মোবাইলটা বেজেই চলেছে । একবার দুইবার তিনবার… । অপরিচিত কোন নম্বর থেকে ফোন এলে নিশীতা ধরেনা । বছর তিনেক হলো অপরিচিত নম্বরের কল রিসিভ করা বন্ধ করে দিয়েছে । হাতেগোনা গুটিকয়েক জানাশুনা মানুষের সঙ্গে দরকারি কথা ছাড়া অন্যকোন লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে চায়না নিশীতা । যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে । স্বপ্নে বিভোর সেই এলোমেলো দিনগুলো এখন আর নেই নিশীতার । সেসব তিন বছর আগের কথা, অতীত ।
নিশীতা এখন অনেক কিছুই বোঝে । অনেক শিখেছে । অনেক কিছুই দেখেছে । সমাজ-সংসার, আবেগ, প্রেম-ভালোবাসা,পুরুষ মানুষ সবকিছুই । এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনা । এমন কি মাঝে মধ্যে নিজেকেও না ! এজন্য নিজেকে সবসময় বড্ড বেশী সাবধানে রাখতে চায় । নতুন কোন ভুলের দরজায় আর পা দিতে চায় না সে ।
ফোনটা এখনও বাজছে । আননোন নম্বর । এভাবেই একদিন পরিচয় হয়েছিলো রাজিবের সঙ্গে । কোটিপতি বাবার পুত্র ! তারপরের একবছর স্বপ্নের মতো কেটেছে নিশীতার । বান্ধবীরা ওকে খুব হিংসা করতো । রাজিব প্রায় প্রতিদিনই প্রাইভেটকার নিয়ে নিশীতার হলের সামনে আসতো । নিশীতা যখন নামী- দামী ড্রেস ও কসমেটিকস পরে বান্ধবীদের সামনে দিয়ে বাজিবের হাত ধরে প্রাইভেট কারে চড়তো, তখন বান্ধবীদের আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে নিজেকে রাজপরিবারের একজন বলে ভাবতো । পাড়াশুনা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছিল নিশীতার । দুটি সেমিস্টারের গ্রেড পয়েন্টও ফল্ট করলো । ফারুক মাঝে মধ্যে নিশীতাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো । ফারুক ছিলো নিশীতার দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাই । ছোটবেলা থেকেই নিশীতাকে চেনে । রাজিবের সাথে নিশীতার সম্পর্কের ব্যাপারটা ফারুক না জানলেও সেমিস্টারের গ্রেড পয়েন্ট ফল্ট করার খবর শুনে বুঝতে পেরেছিলো ভেতরে ভতরে কিছু একটা হচ্ছে । আরো নিশ্চিত হলো, যখন নিশীতার খারাপ রেজাল্টের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তাকে চরম ভাবে অপমানিত হতে হলো।
অল্প সময়ের মধ্যে রাজিব ও নিশীতা খুব দ্রুত প্রিয়জন থেকে আপনজন হতে থাকলো । আজ চায়নিজ রেস্টূরেন্ট তো কাল নন্দন পার্ক, আবার পরশু হয়ত বোটানিক্যাল ! শারীরিক ম্পর্শের আনন্দগুলো ওদের কাছে একেবারে সাধারণ ব্যপার হয়ে যেতে থাললো । এসব ক্ষেত্রে নিশীতা কিছুই বলতোনা ।
হয়তো প্রাচুর্যের হাতছানির কারনে “না” বলতে পারতোনা । বরং তার নিজেরও শরীরের এই অচেনা অনুভুতিগুলোকে উপভোগ করতে ভালো লাগতো । এভাবে যৌবনের চাহিদাগুলো ইলাস্টিকের মতো বাড়তে বাড়তে একদিন যখন রাজিব একেবারে পাগলা ঘোড়ার মতো আচরন শুরু করলো, নিশীতা সেদিন নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি । এরপর নিশীতা যখন বিয়ের কথা ভাবার জন্য রাজিবকে বললো, রাজিব বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিয়ে বললো,
‘বিয়ে নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই । আব্বা-আম্মাকে সব বলেছি । এক বছরের মধ্যেই আমরা বিয়ে করবো ।’
তারপর ! না, তারপরের ঘটনাগুলো নিশীতা আর মনে করতে চায়না । ভুলে যেতে চায় । কিন্তু মানুষ চাইলেই কি সবকিছু ভুলে যেতে পারে ? নিশীতাও কি ভুলে যেতে পারবে, কিভাবে ফারুক ভাই সেদিন তাকে অন্ধকার মৃত্যুর দরজা থেকে আবার আলোতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো ! ফারুক ভাইয়ের কথা মনে হতেই শ্রদ্ধায় মাথাটা নুয়ে আসতে চায় নিশীতার । সব সময়ই অবহেলা করেছে তাকে, অপমানও করেছে । অথচ জীবনের সংকটময় মুহূর্তে একমাত্র সেই এগিয়ে এসেছিলো । কোন কৈফিয়াত চায়নি ।
নিশীতা যখন স্বপ্নের জগতে উড়ে বেড়াচ্ছিলো তখনই হটাৎ একদিন বুঝতে পারলো তার শরীরের অভ্যন্তরে নতুন একটা অস্তিত্বের জন্ম হয়ে গেছে । দিশেহারা হয়ে পড়লো নিশীতা ।
ইতিমধ্যে খবরটা সমস্ত ভার্সিটিতেও ছড়িয়ে পড়লো । বান্ধবীরাও তাকে প্রচন্ড ঘৃনা করতে শুরু করলো । কেউ তার পাশে দাঁড়ালোনা । বরং সবাই তাকে কুৎসিতভাবে ইংগিত করতে থাকলো । রাজিবকে তার প্রেগনেন্সির কথা জানিয়ে নিশীতা যখন দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করতে বললো, রাজিব কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বললো, ‘ভেবে দেখি কি করা যায় ।’
এরপর থেকেই রাজিব সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিল । নিশীতা রাজিবের বাসায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, ফ্যামিলি থেকে অনেক আগেই তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে । মানুষের সামনে মুখ দেখানোর মতো সব পথ বন্ধ হয়ে গেল নিশীতার । সে তখন আত্নহত্যার কথা চিন্তা করতে লাগলো । ফারুকের কানে যখন ঘটনাটা পৌচ্ছালো তখন এক মুহূর্ত দেরি না করে সে নিশীতার পাশে এসে দাঁড়াল ।
নিশীতা বলতে সংকোচবোধ করলেও ফারুক জোরপূর্বক বিস্তারিত সব ঘটনা শুনলো । দ্রুত ওর অ্যাবরশনের ব্যবস্থা করলো এবং পরবর্তী এক মাস ছায়ার মতো সর্বক্ষণ ওর সঙ্গে থাকলো ।
হাজারটা কথা বলে বুঝিয়ে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য করে ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলো । এক সময় নিশীতা যখন অনেকটা স্বাভাবিক হলো, ফারুক ধীরে ধীরে আবার নিশীতার কাছ থেকে আড়ালে চলে গেল । তারপর থেকে, একবার অন্তত ক্ষমা চাওয়ার জন্যে নিশীতা ফারুককে আনেক খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি ।