“ভাইয়া তুই নাকি আমাকে মানুষের কাছে বিক্রি করে দিবি” ছোট বোন নাহিদার কথা শুনে, ইমন বেশ চমকে গেলো।
— তোকে কে বললো এই কথা? নাহিদা মাথা নিচু করে আছে। মায়ের দেয়া চদরটা শরীরে পেঁচানো। চাদরটা দিয়ে বারবার চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে। ইমন হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে ধরলো।
— কিরে বল? তোকে এই কথাটা কে বললো? ইমনের হাতটা সরিয়ে দিয়ে, বেশ অভিমানী কণ্ঠে বললো,
— দেখ, তুই কিন্তু আমার ভাই! তুই কখন কী করিস না করিস সব খবর কিন্তু আমি রাখি। ইমন একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
— কেন? তোর খোঁজ খবর বোধহয় আমি রাখি না?
— এহহ মোটেও না! আমার মতো খোঁজ খবর রাখিস না।
— তুই কেমন খোঁজ খবর রাখিস আমার?
— তুই যে কয়টা প্রেম করিস আমি তাও জানি! ইমন বেশ জোরেশোরে হাসি দিয়ে উঠলো। হাসির শব্দ শুনে পাশের রুম থেকে তাদের বৃদ্ধ বাবা বলে উঠলো,
— কিরে আজ সূর্য কোন দিক থেকে উঠলো? প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে তোদের ঝগড়া শুনে! আজ এত হাসি কেন? নাহিদা বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
— বাবা, এখন পিটানি দেবো তোমার ছেলেকে। কাঁদার আগে একটু হাসার সুযোগ দিচ্ছি মাত্র। তাদের বাবা জাফর মিয়া শোয়া থেকে উঠে চলে এলো।
— কেন? কী করলো আমার ছেলে?
— তোমার ছেলে আমাকে বিক্রয় করে দিতে চায় মানুষের কাছে। জাফর মিয়া নাহিদার পাশে যেয়ে বসলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— মা আর কতদিন বড় ভাইর ঘাড়ের উপর থাকবি বল? তোর তো বয়স হয়েছে। নাহিদা চোখ বড় বড় করে বলতে লাগলো,
— মানে? কী বলতে চাও তুমি বাবা? ইমন মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে তার বাবা’কে বললো,
— বাবা তুমি ফ্রেশ হতে চলে যাও। আমি ওর সাথে কথা বলছি। বাবা’কে যেতে বলছে তাই নাহিদা ইমনের চুল টেনে ধরে বললো,
— বাবা যাবে কেন? তুই যা বলার বাবার সামনে বলবি। ইমন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— বাবা সব জানে। দেখ বোন, তোর বয়স হয়েছে। এখন এভাবে থাকা উচিৎ না। তাই তোকে বিক্রি করে দিবো। মানে বিয়ে দিয়ে দিবো!
— কী বললি হারামী? আমাকে বিয়ে দিয়ে তোরা সুখে থাকতে চাচ্ছিস! এটা কোনোদিন সম্ভব না। যতদিন জীবিত আছি তোরে জ্বালাইতে থাকবো।
এটা বলেই নাহিদা ইমনের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। শুরু হয়ে গেলো কিল ঘুষি। জাফর মিয়া হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে পারলো না। দৌড়ে চলে এলো। ছোট মেয়ের হাত থেকে কোনোমতে ছেলেটাকে উদ্ধার করলো। ইশারায় ইমনকে চলে যেতে বললো। ইমন নাাহিদার কান ধরে একটা টান দিয়ে, রুম থেকে দৌড়ে চলে গেলো।
রাত আটটা বাজে। সবাই খেতে বসলো, কিন্তু নাহিদা নেই! বাবা’কে খেতে বলে ইমন নাহিদাকে খুঁজে গেলো। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে যেয়ে পেলো। পাগলীটা ছাদের এক কোণে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইমন পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। নাহিদা আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বলতে লাগলো,
— ভাইয়া, মা কি আমাদের ঝগড়া দুষ্টুমি দেখতে পায়? কতদিন হলো মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। মা যদি আজ বেচে থাকতো, তাহলে আমাদের কত্ত আদর করতো। ইমন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাহিদাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
— কেন আমি বাবা কি তোকে কম আদর করি?
— জানিস তো ভাইয়া, মায়ের ভালোবাসার অভাব কোনোদিন পূরণ হয় না! ইমন নাহিদার কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
— চল খাবি এখন।
— নাহ্! আজ আমরা ক্ষুদা নেই। তুই খেয়ে নে যা।
— তোকে ছাড়া কখনো খাইনি। চল আজ তোকে আমি খাইয়ে দিবো।
দুই ভাই বোন একজন অপরজনকে খাইয়ি দিলো। খাবার মুখে তুলে দেবার সময় কখনো ইমন নাহিদার আঙুলে কামড় দিচ্ছে, আবার কখনো নাহিদা ইমনের আঙুলে কামড় দিচ্ছে। এভাবেই চলছিলো তাদের দুষ্ঠু মিষ্টি ভালোবাসা।
আজ একমাস সাতদিন হলো নাহিদার বিয়ে হয়েছে। এখন সংসারের সব কাজ তাকেই করতে হয়। তার দেহটাই শুধু এখানে। মন পড়ে আছে ভাই এবং বাবা’র কাছে। এই কয়দিন এর ভিতর একটাবার ও তার খোঁজ কেউ নিলো না। সে মনে মনে ভাবছে, সে বোধহয় এতদিন তাদের জন্য একটা ঝামেলা হয়ে ছিলো। বিয়ে দিয়ে তারা এখন ঝামেলা মুক্ত। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে, তার বাবা জাফর মিয়া হাজির হলো। বাবা’কে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে। বাবা’কে বুকে জড়িয়ে নিলো। কিন্তু তার চোখ শুধু এদিকওদিক করছে। কোনো একজনকে খুঁজছে। জাফর মিয়ে বললেন,
— কিরে মা, এদিকওদিক কাকে খুঁজিস? নাহিদা বেশ অভিমানী কণ্ঠে বললো,
— কাকে আবার! তোর ফাজিল হারামী ছেলেটাকে খুঁজি। জাফর মিয়া মুখটা অন্যদিক ঘুরিয়ে নিয়ে, চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
— বাবা তুমি কাঁদছো কেন?
কোনো উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিলো। নাহিদা কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো,
“আমার লক্ষী বোন, তুই নিশ্চয় এখন আমার লেখা চিঠিটা পড়ছিস। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো বিয়ের কিছুদিন পরেই দেখতে যাওয়ার। কিন্তু তা আর হলো না। যেদিন তোর সাথে দেখা করতে যাবো, তার আগেরদিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আর এই চিঠিটা এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে লিখছি। বিশ্বাস কর, আমি তোদের ছেড়ে যেতে চাই না। তবুও নিয়তি যে বড়ই নিষ্ঠুর! তাই যেতে হচ্ছে।
আমি অনেক আগে থেকেই অসুস্থ ছিলাম। ডাক্তার বলেছিলো, আমার ক্যান্সার হয়েছে। তোকে কখনো বলিনি, কারণ তুই খুব কষ্ট পাবি। আমার হাতে বেশি সময় ছিলো না। তাই তো তোকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলাম। কারণ বাবা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমার পরি বোনটাকে বউ সাজে দেখার আমার খুব শখ ছিলো। পারলে তোর এই হারামী ভাইটাকে নিজ গুনে ক্ষমা করে দিস। ভালো থাকিস আমার পেটুক বোন!”নাহিদা “ভাইয়া” বলে একটা চিৎকার দিয়ে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে নিলো।
সমাপ্ত