় বলল,
– আরেক দিন কিন্তুু আপনি আসবেন।আসবেন তো?
– আসব।

প্রত্যয় মিজান আহমেদের রাজকীয় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামল।অনেকদিন “ব্লেড সামছুর” সাথে দেখা হয় না।আজ কোনো ভাবে হলে মন্দ হত না।রাত সাড়ে এগারো টার দিকে ব্লেড সামছুর দেখা মিলল। ফার্মগেট ওভার ব্রিজে ঝিম মেরে বসে একের পর এক সিগেরেটে টান দিচ্ছে আর ফরফর করে উপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে।প্রত্যয় খুশিতে গদগদ এমন একটা ভাব নিয়ে ব্লেড সামছুকে ডাকল!বলল,

– ব্লেড সামছু ভাই!কেমন আছি? ব্লেড সামছু নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল। মূহুর্তেই তার চোখ চকচক করে উঠল।চোখ চকচক করলেও সে গলা ভারী করে বলল,
– প্রত্যয় ভাই,আপনে যে কি জ্বালায় ফালাইছেন আমারে।আমারে আর ব্লেড সামছু ডাইকেন না।আমি আর ব্লেড সামছু নাই।আমি এহন ঘ্যাচ সামছু।
– ঘ্যাচ সামছু আবার কি? ব্লেড সামছু ছোট খাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– ভাই আপনে তো জানেনই ছোট ছোট পুলাইপানে যেমনে ব্লেড দিয়া গাছের কচি কচি পাতা কাটে আমার কাছে মানুষ কাটা ছিলো হেইরহম।ব্লেড দিয়া মাইনসের গলায় পুছ মারা আছিল আমার কাছে ভাতমাছ।কিন্তুু আপনে হেইদিন কি কি কথা মাথার মধ্যে ঢুকাইলেন তহন থেইকাই যত গুন্ডগুল।মাইনসে ঠিকই কয়,আপনের কথা হুনলেও বিপদ না হুনলেও বিপদ।এহন ব্লেড হাতে নিয়া মাইনসের গলায় পুছ মারার কথা চিন্তা করলেও আত্মায় ঘ্যাচ কইরা উঠে।শরীরের পশম খারাইয়া যায়।কাউরে একটা চড়ও মারতে পারি না ময়া লাগে।এজন্যই এহন আমি ঘ্যাচ সামছু।বুঝবার পারছেন?

– হুঁ, পারছি একটু।সিগেরেট আছে? সিগেরেট দাও খাব! ব্লেপ সামছু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগেরেট বের করে দিল।প্রত্যয় সিগেরেট ধরাতে ধরাতে বলল,
– তো এখন কি করছ?চলছ কিভাবে?
– কিছু করছি না ভাই।কাম ধান্দা সব বন্ধ।কিছু পারিও না যে করে কেটে খাব।ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই ভাই।

– ভাল চিন্তা।আমাদের দেশে ভিক্ষা কিন্তুু হেলা ফেলার কিছু না।বড় বড় যে পীর ফকির এই ধর,তালা বাবা,ছালা বাবা,মালা বাবা,এরাও কিন্তুু ভিক্ষা করে।তবে এদের ভিক্ষার ধরন আলাদা।এরা ভিক্ষা করে সম্মানের সাথে।এরা ভিক্ষুক হিসেবে না,এরা পরিচিত ফকির বাবা হিসেবে।তাই তুমিও শংকামুক্ত হয়ে এই প্রোফেশন বেঁছে নিতে পার। তবে একটা কাজ করলে তোমার বিজসেট টা আরো সমৃদ্ধ হবে।আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপা আছে।ওনার দু চোখেই সমস্যা।তোমার চোখ দুটো ওনাকে ট্রান্সপ্লান্ট করলে তুমিও বিশেষ বিশেষ দিক দিয়ে উপকৃত হবে সাথে ফুপাও।প্রথমত, তোমার ভিক্ষা বিজনেস টা জোড়ালো হবে।কারন তোমার দুটো চোখই না থাকায় তুমি খুব সহজেই পাব্লিকের মায়া আকর্ষন করতে পারবে।দ্বিতীয়ত, ফুপা জীবনে অনেক টাকা পয়সাই রোজগার করেছেন।খুশি হয়ে ওনি তোমাকে বেশ মোটা অংকের টাকাও দিয়ে দিতে পারে।যার কারনে তুমি চাইলে ভিক্ষা চিন্তা বাদ দিয়ে মাথায় অন্য কোন চিন্তাও আনতে পার।তৃতীয়ত,ফুপা একজন ধার্মিক মানুষ।ওনি তোমার চোখ দিয়ে যত সোয়াব অর্জন করবেন তার একটা অংশ তুমিও পাবে।আরো অনেক ভাল দিক আছে যা চিন্তা করলেই বেরিয়ে আসবে।

ব্লেড সামছু ভীত চোখে তাকাল। ভাবছে লোকটা আসলেই ভয়ংকর কসিমের!এর মাথায় কখন কি চলছে বুঝা মুশকিল। আর কিছুক্ষন পর হয়তো ওর নিজের চিন্তাশক্তিও লোপ পাবে।পাশে বসা এই মানুষটা এমন ভয়ংকর ভয়ংকর কথা বলবে যে ও নিজেই ঢ্যাংঢ্যাং করে নাচতে নাচতে বলবে, প্রত্যয় ভাই,চলুন তাহলে চোখ দুটো দিয়েই আসি।ব্লেড সামছু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে,এখন সে এমন একটা ভৌ দৌড় লাগাবে যে এক দৌড়ে পগার পার।ব্লেড সামছুর দৌড়ের প্ল্যান কাজে দিল না।প্রত্যয় সিগেরেটের আগুন নেভাবে নেভাবে বলল,

– আমি একটা বাড়ির ঠিকানা দিচ্ছি।বাড়ির মালিকের নাম মিজান আহমেদ। ভাল মানুষ।তুমি গিয়ে ওনার সাথে দেখা করবে আর বলবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি।আমি তোমার ব্যাপারে বলে রাখব। ব্লেড সামছুর খুশিতে বিষম খাওয়ার মত অবস্থা।সে অত্যান্ত আনন্দের বিষম খেতে খেতে বলল,

– করুম ভাই।অবশ্যই দেখা করুম।আপনের কথা কি কমু?কমু যে প্রত্যয় স্যার পাঠাইছে?
– স্যার বলতে হবে না।বলবে প্রত্যয় ভাই পাঠাইছে!ভাল কথা,ওখানে গিয়ে তো আবার কচুকাটা সামছু হয়ে উঠবে না?
– কচুকাটা সামছু কি ভাই?
– কচুকাটা সামছু হল,মনে কর তুমি মালদার পার্টি দেখে নিজের আগের অবতার ধারন করলে।সব কচুকাটা করে ব্যাগ বোছকা গুছিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে। তখন তো আমি পড়ে যাব মহামুশকিলে! ব্লেড সামছু করুন চোখে তাকাল।অথচ তার চোখে মুখে আনন্দের হাসি।কুৎসিত কোনো হাসি নয়।ভালো মানুষের হাসি।কৃতজ্ঞতার হাসি।রাত হলেও সামছুর চোখের জল চিকচিক করতে দেখা যাচ্ছে।

– এই,চল না কদিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসি।
-হুঁ,অবশ্যই চলব। রুমি খানিকটা রাগ দেখানের মত করে বলল,

– অবশ্যই চলব মানে?দেখ,প্রত্যয় তোমার হাংকি পাংকি কথা বার্তা অসহ্য লাগে এখন।বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত যখনই তোমায় কোথাও যাওয়ার কথা বলেছি শুরুতে এমন একটা ভাব করেছ যেন যাওয়ার জন্য তুমি খুশিতে গলে গলে পড়ছ।মরে যাচ্ছ একদম।কিন্তুু শেষে কোন না কোন এমন বাহানা বানিয়েছ যে,একটা কথা বলারও উপায় থাকে নি।বাহানা বানিয়েছ তো বানিয়েছ, তারপর আবার এমন একখান ভাব করেছ যে,না যেতে পেরে দুঃখের কোনো সীমা নেই তোমার।একেবারে দুঃখের সুমুদ্রে পড়েছ।

– প্রত্যয় বলছ কেনো?আমি তোমার কবছরের বড় জানো? রুমি ছোট করে দীর্ঘশ্বাসের মত ফেলল।আহত স্বরে বলল,
– প্রত্যয়!কেন কর এমন?
– সরি!
– আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই তোমার কাছে?আমার কি কোনো ইচ্ছে থাকতে পারে না?
– আচ্ছা যাব।তুমি যেখানে যেতে বলবে সেখানেই যাব।কোন তালবাহানা করব না। ঠোঁটের কোনে আনন্দের একটা সুক্ষ্ম রেখা টেনে রুমি বলল,
– যাবে না ছাঁই!তোমাকে চিনি না আমি।শেষের দিকে তুমি ঠিকই হাত ফসকে বেড়িয়ে যাবে। প্রত্যয় কথা পাল্টে আহ্লাদী সুরে বলল,
– একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।খাব?
– না।খাবে না।
– আচ্ছা,খাব না!

রুমি রাগি চোখে তাকাল।ধীরে ধীরে নিজেই এগিয়ে গেল আহব্বানে সাড়া দিতে। ধরফর করে উঠে বসল প্রত্যয়।কি হচ্ছে এসব।প্রতিরাতে সে কিভাবে রুমি মেয়েটাকে নিয়ে দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখছে?আর সব থেকে অশ্চর্যের বিষয় হল,স্বপ্নের আলচ্য বিষয় আলাদা আলাদা হলেও প্রতিরাতে রুমি মেয়েটাই ওর বিবাহিত জীবনের স্বপ্নে আসছে।তাছাড়া প্রতিটা স্বপ্নই একই রুমে সীমাবদ্ধ।সম্ববত ওদের স্বপ্ন বিবাহিত জীবনের বেড রুম এটা।কিন্তুু এমন তো নয় যে এই রুমটা প্রত্যয়ের পূর্বপরিচিত, বা অতি-পরিচিত কোনো রুম।এমনও নয় যে, সে ঠিক এমনই একটা রুম মনে মনে নিজের কল্পনায় সাঁজিয়েছে দাম্পত্য জীবনের জন্য।তবে কিভাবে সে প্রতিটা স্বপ্নেই রুমি মেয়েটার সাথে একই রুমে উপস্থিত হয়?কিভাবে সম্ভব!তবে কি সে কোন মায়া জালে বেড়িয়ে পড়ছে?সেই অদ্ভুত মায়া জাল যা কারেন্ট জালের থেকেও ভয়ংকর!যে জালে একবার আটকা পড়লে যত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয় ততই আষ্টেপিষ্ঠে মারাত্মকভাবে পেঁচিয়ে পড়তে হয়!!

– কি ভালো? রুমি স্বাভাবিক ভাবে চমকাল!এবং দ্রুত নিজেকে সামনেও নিল।বলল,
– জ্বি ভাল।আপনি কেমন আছেন?
– ভাল।তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ নাকি না চিনেও চেনার ভান করছ?
– চিনতে পেরেছি।আপনাকে না চেনার কিছু নেই।আর আমি একবার যাকে দেখি সারাজীবনেও ভূলি না।
– ওহ আচ্ছা।বসে কথা বলি?
– জ্বি বসুন।

প্রত্যয় বসল।এই টেবিলেই, ২৭-২৮ বছর বয়সি আরো একজন সুদর্শন লোক যুক্ত আছে।সে সরু চোখে বেশ কৌতুহলের সাথে তাকিয়ে রয়েছে।প্রত্যয় অতি বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,

– সিহাব সাহেব,ভাল আছেন?

রুমি এবং সিহাব উদ্দিন নামের লোকটি দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকাল!সিহাব উদ্দিন অবাক হয়ে বলল,

– আপনি আমাকে চেনেন?
– আগে চিনতাম না।এখন দেখেই যেহেতু চিনতে পেরেছি সেহেতু এখন চিনি।
– মানে? প্রত্যয় হাই তুলতে তুলতে বলল,
– কোন মানে নেই।

সিহাব উদ্দিন নামের লোকটি এখন চিন্তায় পড়ে যাবে।ভাববে,এই লোকটি কে?লোকটি আমার নাম জানল কিভাবে?রুমির সাথে কি লোকটার কোন সম্পর্ক আছে নাকি?কি ধরনের সম্পর্ক?ঘনিষ্ঠ কোন সম্পূর্ন কি?আরো রঙ বেরঙের প্রশ্ন সে খুঁজে বেড়াবে।উওর না খুঁজে প্রশ্ন খোঁজার ফলে পরে যাবে মহাবিপদে। একসময় সে প্রশ্নে প্রশ্নে গিট্টু লাগিয়ে ফেলবে।তখন তার টেনশনের সীমা থাকবে না। রুমি সরু চোখেই তাকিয়ে আছে।প্রত্যয় অভিযোগ করার মত করে রুমির দিকে তাকিয়ে বলল,

– এরকম নামি দামী একটা কফিশপে এসে খালি হাতে বসে আছ কেন?কফি অর্ডার কর।কফি খেতে খেতে গল্প করি।
রুমি খানিকটা লজ্জা পেল।বাড়িতে মেহমাহ এলে তাদের অন্তত হালকা কিছু খাবার অফার করার কথা ভূলে গিয়ে তাদের সাথে গল্পে মেতে উঠলে হঠাৎ যদি মেহমানদের মধ্যে কেউ বলে উঠে আজকে কি গল্প টল্প করেই পেট ভরাবে নাকি?না কিছু খাবার অফারও পাব?তখন যে টাইপের লজ্জা পাওয়া যায় ঠিক সেই টাইপ লজ্জা।
কফি অর্ডার করল রুমি।বেশ ভাল লাগছে ওর।সিহাব উদ্দিন লোকটার সাথে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল।প্রত্যয় আসায় অস্বস্তিবোধ টা পুরোপুরিভাবে কেটে গেছে।রুমি প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

– আপনাকে ধন্যবাদ জানানো হয় নি।সামছু নামের যে লোকটিকে আপনি পাঠিয়েছিলেন লোকটি বাবুর্চি হিসেবে খুবই ভাল।আজকাল এমন ভাল কাজ কর্মের লোক পাওয়া যায় না।ওনার রান্না করা খাবার খেয়ে বাবা প্রথম দিনই বেতন ডাবল করে দিয়েছেন।বাবার মতে সামছু আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেরা রাঁধুনির পুরষ্কারে পুরস্কিত হওয়ার যোগ্য!তাই আর যাই হোক এমন লোক কে কোন মতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।
প্রত্যয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভূল ধরিয়ে দেয়ার মত করে বলল,

– একটু ভূল করছ।লোকটার নাম ঠিক সামছু নয়।ব্লেড সামছু। রুমি চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
– ব্লেড সামছু মানে?

– ব্লেড সামছু মানে,লোকটার নাম সামছু।তার একমাএ পেশা ছিল ব্লেড চালানো!সে রাত হলে রাস্তায় নামত এবং ভাল ভাল মক্কেলকে টার্গেট করে খপ করে ধরত।বিঁড়াল যেভাবে ইঁদুর ধরে ঠিক সেভাবে।মক্কেল টাকা পয়সা মাল ছাবানা বের করতে বেশি তেরিবেরি করলে ব্লেড দিয়ে গলা বরাবর একটা টান দিয়ে কাম তাবাম করে চলে যেত।অবশ্য কাজটা সে একা করত না।তার কিছু চেলাপেলাও ছিল।আর এজন্যই তার নাম ব্লেড সামছু।এখন অবশ্য তার নাম ব্লেড সামছু নেই।এখন তার নাম ঘ্যাচ সামছু।এখন ব্লেড হাতে নিয়ে মানুষের গলা বরাবর টান দেওয়ার কথা চিন্তা করলেই নাকি আত্মায় ঘ্যাচ করে উঠে।শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায়।মানুষকে একটা চড় মারতেও নাকি ময়া লাগে।এজন্যই ব্লেড সামছু থেকে সে এখন ঘ্যাচ সামছু।বুঝতে পেরেছি?

রুমি যেন হতভম্ব হয়ে গেল।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রত্যয় মজা করছে কিনা বুৃঝার চেষ্টা করল।সিহাব উদ্দিন নামের লোকটারও একই অবস্থা।তার চোখ দুটো পারলে যেন বেড়িয়ে আসবে।
সিহাব উদ্দিন বিস্মিত গলায় বলল,

– ওহ মাই গড!আপনার এমন ডেন্জারাস লোকজনদের সাথে মেলামেশা?এমন ডেন্জারাস একজন লোককে আবার রুমিদের বাড়িতেও পাঠিয়েছেন কাজ করার জন্য?

– হুঁ।যদি আপনারও এমন কাউকে দরকার হয় বলতে পারেন ব্যাবস্থা করে দিব।”মেরি পাছ অর ভি খাতারনাক আদমি হেয়”!আমার ধারণা রুমির মুখে সামছুর প্রসংশা শুনে আপনিও প্রথমে বেশ আগ্রহবোধ করছিলেন এমন একটা লোকের।হয়ত আমাকে বলতেও চাচ্ছিলেন এমন একজন ভাল কাজ কর্মের লোকের ব্যাবস্থা করে দিতে। জড়তার কারনে বলে উঠতে পারেন নি।ঠিক বলছি?
সিহাব উদ্দিন বিড়বিড় করতে করতে বললেন,

– ভাগ্যিস বলি নি!

জরুরী কাজ দেখিয়ে অতি দ্রুত কফিশপ থেকে বেরিয়ে এল সিহাব উদ্দিন।বেরিয়ে এসে যেন সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।এমন লোকের আশেপাশে থাকাও বিপদজ্জনক!! প্রত্যয় রুমির দিকে তাকিয়ে বলল,

– তুমি কি সামছুকে পুলিশে দেওয়ার কথা ভাবছ?
– ভাবাটাই কি স্বাভাবিক নয়?
– হুঁ স্বাভাবিক।তবে অস্বাভাবিক কি জান?তুমি নিজেই পারবে না সামছুকে পুলিশে দিতে।সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে দিয়ে সবসময়ই খারাপ মানুষ গুলোকে শুদ্ধ এবং পবিএ করার বড় একটা সুযোগ করে দেন যা আমরা চাইলেও আটকাতে পারি না।কারন প্রকৃতির এই খেলায় তুমি আমি আরো অনেকেই যুক্ত হয়ে গেছি খেলারই একটা অংশ হিসেবে।
রুমি বিরক্তির সুরে বলল,

– আপনি বলতে চাচ্ছেন সামছু নামের লোকটিকে শুদ্ধ এবং পবিএ করার জন্য প্রকৃতি সুযোগ করে দিয়েছে?আর এই সুযোগ থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না?
– তাই তো মনে হচ্ছে। রুমি উঠে পড়ল।মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
– আমাকে যেতে হবে!

এর বেশ কিছুদিন পরের কথা।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।প্রত্যয় এখন বেশ আরাম বোধ করছে।জ্বর আর নেই বললেই চলে।মাথা ব্যাথা পুরোপুরি না কমলেও অনেকটাই কমে এসেছে।মেসের ফজলু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

– ভাই আসব?
– আয়। ফজলু মায়া ভরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কোমল স্বরে বলল,
– ভাই এখন কেমন লাগছে?জ্বরটা কি কমেছে?
– হুঁ কমেছে।বেশ আরামবোধও করছি।
– ভাই চা খাবেন?এক কাপ কড়া করে চা বানিয়ে দেই?
– হুঁ,দে। ফজলু গেল না।প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই হাসি হাসি মুখে বলল,
– রুমি আপা এ কয়দিন নিয়ম করে আপনাকে দেখতে এসেছেন।

কেমন দরদ নিয়ে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছেন।আপনার পাশে কিছুক্ষন বসে থেকে চোখ মুখ লাল করে আবার চলে গেছেন।মাঝে মাঝে আমার সাথে গল্প গুজবও করেছেন।ভাই,রুমি আপা অনেক ভাল তাই না?

– কেনো তোর সাথে গল্প গুজব করেছে বলে ভাল? ফজলু বক্তৃতা দেয়ার মত করে বলল,
– ভাই,ভাল মানুষ খারাপ মানুষ দেখলেই বুঝা যায়।

ভাল মানুষ,খারাপ মানুষ দেখে চেনার কোনো উপায় নেই।অনেক ভাল মানুষ আছে যারা খারাপ মানুষের মুখোশ পরে খারাপ মানুষ সাঁজার অভিনয় করে।আর খারাপ মানুষেরা ভাল মানুষ সাঁজার।দুটো অভিনয়ই খাঁদহীন।অভিনয় ধরার উপায় নেই।ভূল ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না প্রত্যয়ের।ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ফজলু কে বলল,

– চা খাওয়াবি না?
– একটু অপেক্ষা করেন ভাই।মনে করেন এই গেলাম আর এলাম। ফজলু রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রত্যয় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল।দিনের আলোও নেই আবার রাতের আধাঁরও পুরোপুরি নামে নি।আলো আধাঁরে সাম্যবস্থা।জ্বরে ভোগান্তির ব্যাপারে ভাবল প্রত্যয়। দিন কয়েক আগে মিজান আহমেদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে প্রত্যয় আবার উপস্থিত হয়েছিল সেই রাজকীয় বাড়িতে।রাজকীয় এই বাড়িতে এলেই সে ঘোরের মধ্যে চলে যায়।মনে হয় অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করেছে।বিবাহবার্ষিকীর পার্টি উপলক্ষে বাড়িটাকে নানা রকম ফুল টুল দিয়ে রকমারি সাজসজ্জায় সাঁজানো হয়েছে।প্রত্যয় পার্টিতে এসে অস্বস্তিতে পড়ে গেল।পার্টিতে যে যার মত ব্যাস্ত।প্রত্যয় বসে আছে এক কোনায়।

এখানে আসার পর মিজান আহমেদের সাথে খুব অল্প কিছু সময়ের জন্য কথা হয়েছিল।বেচারা মিজান আহমেদ পড়েছে মহাযন্ত্রণায়।তার নিজের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে যেহেতু গোটা পার্টির আয়জন করা সেহেতু তাকে একই সঙ্গে সবাইকে সঙ্গ দিতে হচ্ছে।যেনো সময়ের ফ্যারে পড়েছেন তিনি।কিছুসময় যেতেই রুমি এবং সিহাব উদ্দিনকে একসঙ্গে দেখা গেল।সিহাব উদ্দিন লোকটাকে আজ আরো বেশি সুদর্শন লাগছে।রুমি লেহেঙ্গা পড়েছে।লেহেঙ্গার রঙ সাদাও না আবার সোনালিও না।এই দুয়ের মাঝামাঝি।লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচ করে গলায় ভারি হাড় পড়েছে,ম্যাচ করে ঝাড়বাতির মত কানের দুল পড়েছে।মাথায় টিকলি দিয়েছে।যেন রূপের আরেক নাম রুমি।ক্ষনিকের জন্য নিজের অজান্তেই ঈর্ষা ভর করল প্রত্যয়ের ভিতর।মনে হল,সিহাব উদ্দিন জগতের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যবানদের একজন যে কিনা রুমির মত একজন তিক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী এবং ব্যাখ্যাতীত রূপের অধিকারিনী কে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেতে যাচ্ছে!রুমি এবং সিহাব উদ্দিন এক সাথেই প্রত্যয়ের দিকে এল।প্রত্যয় অতি বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,

– রুমি ভাল আছ? রুমি কিছু বলার আগেই আবার সিহাব উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– সিহাব সাহেব আপনি ভাল আছেন ? সিহাব উদ্দিন অনিচ্ছা স্বত্বেও উওর দিল।মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,

– জ্বি ভাল। প্রত্যয়ের দিকে সামান্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রুমি বলল,
– আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বোর ফিল করছেন। এমনটা মনে হওয়ার কারন কি?আপনি সত্যিই বোর ফিল করছেন কি?
– জ্বি করছি।এমন পরিবেশে আমি অভ্যস্ত নই। রুমি শীতল গলায় বলল,
– বোর হচ্ছেন তো চলে যাচ্ছেন না কেনো?
– এক কাপ চা খেয়ে চলে যাব। রুমি সিহাব উদ্দিনের দিকে তাকাল।গাম্ভীর্যের সুরে বলল,
– আমি প্রত্যয় সাহেবের সাথে একান্তে কিছুক্ষন কথা বলতে চাই।

সিহাব উদ্দিনের ভ্রু কুচকে গেল।ঈর্ষায় তার চোখ চকচক করছে।বেচারার “না পারি বলিতে,না পারি সহিতে অবস্থা।”সে কিছু বলবে তারও উপায় নেই।রুমি শুধুমাএ ওর নিজের মর্জি জানিয়েছে।যার স্পর্ষ্ট অর্থ,আমি প্রত্যয় সাহেবের সাথে একান্তে কথা বলতে চাই।সেখানে তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে আপনাকে আমি এলাউ করছি ন।আপনি দয়া করে এখান থেকে যান।সিহাব উদ্দিন সুবোধ বালকের মত বলল,

– আচ্ছা, আমি ওদিকটায় আছি।(যার অস্পষ্ট অর্থ,আমি ওদিকটায় আছি।তাড়াতাড়ি কথাবার্তা শেষ করে তুমিও চলে এসো।কি বিপদ!)

রুমি প্রত্যয়কে উপরে ওর নিজের রুমে নিয়ে গেল।বেলকনিতে দুটো বেতের চেয়ার বসানো ছিল।সেখানে বসতে দিল।সম্ভবত চেয়ার দুটোর একটি রুমির নিজের বসার জন্য অন্যটিতে মিজান আহমেদ বসে মাঝে মাঝে মেয়ের সাথে আয়েশ করে গল্প গুজব করেন।রুমি বলল,

– আপনি একটু বসুন আমি চা নিয়ে আসছি। প্রত্যয় পা দুটো মেলে পরম সুখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
– চা না।কফি খেতে ইচ্ছে করছে।
– বসুন আসছি।

প্রত্যয় ভেবেছিল রুমি ভ্রু কুচকে তাকাবে।বলবে,কিছুক্ষন আগেই তো চা খাওয়ার কথা বলছিলেন।তা হল না।সবসময় ভাবনা অনুযায়ীই যে সব কিছু হবে এমন কোনো কথা নেই। রুমি দু কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এল।এক কাপ প্রত্যয়কে দিয়ে অন্য কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,

– আপনি ঠিকই বলেছিলেন প্রত্যয় সাহেব।সামছুকে আমি নিজেই পুলিশে দিতে পারি নি।এবং সিহাব সাহেবকেও আমিই বলেছি ওনি যেন ছামছুর ব্যাপারে কারো সাথে কিছু না বলেন।কিন্তুু আমার এমন সিদ্ধান্তের কারন টা আমি আপনাকে বলব না।প্রত্যয় সাহেব আপনি কি জানেন কারন টা কি?

– না,জানি না।

– আপনার অদ্ভুত কিছু ক্ষমতার কথা শুনেছি আমি।যদিও বিশ্বাস যোগ্য কোন কথা না সেসব,তবুও আমি পরিক্ষা করে দেখতে চাই।আপনি আমার ব্যাপারে এমন কিছু বলুন যা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। যা আমি কারো সাথেই শেয়ার করি নি কখনো।এমন কিছু যার কোন কূল কিনারা আমি নিজেও খুঁজে পাচ্ছি না।
প্রত্যয় চেয়ারে গা এলিয়েই আরাম করার মত করে চোঁখ বন্ধ করল।বলল,

– তুমি সিহাব উদ্দিনের সাথে বিয়েটা করছ নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে।সিহাব উদ্দিন লোকটাকে তোমার ঠিক পছন্দ নয়। রুমি খানিকটা হাসল।বানানো হাসি।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
– আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেশ ভাল প্রত্যয় সাহেব।যা প্রায় সবার মাঝেই কম বেশি উপস্থিত।আপনি কি জানেন আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও বেশ ভাল?
– জানি।

– সিহাব সাহেবকে নিয়ে আমার মনভাব,ওনাকে নিয়ে যেকোন কথা দ্রুততার সঙ্গে এড়িয়ে চলা,ওনার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি এসব ছাড়াও খুটিনাটি বিষয়গুলিও আপনি খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং শেষে আপনি উপনিত হয়েছেন যে ওনাকে আমার পছন্দ নয়।আমি বিয়েটা করছি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কেনো করছি সেটাও বোধহয় আপনার অজানা নয়।তবে আমি এসব জানতে চাচ্ছি না।এমন কিছু জানতে চাচ্ছি যা আপনার অস্বাভাবিক ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত।

– তুমি প্রতিদিন একটা স্বপ্ন দেখ।বিবাহিত জিবনের স্বপ্ন।আশ্চর্যের ব্যাপার হল স্বপ্নটা তুমি দেখ আমাকে নিয়ে।যেখানে তুমি আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে দেখতে পাও। আর সব থেকে অশ্চর্যের ব্যাপার হল,তোমার স্বপ্নটা একটি মাএ রুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।বোধহয় তোমার স্বপ্ন বিবাহিত জীবনের বেড রুম সেটা।ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও রুমটা না তোমার পূর্বপরিচিত না তোমার অতিপরিচিত।এমনও নয় যে এমন একটি রুম তুমি মনে মনে নিজের কল্পনা জল্পনায় একেঁছ কখনো।তাহলে তুমি কিভাবে প্রতিটা স্বপ্নে আমার সাথে একই রুমে উপস্থিত হও?এটাই তোমার বর্তমান দুশ্চিন্তা।যা তুমি সহজ করে ভাবলে সহজ।আর জটিল করে ভাবলে অতি জটিল।যে জটিলতার কোন ব্যাখ্যা নেই। রুমির চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল।প্রচন্ড বিস্ময়ে কিছুসময় স্ট্যাচুর মত বসে রইল।বিস্মিত গলায় বলল,

– তারমানে আপনার কাছে সত্যি সত্যিই কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে?
– বুঝতে পারছি না। রুমি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– বুঝলেও আপনি বলবেন না।কারন অস্পষ্টতাই আপনার পছন্দ।কফিটা কেমন হয়েছে?
– ভাল।তবে বুঝতে পারছি না তুমি কফি ভাল বানাও, না কফি তোমার স্পর্শ পেয়ে ভাল হয়। রুমি কিছুটা লজ্জা পেল বলে মনে হয়।লজ্জা মিশ্রিত মিষ্টি করে একটু হাসল।পরক্ষনেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল।গাম্ভীর্যের স্বরে বলল,
– আপনি কি আমার সাথে ফ্লাট করার চেষ্টা করছেন?
– জ্বি করছি।
– দয়া করে আর করবেন না।আমার পছন্দ নয়।
– আচ্ছা করব না। কিছুক্ষন নিরবতা ভর করল চারপাশে।প্রত্যয় গভীর স্বরে বলল,
– রুমি,তুমি কি জানে তোমার হাসিটা যে কি পরিমান মিষ্টি? রুমি যেন কেঁপে উঠল।গাম্ভীর্যের সাথে সাথে গলার স্বর যথাসম্ভব কড়া করে বলল,
– আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন না দয়া করে।তুমি করে বলার মত ঘনিষ্ঠ কোন সম্পর্ক আপনার সাথে আমার হয় নি কখনো।
– আচ্ছা আর বলব না।

প্রত্যয় যখন রুমিদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে এল তখন বাহিরে কাটা বৃষ্টি পড়ছে।কাটা বৃষ্টি বলতে আমি বুঝিয়েছি এমন এক বৃষ্টি যে বৃষ্টি এত তিব্র যে গায়ে পড়লে মনে হয় বৃষ্টি কাটার মত গায়ে বিঁধে যাচ্ছে।এমন তিব্র বৃষ্টিতে প্রত্যয় হাঁটা ধরল।বৃষ্টিতে কাঁকভেজা হয়ে মেসে ফিরল।আর তারপরই গাঁ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল।যে জ্বর বেশ ভাল ভোগান্তিই ভুগিয়েছে ওকে।ফজলু চা দিয়ে গেছে।প্রত্যয় চায়ের কাপে চুমুক দিল।একদম নিঁখুত চা।এ সময়ে এরকম একটা চা -য়েরই যেন দরকার ছিল।আজকের সন্ধ্যা টাকে বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগছে।এই বিষণ্ণতার কারন প্রত্যয় ধরতে পারছে না।হঠাৎ প্রত্যয়ের কাছে বিষণ্ণতার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।সন্ধ্যাটা মোটেও বিষণ্ণ নয় বিষণ্ণ হচ্ছে ও নিজে।ও নিজে বিষণ্ন বলেই চারপাশটাও বিষণ্ণ লাগছে।ফোন বেঁজে উঠল।দু’বার রিং হয়ে কেটেও গেল।তৃতীয় বারে প্রত্যয় ফোন রিসিভ করল।হ্যালো, বলার পরেও ওপাশ থেকে কোন সাঁড়া পাওয়া গেল না।লাইন কেটে গেছে কিনা চেক করল প্রত্যয়।লাইন কাটে নি।প্রত্যয় কোমল স্বরে বলল,

– কেমন আছ রুমি? রুমি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– বুঝতে পারছি না।আপনি কেমন আছেন?
– আমিও বুঝতে পারছি না।তবে কিছুক্ষন আগে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি।আমার মনটা বোধহয় আজ বিষণ্ণ।কিভাবে বুঝতে পারলাম শুনবে? রুমি কিছুসময় চুপ থেকে বলল,
– আপনি যে কতটা ভাল একজন মানুষ তা কি আপনি জানেন?
– না জানি না।তুমি বরং বল শুনি।অন্যের মুখ থেকে নিজের প্রসংশা শুনতে খুবই ভাল লাগে।
– আপনি হয়তো নিজেও জানেন না কত মানুষের মনে আপনি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার জায়গা এক সঙ্গে করে নিয়েছেন।

শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দুটোই অনেক বড় ব্যাপার প্রত্যয় সাহেব।কারো মনে কোন ব্যাক্তির জন্য শ্রদ্ধা থাকলে ভালোবাসা থাকে না।আবার ভালোবাসা থাকলে শ্রদ্ধা থাকে না।কিন্তুু আপনি এই দুটো জিনিসই একই সঙ্গে অর্জন করেছেন।অনেকে হয়তো মহান আল্লাহ তা’আলার পরের আসনটাতেই আপনাকে বসিয়ে রেখেছে।ছামছু আর ফজলুর কথাই ধরুন।আমার যতদূর মনে হয় ওদের যদি আপনি বলেন, “তোদের প্রাণবায়ু আমার দরকার” ওরা সেই মুহুর্তেই কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই হাসি মুখে, বিনা আফসোসে নিজেদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করবে।কোন সাধারন মানুষ একাধিক মানুষের মনে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার জায়গা একই সঙ্গে দখল করতে পারে না প্রত্যয় সাহেব। রুমি আবার চুপ করল।কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,

– আমি হয়তো আপনার বিয়ে সাদী না করে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের সিদ্ধান্তের কারনটাও খুঁজে বের করতে পেরেছি।বলব?
– হুঁ, বল।

– আপনি সবসময়ই চেয়েছেন অতি সাধারন জীবন যাপন করতে।শেষ বয়স পর্যন্তই দুঃস্থ,অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে।তাই এত বড় স্যালারির একটা চাকরি করেও ভাঙ্গাচুড়া একটা মেসে থাকেন।নিজের উপার্জনের অর্ধেক অংশ এনজিওতে দিয়ে দেন।আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তো ভবিষ্যৎ-এ বড় সড় একটা আশ্রম খোলারও পরিকল্পনা আছে আপনার।আর আপনাকে,আপনার এসব কাজ কর্মকে আপনার মত করে কোনো নারীই সঙ্গ দিবে না বলেই সারাজীবন একাকী নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত।আমি কি ভূল বললাম? প্রত্যয় এই কথার জবাব দিল না।বলল,

– আজ তোমায় বধূর সাঁজে কেমন লাগছে তা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।তবে না দেখার মাঝেও একটা মজা আছে।আমি বধূ সাঁজে তোমায় কল্পনা করে নিচ্ছি।কল্পনা মুছে যাচ্ছে আবার কল্পনা করছি, মুছে যাচ্ছে আবার কল্পনা করছি।বেশ ভাল একটা কল্পনা কল্পনা খেলা বলতে পার।

– আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে প্রত্যয় সাহেব।আপনি দেখলে হয়ত চোখ ফেরাতেই পারতেন না।ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতেন আর আমি অস্বস্থিতে পড়ে যেতাম। শেষের কথাগুলো বলার সময় রুমির গলা ধরে এল।মনে হচ্ছিল গলায় কথা দলা বেঁধে আটকে থাকতে চাইছে।কিছুক্ষন চুপ থেকে রুমি আবার বলল,

– প্রত্যয় সাহেব,আপনাকে যে আমি অসম্ভব রকমের ভালোবেসে ফেলেছি আপনি কি তা জানেন?আপনি কি জানেন আমার পক্ষে এ জীবনে আর অন্য কিছু ভাবা সম্ভব নয়?
– জানি। ওপাশ থেকে আর কোন শব্দ এল না।প্রত্যয় মায়া মাখা স্বরে বলল,
– রুমি তুমি কি কাঁদছ?রুমি শব্দ করে কেঁদে উঠল।

হুহু করে কাঁদছে মেয়েটা।প্রত্যয় মনে মনে বলল,তুমি কেঁদো না রুমি।এ বিয়ে হবে না।তোমার ভয়ঙ্কর ভালোবাসার জাল থেকে বেরোনোর ক্ষমতা আমার নেই!না আছে সিহাব উদ্দিনের সেই ভয়ঙ্কর ভালোবাসার জাল কাটার ক্ষমতা!!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত